ঋষি সুনক: ব্রিটিশ ও ভারত সরকারের সাদৃশ্য

রূপক গায়েন

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঋষি সুনকের ঝটিতি উত্থান ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই এক অকেজো উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করছে। উচ্ছ্বাসের শিকড়ে ঋষি সুনকের তথাকথিত ভারতীয়ত্ব। তবে সুনকের ফ্যামিলি হিস্ট্রি দেখলেই বোঝা যাবে তার দাদু-ঠাকুরদা'রা যথাক্রমে বর্তমান ভারত ও পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলেন, তার নিজের বাবা-মা জন্মান আফ্রিকায় এবং ঋষির নিজের জন্ম ব্রিটেনে। ফলে এই ভারতীয়ত্বের উচ্ছ্বাস আন্তর্জালে বিভিন্ন মিমের উদ্রেক ঘটিয়েছে; যেমন মানব জাতির আফ্রিকায় প্রাথমিক উৎপত্তির তত্ত্ব অনুযায়ী সবাই আদতে আফ্রিকান হওয়ার মিম ছড়িয়েছে নেট দুনিয়ায়! 

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইহুদি বেঞ্জামিন ডিসরায়েলির পর নিঃসন্দেহে মাইনোরিটি হিসেবে সুনকই প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে, তবে বিস্তীর্ণ ভারতের সীমিত অংশের সাথে তার সম্পর্ক নেহাতই এথনিক সাদৃশ্যতার চেয়ে বেশি কিছু নয়। উল্লেখ্য, মাইনোরিটি প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গে শশী তারুর আর গেরুয়া শিবিরের মধ্যে তর্জা চললেও, আমাদের দেশে কংগ্রেস হোক বা বিজেপি, উভয়েরই শাসনকালে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি দুই-একবার বাদ দিলে মূলত সীমাবদ্ধ থেকেছে পুঁজিপতিদের আঁতুড়ঘর উত্তর প্রদেশ ও গুজরাটের প্রতিনিধিদের মধ্যে আর বিভিন্ন মাইনোরিটিকে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে জাতিগত সমীকরণের রাজনীতি চলেছে। 

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে সুনকের ব্যাক্তিগত কেচ্ছা এবং তার কনজারভেটিভ পার্টির বর্তমান চরিত্র সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার। সুনক দীর্ঘদিন ধরেই নিজের স্ত্রীর নন-ডোমিসাইল স্ট্যাটাসের সুযোগ নিয়ে প্রায় ২০ মিলিয়ন পাউন্ড ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে এবং চাপের মুখে বলতে বাধ্য হয়েছে যে পরেরবার থেকে প্রত্যেক বছরের ট্যাক্স সে দেবে। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন দেশের ধনকুবেরদের কর মুকুব আর সাধারণ মানুষের উপর ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে সুনক নিজেই কর ফাঁকি দিয়েছে! শুধু স্বচ্ছতার অভাবই নয়, কনজারভেটিভ পার্টির প্রতিনিধিরা দেশে হওয়া প্রত্যেকটি ধর্মঘটের উপর একনায়কতান্ত্রিক অবস্থান নিচ্ছে; ধর্মঘটের সময়ে ঠিকা শ্রমিক দিয়ে কাজ চালানো, সকল শ্রমিকের দৈনন্দিন ন্যূনতম বাধ্যতামূলক কর্মসময়, আইন ভাঙলে প্রায় ৫২ সপ্তাহ অব্দি জেল হেফাজত এবং পুলিশের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংসদে আনা হচ্ছে 'মিনিমাম সার্ভিস লেভেল', 'সিরিয়াস ডিসরাপশান প্রিভেনশান অর্ডার' সংক্রান্ত বিল এবং 'পুলিস, ক্রাইম, সেন্টেন্সিং অ্যান্ড কোর্ট আইন, ২০২২'। সুনক ক্ষমতায় এসেই সুয়েলা ব্রেভারম্যানকে গৃহমন্ত্রীর পদে ফেরত নিয়ে এসেছে। গেরুয়া শিবিরের অলীক সুনক প্রীতি এবং সুনক হয়তো ভারতের জন্য নমনীয় কোনো নীতি আনবে এই ভাবের সাগরে ডুবে যাওয়ার আগে সুয়েলা ব্রেভারম্যান সম্পর্কে জানা দরকার। ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুয়েলা পরিচিত তার ভারত বিদ্বেষী এবং অভিবাসন বিরোধী অবস্থান নেওয়ার জন্য। ভারতীয়রা নাকি ভিসার সময়সীমার বেশি সময় ধরে ব্রিটেনে থাকে - এই ধরনের অভিযোগ সে আগেও করেছে। লেইসটারে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ সংক্রান্ত দাঙ্গার সময়ে অভিবাসীরা হোস্ট সংস্কৃতি গ্রহণ করতে না পারার মত উস্কানিমূলক মন্তব্য করতে দেখা গেছে তাকে। লিজ ট্রসের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে ভারতের সাথে মুক্ত বাণিজ্য বন্ধ করার পক্ষে ছিল সুয়েলা। কিছুদিন আগে লিজের ক্যাবিনেট থেকে সে বাদ পড়ে মিনিস্টেরিয়াল পলিসি উল্লঙ্ঘন করার জন্য। তার প্রত্যাবর্তন ভারতীয়দের জন্য মোটেও ভালো খবর নয়। অন্তত পূর্ব পাঠের পুনরালোচনা তো তাই বলছে। 

ভারত বিদ্বেষের প্রচুর এলিমেন্ট, সাথে ব্যাক্তিগত কেচ্ছা ঢাকার সরঞ্জাম নিয়েই ক্যাবিনেট ভরিয়েছে সুনক। তাই কোনো এক ভারতীয়র(?!) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়া ভারতের জন্য প্রীতিকর কতটা তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু মোদী সরকারের সাথে সুনক সরকারের সাদৃশ্যগুলো লক্ষণীয়। ধনকুবেরদের কর মুকুব করার ক্ষেত্রে উভয়েরই জুরি মেলা ভার। সুনক নিজে কর ফাঁকি দেয়, আর ভারত থেকে নীরব মোদী পালিয়ে এসে ঠাঁই নেয় অন্য দেশে! আমাদের এখানে বিজেপি শ্রমিক বিরোধী শ্রম কোড চালু করে আর ব্রিটেনে কনজারভেটিভরা ধর্মঘট দমনের উদ্দেশ্যে নতুন নতুন আইন জারী করে। এখানে অমিত শাহ এনআরসি চালু করে খেটে খাওয়া মানুষ বিতাড়নে বদ্ধপরিকর, আর ব্রিটেনে সুয়েলারা ভারতীয়দের তাড়াতে পারলে বাঁচে! তাহলে খেটে খাওয়া ভারতীয়দের ঠাঁই কোথায়???


Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views