উচ্চ বর্ণের অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্রদের জন্য সংরক্ষণ প্রসঙ্গে আনন্দ তেলতুম্বড়ে

[আনন্দ তেলতুম্বড়ের কারামুক্তি এবং সাম্প্রতিক সুপ্রিম কোর্টের EWS সংরক্ষণ সংক্রান্ত রায়ের প্রেক্ষিতে পাঠকদের জন্য তাঁরই রচিত একটি প্রবন্ধের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ প্রকাশিত হল।]     

মূল রচনা: Reverting to the Original Vision of Reservations; Economic and Political Weekly, 23rd June, 2007 (গুজ্জরদের সংরক্ষণের দাবীতে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত; আজও প্রাসঙ্গিক)  

মূল রচনার লিঙ্ক: https://www.epw.in/journal/2007/25/commentary/reverting-original-vision-reservations.html

বঙ্গানুবাদ: ডিলিজেন্ট পত্রিকা


…যখন আম্বেদকর এবং গান্ধীর মধ্যে পুনা চুক্তির মাধ্যমে অস্পৃশ্যদের জন্য প্রথম সংরক্ষণ প্রবর্তন করা হয়েছিল, যা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কমিউনাল অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী চিহ্নিত করার পদ্ধতির প্রতিস্থাপন করেছিল, তখন তার মূল ভিত্তি ছিল এই যে অস্পৃশ্যরা হল বিশেষভাবে কলঙ্কিত সম্প্রদায় যারা হিন্দু সমাজের সামাজিক বৈষম্যের দ্বারা পীড়িত। এই বিষয়ে সম্মত হওয়া গিয়েছিল যে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের উপর অস্পৃশ্যদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার এবং তাদের প্রাপ্য প্রদানের জন্য নির্ভর করা যায় না। তাই এক ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল যা নিশ্চিত করবে যে অস্পৃশ্যরা তাদের প্রতিনিধিত্বের উপযুক্ত অংশ পাবে। এইভাবে সংরক্ষণ নীতি ভারতীয় সমাজের সামাজিক বৈষম্যমূলক প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে একটি পাল্টা ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল। এটি অসুস্থ ভারতীয় সমাজের জন্য তিক্ত বড়ির মতো, একটি দরকারি শত্রু, যা ততদিন দরকার যতদিন এই রোগটি জিইয়ে থাকবে। সমাজের কাছে এটি তাড়াতাড়ি রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করার এবং ওই বড়ি বন্ধ করার অন্তর্নির্মিত প্রেরণা যুগিয়েছিল। যেহেতু রোগটি মূলত বর্ণপ্রথাকে নির্দেশ করে, তাই সংরক্ষণ ছিল সেই অনুঘটক যা এই প্রথার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করবে।

ইতিবাচক বৈষম্যের নীতি হিসাবে সংরক্ষণ ব্যবস্থা ব্যতিক্রমী এবং স্ব-ধ্বংসাত্মক হওয়া উচিৎ। যদিও উচ্চ-নীচ ভেদাভেদের [স্তূপের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্রাহ্মণদের কিছু উপ-বর্ণ থেকে শুরু করে সেই স্তূপের নীচের দলিতদের মধ্যেকার নিম্নতম কিছু সদস্য পর্যন্ত (উভয়ই পরিপূর্ণ রূপে সংজ্ঞায়িত নয়)] ধারাবাহিকতা হিসাবে বর্ণপ্রথা বিভিন্ন বর্ণের মধ্যেকার বৈষম্যের সাথে যুক্ত রয়েছে, কিন্তু একটি খিঁচ রয়েছে, একটি বাঁক, যা বর্ণ এবং অ-বর্ণ ভিত্তিক সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে, যাদের উভয় দিকে সামাজিক অভিস্রবণ ঘটলেও কোন সামাজিক যোগাযোগ নেই। বর্ণাশ্রম সম্পর্কে এই বোঝাপড়াটি সংরক্ষণ প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র অস্পৃশ্যদের সংরক্ষণ প্রদান করে এই ব্যবস্থা ব্যতিক্রমী করে তোলা হয়েছিল। যদিও এর মধ্যে আত্ম-ধ্বংসাত্মকতা স্পষ্টভাবে প্রদান করা হয়নি, কিন্তু তা অন্তর্নিহিত ছিল: যদি সমাজ দলিতদের প্রতি বৈষম্য বন্ধ করে দেয়, তাহলে সংরক্ষণ ব্যবস্থা অবলুপ্ত করা যেতে পারে।

দুর্ভাগ্যবশত, প্রাথমিক সংরক্ষণের পিছনে থাকা এই দৃষ্টিভঙ্গী বা দর্শন সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি। সংরক্ষণকে শুধুমাত্র সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে, যখন কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি ঔপনিবেশিক শাসনের থেকে এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছিল, তখন এর মধ্যে পশ্চাদপদতার সংজ্ঞাকে সূক্ষ্মভাবে যুক্ত করেছিল এবং সেই অনুযায়ী অন্যান্য "সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসর শ্রেণীর নাগরিকদের" রাষ্ট্রীয় সহায়তার জন্যও বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল (ভারতের সংবিধানের ২৯নং অনুচ্ছেদের ২নং ধারা)। যদিও এটি ছিল অ্যাসেম্বলির মধ্যেকার টানাপড়েনের ফল, এটি নতুন শাসক শ্রেণীর সংরক্ষণের মাধ্যমে বিভাজনের সম্ভাবনার সূক্ষ্ম উপলব্ধিকে উস্কে দেয়। এটা লক্ষণীয় যে সংবিধানে "শ্রেণী"-কে "জাত/বর্ণ" এবং আরও বেশি কিছু হিসাবে ধরা হয়েছে, কিন্তু কেউ কখনও এটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। এই সাংবিধানিক বিধানগুলি ব্যবহার করে, পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়গুলির পক্ষে বিকল্প ব্যবস্থাগুলির সনাক্তকরণ ও পরিকল্পনা করার জন্য বিভিন্ন কমিশন নিযুক্ত করা হয়, যা মন্ডল কমিশনে চূড়ান্ত রূপ পায় এবং তারা অনগ্রসর বর্ণগুলির জন্য সংরক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবস্থার সুপারিশ করে। যখন ভি পি সিং-এর সরকার, স্পষ্টতই রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ১৯৮৯ সালে ওই সুপারিশগুলির একটি অংশ গ্রহণ করে "অনগ্রসর শ্রেণীগুলি"-র জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষণের ইস্যুতে রাজনীতি করার জন্য বাঁধের দরজাগুলি খুলে যায়।

নির্বাচনী রাজনীতির জন্য বিবেচনার পাশাপাশি, সংরক্ষণ ১৯৮০-র দশকের উদারীকরণ নীতি এবং ১৯৯১-এর পরে পূর্ণাঙ্গ বিশ্বায়নের সাথে যুক্ত বেকারত্ব এবং স্বল্প-কর্মসংস্থান সমস্যা থেকে মানুষের মনোযোগ সরানোর জন্য কার্যকর হয়েছিল। বিশ্বায়নের নীতি গুরুতরভাবে সংরক্ষণের কেকের আয়তন কমাতে শুরু করলে এর একটি বৃহত্তর অংশ নিজেদের জন্য দাবি করার একটি স্ফুরণ ঘটে। পিছিয়ে থাকা মুসলমান, দলিত খ্রিস্টানদের নিজেদের এবং বিজেপির তরফে অগ্রগামী বর্ণের অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্রদের জন্য সংরক্ষণ প্রসারিত করার মুলতুবি দাবিগুলি আজ মায়াবতীর মুখে তার সাম্প্রতিক 'সর্বজন সমাজ' নেত্রীতে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এটা অকল্পনীয় যে কেউ কিভাবে সংরক্ষণের জন্য সম্প্রদায়গুলির ক্রমবর্ধমান দাবিগুলিকে মিটমাট করার ক্ষেত্রে একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে যদি না অবশ্যই সম্পূর্ণ কেকটা সমস্ত জাতি এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে একই অনুপাতে বিতরণ করা হয় যেভাবে তারা মোট জনসংখ্যাতে উপস্থিত রয়েছে। এই ব্যবস্থা অভ্যন্তরীণভাবে অকার্যকর যা সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলবে কারণ সংরক্ষণের বর্ধিত অংশ প্রচুর দাবি এবং পাল্টা দাবির উদ্রেক ঘটাবে। বর্ণের সম্পদগত বৈষম্যের ভিত্তিকে উপেক্ষা করে তাদের জন্য ব্যাপক সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠা করা সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণাকে অস্বীকার করা হবে এবং এটাই এই সমগ্র অনুশীলনটি অর্জন করতে চাইছে। ব্যাপক সংরক্ষণের একটি ব্যবস্থা, যা সব ক্ষেত্রেই অর্থহীন।

সমাধানটি ভারতীয় সমাজের সমদর্শিতার অক্ষমতার বিরুদ্ধে এসসি এবং এসটিদের জন্য সংরক্ষণের মূল ধারণায় ফিরে আসার মধ্যে নিহিত রয়েছে। এই নীতির অন্তর্নিহিত অংশটি সঠিকভাবে প্রকাশ করা এবং জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা যেতে পারে। এই সামাজিক অসুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে, এই নীতি শুধুমাত্র পাবলিক সেক্টরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার কোন যুক্তি নেই। এটি যুক্তিসঙ্গতভাবে অন্যান্য সমস্ত সেক্টর, বেসরকারী ক্ষেত্র, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী ইত্যাদিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যেহেতু এটি একটি সামাজিক রোগের প্রতিষেধক হিসাবে কল্পনা করা হয়, তাই সমাজ দ্রুত সম্ভব এটি থেকে নিজেকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করবে। পরিমাপের একটি সঠিক নকশা এবং পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওই দিকে অগ্রগতি রেকর্ড করা যেতে পারে। এমনকি সুবিধাভোগীরাও চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ পছন্দ করবে না কারণ এটি বর্ণের সাথে যুক্ত। রাষ্ট্রের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণের সাথে সাথে জাতিভেদ প্রথার অবসান ঘটানোর জন্য একটি প্রক্রিয়া হিসাবে এই ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা উচিৎ। ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে অনগ্রসরতার মানদণ্ড সংরক্ষণকে ব্যাপক করে তোলে এবং তাই তা অর্থহীন হয়ে ওঠে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দরিদ্রদের পূর্ণ মানবিক ক্ষমতা উপলব্ধি করে সহায়তা করা রাষ্ট্রের একটি মৌলিক দায়িত্ব। ধর্মনিরপেক্ষতার মানদণ্ডে এই সহায়ক ব্যবস্থাটি ভালভাবে তৈরি করা যেতে পারে।

Updated: 27/01/2023

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার