রাম সেতুর উৎপত্তি প্রসঙ্গ
সুমিত গাঙ্গুলি
শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপ এবং ভারতের পাম্বান দ্বীপের সাথে সংযুক্ত একটি পাথরের সংযোগ স্থল - বহু মানুষ মনে করেন এটি 'রাম সেতু'। ১৮ মাইল (৩০ কিলোমিটার) লম্বা এই সেতুকে কেউ কেউ ১,০০০,০০০ বছরেরও বেশি বয়সী বলে মনে করে। রাম সেতুর অবস্থানটি খুব গভীর নয়, মাত্র ১-১.২ মিটার (সমুদ্রের জল হ্রাস পাওয়ায়) নিমজ্জমান ও গভীরভাবে সমান। বহু তথাকথিত বিশেষজ্ঞগণের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, রাম সেতুটি বিখ্যাত ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
এই সেতুটির কথা প্রথম ভারতীয় সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণে বাল্মীকি লিখেছিলেন, যেখানে রাম ভক্ত বানর সৈন্যবাহিনী শ্রীলঙ্কা পৌঁছানোর জন্য এবং রাজা রাবণের থেকে রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করার জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন। যদিও শ্রীলঙ্কার প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে যে রাম সেতুর বয়স ১,০০০,০০০ থেকে ২,০০০,০০০ বছর হতেই পারে, কিন্তু এই সেতুটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে নাকি এটি একটি মানবসৃষ্ট সেতু, তার ব্যাখ্যা তাঁদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ভারত ভূখণ্ডের সভ্যতার প্রাচীনতম ইতিহাসবিদরা নিশ্চিতভাবে এই সেতু নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। বিশ্লেষকরা অনুমান করেছেন যে সম্ভবত এই প্রাচীন সেতুটি লক্ষ লক্ষ বছর আগে শ্রীলঙ্কাকে ভারত থেকে পৃথক করে নির্মিত হয়েছিল।
একবার দেখেনি এ ব্যাপারে সাহিত্য কি বলছে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটদের রামায়ণে আছে যে বিভীষণ রামের সঙ্গে যোগ দিলে রাম বিভীষণকে লঙ্কার রাজা হিসেবে ঘোষণা করে দেয়। এরপর সমুদ্র পেরোনোর জন্য রাম সমুদ্রের উপাসনা করা শুরু করে। সমুদ্র সাড়া না দিলে রাম সিদ্ধান্ত নেয় যে সমুদ্র শুষে নেবেন। তাতে ভয় পেয়ে সমুদ্র এসে আবির্ভূত হয়। এইখানে উপেন্দ্রকিশোর লিখছেন - 'এই বলিয়া রাম ধনুক লইয়া তাহাতে ব্রহ্মাস্ত্র জুড়িলেন। সে অস্ত্রের তেজে চন্দ্র সূর্য অবধি কাঁপিতে লাগিল আর সাগরও প্রাণের ভয়ে আমনি হাত জোড় করিয়া উপস্থিত হইল। তারপর সে রামের নিকট অনেক মিনতি করিয়া বলিল, “এই নল বিশ্বকর্মর পুত্র। নল আমার উপর সেতু বাধিয়া দিলেই সকলে পার হইতে পারিবে। সেতু যাহাতে না ভাঙে, সেজন্য আমি এখন হইতে খুব স্থির হইয়া থাকিব।’ তখনই বানরেরা গাছ আর পাথর আনিয়া সমুদ্রের ধারে ফেলিতে লাগিল। নল কি আশ্চর্য কারিগর। সেই গাছ পাথর দিয়া একশত যোজন লম্বা সুন্দর সেতু প্রস্তুত করিতে ছয় দিনের বেশি লাগিল না। সেই সেতুর উপর দিয়া সকলে পার হইয়া লঙ্কায় আসিল।"
নল স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে এই দায়িত্ব নেওয়ার পরে বানরদল বিরাট আকারের ভারী ভারু গাছের গুড়ি, ছোটো টুকরো ডালপালা, ছোটো বড়ো পাথর এনে জড়ো করা শুরু করে এবং আকার অনুসারে তা সমুদ্রের ওপর সাজানো শুরু করে। বানর দলের সহায়তায় নল মাত্র পাঁচ দিনে দশ যোজন (৮০ মাইল বা ১৩০ কিলোমিটার) দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণ করে। রাম ও তাঁর সৈন্যদল এর ওপর দিয়ে হেঁটে লঙ্কায় পৌঁছান এবং সেখানে তাঁরা রাবণের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। রামায়ণের কোনও কোনও সংস্করণে উল্লেখ রয়েছে যে, নলের পাথরকে জলে ভাসিয়ে রাখার ক্ষমতা ও দক্ষতা ছিল, যার ব্যবহারে নল এই সেতুটি নির্মাণ করতে সফল হন। কোনো কোনো সংস্করণে নলের সাথে সাথে অপর এক বানর তথা তার ভ্রাতা নীলের ঐ ক্ষমতা ছিল, ফলে নল ও নীল একত্রে ঐ বিদ্যার ব্যবহার করে সেতু নির্মাণ করেন। আরেকটি জনশ্রুতি অনুসারে বরুণদেব রামদের আশ্বস্ত করে বলেন যে দেবস্থপতি নল ও নীলের দ্বারা জলে ফেলা পাথর জলে ডুববে না। কিন্তু সমুদ্রের স্রোতের ফলে তারা কেউই জলে স্থায়ীভাবে পাথরগুলি স্থাপন করতে অসফল হয়। এই সময়ে শ্রীরামভক্ত এবং বানরদের দলপতি হনুমান এই সমস্যার অদ্ভুত এক সমাধান করেন। তিনি পাথরে রাম নাম খোদিত করেন যাতে তারা একে অপরের সাথে জুড়ে থাকে।
তেলুগু এবং বাংলাতে যে আঞ্চলিক রামায়ণের সংস্করণগুলি রয়েছে, শুধু তাই নয়, জাভার ছায়ানাটিকাগুলির ক্ষেত্রেও সেতু নির্মাণে মূখ্য হিসাবে নল-নীল ও হনুমানের অবদানের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। নল তার অশুচি বাম হাত দিয়ে হনুমানকে পাথরগুলি হস্তান্তর করাতে তিনি বিশেষ দুঃখিত হন এবং নিজে নিজের শুচি ডান হাত দিয়ে সেগুলি সমুদ্রে প্রতিস্থাপিত করেন। এমতাবস্থায়, রাম হনুমানকে সান্ত্বনা দেন এবং বলেন যে কারিগরির ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম যে নির্মাতারা বাম হাত দিয়ে জিনিস নেবে এবং ডান হাত দিয়ে তার সঠিক স্থানে রাখবে বা পরবর্তীজনকে দেবে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা আনন্দ রামায়ণ নামক রামায়ণের অপর একটি সংস্করণে উল্লেখ রয়েছে সেতু নির্মাণের আগে রাম নলের আনা নয়টি জ্যোতির্ময় পাথরকে নবগ্রহরূপে পূজা করেন।
এদিকে আব্রাহামিক ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে এটি আদম সেতু। শ্রীলঙ্কায়, তাঁদের মতে, ইডেন উদ্যান অবস্থিত ছিল। আবুল কাসেম উবায়দুল্লাহ ইবন আবদালাহ ইবন খোরদাদবেহ এমনটাই দাবি করেন তাঁর কিতাব আল মাসালিক ওয়া-ই-মামালিক গ্রন্থে। আলবেরুনি প্রথম এই ধারনা ব্যক্ত করেন।
ব্যাপক ক্ষেত্র সমীক্ষার অভাব আদমের সেতুর প্রকৃতি এবং উৎস সম্পর্কিত অনেক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বেশিরভাগই বেলেপাথর এবং সমষ্টির সমান্তরাল প্রান্তগুলির একটি সিরিজ নিয়ে গঠিত এই সেতু, যার পৃষ্ঠ শক্ত এবং বালুকাময় তীরে নেমে যাওয়ার সাথে সাথে তা মোটা ও নরম হয়ে ওঠে। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ISRO)-এর স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার (SAC)-এর মেরিন অ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্সেস গ্রুপ এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে অ্যাডামস ব্রিজ ১০৩টি ছোট প্যাচ রিফ নিয়ে গঠিত। একটি সমীক্ষা অস্থায়ীভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ইউস্ট্যাটিক উত্থানের ইঙ্গিত করার জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই এবং দক্ষিণ ভারতে এই উত্থিত প্রাচীর সম্ভবত স্থানীয় ভূখণ্ড উত্থানেরই ফল।
ধর্মীয় বিশ্বাস এই যে এই ভূতাত্ত্বিক কাঠামো রাম দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, যা আগেই বলা হয়েছে। আব্রাহামিক ধর্মের বিশ্বাসীরাও আদমের সেতুর প্রাকৃতিক উৎসকে প্রত্যাখ্যান করে। এস. বদ্রিনারায়ণ, ভারতের জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন পরিচালক, ২০০৮ সালের একটি আদালতের মামলায় ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র, মাদ্রাজ হাইকোর্টে এবং সায়েন্স চ্যানেল সিরিজের একটি পর্ব 'What on Earth?'-এ দাবি করেছেন যে কাঠামোটি মানবসৃষ্ট। টিভি সিরিয়ালটির দাবি যে সেতুটি নির্মিত হয়েছিল মানুষ দ্বারা। তাদের হাতিয়ার অস্পষ্ট অনুমান। অনেক ভূতাত্ত্বিক গঠনের মতো এর গঠনের প্রতিটি বিশদ বিতর্কের নিষ্পত্তি করা হয়নি। কিন্তু ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সি.পি. রাজেন্দ্রন পরবর্তীকালে এই দাবীকে "পোস্ট ট্রুথ" যুগের একটি "ঘৃণ্য" উদাহরণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে বিতর্কগুলি মূলত বাস্তবতার পরিবর্তে আবেগের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
NASA বলেছে যে সেতুটির স্যাটেলাইট ফটোগুলির মারাত্মকভাবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। NASA উল্লেখ করেছে: "ওয়েবসাইটগুলির ছবিগুলি আমাদের হতে পারে, কিন্তু তাদের ব্যাখ্যা অবশ্যই আমাদের নয়। দূর থেকে বা কক্ষপথ থেকে তোলা ছবিগুলি দ্বীপের শৃঙ্খলের উৎপত্তি বা বয়স সম্পর্কে সরাসরি তথ্য দিতে পারে না এবং নিশ্চিতভাবে নিদর্শনগুলি কোনো সেতুর সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা তা নির্ধারণ করতে পারে না"।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্টে এই কাঠামোটি প্রাকৃতিক গঠন ছাড়া আর কিছু হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ এবং ভারত সরকার ২০০৭ সালের একটি হলফনামায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিল যে রামের দ্বারা নির্মিত সেতুর কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কার পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভারতে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে ধর্মীয় পর্যটনকে উন্নীত করার জন্য রামের কিংবদন্তি তুলে ধরে তার "রামায়ণ ট্রেইল"-এর একটি বিষয় হিসাবে ঘটনাটি অন্তর্ভুক্ত করে। কিছু শ্রীলঙ্কার ইতিহাসবিদ এই উদ্যোগকে "শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের চরম বিকৃতি" বলে নিন্দা করেছেন। সেথুসমুদ্রম শিপিং ক্যানেল প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাম সেতুকে একটি পবিত্র প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার ধারণা জোরদার হয়েছে।
পাথর নির্মিত এই সেতুটির ভৌগোলিক উৎপত্তিকে নস্যাৎ করে বর্তমানে এই অবস্থান কেবল ধর্মীয়ই নয়, রাজনৈতিকও বটে। ভূগোল বলছে, রামসেতু আদতে তৈরি লাইমস্টোন বা চুনাপাথর থেকে এবং এর গড়ে ওঠা আদ্যোপান্ত প্রাকৃতিক। রামসেতু বা অ্যাডামস ব্রিজ ভারতের একদম দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রামেশ্বরম দ্বীপ (বা পম্বন দ্বীপ) এবং শ্রীলঙ্কার একদম উত্তর-পশ্চিমের মান্নার দ্বীপের মাঝে অবস্থিত। এই দুই দ্বীপের মধ্যবর্তী পক প্রণালীর যে অংশ দিয়ে খণ্ড খণ্ড শিলাভূমি বিস্তৃত রয়েছে, সেই অংশের গভীরতা অত্যন্ত কম। এমনকী কোথাও কোথাও সেই গভীরতা এক থেকে দশ মিটার মাত্র। তাই সহজেই চোখে পড়ে পাথরের উপরিতল এবং সে জন্যেই এদের ভাসমান পাথর বলা হয়। অক্ষয় কুমার ও রামভক্তদের বিশ্বাসে আঘাত লাগলেও এটাই সত্য যে এই পাথর বা শিলাখণ্ডগুলি ভাসমান নয়। কোনোদিন ছিলও না...
Comments
Post a Comment