সোমনাথ লাহিড়ী ও তৎকালীন কমিউনিস্ট সমাজ: প্রেক্ষাপট ৪৬-এর অন্য কলকাতা

রক্তিম ঘোষ

ইতিহাস মাঝেমাঝে প্রেডিকশনের বাইরে চলে যায়। কী হচ্ছে-কেন হচ্ছে হিসাব কষার বিশেষ উপায় থাকে না। নভেম্বর ১৯৪৫ সালের কলকাতার কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীদের হাল হয়েছিল অনেকটা সেইরকমই। অনেকটা বিষম খাওয়ার মতো। ২১ নভেম্বর ১৯৪৫-এর ঘটনা দিয়েই শুরু করি।

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার চলছে আর সেই নিয়ে একটা সভা ডেকেছে গান্ধিবাদী ছাত্র সংগঠন। দিলীপ কুমার বিশ্বাসদের এই ছাত্র কংগ্রেসের সভায় যাওয়ার কোনও কারণ ছিল না কমিউনিস্ট নৃপেনের। তিনি গিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেনে টেস্ট খেলা দেখতে। ফিরবার পথে খবর পান ধর্মতলায় ছাত্ররা নাকি পথ জুড়ে বসে রয়েছেন। আর পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গণ্ডগোলও বেধেছে। নিছক কৌতূহল মেটাতে সেখানে গিয়ে পৌঁছন নৃপেন। গিয়ে দেখেন এক প্রস্থ লাঠিচার্জ হয়ে গিয়েছে। ছাত্ররা আবার ছত্রভঙ্গ অবস্থা থেকে একত্রিত হচ্ছেন আর অফিস যাত্রীদের ভিড়ও উপচে পড়ছে। এদিকে ভিড় সরাতে ব্যস্ত ঘোড় সওয়ার পুলিশ।

খানিক বাদে খাকসাররা এসে পুলিশের ব্যারিকেডে ধাক্কা মারলেন। শুরু হল আবার লাঠিচার্জ। কলকাতার রাস্তার আলো ভেঙে নিভিয়ে দিলেন সাধারণ জনতা। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। তাঁরা পালিয়ে না গিয়ে লড়ছেন গোরাদের চোখে চোখ রেখে।

নৃপেন দেখলেন কাছের এক দোকান থেকে প্রাদেশিক ছাত্রনেতা রণজিৎ গুহ ফোন করছেন রমেন ব্যানার্জিকে। রমেনদা, তাহলে কি ‘ইন্সারেকশন’ (অভ্যুত্থান) শুরু হয়ে গেল! [i]

অভ্যুত্থান। শুরু হয়ে যেতে পারে এমন একটা ক্ষীণ আশা কিংবা স্বপ্ন কমিউনিস্ট ছাত্রদের বুকে তখন জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু সেই অভ্যুত্থানের পদ্ধতি প্রকরণ, কিংবা সেটা নিয়ে খাবেন না মাথায় মাখবেন সেই ধারণা তখন তাঁদের নেই। খানিক চমকে উঠেছিলেন তাই তাঁরা ৪৫-এর নভেম্বরে। কন্তু ব্যাপারটা শুধু তাইই নয়।

কমিউনিস্ট ছাত্র নেতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের জবানী থেকে আমরা কিছু অন্য দিক সম্পর্কে জানতে পারি। প্রথমত, মিছিলের আহ্বায়করা সেইদিন কমিউনিস্টদেরকে ডাকেননি। কিন্তু ব্যারিকেড যত তীব্র হয়েছে, ততই মিশে গেছেন কমিউনিস্ট এবং অকমিউনিস্ট ছাত্রনেতারা ব্যারিকেডের সঙ্গে। সারা রাত জেগেছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ও। তাঁর অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন অসংখ্য বড় বড় কংগ্রেস নেতাকে আসতে যেতে ঘটনাস্থলে। কিরণ শঙ্কর রায়, শরৎ বোসের নাম করে ছাত্রদের ফিরে যেতে বলেছেন। কিন্তু কেউ ছাত্রদের সঙ্গে থেকে যাননি। শুধুমাত্র দুইজন ছাড়া। একজন জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী, অপরজন বীণা দাস। জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী মায়ের মতন বকাঝকা করে ছাত্রদের আগলে রাখবার চেষ্টা করেছেন সারারাত। তিনি একবার শরৎবাবুর বাড়িতেও ছুটেছেন। জোর করে হলেও তাঁকে ধরে নিয়ে আসবেন ছাত্রদের কাছে। ছাত্রদের পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে হবে তো! কিন্তু না, তিনি ফিরে আসেন হতাশ হয়ে। শরৎ বসু তাঁর কথাতেও আসেননি। [ii]

গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের এই অভিজ্ঞতার বাইরে দুটো সামান্য কথা বলার, কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তৎকালীন কংগ্রেসী এবং অন্যান্যদের মনোভাব। কমিউনিস্টরা আগস্ট বিপ্লব এবং আজাদ হ্নদের বিরোধিতা করে ততদিনে নিজেদের গায়ে দেশবিরোধী তকমা লাগিয়ে ফেলেছেন।

এদিকে কংগ্রেস বা অন্য কেউই তখনও হিসাব করে উঠতে পারেনি ভারতের নিম্নবর্গ সাধারণ মানুষ, ছাত্র-যুব-মধ্যবিত্ত কী চাইছেন। জনগণের মেজাজ বুঝতে অক্ষম নেতারা তাই জনগণকে ঠাণ্ডা করবার চেষ্টায় মেতে উঠেছেন। ২২ নভেম্বরের কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ার দেখেছে অগুন্তি মানুষের জনসমাবেশ। বহু পতাকার মিলন। লাল ঝাণ্ডা, কংগ্রেসী, মুসলিম লীগ সকলের পতাকা পাশাপাশি মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। মানুষের চোখে এক অদম্য নেশা আর সেই ঘোর থেকে জনতাকে বার করে আনতে নেতারা চেষ্টার কোনও কসুর রাখতে চাইছেন না। কিন্তু তার মধ্যেও কমিউনিস্ট-দের সম্পর্কে জনতার মনোভাব… ঠাক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মুখ থেকেই শুনুন।

…শরৎবাবুও এলেন শেষ পর্য্যন্ত, পুত্র অমিয়নাথ এবং বন্ধু সুরেশ মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে। স্তব্ধ হয়ে সেই জনসমুদ্র প্রতিটি কথা শুনছে—‘…আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের মত তোমাদের আদেশ মেনে চলতে হবে…আজ এই আন্দোলন আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তি আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে…আমার উপর বিশ্বাস রাখ…ডাক একদিন দেব, সেদিনের জন্য প্রস্তুত থাক কিন্তু তার সময় আজ নয়…’

বিশ্বাস করতে পারছে না ছাত্ররা যে বক্তা শরৎবাবু, বাংলার কংগ্রেস নেতা শরৎবাবু। ৪২-এর আগস্টে এমনি করে তারা ছুটে গিয়েছিল কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তারে ক্ষিপ্ত হয়ে। সেদিনকার বীরত্বকে প্রত্যেকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সেদিন যদি কম্যুনিস্টরা যোগ দিত, যদি শমিকরা ধর্মঘট করত আর যদি আসত মুসলমানরা তবে কবর রচনা হোত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের—এই কথাই তারা শুনেছে শরৎবাবু আর অন্য সব নেতাদের কাছে।

আজ তো সবাই আছে—শ্রমিকরা এসেছে, এসেছে মুসলমানরা। তবে অপেক্ষা কিসের? কেন ফিরে যাবার এই নির্দেশ? কার কথা তারা শুনবে? একমাস আগের দেশবন্ধু পার্কের শরৎবাবুর, না আজকের শরৎবাবুর? শরৎবাবু তাঁর কর্তব্য পালন করে গিয়ে উঠলেন মোটরে। কিন্তু একজনও ফিরে গেল না তাঁর কথায়। মাঠের কোণে কোণে দলে দলে ছাত্র জটলা পাকিয়েছে। আওয়াজ উঠছে—‘ডালহাউসি, ডালহাউসি’। কম্যুনিস্ট, অ-কম্যুনিস্ট, কম্যুনিস্ট-বিরোধী বহু ছাত্রকর্ম্মী তাদের বোঝাবার চেষ্টা করছে, তাদের ফেরাবার চেষ্টা করছে। এক কোণে দেখলাম দুটি যুবককে ঘিরে কয়েকজন ছাত্র। তাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে—‘শালারা কম্যুনিস্ট—ফিরে যেতে বলছে।’ ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি যুবক দুটির একজন কম্যুনিস্ট-বিরোধী ছাত্র পত্রিকা ‘সাথী’-র সম্পাদক রামমুনি মেনন। অন্যজন তারই সহকর্ম্মী ছাত্র কংগ্রেসের মনুজেন্দু দত্ত মজুমদার। তারা দুজন বোঝাবার চেষ্টা করছে যে ডালহাউসি যাবার চেষ্টা করা আত্মহত্যার সমান। ভাগ্যের নির্ম্মম পরিহাস!

কিন্তু তারপর,

হঠাৎ কে চীৎকার করে ছুটে এল—গুলি গুলি—ধর্ম্মতলা স্ট্রীটে আবার গুলি চলেছে।

ছুটলাম ঘটনাস্থলে। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে বেশ পুলিশ ব্যারিকেডের সামনে—আর লোক আসছে বন্যার স্রোতের মত, চারিদিক থেকে…

…ব্যারিকেডের দু’পাশে পতাকা দুলছে। চীৎকার উঠেছে—স্লোগান কাঁপছে কণ্ঠে কণ্ঠে। যে কোন মুহূর্তে ব্যারিকেড ভেঙ্গে যেতে পারে। তবু গুটিকয় আমরা; ফেরাতেই হবে ক্ষিপ্ত জনতাকে। যে কোন মূল্য দিয়েই।

এমনি সময় এলেন ডাঃ নলিনাক্ষ সান্যাল। প্রাণপণে আবেদন জানালেন। আর একজন সম্ভবত ভূপতিবাবু। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। আজ নেতৃত্ব নেই ‘বিপ্লবী’ নেতাদের হাতে। ক্ষিপ্ত ছাত্র অ-ছাত্র জনতা যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত; কর্তব্যের নির্দেশ না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটছে এই দিকে। সামনেই পুলিশ ব্যারিকেড।

এগিয়ে আসছে একটি শোভাযাত্রা। সামনে দুটি মেয়ে—এক সহপাঠিনীর হাতে ফ্ল্যাগ। এগিয়ে তারা যাবেই, তারা প্রাণ দেবেই। দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন এক বৃদ্ধ কংগ্রেসকর্ম্মী—তোমরা যেতে পারবে না। না না, কিছুতে না।

—‘ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন। এ পথে আমরা যাবই।’

—‘তোমাদের নেতা বারণ করেছেন। কংগ্রেস বারণ করেছে।’

—‘আমাদের নেতা কেউ নেই। ছিলেন যিনি তিনি মৃত। আজ আমরা মরবো। এ পথে যাবই।’

বৃথা চেষ্টা। ওরা যাবেই। ঘুরে দাঁড়ালাম। বুক দিয়ে, পিঠ দিয়ে আটকে ধরেছি পথ, আমরা কয়েকজন হাত ধরাধরি করে। দশহাত দূরে ব্যারিকেড। কি ভয়ঙ্কর মুহূর্ত!

হঠাৎ চেয়ে দেখি পুলিশ ব্যারিকেডের পিছনেও জেগে উঠেছে পতাকার পর পতাকা, শোনা যাচ্ছে আওয়াজ—সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। হাজার হাজার ছাত্র আর নাগরিকের আর এক মিছিল এসেছে উল্টো দিক থেকে। যাঁতাকলের মধ্যে পড়েছে পুলিশের দল। অগণিত মানুষের ক্রোধ ঘিরে ফেলেছে তাদের… পালাচ্ছে, ওরা পালাচ্ছে। একটার পর একটা গাড়ী বোঝাই পুলিশ গণেশ এভিনিউর দিকে রওনা হয়েছে—কলকাতা শহরে! দিনের আলোয়!! লক্ষ লোকের সম্মুখে!!!

তারপর। লক্ষ লক্ষ লোক হেঁটে গেল ডালহাউসির বুকের উপর দিয়ে, স্লোগানে আকাশ ফাটিয়ে। ক্লাইভ স্ট্রীটের অফিস খালি করে বেরিয়ে এল কেরাণীবাবুরা। রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দা ছেয়ে গেছে দর্শকে, যোগ দিয়েছে অফিসের যত দারোয়ান আর কুলী। যারা দেয়নি তারাও বারান্দা থেকে, জানালা থেকে রুমাল নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে আমাদের। এমন বিপুল অভিনন্দন আর কেউ কোনদিন দেখেছি কি?” [iii]

৪৫-৪৬-এর বিপ্লবী উন্মাদনা আমাদের আলোচনার উপজীব্য নয়। আমরা আজ চর্চা করতে এসেছি সেই আন্দোলনের সময়কালে কমিউনিস্টদের অবস্থা-তাঁদের চিন্তা-ভাবনা-বিস্ময় এবং আভ্যন্তরীণ সংলাপ। ওই সময়ের স্পিরিটকে বোঝাতে মাঝেসাঝে একটু উদ্ধৃতি দিতে হবে হয়তো কিন্তু মূল বিষয় থাকবেন তৎকালীন কমিউনিস্টরা। যেমন আমরা যদি সেই কলকাতাকে কমিউনিস্ট কর্মী কুমুদ বিশ্বাসের চোখ দিয়ে দেখি, খানিক মানসিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবো। তিনি বলছেন, ‘১৯৪৫-এর ২১শে নভেম্বরের ঘটনাকে আমরা ‘রিয়ালাইজ’ (উপলব্ধি) করতে পারিনি। ‘উই ফাম্বল্ড্’ (আমরা ইতস্তত করি)—আমরা দ্বিতীয় দিনে যোগ দিই। আমাদের মনে বিস্তর খট্কা ছিল। সাহেবের টুপি খুলে দেওয়া—মেমদের গাউন ধরে টানাটানি—সাহেবের দোকানের কাঁচভাঙার ঘটনাকে বড় করে দেখি।’ তাই পার্টি পুস্তিকায় লেখা হয়:

‘লালঝান্ডার গাড়ী পথে পথে প্রচার করতে লাগলো : উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, সকল দলের মিলিত প্রতিবাদ আন্দোলন চাই।

হাজরা রোড ও সেন্ট্রাল এভেনিউ এলাকার নামকরা গুন্ডারা তখনো, মিলিটারী লরীতে ঢিল ছুঁড়ছে, আগুন লাগাচ্ছে।’ [iv]

জানি না, অন্তত এই ছোট্ট পরিসরে আমরা জানবো না যে এই গুণ্ডারাই সেই গুণ্ডারা কিনা যারা ৪৬-এর আগস্টের কিংবা সেপ্টেম্বরের কলকাতার নরহত্যাকারী দাঙ্গাবাজ হয়ে উঠবে। তবে এই ‘গুণ্ডা’দের আপাতত একটাই লক্ষ্য মিলিটারি। অদ্ভুতভাবে কোনও ধর্মীয় বিভেদও নেই তাঁদের মধ্যে। যদিও এটা শ্রেণি বা গণ লাইন কিনা সেই জটিলতার মধ্যে গিয়ে আমাদের লাভ নেই। কারণ সেইসব যাঁদের নির্ধারণ করার কথা, তাঁদের দর্শক সুলভ উপলব্ধিটুকুই উপলব্ধির চেষ্টায় আমরা নিবিষ্ট। সুতরাং দেখে নেওয়া যাক, আর এক কমিউনিস্ট কর্মী খোকা রায়ের উপলব্ধি।

“১৯৪৫-এর ২১শে নভেম্বর শুনলাম ধর্মতলার ট্রাম লাইনের উপর সত্যাগ্রহ শুরু হয়েছে। আমরা সবাই গেলাম দেখতে—আমি, ভবানী সেন আর নৃপেন চক্রবর্তী। নৃপেনদা তো রাস্তায় বসে পড়লেন। রাত একটায় তখন সেখানে মাত্র শ’দেড়েক লোক। আমরা চলে এসেছি—ঠিক করলাম কাল ট্রাম স্ট্রাইক হবে। লাহিড়ীকে জানানো হলে—লাহিড়ী তার দায়িত্ব নিলেন।

পরের দিন ধর্মতলায় গিয়ে দেখি কাল যেখানে ছিল শ’দেড়েক লোক—আজ সেখানে তিন লক্ষ লোক। চাঁদনি থেকে ওয়েলিংটন পর্যন্ত এক্কেবারে লোকে ঠাসা। বুখতে পারছিলাম মানুষের মধ্যে লড়াই-এর ‘মুড’ রয়েছে—ক্কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ের তা আন্দাজ করতে পারিনি। যদি বলেন ‘সাব্জেক্টিভ্লি’ (নিজেদের মনের দিক থেকে) প্রস্তুত ছিলাম কিনা—না, তা ছিলাম না।” [v]

“আমরাও রয়েছি, যেখানে পারছি সংগঠিত করছি—নেতৃত্ব দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের প্রধান অসুবিধে যুদ্ধের সময় নেতাজীকে জাপানের চর ডাকা। জয়প্রকাশকে, অরুণা আসফ আলিকে পঞ্চমবাহিনী বলা। নেতাজী জাপানের চর নয়—‘মিসগাইডেড পেট্রিয়ট’ (বিপথচালিত দেশভক্ত)—‘পেট্রিয়ট’ যে তাতে কোন সন্দেহ নেই। জয়প্রকাশ আর অরুণার তো তখন দারুণ ইজ্জত—অথচ সি.এস.পি.-র শক্তি আর কতটুকু! কিন্তু অরুণা বেরিয়ে আসার পর দেশবন্ধু পার্কে যে বক্তৃতা দিল—তাতে কাতারে কাতারে লোক। সেই মিটিং-এর দিকে এক শোভাযাত্রা আসছিল তাতে একটি ছেলে ক্রাচে ভর দিয়ে চলছিল। তার মুখে কিন্তু ‘দিল্লী চল—দিল্লী চল’ এই স্লোগান। যে হাঁটতে পারে না সেও দিল্লী যেতে চায়।” [vi]

হাটি হাটি পা পা করে আমরা ৪৫-এর নভেম্বর ছেড়ে পা রাখবো ফেব্রুয়ারি ৪৬-এর কলকাতায়। সেই কলকাতার বিবরণ আলাদা করে রাখবার প্রয়োজন মনে করছি না। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট জনতার মেজাজ ছিল ৪৫-এর নভেম্বরের চাইতেও বেশী তীব্র। সেই মুহূর্তকাল যাপন করা কমিউনিস্ট কর্মীরা যে উপলব্ধি করেছেন, তা তুলে ধরছি আপনাদের সামনে।

কুমুদ বিশ্বাস বলছেন, “লোকে নিজের মতো করে বুঝেছিল, বুঝেছিল ‘লাস্ট আওয়ার অফ ফ্রিডম স্ট্রাগ্ল্ হ্যাজ স্ট্রাক’—স্বাধীনতা আসছে। আমরা বুঝিনি, পিপল্‌ বুঝেছে।” [vii]

শৈলেন মুখার্জি বলছেন, “লোকের মাথা থেকে টুপি, গলার টাই টান মেরে খুলে ফেলা হচ্ছে—পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু পার্টির কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই। অথচ চারদিকে নানা কান্ড ঘটছে—লোকে লড়ছে।” [viii]

ছাত্রনেতা কমল চ্যাটার্জি বলছেন, “ছাত্রদের জঙ্গী মেজাজ দেখে একটা ক্ষীণ উপলব্ধি আমাদের কারও কারও মধ্যে হচ্ছিল যে লাইন বদলাতে হবে। ঘটনা কত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে—পরিস্থিতি কত দ্রুত বদলাচ্ছে। আমরা ঘটনার পেছনে দৌড়ুচ্ছি—কিন্তু দিশেহারা।” [ix]

বীরেন রায় বলছেন, “যুদ্ধোত্তর যুগের অভ্যুত্থান ও তার তাৎপর্য পার্টি বোঝেনি। লক্ষ লক্ষ লোক ডালহৌসি মার্চ করেছিল; তখন কমিউনিস্ট পার্টি যদি বলত, ‘লালবাজার দখল কর!’ তাহলে দু’হাজার মানুষ প্রাণ দিত। কমিউনিস্ট পার্টির স্বতন্ত্র কোন ভূমিকা নেই। তারা তো বুর্জোয়াদের পিছু পিছু ছুটছে। প্রতি পদে দ্বিধা। এমনও ঘটেছে যে পার্টি মিটিং-এ ঠিক হল স্ট্রাইক হবে। আমরা সেইমতো সব জায়গায় খবর পাঠাচ্ছি। তখন টেলিফোন করলেই স্ট্রাইক হয়ে যেত—যেতে হত না শ্রমিকদের কাছে। রাত একটায় নেতারা বললেন, ‘নো স্ট্রাইক’, হয়তো কংগ্রেস আপত্তি করেছে। এদিকে ‘স্বাধীনতা’র পাতায় ভোরের ডাকে ছাপা হয়ে গেছে—স্ট্রাইক হবে। কিন্তু সর্বশেষ সংখ্যায় ছাপা হল—স্ট্রাইক হবে না!” [x]

কথা সত্যি। ১২ ফেব্রুয়ারী তারিখ ‘স্বাধীনতা’-র পাতায় প্রকাশিত হল একটা ছোট্ট বিজ্ঞপ্তি। আসলে সেটা ছিল এক পিছিয়ে যাওয়ার বার্তা। ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ শিরোনামে সেই লেখাটি প্রকাশিত হয়। লেখাটি এমন—“কংগ্রেস ও লীগ নেতাদের সহিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের যে আলোচনা হয়, তাহাতে প্রথম স্থির হইয়াছিল যে, আজ সর্বত্র হরতাল ও ধর্মঘট পালিত হইবে। সে অনুসারে কমিউনিস্ট পার্টি হইতে সর্বত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত জানানো হইয়াছিল। কিন্তু পরে গভীর রাত্রে কংগ্রেস ও লীগ নেতাদের মত পরিবর্তিত হওয়ায়, সকলের সহিত ঐক্যের খাতিরে আমরা ধর্মঘট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত করিতে বাধ্য হইয়াছি—কমিউনিস্ট পার্টি।” [xi]

১৩ ফেব্রুয়ারিতেও কমিউনিস্ট পার্টি মনে করছে জনতার উচ্ছৃঙ্খলতা মহা বিপদ। সেইদিনের স্বাধীনতার সম্পাদকীয়তে লেখা হচ্ছে, …কলিকাতা সহরের হিন্দু মুসলমান অধিবাসীদের মনে যে ঐক্যবোধ ও সংগ্রাম চেতনা জাগিয়াছে তাহা অপূর্ব। সকলকে প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে যে, এই চেতনাকে আমরা উচ্ছৃঙ্খলতার আত্মঘাতী পথে ব্যর্থ হইতে দিব না।” [xii]

অথচ সেই একই দিনে স্বাধীনতার পাতাতেই কমিউনিস্ট পার্টির এক কাতর আবেদন প্রকাশিত হয়। সেই আবেদনের সুর কিন্তু অনেক বেশী দায়িত্বশীল এবং জনগণের সংগ্রামের প্রতি আস্থাশীল। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার কর্মীরা, এমন পরিস্থিতি আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি, তাই দ্বিধায় দ্বন্দ্বে তাঁরা খানিক দীর্ণ হয়েছিলেন।

“উচ্ছৃঙ্খল জনতার গুণ্ডামি বলিয়া সাম্রাজ্যবাদ ইহাকে দেশভক্তদের চোখে খেলো করিবার চেষ্টা করিয়াছে; তাহাতে ব্যর্থ হইয়া ইহার বিরুদ্ধে অমানুষিক আঘাত হানিতেছে। শহরে মিলিটারী স্বেচ্ছাচারের তান্ডবলীলা চলিয়াছে, এমনকি লোকের বাড়ির ভিতর ঢুকিয়াও তাহারা অত্যাচার চালাইয়াছে। ১৪৪ ধারা জারি করিয়া সমস্ত সহরবাসীর কণ্ঠরোধ করিয়াছে। রাস্তা বন্ধ করার অজুহাতে লোককে বেপরোয়া গুলি করা যাইবে বলিয়া নৃশংস আদেশ শুনাইয়া দিয়াছে। শহরময় বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম হইয়াছে।

এই বিভীষিকার বিরুদ্ধে অসংখ্য সাধারণ নাগরিকের যে সংগ্রাম, তাহাকেই মৌলানা আজাদ ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতা গুন্ডাদের কাজ বলিয়া ভাবিতেছেন, ইহা মর্মান্তিক পরিতাপের বিষয়। সাধারণ মানুষের সংগ্রাম পদ্ধতিতে ভ্রান্তি থাকিতে পারে, কিন্তু দেশভক্তির অতুল প্রেরনা আর অত্যাচারীর প্রতি জ্বলন্ত ঘৃণাই যে তাহাদিগকে মরিবার কঠিন পরীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছে সে কথা কে অস্বীকার করিবে? আজ যদি নেতারা তাহাদিগকে গুণ্ডা বলিয়া সরিয়া দাঁড়ান তবে নির্মম মিলিটারী অত্যাচারের হাতেই তাঁহারা তাহাদিগকে সঁপিয়া দিবেন, একটা গোটা অঞ্চলের অধিকাংশ নাগরিকের মনোবল একেবারে ভাঙ্গিয়া দিবেন।” [xiii]

খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেই সময়কালকে এবং সেই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের উপলব্ধিকে তুলে ধরা আদৌ কতটা সম্ভব জানি না। এই লেখাটি শেষ করবার আগে তাই আমরা তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সর্বজনব্দিত নেতা সোমনাথ লাহিড়ীর উপলব্ধি কী ছিল সেটা তুলে ধরবো।

সোমনাথ লাহিড়ীর এই রচনাটি প্রকাশিত হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা-র পাতায়।

“কলকাতার জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ লড়াই সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়েছে। নিহিত আহত ভাই-বোনদের জন্যে শহরের ঘরে ঘরে শোকের ছায়া, কিন্তু সে ছায়ার মধ্যে পরাজয়ের বেদনা নেই। দুর্দম সাহস আর কঠোর প্রতিজ্ঞায় প্রত্যেক শহরবাসী উদ্বুদ্ধ ও সকলেই নিশ্চিন্ত সঙ্কল্প করে নিয়েছেন যে লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্ব শীঘ্রই আরম্ভ হবে। শহরতলীর শ্রমিক ভাইয়েরা এখনও লড়ছেন, সেখানেও হয়তো কয়েকদিনের ভেতর স্তব্ধতা নেমে আসবে, কিন্তু সেখানেও সে স্তব্ধতা হবে দ্বিতীয় ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ।

দ্বিতীয় লড়াই শুরু হওয়ার আগে দেশের প্রত্যেককে যাচাই করে নিতে হবে যে, প্রথম লড়াইয়ে আমাদের কোন ত্রুটি ছিল কিনা এবং ভবিষ্যতে কিভাবে চললে দ্বিতীয় লড়াইয়ে আমরা সফল হতে পারব। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রথম দিনে আমরাও কিছুটা ভুল করেছিলাম। সে ভুল পরিষ্কার করে খুলে ধরলে অন্য সকলেরও নিজ ভুল বুঝতে সুবিধে হবে।

ছাত্রদের উপর লাঠি চলার পর আমাদের হরতাল ও ধর্মঘটের প্রস্তাব কংগ্রেস ও লীগ নেতারা অস্বীকার করলেন, আমরাও প্রথম দিন তাঁদের কথা মানলাম। কিন্তু তাঁদের সে বারণ আমাদের শোনা উচিত হয়নি—বোঝা উচিত ছিল যে, সমস্ত জনসাধারণ যেখানে অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে উন্মুখ, সেখানে আমাদের তথা শ্রমিকশ্রেণীরই কর্তব্য হল সঙ্ঘবদ্ধ ধর্মঘট করে জনসাধারণকে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের পথ দেখানো। নেতারা দূরে থাকলেও, জনসাধারণের অধীর আগ্রহে তাঁরা হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। অথচ জনসাধারণকেও অসঙ্গঠিত উত্তেজনায় গা ভাসিয়ে দিয়ে অযথা রক্ত ব্যয় করতে হত না।

বিভিন্ন শ্রেণীর জনসাধারণ, দল ও নেতাকে একত্র আন্দোলনে যুক্ত করার উদ্যোগ আমরা নিয়েছিলাম এবং খানিকটা সফল হয়েছিলাম বলেই এবার প্রথম দিনই ডালহৌসী স্কোয়ারের পথ অত সহজে উন্মুক্ত হল। কিন্তু ডালহৌসী থেকে ফেরার পর দু’এক জায়গায় দু’একজন নিরীহ সাহেব-মেমের ওপর উৎপাত দেখে আমরা ভুল ভেবেছিলাম যে, গুপ্তচর বা গুন্ডারাই বোধহয় লোককে উস্কাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পরদিন (বুধবার) সকালেই আমাদের ভুল সংশোধিত হল। কংগ্রেস ও লীগ নেতাদের আহ্বান জানিয়ে আমরা লিখলাম, ‘সাধারণ মানুষের সংগ্রাম পদ্ধতিতে ভ্রান্তি থাকিতে পারে, বিশৃঙ্খলা থাকিতে পারে। কিন্তু দেশভক্তির অতুল প্রেরণা আর অত্যাচারীদের প্রতি জ্বলন্ত ঘৃণাই যে তাঁহাদিগকে মরিবার কঠিন পরীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছে সে কথা কে অস্বীকার করিবে?’ সেই জন্যেই আমরা তাঁদের কাছে আবেদন করি যে জনসাধারণের এই সংগ্রামের দায়িত্ব তাঁরা যুক্তভাবে নিন, একে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের পথে পরিচালিত করুন। কিন্তু নেতারা সে আহ্বানে সাড়া দেননি।

নেতারা সাড়া দিন বা না দিন, সকল সাধারণ মানুষের জ্বলন্ত বিক্ষোভ আর অতুল ভ্রাতৃভাব এমনই বিরাট প্রেরণা জাগিয়েছে যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের বন্যা সমস্ত বাধাকে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে, লোকে কাতারে কাতারে গুলির সামনে বীরের মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু সে ঐক্য, সে বীরত্ব, সে মৃত্যু সবই ব্যর্থ হবে—যদি আমরা প্রথম লড়াইয়ের সমস্ত ভুল-ত্রুটি নির্মমভাবে সংশোধন না করি, দ্বিতীয় লড়াইয়ের জন্য সংঘবদ্ধভাবে প্রস্তুত না হই।

ভুল কোথায়? মৃত ভাইদের মুখ স্মরণ করে আকুল আগ্রহে অনেকে ভেবেছেন, আমাদের হাতে অস্ত্র ছিল না বলে এবার আমরা হারলাম, সামনের বারে সে ত্রুটি আমরা সংশোধন করব, তখন আমাদের ঠেকায় কে? কিন্তু আসল ত্রুটি সেখানে নয়।

অত্যাচারের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ও ঘৃণার প্রখর উচ্ছাসে সাধারণ মানুষের নীচের তোলা থেকে আপনা-আপনি একতার জোয়ার উঠেছে। চট্টগ্রামের কসাইপাড়ায় সৈন্যদের অত্যাচারের প্রতিবাদেও ঠিক এমনই জোয়ার উঠেছিল। কিন্তু তারপর ওপর থেকে দমননীতির চাপ এসেছে, স্বার্থের সংঘাত বেধেছে, সে ঐক্য আজ নেই বললেই হয়। এখানেও এই ঐক্যের ওপর এখনই আঘাত আসছে, ক্রমে ক্রমে সে আঘাত বাড়তেই থাকবে। নেতাদের আমরা এক করতে পারিনি—এমনকি কাল সুহরাবর্দ্দি সাহেব যখন সকল দলের নেতাদের দাকলেন তখন কংগ্রেস নেতারা সে বৈঠকে উপস্থিত হলেন না। ‘আজাদ’ পত্রিকা এখনই ইঙ্গিত করতে আরম্ভ করেছে যে এই আন্দোলনকে হিন্দুরা অপব্যবহার করছেন। নির্বাচনের দলাদলি প্রচারে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য আরও ঘা খেতে থাকবে, আর লীগ বা কংগ্রেস মন্ত্রীত্ব কায়েম হলে ভেদ সৃষ্টি চরমে উঠবে। অথচ এই ঐক্য কায়েম রাখাই প্রথম কাজ, সর্বপ্রধান কাজ, বোমা-বন্দুক তার কাছে কিছুই নয়। এই ঐক্যকে আরও বাড়ানোর এবং একে আরও সুদৃঢ় করার কাজ ছেড়ে যিনি বোমা-বন্দুকের পেছনে দৌড়বেন বা তার গল্প শোনাবেন, তিনি গোটা লড়াইটারই সর্বনাশ করবেন।

রক্তাক্ত মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে প্রত্যেক মহল্লার হিন্দু-মুসলমান দল-বেদলের মানুষ এক হয়েছেন। এখন তাঁদের নিয়ে যুক্ত কমিটি গথন করতে হবে, যে কোন বিষয়েই সকলের স্বার্থ তাই নিয়ে এই কমিটিকে সারা মহল্লায় তীব্র আন্দোলন চালাতে হবে। যারা মারা গেল তাদের আত্মীয় স্বজনদের সাহায্যের জন্য এবং যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের কেস চালানোর জন্য যে যুক্ত কমিটি গঠিত হয়েছে তার চাঁদা তোলা ও সাহায্য দেওয়ার মত সামান্য কাজ দিয়েই এই মহল্লা কমিটি কাজ শুরু করতে পারে। কিন্তু এর প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত দ্বিতীয় লড়াইয়ের জন্য সকলকে তৈরি করা, প্রথম লড়াইয়ের ত্রুটি সকলকে বুঝিয়ে দেওয়া, যার যা মনে এল সেইভাবে না লড়ে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে সার্বজনীন ধর্মঘট ও হরতালের পথে যাতে লড়াই শুরু হতে পারে তার আয়োজন করা। এই কমিটিগুলি বোমা-বন্দুকের গুপ্ত চক্র নয়—কমিটিগুলি হবে মহল্লার সমস্ত লোকের সব কাজে অগ্রণী, তাঁদের সব লড়াইয়ের নেতা। শ্রমিকরা, বস্তিবাসীরা, ছাত্ররা—সবাইকে এর সঙ্গে ভলেন্টিয়ার দল গথন করতে হবে—যাতে হরতাল বা ধর্মঘট হলে তাকে সুশৃঙ্খলভাবে চালানো যায়, হারের আশঙ্কা দেখলে পিছু হঠা যায়, আবার আক্রমণে আগানো যায়।

উপযুক্ত সময়ে লড়াই আরম্ভ করার আন্দোলন সৃষ্টি করাও এই কমিটিগুলির কাজ। নীচের তলায় সকল মতের লোক মিলে যে দাবী নিয়ে লড়বেন, যে লড়াই আরম্ভ করবেন, তাতে কোন দলের নেতাই বাধা দিতে পারবেন না—বরং কমিটিগুলির তেমন জোর থাকলে তাঁরাও এর মধ্যে এসে যাবেন। কমিটি গথন ও তার কাজের মধ্যে এইটাই প্রধান কথা। কারণ দলাদলি হচ্ছে দ্বিতীয় লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় শত্রু। কেউ যদি দলাদলির জন্যে এতে যোগ দিতে না চান, তাহলে তিনি লড়াই চান না।

বিক্ষোভের উত্তেজনায় যাঁর রক্ত টগবগ করে ফুটছে, তিনি হয়তো ভাববেন—যুক্ত কমিটির এই শুকনো কর্মতালিকায় কি হবে, আমি লড়াই করতে চাই। আমি বলব, তিনি লড়াই করে মরতে চান, কিন্তু আমরা লড়াই করে জিততে চাই। তার জন্যে এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

হতাশ হয়ে তিনি ভাববেন, এইসব করতে করতে সব তো ঠান্ডা হয়ে যাবে, তাঁকে আমরা বলি আজকের দারুণ যন্ত্রণা ও মৃত্যুভয়হীন বিপ্লবী পরিস্থিতিতে দুদিন অন্তর অসন্তোষের স্ফূলিঙ্গ জ্বলে জ্বলে উঠবে। মুহূর্তে মুহূর্তে অত্যাচারীর সঙ্গে বিরোধ বাঁধবে। দেশের মধ্যে দুর্ভিক্ষের আগুন আসছে, ব্যাপক ছাঁটাইয়ের আগুন আসছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন শ্রেণী অগ্রসর হচ্ছে শত্রুকে আক্রমণ করতে। রেলওয়ে ডাক ও অন্যান্য ধর্মঘটের জোয়ার আসছে। কৃষকরা আবার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াচ্ছে। শাসনযন্ত্র আজ ডান্ডা ছাড়া আর কোনো পথ দেখতে পাচ্ছে না। যে কোনো আগুনের ফুলকি যে কোনোদিন দাবানল হয়ে জ্বলে উঠতে পারে। সাধারণ মানুষের ঐক্য যদি সংগঠিত হয়ে তৈরি থাকে তবে সেই দাবানলে অত্যাচারীকেই আমরা পুড়িয়ে শেষ করতে পারব। আর সংগঠিত না হয়ে যত বীরের মতই লড়ি, সেই আগুনে আমাদের সংগ্রামই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।” [xiv]

লেখাটি আমার মতে সব দিক থেকে ব্যালেন্স করবার একটা চেষ্টা। একদিকে হতাশ কর্মীদের মনোবল জোগাতে নিজেদের ভুল স্বীকার করার একটা চেষ্টা। পরিস্থিতিতে না বুঝতে পারবার কথা উঠে আসছে। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির কারণে কর্মীদের রাশ হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় লাহিড়ী অতি সতর্ক। তিনি কর্মীদের উদ্দীপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। সামাল দিতে চাইছেন তখনকার মতো ঠেকনা দিয়ে। তার মনোভাবের আরও একটা দিক আঁচ করা যায় অন্যভাবে। এই সোমনাথ লাহিড়ীর লেখাটিতে গোটা কমিউনিস্ট পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে কিনা প্রশ্ন করা হলে, লাহিড়ী বলেন, “না, ওটা আমার ‘আন্ডারস্টান্ডিং’, যদিও অনেক কমরেড লেখাটা ‘অ্যাপ্রিসিয়েট’ করেছেন; কারণ, তাঁরাও এভাবে ‘ফীল’ করেছিলেন। মনে রাখা দরকার রশীদ আলি ডে-র একটা ‘লিমিটেশন’ ছিল—একটা ‘কমিউনাল’ দিক ছিল। যেহেতু লীগ সমর্থন করেছে—এই আন্দোলনে সাধারণ বস্তিবাসী মুসলমান তাই দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গোটা বস্তিই ‘ইনভলভ্ড্’ হয়ে পড়ে। কংগ্রেস ‘নিউট্রাল’ তাই ভদ্রলোকেরা বেশি ‘পার্টিসিপেট’ করেনি, যারা অংশ নিয়েছিল ইতিপূর্বে তারা আন্দোলনে আসেনি। লীগ চুপ করে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও চলে যায়।” [xv]

গোটা ইভেন্ট-টাকেই “কমিউনাল” বলে দেগে দিলেন লাহিড়ী। এটাও মনোভাবের আরও একটা দিক।

৪৬-এর ফেব্রুয়ারির কলকাতায় কমিউনিস্টদের মনোভাব আরও ভালোভাবে বুঝতে পারা যাবে, তাঁদের উপর চলা ধারাবাহিক আক্রমণ এবং তাতে কোণঠাসা হয়ে প্রত্যাঘাতের চক্করে তাঁদের জড়িয়ে যাওয়া দেখে। কলকাতার ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পরই আসবে নৌবিদ্রোহ। আবারও কেঁপে উঠবে বোম্বে বন্দরকে কেন্দ্র করে গোটা উপমহাদেশ। এবং শ্রান্ত কলকাতাও একেবারে চুপ করে থাকবে না। ব্রিটিশ এবং কংগ্রেসীরা এইসব “বিশৃংখলার” দায় চাপাবে কমিউনিস্টদের ঘাড়ে। এবং কমিউনিস্টরাও মেতে উঠবেন নিজেরা কোনও ভাবেই উচ্ছৃঙ্খল নন প্রমাণের চেষ্টায়। সেসবের পাশাপাশি কমিউনিস্টদের তৎকালীন “আসল” যুদ্ধের খবর দিই।

(১) ২৫ জানুয়ারী ১৯৪৬ স্বাধীনতার পাতায় প্রকাশিত—“বোম্বাই ২৩ জানুয়ারী মঙ্গলবার রাত্রে একদল লোক খেওয়াদী রোডে কমিউনিস্ট পার্টির সদর কার্যালয়ের উপর হানা দিয়া ‘পিপলস্ এজে’র ছাপাখানার গুরুতর ক্ষতিসাধান করিয়াছে। কমিউনিস্ট পার্টির ৪৩ জন সদস্য আহত হইয়াছেন, তন্মধ্যে কয়েকজনের আঘাত গুরুতর। কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা শ্রীযুক্ত ভুলাভাই দেশাই-এর নিকট সাহায্যের জন্য আবেদন জানান। তাঁহার মতে সব মিলাইয়া ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক লক্ষ টাকা।”

(২) ২৭ জানুয়ারী স্বাধীনতার পাতায় প্রকাশিত—“বোম্বাইয়ের পর কলিকাতা। ২৬শে জানুয়ারি দক্ষিণ কলিকাতা কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের উপর হামলা করা হয়। প্রায় দশজন কর্মী আহত হন এবং তাঁদের অন্যতম ‘স্বাধীনতা’র সহকারী সম্পাদক কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী। পুলিশ চারজন পার্টি-সভ্যকে গ্রেপ্তার করেছে।”

(৩) ৭ ফেব্রুয়ারী স্বাধীনতার পাতায় প্রকাশিত—“মুঙ্গেরের কংগ্রেস নেতা অর্থাৎ জেলা কংগ্রেসের সেক্রেটারির নেতৃত্বে কয়েক হাজার লোক কমিউনিস্ট পার্টির সভা ভেঙে দেয় ও পার্টি নেতা কমরেড কার্যানন্দ শর্মাকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলে।”

(৪) ১৮ ফেব্রুয়ারী স্বাধীনতার পাতায় প্রকাশিত—“ভাটপাড়ায় কমরেড শীতাংশু ভট্টাচার্যকে ভীষণভাবে মারার পর সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁকে রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হয়। একজন পার্টি দরদী তাঁকে সেই অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেন।” [xvi]

‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরোধিতা এবং নেতাজী ও আজাদ হিন্দ-এর বিরোধিতা করার ফলে মধ্যবিত্ত জনমানসের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল কমিউনিস্ট-দের উপর। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সমগ্র ৪৫ থেকে ফেব্রুয়ারি ৪৬ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কমিউনিস্টদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে কংগ্রেস। যদিও যে কংগ্রেস নেতারা আক্রমণ শানাচ্ছিলেন, তাঁরা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় নিজেরা জেলেই ছিলেন। সুতরাং জনতার বিদ্রোহে পাশে থাকতে পারেননি। অপরদিকে তাঁরা আজাদ হিন্দ এবং সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধতায় কমিউনিস্টদের চেয়ে কোনও অংশে কম যাননি। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবার পর জনতার উন্মাদনা দেখে, তাঁরা নিজেদের ‘দেশপ্রেমিক’ প্রমাণ করতে তৎপর হন। সমস্ত ‘ভুল’-এর দায় ফেলে দেওয়া হয় কমিউনিস্ট-দের ঘাড়ে।

প্রতিক্রিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক যোশী বলছেন, “আজ সারা দেশ জানে যে, কংগ্রেস কর্মীরাই কমিউনিস্টদের আঘাত করিতেছে, আমাদের বিরুদ্ধে গুণ্ডা লেলাইয়া দিতেছে—কমিউনিস্টরা কংগ্রেস কর্মীদের আঘাত করে নাই। এখন আর কোনো আঘাত মুখ বুজিয়া সহিয়া যাইবার প্রয়োজন নাই।

…কমিউনিস্ট বিরোধীরা ঘোর কাপুরুষের দল। তারা শুধু ভাড়া করিয়া গুন্ডাই আনিতে পারে। আমরা কমিউনিস্টরা নিষ্ঠাবান বিপ্লবী। বীর শ্রমিক ও কৃষক আমাদের পিছনে আছে। এখন হইতে কোনো একজন কমিউনিস্টও যেন আঘাত সহ্য না করেন। যেখানেই আক্রান্ত হউন না কেন আত্মরক্ষা করিতে হইবে। আমরা আক্রমণ করিতে যাইব না। কিন্তু অস্ত্রই হাতের কাছে পাইব তাহা দিয়াই আমরা আত্মরক্ষা করিব। আমাদের মেয়ে কমরেডরা তাঁহাদের জুতা ও মুখের জোরে নিজেদের রক্ষা করিবেন।

যদি কোনো কমরেড মার খাইয়া শক্ত মার না দিয়া ফিরিয়া আসেন, তবে তাঁহাকে কাপুরুষ অপবাদ দিয়া পার্টি হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হইবে।

বীরের মতো দাঁড়াইয়া পার্টির প্রত্যেকটি অফিসক্র রক্ষা করিতে হইবে—যতক্ষণ পর্যন্ত একজন কমরেডও বাঁচিয়া থাকেন ততক্ষণ পর্যন্ত রক্ষা করিতে হবে। কখনো কোনো অফিস ছাড়া যাওয়া চলিবে না।

অতিরিক্ত কয়েকজন গার্ড অথবা ঐ জাতীয় ব্যবস্থার কিছুমাত্র দরকার নাই। সেটা বিহ্বলতার লক্ষণ। কোনো দামী দলিল বা দামী অন্য জিনিষ পার্টি অফিসে যেন রাখা না হয়। কমরেডরা স্বাভাবিক অবস্থার মতো পার্টি অফিসে কাজ চালাইয়া যাইবেন—শুধু আগের চেয়ে একটু সজাগ থাকিয়া অফিসে গোটা কয়েক লাঠি রাখিয়া দিভেন এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্য্যন্ত অফিসকে রক্ষা করিয়া যাইবেন।

সমস্ত পার্টি-সভ্য, বিশেষ করিয়া সারাক্ষণের কর্মীরা লাঠি, ডান্ডা বা সুবিধামতো অন্য কিছু লইয়া ঘোরাফেরা করিবেন।” [xvii] 

ফেব্রুয়ারি ৪৬-এর কলকাতায় কমিউনিস্টদের ভূমিকা এবং পরিস্থিতির কথায় আপাতত এখানেই ছেদ টানলাম। সুযোগ থাকলে পড়ে কখনও বিশদে চর্চা করা যাবে।

[i-xvii: উত্তাল চল্লিশ অসমাপ্ত বিপ্লব: অমলেন্দু সেনগুপ্ত: কোলকাতা, পার্ল পাবলিশার্স, ১৯৫৭]

[ডিলিজেন্টের ২০২২-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।]

Photo Courtesy: Comrade Facebook Page, Hindusthan Times, Hindusthan Standard

Updated: 20/02/2023

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার