বুর্জোয়া পার্লামেন্টে যোগ দেওয়া কি আমাদের উচিৎ?

ভি আই লেনিন

জার্মানীর “বামপন্থী” কমিউনিস্টরা নিতান্ত ঘৃণাভরে এবং চরম চপলতার সঙ্গে এ প্রশ্নের জবাবে জানিয়ে দিয়েছেন – না। তাঁদের যুক্তি? উপরের উদ্ধৃতিতে আমরা দেখতে পাইঃ

“পার্লামেন্টারী সংগ্রাম পদ্ধতিতে ফিরে যাবার সমস্ত চেষ্টাকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে সজোরে – এই পদ্ধতি ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে অচল হয়ে গেছে।”

উদ্ভট বিজ্ঞতা ফলিয়ে বলা হয়েছে এ কথা। নিঃসন্দেহে এটা ভুল। পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে “ফিরে যাওয়া”। জার্মানীতে বুঝি ইতোমধ্যেই একটা সোভিয়েত সাধারণতন্ত্র কায়েম হয়েছে? অন্তত দেখে তো তা বোঝবার জো নেই। কেমন করে তবে “ফিরে যাবার” কথা ওঠে? এটা নেহাতই একটা ফাঁকা বুলি নয় কি?

পার্লামেন্টারী রাজনীতি “ঐতিহাসিক দিক থেকে অচল” হয়ে গেছে। প্রচারের পক্ষে এটা ঠিক। কিন্তু সকলেই জানে যে, কার্যক্ষেত্রে একে ঘায়েল করার এখনো অনেক বাকি। অনেক কাল আগেই অন্তত ন্যায়সঙ্গতভাবেই পুঁজিবাদকে “ঐতিহাসিক দিক থেকে অচল” বলে ঘোষণা করা চলত। কিন্তু তাতে পুঁজিবাদদের মাটিতেই দীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিকভাবে লড়াই চালানো প্রয়োজন  মোটেই ফুরায় না। বিশ্ব-ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা চলে যে, পার্লামেন্টারী রাজনীতি “ঐতিহাসিকভাবে অচল” অর্থাৎ কিনা বুর্জোয়া পার্লামেন্টারী রাজনৈতিক যুগের অবসান ঘটেছে এবং শ্রমিকশ্রেণীর একাধিপত্যের যুগের সূচনা হয়েছে এ বিষয়ে কোনো মতভেদ থাকতে পারে না। কিন্তু বিশ্ব-ইতিহাসের প্রশ্ন আলোচনার সময় আমরা হিসাব করি যুগের পরিমাপে। বিশ্ব-ইতিহাসের মানদণ্ডে দশ-বিশ বছরের কম বেশিতে বিশেষ কিছু ইতর বিশেষ হয় না; বিশ্ব-ইতিহাসের দৃষ্টিতে এটা এতই তুচ্ছ যে এর মোটামুটি হিসাবও সম্ভব হয় না। কিন্তু ঠিক এই কারণেই দৈনন্দিনের বাস্তব রাজনীতির প্রশ্নকে বিশ্ব-ইতিহাসের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করতে যাওয়া একটা মারাত্মক রকমের তত্ত্বগত বিভ্রান্তি।

পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা “রাজনৈতিক দিক থেকে অচল” হয়ে গেছে কি? এটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। এ কথা সত্য হলে, “বামপন্থীদের” বক্তব্য অনেক জোরালো হতো। কিন্তু অত্যন্ত নিখুঁত বিশ্লেষণ শুরু করে এটা আগে প্রমাণ করা দরকার অথচ কেমন করে এই বিশ্লেষণ শুরু করতে হবে তা পর্যন্ত “বামপন্থীরা” জানে না। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আমস্টার্ডাম অস্থায়ী ব্যুরোর ১নং বুলেটিনে “পার্লামেন্টারী রাজনীতি সংক্রান্ত নিবন্ধ” বলে একটি লেখা বেরিয়েছিল; স্পষ্টতই এতে প্রতিফলিত হয়েছে ওলন্দাজ-বামপন্থী বা বামপন্থী-ওলন্দাজদের মনোভাব। এতে যে বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে তাও অত্যন্ত বাজে।

প্রথমত, আমরা জানি যে, ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসেই জার্মান “বামপন্থীরা” রোজা লুক্সেমবুর্গ এবং কার্ল লিবকনেখটের মতো প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতাদের মতের বিরুদ্ধতা করে পার্লামেন্টারী ব্যবস্থাকে “রাজনৈতিক দিক দিয়েও অচল মনে করতেন। আমি জানি যে, “বামপন্থীরা” ভুল করেছিলেন। পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা “রাজনৈতিক দিক থেকে অচল    এই ধারণা সম্পূর্ণভাবে এক ধাক্কাতেই বানচাল হয়ে যাচ্ছে মাত্র এই একটি তথ্যের জোরে। সে সময় “বামপন্থীরা” যে ভুল করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদের অবকাশ নেই। তাঁদের সে সময়কার ভুলটা এখন আর কেন ভুল বলে গণ্য হবে না – তা প্রমাণ করার দায়িত্ব “বামপন্থীদের”। কিন্তু তাঁরা প্রমাণের বিন্দুবিসর্গও হাজির করেননি এবং করতে পারবেনও না। কোন রাজনৈতিক পার্টি কতখানি একনিষ্ঠ এবং নিজ শ্রেণী আর মেহনতি জনসাধারণের কাছে নিজের দায়িত্ব সে কার্যত কতখানি পালন করে তা বিচার করার সবচেয়ে নিশ্চিত আর এক মূল্যবান উপায়ের অন্যতম হলো নিজের ভুল সম্বন্ধে পার্টির মনোভাব। অকপটে ভুলভ্রান্তি স্বীকার করা, তার কারণ খুঁজে বের করা, কোন অবস্থায় এই ভুল হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা এবং সংশোধন করার উপায় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করা – এই সবই হলো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক পার্টির লক্ষণ; এইভাবেই তার কর্তব্য পালন করা উচিত, এইভাবেই তার উচিত প্রথমে শ্রেণীকে, তারপর জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলা। এই কর্তব্যপালন করতে, নিজেদের সুস্পষ্ট ভুলভ্রান্তিগুলির প্রতি গভীর মনোযোগ দিতে জার্মানীর (এবং হল্যান্ডেরও) “বামপন্থীরা” ব্যর্থ হয়েছেন। এই থেকেই প্রমাণ হয় যে তাঁরা একটা শ্রেণীর পার্টি নন, একটা চক্রমাত্র, জনসাধারণের পার্টি নন, কিন্তু বুদ্ধিজীবী এবং বুদ্ধি-দিগগজগিরির জঘন্যতম লক্ষণগুলির অনুকরণকারী মুষ্ঠিমেয় শ্রমিকের একটা গোষ্ঠী। 

দ্বিতীয়ত, ফ্রাঙ্কফুর্টের “বামপন্থী” গোষ্ঠীর যে পুস্তিকা থেকে আমরা ইতিপূর্বেই বিশদভাবে উদ্ধৃত করেছি তাতেই আমরা দেখতে পাইঃ

“... লক্ষ লক্ষ যেসব শ্রমিক এখনও মধ্যপন্থীদের (ক্যাথলিক ‘মধ্যপন্থী’ পার্টি) অনুসরণ করে তারা হলো প্রতি-বিপ্লবী। গ্রাম্য শ্রমিকরা দলে দলে খোরাক জোগায় প্রতি-বিপ্লবী সেনাবাহিনীর।”  

যে কোনো দিক দিয়েই দেখা যাক না এই উক্তি নিতান্তই ব্যাপক এবং অতিরঞ্জিত। কিন্তু এখানে যে মূল কথাটা বলা হয়েছে তা অনস্বীকার্য এবং “বামপন্থীদের” এই স্বীকৃতিই তাদের ভুলের অত্যন্ত সুস্পষ্ট প্রমাণ। যখন ‘লক্ষ লক্ষ’ ‘দলে দলে’ শ্রমিকেরা শুধুই যে পার্লামেন্টারী রাজনীতিরই পক্ষপাতী তাই নয় – একেবারে, সোজাসুজি “প্রতি-বিপ্লবী’ তখন কেমন করে বলা চলে যে, “পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা রাজনৈতিক দিক থেকে অচল” হয়ে গেছে। স্পষ্টই বোঝা যায় যে জার্মানীতে পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা এখনও “রাজনৈতিক দিক দিয়ে অচল” হয়ে যায়নি। জার্মানীর “বাম-পন্থীরা” তাঁদের ইচ্ছার সঙ্গে, রাজনৈতিক মতবাদগত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বাস্তব অবস্থাকে যে গুলিয়ে ফেলেছেন তাও পরিস্কার। বিপ্লবীদের পক্ষে এটাই হলো সবচেয়ে বিপজ্জনক বিভ্রান্তি। রাশিয়াতে দীর্ঘকাল ধরে, বিশেষ করে নানা রকম ফেরের মধ্যে, জারতন্ত্রের ভয়ঙ্কর, বর্বর অত্যাচার নানা ধরণের বিপ্লবী সীইষ্টি করেছিল; এই সব বিপ্লবীদের ছিল আশ্চর্য নিষ্ঠা, উৎসাহ, বীরত্ব আর সংকল্পের দৃঢ়তা। আমরা সেখানে বিপ্লবীদের এই সব ভুলভ্রান্তি লক্ষ্য করেছি খুবই নিখুঁতভাবে, বিশেষ মনোযোগের সঙ্গে আমরা এগুলি পর্যালোচনা করেছি এবং এর সঙ্গে আমরা বিশেষভাবে পরিচিত। এই জন্যই অপরের মধ্যে এই ভুল আমরা সহজেই চিনে নিতে পারি। অবশ্যই জার্মানীর কমিউনিস্টদের কাছে “পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা রাজনৈতিক দিক দিয়ে  অচল”। কিন্তু  আর একটাই আসল কথা – আমাদের কাছে যা অচল তাকে শ্রেণির পক্ষে অচল, জনসাধারণের পক্ষে অচল ভাবা কিছুতেই চলতে পারে না। এখানেও আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি যে “বামপন্থীরা” জানে না কিভাবে শ্রেণীর পার্টি হিসাবে, জনসাধারণের পার্টি হিসাবে বিচার করতে হয়, কাজ করতে হয়। জনসাধারণের স্তরে, শ্রেণীর পশ্চাৎপদ অংশের স্তরে আমাদের নেমে এলে চলবে না – এ বিষয়ে কোনো মতভেদই থাকতে পারে না। তাদের অতি তিক্ত সত্য কথা শোনাতে হবে। তাদের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক, পার্লামেন্টারী কুসংস্কারকে – কুসংস্কারই বলতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে ধীরস্থিরভাবে আমাদের লক্ষ্য করতে হবে সমগ্র শ্রেণির (শুধু এর অগ্রগামী কমিউনিস্টদের নয়), সমগ্র মেহনতী জনগণের (কেবল তাদের অগ্রগামী অংশের নয়) শ্রেণি-চেতনা ও প্রস্তুতির প্রকৃত অবস্থাকে।

এমনকি ‘লক্ষ লক্ষ’ এবং ‘দলে দলে’ না হলেও কলকারখানার শ্রমিকদের একটা বড়ো রকমের সংখ্যালঘু অংশও যদি ক্যাথলিক পাদ্রীদের অনুগামী হয় এবং গ্রামীণ শ্রমিকদের অনুরূপ একটা অংশ জমিদার বা ধনী কৃষকদের (গ্রসবাওয়ান) অনুসরণ করে – তবে নিঃসন্দেহে বোঝা যায় যে, জার্মানীতে পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা এখনও রাজনৈতিক দিক দিয়ে অচল হয়ে যায়নি; বোঝা যায় যে, ঠিক নিজ শ্রেণীর পশ্চাৎপদ অংশকে শিক্ষিত করে তোলার জন্যই অনুন্নত, নিপিড়িত, অজ্ঞ গ্রামীণ জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার জন্যই বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির পক্ষে পার্লামেন্টারী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, পার্লামেন্টের মঞ্চ থেকেও সংগ্রাম চালানো অবশ্য কর্তব্য। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনারা বুর্জোয়া পার্লামেন্ট এবং অন্যান্য সমস্ত ধরণের প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানকে পর্যুদস্ত করতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের অতি অবশ্যই তাদের মধ্যে কাজ চালাতে হবে কারণ ঠিক সেখানেই এখনো পুরুতদের ভাঁওতাবাজীতে বিভ্রান্ত এবং গ্রাম্য জীবনের একঘেয়েমিতে ক্লান্ত শ্রমিকদের দেখা যাবে। নইলে আপনাদের নিছক বাক্যবাগীশ হয়ে দাঁড়াবার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

তৃতীয়ত “বামপন্থী”কমিউনিস্টরা আমাদের, বলশেভিকদের, প্রশংসা করে অনেক কিছু বলে থাকেন; কখনো কখনো এদের বলতে ইচ্ছা করে – আপনারা আমাদের প্রশংসাটা কমিয়ে, বলশেভিকদের কর্মকৌশল বেশি করে বোঝবার চেষ্টা করুন, সেগুলির সঙ্গে আরো ভালোভাবে নিজেরা পরিচিত হোন। ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর – নভেম্বর মাসে রাশিয়ার বুর্জোয়া পার্লামেন্ট, গণ-পরিষদের নির্বাচনে আমরা অংশ গ্রহণ করেছিলাম। আমাদের কৌশল ঠিক হয়েছিলো না ভুল হয়েছিলো? যদি না হয়ে থাকে তবে তা স্পষ্ট করে বলা দরকার, প্রমাণ করা দরকার - কারণ আন্তর্জাতিক কমিউনিজমের সঠিক কৌশল রচনার জন্য এটা অবশ্য প্রয়োজন। এগুলি যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে এ থেকে কয়েকটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো দরকার। অবশ্য রাশিয়ার অবস্থার সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের অবস্থার তুলনা চলে না। কিন্তু “পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা রাজনৈতিক দিক দিয়ে অচল” এ কথার তাৎপর্য সংক্রান্ত বিশেষ প্রশ্ন সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা সযত্নে বিবেচনা করা দরকার – কেননা সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাকে বিচার না করলে এই ধরণের ধারণা খুব সহজেই পরিণত হয়  ফাঁকা বুলিতে। কোনো পশ্চিমী কমিউনিস্টদের চেয়ে ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর –  নভেম্বর মাসে পার্লামেন্টারী ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে অচল বলে মনে করার অধিকার কি আমাদের, রুশ বলশেভিকদের বেশি ছিল না? অবশ্যই আমদের ছিল। কারণ বুর্জোয়া পার্লামেন্টের অস্তিত্ব বেশি দিনের, না কম দিনের সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা হলো – শ্রমজীবী জনগণের ব্যাপকতম অংশ সোভিয়েত সমাজব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে এবং বুর্জোয়া – গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টকে ভেঙে দিতে (বা ভেঙে দেওয়া সহ্য করতে) কতদুর (আদর্শের দিক দিয়ে, রাজনৈতিক দিক দিয়ে; কার্যকরিভাবে) প্রস্তুত?  কতকগুলি বিশেষ অবস্থার দরুন ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর – নভেম্বর মাসে রাশিয়ার শহুরে শ্রমিকশ্রেণী আর কৃষক ও সৈনিকরা যে সোভিয়েত ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে এবং সবচেয়ে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া – পার্লামেন্টকেও ভেঙে দিতে অসাধারণভাবে প্রস্তুত ছিল এটা সম্পূর্ণ অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু তবু বলশেভিকরা গণ – পরিষদের নির্বাচন বর্জন করেনি বরং শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখল করবার আগে এবং পরে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল। এইসব নির্বাচনে যে অত্যন্ত মূল্যবান (এবং শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে বিশেষ দরকারি) রাজনৈতিক ফললাভ হয়েছিল, আশা করি উল্লিখিত প্রবন্ধটিতে তা আমি প্রমাণ করেছি – এতে রশিয়ার গণ – পরিষদ নির্বাচনের সংখ্যাতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে বিশদভাবে।    

এ থেকে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা একেবারেই অকাট্য; এ থেকে প্রমাণ হয়েছে যে, সোভিয়েত রিপাবলিকের জয়লাভের কয়েক সপ্তাহ আগে, এমন কি, পরেও বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টে অংশ গ্রহণ করায় বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষতি তো হয়ই না বরং এতে পশ্চাৎপদ জনসাধারণের কাছে প্রমাণ করতে সত্য সত্যই সুবিধা হয় – কেন এ ধরণের পার্লামেন্টকে ভেঙে দেওয়া উচিত; এতে এই ভেঙে দেওয়ার  কাজ ত্বরান্বিত হয় এবং বুর্জোয়া পারলামেন্টারী ব্যবস্থাকে “রাজনৈতিক দিক দিয়ে অচল” করে দেওয়ার সাহায্য হয়। এই অভিজ্ঞতাকে হিসাবের মধ্যে গণ্য করতে অস্বীকার করে সঙ্গে সঙ্গে আবার কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার দাবি করার অর্থ মারাত্মক রকমের ভুল করা এবং আন্তর্জাতিকতার প্রতি মৌখিক সমর্থন জানিয়ে কার্যত আন্তর্জাতিকতা থেকে পিছু হটে আসা। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে তার কর্ম কৌশল ঠিক করতে হয় আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে (সংকীর্ণ, একপেশে জাতীয় ভিত্তিতে রচিত কৌশল নয়, আন্তর্জাতিক কৌশল)।

“ওলন্দাজ বামপন্থীরা” পার্লামেন্টে যোগদান না করার পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন তা এবার বিচার করা যাক। উল্লিখিত “ওলন্দাজ” নিবন্ধের মধ্যে নিম্নোক্তটি (৪নং নিবন্ধ) হলো সবচেয়ে মূল্যবানঃ

“পুঁজিবাদী – উৎপাদন ব্যবস্থা যখন ভেঙ্গে পড়েছে এবং সমাজে দেখা দিয়েছে বিপ্লবী অবস্থা তখন জনসাধারণের নিজেদের কার্যকলাপের তুলনায় পার্লামেন্টারী কার্যকলাপের তাৎপর্য ক্রমশ নষ্ট হয়ে যায়। এইরকম অবস্থায় যখন পার্লামেন্ট পরিণত হয় প্রতি – বিপ্লবী কেন্দ্রে বা মুখপত্রে আর শ্রমিকশ্রেণী নিজের রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে গড়ে তোলে সোভিয়েত তখন সমস্ত রকম পার্লামেন্টারী কার্যকলাপে যোগদান থেকে একেবারেই বিরত থাকা দরকার হতে পারে।”  

প্রথম বাক্যটি স্পষ্টতই ভুল, কারণ শুধু বিপ্লবের সময় বা বিপ্লবী পরিস্থিতিতেই নয়, সব সময়েই জনসাধারণের কার্যকলাপ – যেমন ধরুন একটা বড়ো রকমের ধর্মঘট – পার্লামেন্টারি কার্যকলাপের চেয়ে মূল্যবান। এই স্পষ্টত অযৌক্তিক এবং রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে ভ্রান্ত উক্তি থেকেই প্রমাণ হয় যে লেখকরা বৈধ আর বেআইনি সংগ্রামকে যুক্ত করার গুরুত্ব সম্বন্ধে সাধারণভাবে ইউরোপের অভিজ্ঞতা (১৮৪৮ ও ১৮৭০ সালের বিপ্লবের আগেকার ফরাসি অভিজ্ঞতা; ১৮৭৮ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত জার্মানির অভিজ্ঞতা ইত্যাদি) এবং রাশিয়ার অভিজ্ঞতা (উপরে দেখুন) উভয়কেই সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করেছেন।

সাধারণভাবে ও বিশেষ ক্ষেত্রে এ প্রশ্নের গুরুত্ব অসাধারণ, কারন সমস্ত সভ্য ও অগ্রগামী দেশে সময় আসছে – যখন এইভাবে বৈধ আর বে-আইনি কাজের যোগসাধন বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির পক্ষে অবশ্য পালনীয় হয়ে পড়বে। এখনই হয়তো আংশিকভাবে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে।  এর প্রয়োজন হয়েছে শ্রমিকশ্রেণী আর বুর্জোয়াদের মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম দানা বেঁধে ওঠার বা এসে পড়ায়, সাধারণভাবে সমস্ত সাধারণতন্ত্রী আর বুর্জোয়া গভর্নমেন্ট কর্তৃক ভীষণভাবে সমস্ত রকম আইন তুচ্ছ করে বা ঐ রকম নানাভাবে কমিউনিস্টদের উপর নির্যাতন আরম্ভ করার (কেবলমাত্র আমেরিকার দৃষ্টান্তই দেখুন)। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিই ওলন্দাজেরা কিংবা সাধারণভাবে বামপন্থীরা একেবারেই ধরতে পারেননি।

দ্বিতীয় বাক্যটি সম্বন্ধে প্রথমেই বলা যায় যে, এটি ঐতিহাসিক দিক দিয়ে অসত্য। আমরা, বলশেভিকরা, অত্যন্ত প্রতি-বিপ্লবী পার্লামেন্টেও অংশগ্রহণ করেছিলাম। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, এই অংশগ্রহণে শুধু যে সুফল ফলেছিল তাই নয়, বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির পক্ষে রাশিয়াতে প্রথম বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের (১৯০৫) ঠিক পরেই, দ্বিতীয় বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের (ফেব্রুয়ারি ১৯১৭,) এবং পরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের (নভেম্বর ১৯১৭) পথ প্রস্তুত করার জন্য এর একান্ত প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত এই বাক্যটি মারাত্মক রকম অযৌক্তিক। পার্লামেন্ট যদি প্রতি-বিপ্লবের মুখপাত্র এবং “কেন্দ্রে” (প্রসঙ্গত বলা যায়, এটি কখনো বাস্তবে ‘কেন্দ্র’ হয়নি, হতে পারেও না) পরিণত হয় এবং শ্রমিকশ্রেণী তার ক্ষমতার হাতিয়ার হিসাবে সৃষ্টি করে সোভিয়েত – তাতে এই সিদ্ধান্তেই আসা যায় যে, পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে সোভিয়েতের লড়াইয়ের জন্য, সোভিয়েত কর্তৃক পার্লামেন্টকে ভেঙে দেবার জন্য মতবাদের দিক দিয়ে, রাজনৈতিক দিক দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীকে অবশ্যই তৈরি হতে হবে। কিন্তু এ থেকে এ কথা বোঝায় না যে, প্রতি-বিপ্লবী পার্লামেন্টের ভিতরেই বিরোধী সোভিয়েত পক্ষ থাকলে এই ভেঙে দেওয়ার কাজ অধিকতর কষ্টসাধ্য হয় কিংবা সহজসাধ্য হয় না।      

ডেনিকিন আর কোলচাকের বিরুদ্ধে আমাদের সাফল্যজনক সংগ্রামের সময় তাদের শিবিরে সোভিয়েত ও শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষভুক্ত বিরোধী দলের অস্তিত্বকে আমাদের জয়লাভের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলে আমরা কোনো দিনই মনে করিনি। আমরা ভালোভাবেই জানি যে, আসন্ন ধ্বংসোন্মুখ প্রতি-বিপ্লবী গণ-পরিষদের মধ্যে একটা সুদৃঢ় বলশেভিক এবং দোদুল্যমান বামপন্থী সোসালিস্ট রেভলিউশনারি সোভিয়েত পক্ষীয় বিরোধী দলের অস্তিত্বের ফলে ১৯১৮ সালের ৫ই জানুয়ারি তারিখে গণপরিষদকে ভেঙে দেওয়ায় আমাদের অসুবিধা হয়নি বরং সুবিধাই হয়েছিল। এই নিবন্ধ প্রণেতারা জগাখিচুড়ী বাধিয়ে বসেছেন; ভুলে গেছেন যে সমস্ত নাহলেও, অধিকাংশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকেই প্রমাণ হয় যে বিপ্লবের সময় প্রতিক্রিয়াশীল পার্লামেন্টের বাইরে গণ-আন্দোলনের সঙ্গে পার্লামেন্টের ভিতরকার বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিরোধী দলের (কিংবা প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করলে তো কথাই নেই) কাজের সংযোগ সাধন কত বেশি দরকার। এইসব ওলন্দাজরা (এবং সাধারণভাবে সমস্ত “বামপন্থীরা”ই) পুঁথিগত বিপ্লবীর মতোই যুক্তি দিয়েছেন যাঁরা কখনো সত্যিকার বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেননি, বিপ্লবের ইতিহাস সম্বন্ধে কখনো গভীরভাবে চিন্তা করেননি কিংবা নেহাৎ ছেলেমানুষের মতো যাঁরা কোনো প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানকে মনে মনে “অগ্রাহ্য” করাকেই ভুল করে বিভিন্ন বাস্তব অবস্থার সম্মিলিত আঘাতে তাকে চুর্ণ বিচুর্ণ করার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। কোন নতুন রাজনৈতিক (শুধু রাজনৈতিকই নয়) ধারণাকে খেলো করে দেবার ও তার ক্ষতি করবার সব থেকে নিশ্চিত পথ হলো, সমর্থন করার নামে তাকে একটা উদ্ভট ব্যাপারে পরিণত করা। (জেষ্ঠ ডিজেনের ভাষায় [১]) যে কোনও সত্যকে নিয়ে যদি “বাড়াবাড়ি করা হয়”, অতিরঞ্জিত করা হয়, বাস্তব প্রয়োগের সীমা অতিক্রম করে যদি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় – তবে সে সত্য হয়ে দাঁড়াতে পারে উদ্ভট এবং উপরের অবস্থায় উদ্ভট হয়ে দাঁড়তে বাধ্যও। জার্মান আর ওলন্দাজ “বামপন্থীরা” বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টের চেয়ে সোভিয়েত শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব – এই নয়া সত্যের ঠিক এইভাবে স্তুতিচ্ছলে নিন্ধাই করেছেন আসলে। অবশ্য আগেকার মতো মত যদি কারো থাকে বা সাধ্রণভাবে কেউ যদি বলেন যে, কোনো অবস্থাতেই বুর্জোয়া পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করা চলতে পারে না – তবে তিনি নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। কোন অবস্থায় বয়কট কার্যকরী হতে পারে তা বর্ণনা করার চেষ্টা আমি এখানে করতে পারি না, কারণ আমার পুস্তিকার বক্তব্য সীমাবদ্ধ – আজকের দিনের কতকগুলি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কর্মকৌশলগত প্রশ্নের ক্ষেত্রে রাশিয়ার অভিজ্ঞতাকে যাচাই করা। রাশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাই যে বলশেভিকরা একবার (১৯০৫ সালে) সঠিক ও সফলভাবে, আর একবার ভুলভাবে (১৯০৬ সালে) প্রয়োগ করেছিল বয়কটকে। প্রথম দৃষ্টান্তটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, যখন পার্লামেন্টের আওতার বাইরে, বিপ্লবী গণআন্দোলন (বিশেষ করে ধর্মঘট) অভূতপুর্ব দ্রুতগতীতে বেড়ে চলছিল, যখন শ্রমিকশ্রেণী বা কৃষকদের একটি অংশও কোনভাবেই প্রতিক্রিয়াশীল গভর্নমেন্টকে সমর্থন করছিল না, যখন ধর্মঘটের লড়াই আর কৃষকদের আন্দোলনের মারফত বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণী পশ্চাৎপদ জনগণের ব্যাপক অংশের উপর প্রভাব বিস্তার করছিল, সেই  অবস্থায় প্রতিক্রিয়াশীল গভর্নমেন্ট কর্তৃক একটা প্রতিক্রিয়াশীল পার্লামেন্টের আহ্বান বন্ধ করতে পেরেছিলাম আমরা। এ কথা খুবই স্পষ্ট যে এই অভিজ্ঞতা আজকের ইউরোপের অবস্থা সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। তেমনই আবার এও স্পষ্ট – উপরের যুক্তি থেকে তার সমর্থনও মেলে যে – ওলন্দাজ ও অন্যান্য “বামপন্থীরা” কিছুটা হাতে রেখেও পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার  করার পক্ষে ওকালতি করছেন তা মূলত ভুল এবং বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর।

পশ্চিম ইউরোপ আর আমেরিকায় শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রগামী অংশের কাছে পার্লামেন্ট বিশেষভাবে ঘৃণ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। এই কারণও সহজবোধ্য – যেহেতু যুদ্ধের সময় এবং পরে বিপুল সংখ্যক সোসালিস্ট আর সোসাল ডেমোক্রাটিক পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদের আচরণের  চেয়ে জঘন্যতর,  কুৎসিততর  বিশ্বাসঘাতকতা কল্পনা করা শক্ত। কিন্তু কিভাবে এই সর্বজন-স্বীকৃত দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে তা স্থির করার সময় এই মনোভাবের কাছে আত্মসমর্পন করা শুধু অযৌক্তিকই নয় – বাস্তবিক পক্ষে অপরাধ। পশ্চিম ইউরোপের অনেকগুলি দেশে বিপ্লবী মনোভাব, বলা চলে, “দুর্লভ” “নতুন” বস্তু; এজন্যে দীর্ঘকাল ধরে বৃথাই অপেক্ষা করে করে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবার উপক্রম হয়েছে। এবং সম্ভবত এই কারণেই এ মনোভাবের কাছে এত সহজে আত্মসমপর্ণ করা হচ্ছে । অবশ্য জনসাধারণের মধ্যে বিপ্লবী মনোভাব না থাকলে এবং এই বিপ্লবী মনোভাব বৃদ্ধি করার উপযোগী অবস্থা না থাকলে বিপ্লবী কৌশলকে কখনোই কাজে পরিণত করা যাবে না। কিন্তু রাশিয়াতে আমরা দীর্ঘ, বেদনাদায়ক রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এই সত্যই উপলব্ধি করেছি যে, কেবলমাত্র বিপ্লবী মনোভাবের উপর ভিত্তি করে বিপ্লবী কৌশল গড়া যায় না। কর্মকৌশলের ভিত্তি করতে হবে নির্দৃষ্ট রাষ্ট্রের (পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলির এবং দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রের) সমস্ত শ্রেণীশক্তির ধীরস্থির এবং নিঁখুত বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনার উপর আর সেই সঙ্গে বিপ্লবী আন্দোলনের অভিজ্ঞতারও উপর। কেবলমাত্র পার্লামেন্টারি সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করে, কেবলমাত্র পার্লামেন্টে যোগ দিতে অস্বীকার করে নিজের “বিপ্লবীপনা” প্রমাণ করা খুবই সোজা; কিন্তু সোজা বলেই একটা কঠিন। নিতান্ত কঠিন সমস্যা সামাধানের পথ এটা নয়। রাশিয়ার চেয়েও ইউরোপের কোনো পার্লামেন্টের সত্যিকারের বিপ্লবী সংস্থা গঠন করা অনেক বেশি কঠিন।  ঠিক। কিন্তু এটা এই সাধারণ সত্যের একটা বিশেষ অভিব্যক্তি মাত্র যে, ১৯১৭ সালের বিশেষ, ঐতিহাসিক দিক থেকে সকলের থেকে সতন্ত্র এক অবস্থায় রাশিয়ার পক্ষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু করা সহজ হয়েছিল, কিন্তু ইউরোপের দেশগুলির চেয়ে রাশিয়ার পক্ষে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সম্পূর্ণ করা অধিকতর কষ্টসাধ্য হবে। ১৯১৮ সালের গোড়াতেই আমি এটা দেখিয়েছিলাম এবং আমাদের গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় এই মতের নির্ভুলতা সম্পূর্ণ সমর্থিত হয়েছে। কতকগুলি বিশেষ অবস্থা যেমন – (১) সোভিয়েতের বিপ্লবের সঙ্গে এই  বিপ্লবেরই ফলে যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবসান হয়েছে এবং যাতে শ্রমিক কৃষকরা অসম্ভব রকম অবসন্ন হয়ে পড়েছে তাকে সংযুক্ত করার সম্ভাবনা; (২) সোভিয়েতের শত্রুর বিরুদ্ধে একজোট হতে অক্ষম সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের দুটি দুনিয়া–জোড়া গোষ্ঠীর মধ্যে মারাত্মক বিরোধের কিছুদিনের মতো সুযোগ নেবার সম্ভাবনা; (৩) বিশেষ করে দেশের বিপুল আয়তন এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে অপেক্ষাকৃত দীর্ধস্থায়ী গৃহযুদ্ধ সহ্য করার সম্ভাবনা; (৪) কৃষকদের মধ্যে এমন বিপুল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক  আন্দোলনের অস্তিত্ব – যার ফলে শ্রমিকশ্রেণির পার্টির পক্ষে কৃষক দলের (সোসালিস্ট রেভলিউশনারি দলের – যার অধিকাংশ সদস্য ছিল নিঃসন্দেহে বলশেভিক বিরোধী) বিপ্লবী দাবিগুলি গ্রহণ করা এবং শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকারের ফলে সেগুলি পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল – এসব বিশেষ অবস্থা বর্তমানে পশ্চিম ইউরোপে নেই এবং খুব সহজে এসব বা অনুরূপ অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। অন্যান্য অনেকগুলি কারণের কথা ছেড়ে দিলেও – এই কারণেই আমাদের চেয়ে পশ্চিম ইউরোপের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু করা অধিকতর কষ্টসাধ্য হবে। প্রতিক্রিয়াশীল পার্লামেন্টকে বিপ্লবী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার কঠিন দায়িত্ব “এড়িয়ে” গিয়ে এই কষ্টসাধ্য ব্যাপার “পাশ কাটাবার” চেষ্টা করা নিতান্তই ছেলেমানুষি। আপনারা চান এক নতুন সমাজ গড়তে, অথচ প্রতিক্রিয়াশীল পার্লামেন্টের ভিতর একনিষ্ঠ, সুদৃঢ় নির্ভিক কমিউন্সটদের নিয়ে একটা ভাল পার্লামেন্টারি সংস্থা গড়ার কষ্টের ভয়েই আপনারা ভীত। এটা ছেলেমানুষি নয়? তলা থেকে জনসাধারণের সমর্থন ছাড়াই জার্মানিতে চার্লস লিবকনেখট আর সুইডেনে জেড, হগলুন্ড যদি প্রতিক্রিয়াশীল পার্লামেন্টকে বিপ্লবী উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরে থাকেন তবে আপনারা কেমন করে বলেন যে, যুদ্ধোত্তরকালে জনসাধারণের যখন মোহমুক্তি ঘটেছে, তাদের মধ্যে যখন অসন্তোষ তীব্র হয়ে উঠেছে- সেই অবস্থায় একটা ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী, জনগণের পার্টি সব চেয়ে জঘন্য পার্লামেন্টের মধ্যেও একটা কমিউনিস্ট সংস্থা গড়েপিটে তুলতে  পারবে না। রাশিয়ার চেয়ে পশ্চিম ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণীর এবং তার চেয়েও বেশি খুদে চাষীদের ব্যাপক পশ্চাৎপদ অংশের মধ্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক এবং পার্লামেন্টারি কুসংস্কার অনেক বেশি গভীর; ঠিক এই জন্যই বুর্জোয়া পার্লামেন্টের মতো প্রতিষ্ঠানের ভিতর থেকেই কেবল কমিউনিস্টরা বাধাবিঘ্নে ভীত না হয়ে এই সব কুসংস্কারের মুখোশ খুলে দেবার, এগুলি দূর করবার, এগুলির বিরুদ্ধে জয়লাভ করবার – দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রাম চালাতে পারে (এবং চালাতে তাদের হবেই)। 

জার্মান “বামপন্থীরা” তাদের খারাপ “নেতৃত্বের” অভিযোগ করেন, হতাশায় গা ভাসিয়ে দেন, এমন কি “নেতাদের” “বাতিল করে দেওয়ার” মতো অদ্ভুত কাজ করতেও ছাড়েন না। কিন্তু অবস্থা যখন এমন যে প্রায়ই “নেতাদের” লুকিয়ে রাখার দরকার হয় তখন ভালো, বিশ্বস্ত, অভিজ্ঞ, সাচ্চা নেতা গড়ে তোলা খুবই শক্ত ব্যাপার, আর বৈধ ও অবৈধ কাজের যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য উপায়ের সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্টারি ক্ষেত্রেও “নেতাদের” যাচাই করা ছাড়া এসব বাধাবিঘ্ন সাফল্যের সঙ্গে কাটিয়ে ওঠা যাবে না। পার্লামেন্টারি ব্যাপার বা পার্লামেন্টারি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নয় – যেসব নেতারা  পার্লামেন্টারি নির্বাচন এবং পার্লামেন্টারি মঞ্চকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট কায়দায় ব্যবহার করতে অক্ষম, বিশেষত যাঁরা একাজ করতে অনিচ্ছুক তাঁদের বিরুদ্ধে আরও বেশি করে তীব্র, তীক্ষ্ণ, আপসহীন সমালোচনা করা দরকার। একমাত্র এই ধরণের সমালোচনার – অবশ্য এই সঙ্গে অপদার্থ নেতাদের অপসারণ এবং তার জায়গায় যোগ্য নেতাদের প্রতিষ্ঠা – মারফতই দরকারি আর ফলপ্রদ বিপ্লবী কাজ হতে পারে, যাতে একই সঙ্গে “নেতারা” হতে শিখবেন শ্রমিকশ্রেণী আর শ্রমজীবী জনগণের যোগ্য এবং জনগণ শিখবে যথাযথভাবে রাজনৈতিক অবস্থা বুঝতে আর সেই অবস্থা থেকে প্রায়শই উদ্ভুত অত্যন্ত জটিল ও দুরূহ কর্তব্যসমূহ অনুধাবন করতে। * 

………..

*ইতালির “বামপন্থী” কমিউনিজমের সঙ্গে পরিচিত হবার আমি খুব কমই সুযোগ পেয়েছি। কমরেড বোর্দিগা, তার “বয়কট-পন্থী কমিউনিস্ট” উপদলের (কমিউনিস্টা এ্যাস্টেনসিগনস্টা) যেসব কমরেডরা পার্লামেন্টে যোগদানের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন তাঁরা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। কিন্তু তাঁর কাগজ, “ইল সোভিয়েৎ”-এর দুটি সংখ্যা (১৯২০ সালের ১৬ই জানুয়ারি ও ১লা ফেব্রুয়ারি ৩৬৪ নং), কমরেড সেরাতির চমৎকার সাময়িক পত্র “কমিউনিজমো”র বারটি সংখ্যা (১ – ৪ নং, ১লা অক্টোবর – ৩০শে নভেম্বর, ১৯১৯) এবং ইতালির বুর্জোয়া কাগজের বিভিন্ন যে ক’টি সংখ্যা আমার হাতে এসেছে তা থেকে, আমার মনে হয়, একটি বিষয়ে কমরেড বোর্দিগাই ঠিক। কমরেড বোর্দিগা আর তার উপদল তুরাতি আর তার সমর্থকদের আক্রমণ করে ঠিকই করেছেন – যাঁরা এমন এক পার্টিতে রয়েছেন যে পার্টি সোভিয়েত শক্তি আর শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্রকে স্বীকার করে, অথচ এঁরা পার্লামেন্টের সভ্য হিসাবে চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের পুর্বেকার সুবিধাবাদী, জঘন্য কার্যকলাপ। অবশ্যই এই অবস্থা সহ্য করে কমরেড সেরাতি এবং ইতালির সমগ্র সোসালিস্ট পার্টি এমন ভুল করেছেন যার ফলে ঠিক হাঙ্গেরির মতোই বিপদের ও ক্ষতির ভয় রয়েছে। হাঙ্গেরিতে হাঙ্গেরিয়ান তুরাতিরাই পার্টি আর সোভিয়েত গভর্নমেন্ট উভয়কেই ধ্বংশ করেছিল ভিতর থেকে। পার্লামেন্টারি সুবিধাবাদ সম্বন্ধে এই ধরণের ভ্রান্ত, সামঞ্জস্যহীন বা মেরুদণ্ডহীন নীতির ফলেই একদিকে মাথাচাড়া দেয় “বামপন্থী”কমিউনিজম আর অন্যদিকে এর কিছুটা সাফাইও থাকে। পার্লামেন্টে সদস্য তিরাতির বিরুদ্ধে “সামঞ্জস্যহীনতার” দোষারোপ যখন কমরেড সেরাতি করেন (কমিউনিজমো – ৩ নং) তখন তিনি স্পষ্টতই ভ্রান্ত – কারণ আসলে সামঞ্জস্যহীন হলে ইতালির সোসালিস্ট পার্টি নিজেই – যেহেতু তুরাতি কোম্পানির মতো সুবিধাবাদী পার্লামেন্ট-সেবীদের তা সহ্য করে  চলেছে ।

টীকা (সংক্ষিপ্ত)

১। ডেনিকিন একজন জার্মান চর্মকার, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও দার্শনিক ছিলেন যিনি নিজের যুক্তিতেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে পৌঁছেছিলেন।

[প্রবন্ধ সূত্রঃ 'বামপন্থী কমিউনিজম শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা'। বঙ্গানুবাদ সূত্রঃ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ১৯৯০] 

Image Courtesy: Wikipedia                                                                                                                                                                                                                                                                                          

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার