প্রসঙ্গ যুবদিবস ২০২৩

বিমলকান্তি দাশগুপ্ত 

১২/০১/২০২৩

 

১২ই জানুয়ারী স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম দিন। এই দিনটি ভারতে সরকারিভাবে পালিত হয় যুব দিবস হিসেবে। সে দিক থেকে দেখলে ভারতে আজ যুবকেরা নানা ভাবে দিনটি উদযাপন করবেন নিজেদের মতো করে।

আশি ঊর্ধ্ব আমি; আজ অবশ্যই যুবক নই। এমন দাবিও করি না। তবু আজকের দিনে স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে এলো আজকেরই সকালে। একদিন তো যুবক ছিলাম। তখন যুব দিবস ছিল না। আমি বা আমরা কেমন করে দেখেছি বিবেকানন্দকে। সেই স্মৃতি সম্বল করে আজ আমার তাঁকে স্মরণ। 

আমি যখন জন্মেছি তার তেত্রিশ বছর আগে বিবেকানন্দের মৃত্যু ঘটে গেছে। সূর্য অস্ত গেলেও তার তাপ রয়ে যায় অনেকক্ষণ। আমার বালককালে বিবেকানন্দের উপস্থিতির সেই তাপের অনুভূতি পেয়েছি আমি আমার পরিবারের জ্যেষ্ঠদের থেকে। অনেকটা যেন তাপের প্রতিসরণের নিয়ম মেনেই। 

ইশকুলে যখন পড়ি তখন আমি রীতিমতো বিবেকানন্দের ভক্ত। চিকাগো ধর্মসভায় বক্তা বিবেকানন্দের যে ছবি খুব প্রচারিত সেই ছবির আদলে দাঁড়াতে ভালো লাগত প্যাংলা শরীরে। এ নেহাতই প্রিয়জনকে অনুকরণের প্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সবাই জানেন শেষ অবধি তো এ সব থাকেনা। সে সময় লোকেরা হেসেছেন। আর এ সময় নিজেরই হাসি পায় নিজেকে নিয়ে। কী ছেলেমানুষীই না ছিল সেটা। 

বেলুড় মঠে প্রথম গিয়েছি পরিবারের সঙ্গে। কোনোও এক উৎসব উপলক্ষে। হাওড়া থেকে বাস। ভিড় এতটাই ছিল যে কালীমামা আমাকে চ্যাংদোলা করে জানালা দিয়ে বাসের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এর পর বেলুড় দক্ষিনেশ্বর আমার নিয়মিত গন্তব্য। এখানে বিবেকানন্দের সান্নিধ্য অনুভব করতাম। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের ঘরে বসলে আমার অনুভব হত যেন নরেন্দ্রনাথের পাশেই বসে আছি। স্বামী বিরজানন্দ, তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের কাছে দীক্ষা নেওয়া সন্যাসী। স্বামী রঙ্গনাথানন্দ ছিলেন সারদাদেবীর কাছে দীক্ষা নেওয়া সন্ন্যাসী। এঁদের প্রত্যক্ষ করেছি আমি খুব কাছ থেকে। আর নিজের মনে অনুভব করেছি বিবেকানন্দ আর সারদা মণির সান্নিধ্য। আর বিস্ময় বোধ করেছি এই ভেবে যে এঁরা ওই সব মহানদের স্পর্শ করেছেন। ওঁদের স্পর্শ পেয়েছেন। ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর নয় কি!  

এখন আমি নিমতা মৌজার উত্তর দমদমের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের প্রান্ত সীমায় উদ্বাস্তু পরিচয়ের বাসিন্দা। আমার বাসস্থানের অন্তত দুই কিলো মিটার উত্তরে শহরের সঙ্গে যোগাযোগের কাঁচা সড়ক। পুবে কাছের গ্রাম মুসলমানের। সেখানে মসজিদ আছে। আছে কবরস্থান।  দক্ষিণ- পূর্ব দিকে হিন্দুদের প্রাচীন গ্রাম। তার পাশে খ্রিস্টান বসতিও আছে। তাদের উপাসনার জন্য গির্জা আছে। আর পশ্চিমে দেড় কিলোমিটার দূরে রেলের লাইন। ষ্টেশন। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের সহজ আর নিকটতম ব্যবস্থা। 

ভারত ভাগ হয়ে স্বাধীন হয়েছে এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ফলে স্বাধীনতার পর থেকেই সমাজ জীবনে ধর্মের প্রভাব কমে গিয়ে রাজনীতির প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের মাঝে রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়েছে। প্রধানত দু’টো ভাগ। শাসক দল আর বিরোধী দল। প্রথম দলের আশ্রয় কংগ্রেস পার্টি, দ্বিতীয় দলের আশ্রয় কমিউনিস্ট পার্টি। আমার সামাজিক কাজকর্মের কেন্দ্রে কমিউনিস্ট দলের প্রাধান্য। আর আমারও সেই দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি। এই কর্মকান্ডে বিবেকানন্দের স্থান কোথায়? এ-তো সকলের হাতে হাত লাগিয়ে নগর গড়ে তোলবার কাজ। একটা ছিন্নমূল সমাজকে অপরিচিত জমিতে প্রতিষ্ঠিত করবার কাজ। রাষ্ট্রনীতির ভাষায় কলোনি প্রতিষ্ঠা। একটা নতুন পরিবেশে নতুন নগর সভ্যতার প্রতিষ্ঠার কাজ। দেশজুড়ে চলছে সরকারি খাস জমি দখল। কোথাও জমিদারের উদ্বৃত্ত জমি অথবা পড়ে থাকা জনহীন বাড়ির দখল নিয়ে, আবার কোথাও অল্প সংখ্যায় সমর্থরা একক অথবা যৌথভাবে জমি কিনে জোট বেঁধে বসবাসের ব্যবস্থা করছেন। প্রতিবেশে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন সভ্য সমাজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব কলহ সংঘর্ষ আর আপোশ রফার প্রক্রিয়া চলছে। 

কৈশোরে বিবেকানন্দের উদাত্ত আহ্বানে যে স্বপ্ন দেখে আবিষ্ট হয়ে ছিলাম সে স্বপ্ন কখন যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল টেরই পেলাম না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপার্জনের যোগ্য হতে হবে। এই ছিল আমাদের সে-দিনের লক্ষ্য। “দরিদ্র নারায়ণের সেবা”। এখানে কে দরিদ্র কে বা নারায়ণ আর কেই বা সেবক। মানুষের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষকে সেবা করবার যে ধর্ম বা কর্মের প্রচার তার মাঝে কোথাও লুকিয়ে আছে বিচ্ছিন্নতার বীজ। এমন ভাবনাই ওই মহান মানুষের সঙ্গে আমার দূরত্ব তয়ের করে দিল। 

তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত শত যুবক দেশের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করলেন, এমনই এক বীর মাস্টারদা সূর্য সেনের আজ ফাঁসিতে আত্মবলিদান দিবস। ফাঁসি হয়েছিল তাঁর ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে। স্বামীজির মৃত্যুর বত্রিশ বছর পর। তিনি যেন ছিলেন গল্পের সেই হেমলিনের বাঁশীওয়ালা। তাঁর আহ্বান উপেক্ষা করা দুঃসাধ্য। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। 

আজ মনে হয়, বিবেকানন্দের সাফল্য, বাংলার সংস্কার আন্দোলনকে ধর্মীয় সংস্কারের রূপ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা। আর আজকের যুবকের মুখে যে হুংকার শুনে অন্য ধর্মের মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত তার পেছনে রয়েছে ওই মহান মানুষের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা আর কর্ম প্রচেষ্টার শতাধিক বছরের অনুশীলনের বিকশিত রূপ। হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করাই ছিল তাঁর চিকাগো ধর্ম সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্য এবং তাৎপর্য। 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার