কাতার বিশ্বকাপের পর্যালোচনা

রূমেলা দেব

প্রায় একমাস হতে চলল কাতারে শেষ হওয়া "দ্য গ্রেটেস্ট সো অন দ্য আর্থ" অর্থাৎ ২০২২ ফুটবল পুরুষ বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলি বিশ্বকাপ হয়েছে (পুরুষ, নারী বিভাগ) প্রত্যেকটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং অর্থনৈতিকভাবেও অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে ফুটবলের মহোৎসব আয়োজনে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ। ২০১০ সালে প্রথমবার ফিফার কাছ থেকে হাইজ্যাক করে বিশ্বকাপ নিয়ে এসেছিলো কাতার তার নিজ দেশে অনুষ্ঠিত করার জন্য। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল এবং কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে গভীর রাজনীতি এবং বৈষম্যের প্রভাব রয়েছে। সাথে এশিয়ার সূর্য হিসেবে উদীয়মান কিছু দেশ ইউরোপের একচেটিয়া ফ্র্যাঞ্চাইসি ফুটবল ও EUFA-র কর্পোরেট মাফিয়াদের বুকের উপর দাঁড়িয়ে ইতিহাস রচনা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত ধনী এবং শরীয়ত আইন দ্বারা প্রভাবিত একটি দেশ কাতার এ বছর প্রথম সর্বোচ্চ বিলিয়ন খরচা করে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করেছিল মরুর বুকে। আরব মরুভূমির এই দেশটিতে ফুটবলের ন্যূনতম অবকাঠামো না থাকা সত্ত্বেও ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচা করে খেলার উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করেছে। প্রথম থেকেই তীব্র শোষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও চরম দুর্নীতিতে জর্জরিত কাতার। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে যে নিজ দেশকে ফুটবলের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ফিফার কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালেই আফ্রিকান ফুটবল কনফেডারেশনে বিপুল অর্থ সহায়তা করে কাতার, তাদের কাছ থেকে ভোট পাওয়ার জন্য। এছাড়াও প্যারিস, স্পেন, জার্মানিকে বিপুল অর্থ সহায়তা করা হয়। বিশ্বের প্রথম সারির ধনী ক্লাব পিএস-জিএফসিকে ৫০০ মিলিয়ন ইউরো এবং স্পেনের বার্সেলোনাকে পাঁচ বছরের জন্য ১৫০ মিলিয়ন ইউরো দেয় কাতার। তাছাড়া ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত ফুটবল ক্লাবগুলোতেও মধ্যপ্রাচ্যের "আমীর"দের রেকর্ড হারে পুঁজির বিনিয়োগ চলছে।

ফিফা কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল ঘোষণা করার পর থেকেই অতি কম সময়ের মধ্যেই সামগ্রিক পরিকল্পিত নগরায়ন অর্থাৎ দোহা মেট্রো র‍্যাপিড ট্রান্সমিট সিস্টেম, এয়ারপোর্ট, রাস্তাঘাট, বিলাসবহুল হোটেল থেকে শুরু করে সাতটি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়‌। ঠিক এখানেই লুকিয়ে আছে আছে কাতারের একের পর এক চমক যা চকচকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্টেডিয়ামের পিছনের ভয়াবহ ইতিহাস। ইন্টারন্যাশনাল লেবার নিউজ থেকে জানা যায় যে প্রায় ২৭ হাজার এশিয়ান-আফ্রিকান পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘাম-রক্ত-লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এগুলো। কাতার অতি দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য দশ বছর যাবৎ প্রতি সপ্তাহে ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ এবং চার লক্ষ অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করেছিল। ছোট ও মাঝারি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির দ্বারা শ্রমিকদের এনে ভয়ংকর গরমে জোর করে কাজ করানো, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা, ওভার টাইম খাটানো এবং আইনত নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ঠিকাদারদের শ্রমিকদের থেকে নিয়োগের জন্য টাকা নেওয়া চলতে থাকে। তাদেরকে রাখা হত অন্ধকার পায়রার খোপের মতো ঘরে, এছাড়াও তাদের খাওয়ার সময় দেওয়া হতো না কারণ কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্টেডিয়ামের থেকে কাতারের স্টেডিয়াম সম্পূর্ণ আলাদা কারণ কাতারে উচ্চ তাপমাত্রা ৫০° সেলসিয়াস। তাই সেখানে স্টেডিয়ামের আর্কিটেকচার থেকে স্ট্রাকচার সবই ছিল ভিন্ন। গরম হাওয়া যাতে না ঢোকে ও তাপমাত্রা যেন সহনশীল হয়, খেলোয়াড় এবং অডিয়েন্সের যাতে কোন রকম সমস্যা না হয়, এর জন্য স্টেডিয়ামের উচ্চতা অনেক দীর্ঘ ও ভেতরের অংশ মৃত্যু কূপের মতো গভীর ছিল। ঠিক এই ভয়াবহ পরিবেশে শ্রমিকদেরকে বিন্দুমাত্র প্রোটেকশন ছাড়াই নামমাত্র বেতন দ্বারা কাজ করতে বাধ্য করা হত। কাতার ছেড়ে যেতে চাইলে বা কর্মস্থল পরিবর্তন করতে চাইলে মাসের পর মাস বেতন বন্ধ, পাসপোর্ট আটকে রাখা হত। অতি উচ্চতায় কাজ করতে গিয়ে অনায়াসে বহু শ্রমিকের উপর থেকে পড়ে মৃত্যু হলে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে বাড়ির লোকের কাছে খবর দেওয়া, ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ থেকে শোকপ্রকাশ, কোন কিছুই কাতার প্রশাসন করেনি। অতএব রেকর্ড বিলিয়ন ডলার দেশকে সাজানোর পেছনে খরচা করলেও বিশ্বকাপের কান্ডারী শ্রমিকদের জীবনের মূল্য তাদের কাছে এক কানা কড়িও ছিল না। ইসলামের একটি অত্যন্ত বিখ্যাত লাইন আছে "শ্রমিকের ঘাম লোকানোর আগে তার মজুরি দিয়ে দাও" কিন্তু কাতার প্রশাসন নিজেদের অতি দুর্বল শ্রম আইনের দৃষ্টিতে নির্মাণ কর্মীদের শ্রমিক বলেই মানে না এবং তাদের দাসের থেকেও নিম্ন চোখে দেখে। বিশ্বকাপের জন্য নিয়োজিত হাজার হাজার শ্রমিকদের বকেয়া বেতন এখনো পরিশোধ করেনি তারা। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন্স, শ্রীলঙ্কা এবং আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের পরিবারের কথা ভেবে জীবনের পরোয়া না করে কাতারের মতন এই নরকে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল। এর পরের পর্বে আসে কাতারের তথ্য গোপন। ঠিক কতজন শ্রমিক মারা গিয়েছে তা নিয়ে সম্পূর্ণ নীরব কাতার। দ্য গার্ডিয়ান সহ বিভিন্ন মিডিয়া সূত্রে জানা গেছে ৬০৮৯জন শ্রমিক মারা গিয়েছে। এছাড়াও মানবাধিকার সংগঠনের দেওয়া তথ্য বলছে ৩৬জন পরিযায়ী শ্রমিক অতিরিক্ত পরিশ্রম সহ্য করতে না পেরে নির্মান স্থল থেকে কাজ শেষ করার খানিকক্ষণের মধ্যেই মারা গেছে। এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতে সংখ্যাটা এক লক্ষের বেশি। কাতারের এই উচ্চ বিলাসী স্টেডিয়াম, ঝাঁ চকচকে শহরের বুকে যখন বিলবোর্ডে পৃথিবীর বিখ্যাত খেলোয়াড়দের ছবি উঠে আসছে, ঠিক সেই সময় প্রবাসে সন্তান হারা শ্রমিক পরিবারগুলোতে চোখের জলে স্মরণ হচ্ছে প্রিয়জনেরা। শেষ দেখাও দেখা হলো না তাদের পরিবারের সেই মানুষটিকে। ন্যূনতম আন্তর্জাতিক শ্রম আইন এবং মৃত্যু পরবর্তী ক্ষতিপূরণের কোনো দায়ই নেয়নি কাতার প্রশাসন।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই কাতার প্রশাসন মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সরাসরি বিরোধিতা করেছে তাদের ইসলামিক শরীয়তি সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে। মানুষের যৌনতার ও পোশাকের অধিকারের বিষয়টিকে তারা প্রকাশ্যে বিরোধিতা জানিয়ে একাধিক বার হুঁশিয়ারি দিয়েছে দর্শকদের মধ্যে কেউ "খোলামেলা" পোশাক পড়লে অথবা স্টেডিয়ামের মধ্যে মদ্যপান, গান বাজনা, আলিঙ্গন করলে তাদেরকে দেশীয় আইনে গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। কাতার আইনে ফুটবল দেখতে আসা মানুষদের ফতোয়া মেনেই চলতে হবে। এই নিয়ে প্রথম থেকে ইউয়েফার তরফ থেকে বিরোধীতা ও দর্শকদের মধ্যে প্রবল বিতর্ক ছিল। কাতার তাদের ইসলামী সংস্কৃতি প্রচারে ইসলাম ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে খেলা উদ্বোধন করিয়ে যে মুসলিম পিছিয়ে পড়া দেশগুলি শ্রমিকরা কাতারে স্টেডিয়াম বানাতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রোপাগান্ডা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। সেটা মধ্যপ্রাচ্যের মিডিয়ায় প্রশংসিত হলেও আসলে উল্টোদিকে তারা ভারত সহ অন্য তিনটি দেশের পরিচিত চারজন সেলিব্রিটি মহিলা দ্বারা চটুল গান-নাচ প্রচার করে বিশ্বব্যাপী মানুষদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।

কাতারে নিষিদ্ধ LGBTQ সম্পর্ক। সমকামী ও ক্যুইয়ার সহ প্রান্তিক জেন্ডাররা কাতারে অপরাধী হিসেবে গণ্য। কাতারের সমকামী বা কুইয়ারের মতো প্রান্তিক লিঙ্গের বেঁচে থাকার, পরস্পরকে ভালোবাসার বা সন্তান দত্তক নেওয়ার মতো কোনো অধিকার নেই। এগুলো আইনত ইসলামিক রক্ষনশীল শাসনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশ্বকাপ শুরুর পূর্ব থেকেই কাতার ফিফার কাছে আবেদন করে মাঠে যেন কেউ রামধনু রঙের পতাকা, জামা, ব্যান্ড ইত্যাদি নিয়ে না ঢোকে। UEFA, FSA, FA - এই তিন সংস্থা ও সাথে ইউরোপীয় দেশগুলি সেপ্টেম্বর মাসেই ফিফাকে এর বিরুদ্ধে চরম বিরোধিতা জানায় এবং সুপারিশ করে রামধনু ব্যান্ড পরে খেলোয়াড়দের মাঠে নামতে দেওয়ার জন্য। অথচ ফিফা এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব ছিল এবং কোনো জবাব দেয়নি। আজকে বিশ্বজুড়ে যেখানে প্রান্তিক যৌনতার মানুষরা একত্র হয়েছে তাদের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমান অধিকারের জন্য, সেখানে সরাসরি এমন ফতোয়া প্রবল নিন্দা ও বিতর্কের ঝড় তুলেছে। ফুটবল সমর্থকরা এই বিষয়গুলো নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে‌। ইউরোপের ফুটবল ম্যাচগুলিতে LGBTQ-এর ভালোবাসার অধিকারের পক্ষে সলিডারিটি জানিয়ে প্রত্যেক দলের অধিনায়কের রামধনু রঙের ওয়ান লাভ ব্যান্ড পরে মাঠে নামার প্রচলন আছে। পাশ্চাত্য দেশগুলোর মধ্যে প্রথম থেকেই সোচ্চার  ইংল্যান্ড, ওয়েলস, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস। এদের দলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে-কোনোভাবেই তারা রেনবো আর্মব্যান্ড পড়েই কাতার বিশ্বকাপে নামবে। তারা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতেও প্রস্তুত ছিল। ইংল্যান্ড টিমের অধিনায়ক হ্যারি ক্যানী, জার্মানির ম্যানুয়াল নুয়্যার, ওয়েলস-এর গ্যারেথ বেল প্রকাশ্যে বলেছিল যে-কোনভাবেই সাত রঙের আর্মব্যান্ড পড়েই নামবে। কিন্তু ফিফার বারংবার শাস্তির হুশিয়ারি, হলুদ কার্ড দেখিয়ে হেনস্থা এবং ক্যারিয়ার বিপর্যয়ের আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত তারা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয় ও এক কালারের আর্মব্যান্ড পরেই মাঠে নামে। এই বিশ্বকাপজুড়েই কাতার প্রশাসনের ইসলামী সংস্কৃতির নামে নিলজ্জ LGBTQ বিদ্বেষ উদযাপন চলতেই থাকে। রামধনু জামা পড়া বেশকিছু দর্শক ও সাংবাদিকদের তারা মাঠে ঢুকতে দেয়নি। সাংবাদিক গ্রান্ট ওয়াল এর প্রতিবাদ করলে তিনি খুনের হুমকি পান। কাতারের সমকামী বিরোধীতা নিয়ে সবথেকে উদ্বেগকারী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার পুরুষ জাতীয় দলের সেন্ট্রাল মিড ফিল্ডার যশ ক্যাভাল্লোকে কেন্দ্র করে, যিনি প্রথম স্বঘোষিত সমকামী পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে নিয়ে প্রথম থেকেই কাতারে বিতর্ক ছিল এবং তিনি বিশ্বকাপ খেলতে আসলে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হবেও বলা হয়। অ্যাটিচিউড পত্রিকার ‘ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ অনুষ্ঠানে জশ জাতীয় দলে ডাক পেলেও নিরাপত্তা জনিত কারণে নিজেই অস্বীকার করেন কাতারের মতো মধ্যযুগীয় দেশে খেলতে যেতে যেখানে ভালোবাসার সমান অধিকার নিষিদ্ধ। বিগত মাসে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত ধনী আমীর দেশ কাতারের এই সমকামী বিদ্বেষ নিয়ে ভারত, বাংলাদেশের সোশাল মিডিয়ার ইউজারদের যে পরিমাণ উল্লাস ও আপ্লুত মনোভাব লক্ষ্য করা যায়, তাতে বোঝা যায়, সমলিঙ্গের রাজনৈতিক ও ভালোবাসার অধিকারের জন্য গোটা বিশ্বে আওয়াজ উঠলেও তা কেবল ঢক্বানিনাদ। বাঙালি সমাজও এর বাইরে নয়। প্রকৃত অধিকারের লড়াই প্রতিষ্ঠিত হতে বহুদূর পথ চলা বাকি। অনস্বীকার্যভাবে প্রথম থেকে পাশ্চাত্য দেশ এবং সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বামপন্থীরা এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেছে। এছাড়াও বহু আন্তর্জাতিক প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম, এনজিও ইসলামিক রাষ্ট্রের কট্টর মতাদর্শের সমালোচনা করতে পিছপা হয়নি। তবে আশার কথা অবশ্যই আছে। বিবিসি ক্রীড়া সাংবাদিক অ্যালেক্স স্কট ইংল্যান্ড-ওয়েলস ম্যাচের সময় নির্ভীকভাবে রামধনু ব্যান্ড পড়ে সাংবাদিকতা করেন।

গত বছর ইউরোপ জুড়ে মার্কিনী মদৎপুষ্ট ইউক্রেন ও চীন মদৎপুষ্ট রাশিয়ার সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া সরাসরিভাবে এসে পড়েছিল ফিফা ২০২২ কাতার পুরুষ বিশ্বকাপেও। বাছাই পর্ব প্লে অফ রাউন্ড থেকেই অনির্দিষ্টকালের জন্য ফিফা এবং তাকে অনুসরণ করে উয়েফা, ২০১৮ বিশ্বকাপ-এর হোস্ট দেশ রাশিয়া ও রাশিয়ান ফেডারেশনের পতাকাকে সমস্ত রকম আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খেলা থেকে নিষিদ্ধ করেছে। প্লে অফে বি গ্রুপে রাশিয়া vs পোল্যান্ড ম্যাচ, চ্যামপিয়নস লিগ, উইম্যান ইউরো এবং ইউরোপা লিগের স্পাটার্ক মস্কো সমগ্র জায়গা থেকেই একতরফা একঘরে করা হয়েছে রাশিয়াকে। এছাড়াও সংঘর্ষের প্রভাবে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে রাশিয়া ও সহযোগী বেলারুশকেও অলিম্পিক থেকে নিষিদ্ধ করে। গত বছর ইউক্রেন এবং রাশিয়া সংঘর্ষের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থাগুলি রাশিয়ার সমস্ত ইভেন্ট ও Gazprom গ্যাস কোম্পানির স্পন্সারশিপ বাতিল করার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। এখানে স্পষ্ট যে এর পিছনে পশ্চিমা শক্তি ন্যাটোর মূল সমর্থক এবং মার্কিনী মদনপুষ্ট দেশগুলোর চাপ সক্রিয় ছিল। পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, সুইডেন তিনটে দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন একসাথে আপত্তি জানায় রাশিয়ায় গিয়ে খেলতে। এবার ফুটবলীয় রাজনীতির নিয়ে কথা বলা যাক। ফিফা এবং ইউয়েফা খেলাধুলার সাথে রাজনীতিকে না জড়ানোর পরামর্শ আমাদের দিয়ে থাকে। এবং এক শ্রেনীর উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দর্শকরাও এই বিষয়ে অর্থাৎ অরাজনৈতিক ফুটবলের বিষয়ে প্রবল পক্ষপাতদুষ্ট। তারা চায় খেলাকে কেবল বিনোদন হিসেবে দেখতে এবং মাঠে খেলা সেখানেই শেষ করে আসতে। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকা থেকে ইউরোপের প্রারম্ভিক ফুটবল ইতিহাস থেকে যদি আজকের ইউক্রেন-রাশিয়াকে ধরা যায়, সেখানে কোন কিছুই অরাজনৈতিক ঘটেনি, প্রতিটি ঘটনা কোন না কোন রাজনীতির পক্ষেই কথা বলেছে। কিন্তু পশ্চিমা শক্তির সম্মিলিতভাবে রাশিয়াকে খেলা থেকে বয়কটের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লকডাউনে ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য অস্ত্রের বিক্রি বাড়াতে এবং ক্ষয়িষ্ণু পুঁজির বাজার পুনর্জীবিত করার জন্যই সংঘাতের আয়োজন। ন্যাটো শক্তি ইউক্রেন বর্ডারে ঢুকে রাশিয়ার বর্ডারে বোমা বর্ষণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমতুল্য কলহের প্ররোচনা দেয়‌। রাশিয়াও নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং যে তেল ও গ্যাসের মালিকানার স্বার্থে এই যুদ্ধ, ফিফা ও ইউয়েফা তাদের পক্ষ বেছে নিয়েছে। একপাক্ষিকভাবে মার্কিনী শক্তির চাপে আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার রাশিয়ার ফুটবল অথচ ইউক্রেনে মার্কিন ব্যাকআপ দ্বারা ক্ষমতায় আসা ঝেলেনেস্কি ন্যাটোতে নিজের দেশকে সদস্য করার চেষ্টা থেকে মার্কিন মদতপুষ্ট সমস্ত রকম অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার পরেও খেলার দুনিয়ায় কোনোভাবে নিন্দিত বা নিষিদ্ধ হয়নি। ইউক্রেন প্লে অফে ওঠে এবং সেখান থেকে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফিফার কর্মকর্তারা নিজেরাই বলেছেন সংঘাত দিয়ে কখনো সমাধান হয় না, ফুটবল ঐক্য ও শান্তির বাহক। অথচ বিপরীতে যখন গৃহযুদ্ধ ও অমানবিক গণহত্যার প্রেক্ষাপট হয়ে দাঁড়ায় এশিয়া ও আফ্রিকান মহাদেশ সেখানে ফিফার অতি সক্রিয় হয়ে ফুটবল দ্বারা কোনোরূপ প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ দেখা যায় না। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলে আসা ইজরায়েল দ্বারা প্যালেস্তাইনের ওপর মিসাইল এবং বর্বর সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে ফিফা বরাবর নিশ্চুপ। অথচ আগামী ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে ইসরায়েল খেলতে চলেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ইরানের ওপর সবরকম বয়কট ও বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধেও ফিফার কোন প্রতিবাদ বা বক্তব্য শোনা যায় না। একাধিকবার বিভিন্ন দেশে হামলা অমানবিক অত্যাচার, শিশুদের গৃহহীন করার পরও একবারও ফিফা দ্বারা নির্বাসিত বা নিষিদ্ধ হয়নি। এছাড়াও সাম্প্রতিককালে রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান তারকা জুনিয়র ভিনিকে দর্শকদের একাংশ দ্বারা বর্ণবাদী কটুক্তি করা হয়েছে। তিনি পরিষ্কার অভিযোগ জানিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে লা লিগা এর বিরুদ্ধে কোন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে এরকম ঘটনা প্রথমবার নয়।

৫০ বছর আগে ১৯৭৪ নভেম্বরে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে সুযোগ হারিয়ে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব এসে পড়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে। গত বছর ইউরোপের ফুটবলের সামগ্রিক ম্যাচ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে বহু ম্যাচে এবং বহু তারকা খেলোয়াররা প্রকাশ্যে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়িয়ে "নো ওয়ার", "স্টপ ওয়ার" জানিয়ে ভোকাল হয়েছেন। তারা  জার্সি - ফ্লেক্স এবং নিজস্ব সোশাল মিডিয়াতেও স্পষ্ট পক্ষ নিয়েছেন। অর্থাৎ এটিকে আমরা প্রতিবাদ ছাড়াও একটি ইউরোপীয় ফুটবল প্রোপাগান্ডা হিসেবে ধরতে পারি যার মাধ্যমে দর্শকদেরকে একটি দিক দেখানো এবং অন্য দিক থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ন্যাটো দ্রুত পশ্চিমা দেশের সদস্য পদ বাড়িয়ে রাশিয়ার সীমানার তেল ও গ্যাসের দখল করতে উদ্যোগী। ইউক্রেনের সাথে পোল্যান্ড, জার্মানির মতন ন্যাটোর দেশগুলোও এ কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পুনরায় পৃথিবীকে অশান্ত করার অপচেষ্টার সত্যটিকে ফুটবল দুনিয়া থেকে দূরে রাখার জন্যই ফিফার এতো যুদ্ধ বিরোধী কুমিরের কান্না।

Image Courtesy: Eurosport

[ডিলিজেন্টের ২০২৩-এর তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।] 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার