বর্তমান ছাত্র আন্দোলনের অগ্রগতি প্রসঙ্গে

রূপক গায়েন


সাম্প্রতিককালের ছাত্র আন্দোলনের পরিসরে মেডিকেল কলেজের ছাত্র আন্দোলন সাফল্য লাভ করেছে। তবে আন্দোলনের ঝোঁক শুরু থেকেই ছিল ভীষণভাবে অনশন কেন্দ্রীক অর্থাৎ আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরগুলো অতিক্রম না করেই আগেভাগে অনশনে বসে যাওয়া। মেডিকেল কলেজগুলোর আন্দোলনে এই ধরনের প্রবণতা অনেকদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই অনশন আন্দোলনেরই একটি পর্যায় কিন্তু তা সর্বশেষ হাতিয়ার হওয়ার কথা। দীর্ঘ আন্দোলনের আগেই অনশন কর্মসূচী কার্যত আন্দোলনে সমাবিষ্ট পড়ুয়াদের ঘনত্ব কমায়। ফলে দেখা গেছে, চটজলদি কিছু দাবি কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চায়।

ছাত্র আন্দোলনের অভিমুখ যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে কর্তৃপক্ষের আচরণেরও। আজ থেকে দশ বছর আগে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি ব্যবহার যা হতো, তার ভোল পাল্টে গেছে; কর্তৃপক্ষ অনেক বেশি স্বৈরাচারী এবং জিঘাংসাকামী হয়ে উঠেছে। আমাদের রাজ্যে এই ধরনের কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় যা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। একই রকম আচরণ রাজ্য সরকারের অধীন কলেজগুলোতেও দেখা যাচ্ছেঃ আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের তৃণমূলপন্থী প্রিন্সিপাল দ্বারা অবস্থানরত পড়ুয়াদের উপর পোস্টের ছিঁড়ে ছুঁড়ে মারা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উগ্ৰতা ইত্যাদি। ওকুপাই সিইউ-র যোগ্য এবং ইচ্ছুক ছাত্র ভর্তির দাবীতে আন্দোলনের ফলে কিছু কিছু বিভাগে ছাত্র ভর্তি হলেও কর্তৃপক্ষের ছাত্র বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের বছর নষ্ট করতেও পিছপা হচ্ছে না তারা, অর্থনীতি বিভাগে আবার নতুন ছাত্রদের ক্যাম্পাসিং-এ বসতে দেওয়া হচ্ছে না। একদিকে ছাত্র আন্দোলনের চটজলদি কিছু দাবী আদায়ের পদক্ষেপ আর অন্যদিকে ২০১১তে ক্ষমতায় এসেই ছাত্র সংসদকে শুধু সরস্বতী পূজা আর বার্ষিক মদ-মাংসের ফেস্ট করানোর বিরাট দায়িত্ব দিয়ে তৃণমূলের বিরাজনীতিকরণের বাতাবরণ তৈরীর প্রচেষ্টা ছাত্র সমাজের লড়াকু চরিত্রকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।

এবার আসা যাক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে। ভোর রাতে করুণাময়ী থেকে আন্দোলনরত হবু শিক্ষকদের অ্যারেস্ট, পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের হাত কামড়ানো, এসবের চিত্র রাজ্যবাসীর মনে এখনও জ্বলজ্বল করছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কেন? আসলে এগুলোর ভিতর লুকিয়ে আছে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্থরকে আল্গা করে দিয়ে বেসরকারীকরণের পথকে সুগম করে তোলার চক্রান্ত, বিজেপির নিউ এডুকেশন পলিসি ধীরে ধীরে লাগু করার তৃণমূলী লক্ষ্য। এই বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে নতুন করে শিক্ষকদের সংগঠন গড়ে তোলা ভীষণভাবে জরুরি। বিভিন্ন পার্টির শিক্ষক সংগঠনগুলোর বাইরে, যার বামপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানও থাকবে আবার একই সাথে ছাত্র আন্দোলনগুলিকে বিভিন্ন জায়গায় ঠেশ দিয়ে রাখবে, এমন নয়া শিক্ষক সংগঠন দরকার। কারণ বর্তমানে শিক্ষকদের সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই ছাত্র আন্দোলন এগোতে পারবে না। বিভিন্ন স্কুল, কলেজে প্রত্যেক বছর যেন শিক্ষক নিয়োগ ঠিকভাবে হয় তার জন্য লড়াই করতে হবে। স্থায়ী শিক্ষকদের থেকে কনট্র্যাকচুয়্যাল শিক্ষকদের সংঘবদ্ধ করা বেশি দরকার কারণ যে ক্লাস প্রতি সামান্য মাইনে তাঁরা পান তার বৃদ্ধি, মাস মাইনের ব্যবস্থা করা এবং তাঁদের উপর যে প্রাতিষ্ঠানিক জুলুম চলে সেগুলো থেকে মুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষক সংগঠনগুলির পাশাপাশি যুব সংগঠনগুলিকেও কর্মসংস্থানের দাবীতে আন্দোলনের পথে এগোতে হবে। শিক্ষক আন্দোলন শক্তিশালী না হলে কর্তৃপক্ষের উগ্ৰতা ছাত্রদের প্রতি পরোক্ষে বাড়তেই থাকবে।

একদিকে এবিভিপি-র ছাত্রদের ধর্ষকদের হয়ে লড়ার স্লোগান আর অন্যদিকে তৃণমূলী গুন্ডাবাহিনীর স্কুল কলেজগুলো থেকে যথেচ্ছভাবে টাকা হাতানোর থেকে ছাত্র আন্দোলনকে বাঁচাতে হবে। একই সাথে পাঠক্রমকে তৃণমূলী নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করা, যুগপোযোগী করা এবং বিভিন্ন ধরনের তথ্যগত বিকৃতির গেরুয়া প্রবণতাকে বানচাল করার পরিকল্পনা সুচারুভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলির পাশাপাশি বিভিন্ন পার্টির গণসংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। শুধু শিক্ষক বা ছাত্র নয়, কনট্র্যাকচুয়্যাল শ্রমিক সংগঠনগুলোও যেন এগিয়ে আসে এক্ষেত্রে, না হলে দেখা যাচ্ছে, মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উপর কনট্র্যাকচুয়্যাল নার্সদেরকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কনট্র্যাকচুয়্যাল কর্মীদেরই লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছাত্রদের মেরে, পিটিয়ে অবস্থান তোলানোর জন্য। এই যে পারস্পরিক কলহ তৈরি করা হচ্ছে সেটা থামানোর দরকার।

ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের আন্দোলনের সাপেক্ষে সেখানকার ছাত্র নেতৃত্বের এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলির উচিৎ ছিল পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এই আন্দোলনকে রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে দেওয়া কিন্তু তা করা হয়নি। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনার সদিচ্ছার অভাবের ছাপ সকল বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের ক্ষেত্রেই লক্ষণীয়। কেবল নিজেদের সংগঠনের পুষ্টির কথা ভেবে সংকীর্ণভাবে কাজ করে যাচ্ছে তারা, সার্বিক আন্দোলনের পরিসরে তাই ভাটা চলছে।

ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার জন্য তৃণমূল ছাত্র পরিষদের গুন্ডা বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে নামা আজ সময়ের দাবী। একই সাথে ভেবে দেখার বিষয় হল, শুধু ছাত্র ভোট হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা নয়, বরং বিগত বেশকিছু দশক ধরেই কয়েকটি তথাকথিত এগিয়ে থাকা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই ছাত্রসংসদের ভূমিকা নিয়ে সঠিক ধারণাই নেই এবং এমনকি এই গুটিকয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কর্তৃপক্ষের মিটিং-এ নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্ৰহণের পদ্ধতিও ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সরস্বতী পূজা এবং ফেস্টের বাইরে ছাত্রসংসদের কার্যক্রম করতে হলে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতিতে স্থানীয় বিধায়কদের প্রভাব সংকুচিত করতে হলে এবং কলেজগুলোর ফান্ড নিয়ে নয়ছয় করা সহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে হলে ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ কাউন্সিলের মিটিংগুলোকে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রণভূমিতে পরিণত করতে হবে, যাতে শাসক দলের নেতারা কলেজগুলোর ফান্ড নয়ছয় করার পূর্বে যেন তাদের মনে এই আশঙ্কা প্রতিধ্বনিত হয়ঃ ‘ইয়ে কলেজ কি দিওয়ার টুটতে কিউ নেহি, ছাত্র সংসদ কি সিমেন্ট সে জো বানি হ্যায়’

[ডিলিজেন্টের ২০২৩-এর তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।]

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার