কেন ৪২ দিনের আইএসএফ নেতৃত্বের কারাবাস পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক পরিবেশের অবনতির দ্যোতনা?

অর্ক সাহা 


২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট-এর প্রতিষ্ঠা হয়। এই পার্টি প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই তাদের রাজনীতি প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন উঠে আসছেঃ বিভিন্ন নিপীড়িত সামাজিক প্রতিনিধিত্বের (মূলত সংখ্যালঘু + দলিত + আদিবাসী) মেলবন্ধন ঘটিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপিকে পরাস্ত করার সরল সমীকরণের রাজনৈতিক লাইন আলাদা আলাদা করে ধরা এক একটা সামাজিক ফ্যাক্টরের পরস্পরের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও মিথষ্ক্রিয়ার গাণিতিক জটিলতাকে গ্রাহ্য করে কি? উল্লেখ্য, বিতর্কিত ধর্মগুরু আব্বাস সিদ্দিকিকে বর্তমানে পার্টিগত কাজকর্মে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। যাই হোক, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে ভাঙড়ে আইএসএফ তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থিত কুখ্যাত সমাজ বিরোধী আরাবুল ইসলামের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আরাবুলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ গত ২১শে জানুয়ারি পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসে সমাবেশ সমাপ্তির মুহূর্তে ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির ডাকে আইএসএফ কর্মীরা এসপ্ল্যানেড চত্বরে পথ অবরোধ কর্মসূচী পালন করতে গেলে পুলিশি প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। নওশাদ সহ অন্যান্য আইএসএফ নেতৃত্বকে গ্রেফতার করে খুনের চেষ্টা, দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা ইত্যাদি সংক্রান্ত কেস দায়ের করে পুলিশ। নিম্ন আদালতে শুনানী চলাকালীন তদন্ত প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার সহায়ক হয় তৃণমূল কংগ্রেস এমপি কাকলী ঘোষ দস্তিদারের আইএসএফ-এর বিরুদ্ধে দাঙ্গার প্ররোচনার কু’মন্তব্য; সেই কাকলী ঘোষ দস্তিদার যিনি পার্ক স্ট্রীট গণধর্ষণের ঘটনাকে বারবনিতার সাথে রফাসূত্রের গণ্ডগোল হিসেবে দর্শেছিলেন। বারংবার অভিযোগ উঠেছে যে পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন আইএসএফ কর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে, একজন মহিলা সদস্যাকে একা একটি সেলে রাখা হয়েছে, এমনকি অনেক কর্মীকে আসামীর পোশাক পর্যন্ত পড়ানো হয়েছে। তাহলে কি শহীদ-এ-আজম ভগৎ সিং-এর আন্দোলন লব্ধ রাজবন্দীদের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে তৃণমূল প্রশাসন? ২০২১ বিধান সভা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পুলিশি সন্ত্রাস বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। চিট ফান্ড দুর্নীতির অধ্যায় পেরিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে জর্জরিত তৃণমূল কংগ্রেস পুলিশি সন্ত্রাসের মাধ্যমে সকল প্রকার বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন করতে চাইছে। প্রতিবাদী যুবক আনিস খানের বাড়িতে হানা (পরবর্তী ঘটনা বলাই বাহুল্য) থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ না হওয়া মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী বইয়ের নাম উল্লেখ করায় আইনজীবীকে গ্রেফতার – মধ্যরাতে উর্দিধারীদের অভিযান অব্যাহতই রয়েছে। দীর্ঘ ৪২ দিনে পুলিশ ঠোস প্রমাণ দেখাতে না পারায় কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে শর্তহীন জামিন পেয়েছে আইএসএফ কর্মীরা। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সংখ্যালঘু ধর্মগুরুর নেতৃত্বই কি দলটাকে শাসক পার্টির তরফে অতি সহজেই ‘সাম্প্রাদায়িক’ তকমা দিতে সুবিধা করে দিল? তাই যদি হয়, তাহলে ‘লেসার ইভিল’ তৃণমূল কংগ্রেস আর ‘গ্রেটার ইভিল’ বিজেপির মধ্যে পার্থক্য কি রইল? আসলে তৃণমূলের এই গেরুয়া রাজনীতিতে পদার্পণের ক্ষেত্রে আম আদমি পার্টি অনেকটা রোল মডেল হিসেবে কাজ করছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট পেলেও এখন শাসক দল আনিস খানের হত্যা থেকে শুরু করে পুলিশ কর্মী সুরাফ হোসেনকে মারধরের ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে কিংবা বিনা দোষে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য সম্বলিত পার্টির বিরুদ্ধে দাঙ্গার অভিযোগ তুলে গেরুয়া রাজনীতিতে হাত পাকাতে চাইছে। তৃণমূলের এই গেরুয়া প্রোজেক্টেরই অন্তর্গত হল ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের নাম মুছে দিয়ে ওই জেলার বিভক্তিকরণের পদক্ষেপ এবং সাম্প্রতিক মদন কর্তৃক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর বিতর্কের উন্মেষ। অবজ্ঞা অবহেলার ইতিহাসই রাজ্যের নিপীড়িত অংশকে বাম রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বামপন্থী কর্মীদের আন্তরিক আত্মসমালোচনা এবং আরএসএস-এর দুর্গার হাত থেকে বাঁচতে সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসীদের বামপন্থী রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন আজ সময়ের দাবী…   

 


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!