আজকের এই বেকারত্বের যুগে নারী ক্ষমতায়নের প্রশ্ন

অনন্যা দেব

আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস, ২০২৩

আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোতে মহিলারা বছরের পর বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পরাধীনতায় যুগের পর যুগ কাটিয়ে যাচ্ছেন।এযাবৎকাল গোটা পৃথিবী জুড়ে  নারীর শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক, বামপন্থী-নারীবাদী যত প্রকার আন্দোলন হয়েছে, তার মধ্যে থেকে উঠে আসা সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হল -- 'পারিবারিক নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য প্রত্যেক নারীকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে'। কিন্তু এই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্য মহিলাদের যে কর্মসংস্থানের প্রয়োজন, তা-ই যদি না থাকে পর্যাপ্ত পরিমানে? আজকের এই বেকারত্বের যুগে কেমন আছেন নারীরা?

দীর্ঘ বাম আন্দোলনের সাংস্কৃতিক প্রভাবে সীমিত স্তরে কিছু রাজ্যে এবং পরবর্তীতে সার্বিকভাবে সারা দেশে বিশ্বায়নের প্রারম্ভিক স্তরের ভুঁইফোড় প্রচারের ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলারা বিবাহ পরবর্তী জীবনে শ্বশুরবাড়ির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কর্মরতা জীবন বেছে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। চাকুরীরতা স্ত্রীদের নিয়ে পরিবারের মধ্যেও শুরু হয় বাদ-বিবাদ। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের সারাদিনের রান্নাবান্না, এঁটো পরিষ্কার, ঘর গেরস্থালির কাজ - আর এই একই কাজের পুনরাবৃত্তি, তাতে জড়িয়ে থাকা একঘেয়েমি, ঘ্যানঘ্যানে, প্যাচপ্যাচে, নীরস জীবনের জায়গায় একটা স্বাধীনতার স্বপ্ন জেগেছিল। পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে পরিবারের মানুষজন মহিলাদের উচ্চ শিক্ষা, তাদের আর্থিক স্বনির্ভরতাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে এবং মহিলাদের একাংশ নিজেরা সিদ্ধান্ত নেয় উপার্জনশীল না হয়ে বৈবাহিক জীবনে পদার্পণ করবে না। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এই ফানুশ ফেটে যায়, কারন এই নয়াউদারবাদী অর্থনীতি জন্ম দেয় বিপুল পরিমান বেকারত্বের। সার্বিক কর্ম হ্রাস জায়গা করে দেয় খুব কম সংখ্যক বেশি মাইনের চাকরির। এর নেতিবাচক প্রভাবে আজ জর্জরিত সমগ্র নারী সমাজ।

ব্যাপারটাকে তাহলে খোলসা করে বলি-- 

১. এক সময় গ্রাম, মফস্বল থেকে মেয়েদের চট করে শহরে বা দূরে কোথাও লেখাপড়া করতে পাঠানো হত না; ভালো রেজাল্ট থাকার পরেও, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়ার পরেও। পরবর্তীতে মেয়েদের অনেকাংশই কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে দেখে অনেক বাবা-মায়েরাই পুরানো ধ্যানধারণা ছেড়ে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, গ্রামে গঞ্জে মেয়েদের পড়াশোনাকে উপজীব্য করে কলকাতার কলেজে ভর্তি করার হার কমেছে। এই প্রবণতা প্রযোজ্য দেশের অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রেও। পড়াশোনা, হোস্টেল এসবের লাগামহীন খরচ বৃদ্ধি আর শিক্ষান্তে কাজের অনিশ্চয়তা আবার পারিবারিক চিন্তাকে পূর্বতন সংকীর্ণ মানসিকতায় ফিরিয়ে আনছে। মেয়ের প্রতিষ্ঠিত হওয়া অবধি অপেক্ষা না করেই পারিবারিকভাবে বিয়ের জন্য প্রবল চাপ দেওয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে পোক্ত না হতে পারার জন্য পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করেও মেয়েরা আর জিতে উঠতে পারছে না। উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে আর্থিক স্বাধীনতা লাভ না করায়, একদা যে সকল মেয়েরা পরিবারের অন্তর্মহল ত্যাগ করে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল, তাদের মনে প্রবেশ করেছিল মুক্তির আনন্দ, তারাও আর তাদের স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে পারছে না। দিনের শেষে এই সব মেয়েরা বৈবাহিক পরাধীনতাকেই গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের রাজ্যে এই পরাধীনতা এবং নয়া মাত্রার যৌতুক প্রথার উৎসেচক হিসেবে কাজ করছে রাজ্য সরকারের 'রূপশ্রী' প্রকল্প। এটা  মূলত চাকুরীজীবী/শ্রমজীবী পরিবারের ছাত্রীদের ইস্যু।

২. যে পারিবারিক নির্যাতন, গৃহ হিংসা থেকে মুক্তি পেতে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, আজকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবারের মহিলাদের অবস্থা কিরকম? দেশজোড়া লকডাউনকালীন সময়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মেয়েদের উপর 'ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স' বেড়ে গিয়েছিল আগের থেকে কয়েক গুণ বেশি। তাছাড়া সে সময়ের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কিংবা কাজের অভাবে প্রচুর মহিলাকে আবার বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বা তারা ঢুকে যেতে বাধ্য হয়। লকডাউন পরবর্তী সময়ে তাদের বৃহদাংশ আর কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেনি।

খেটে খাওয়া পরিবারের মহিলাদের উপর আজও প্রচুর পরিমান নির্যাতন ঘটে থাকে এবং তাদের সম্পত্তির থেকেও বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু যে ক্ষমতায়নের উপর ভিত্তি করে মহিলারা লড়াই করবে, আজ সেই জায়গাটাই মুছে যেতে বসেছে। কর্মক্ষেত্র অতিরিক্ত পরিমানে সংকুচিত হওয়ায়, উপযুক্ত পরিমান মজুরী/মাইনে না পাওয়ায় গৃহ হিংসার শিকার নারীরা নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই করতে কিংবা পরিবার ছেড়ে বেড়িয়ে এসে আলাদা জায়গায় ঘর ভাড়া করে তাদের দিন গুজরান করতে পারছে না। ফলত শ্বশুরবাড়ির লাঞ্চনাই আজ তার ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা আজকের দিনে ভীষণ পরিমানে বাস্তব শ্রমজীবী নারীদের ক্ষেত্রে। তাছাড়াও বেসরকারি জায়গায় কাজের কোনো ভবিষ্যৎ না থাকায় এবং অনেক বেশি পরিমান খাটুনি বাইরে দিয়ে আসার ফলে সংসার সামলানোর সকল দায়িত্ব যা মহিলাদের ঘাড়ের উপর থাকে তাতে কিঞ্চিৎ ভাটা পড়ায় বিবাহের পর অনেক পরিবার চাপ দিচ্ছে মহিলাদের কর্মস্থল পরিত্যাগ করতে। তার বদলে সংসারকেই একমাত্র যাপন করে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে মহিলাদের। সরকারী চাকুরী ছাড়া মহিলাদের নিজের পরিবারও তাদের স্বল্প মাইনের কাজকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছে। সবথেকে যা গুরুত্বপূর্ণ, আজকের ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য অনেক বেশি সময় প্রয়োজন হওয়ায় মেয়েদের বাবারা সেই সময় ব্যয় করতে চাইছেন না; তার বদলে অল্প বয়স থাকাকালীনই মেয়েদের সম্বন্ধ দেখে পাত্রস্থ করে দিতে চাইছেন তারা। 

পরিশেষে, মহিলাদের সাংস্কৃতিক চেতনার মান আকাশছোঁয়া করে দিয়ে, সম্মানজনক উপার্জন করার মতন পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না দিতে পারলে আখেরে কোনো লাভ নেই। গৃহ হিংসার শিকার এবং পরিবারের চাপে নিজের বিয়েকে রুখে না দিতে পারা বেশিরভাগ মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনমন ঘটে। কাজের জায়গায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে প্রান্তিক জায়গা থেকে উঠে আসা মেয়েরা বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়, ফলে অনেকেই উপার্জনের জীবন ছেড়ে বিয়ে করে সংসারে ঢুকে যাওয়াকে এক প্রকার নিরাপত্তা মনে করে। 

এক কথায়, মহিলাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সমাজের একাংশের মত থাকার পরেও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তা আর কার্যকরী হচ্ছে না। মহিলাদের অবস্থা পুরানো সেই তিমিরেই আবার ফিরে যাচ্ছে, যা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হওয়া জরুরি। শুধুমাত্র গৃহ হিংসায় শিকার নারীকে কিংবা নিজের পরিবারে পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকা নারীকে, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হবার জ্ঞান দিলেই হবে না, সেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আনার জন্য লড়াইও করতে হবে। পুরুষের ক্ষেত্রে অসম্মানজনক 'বেকার' শব্দটা যে আজ  মহিলাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তা মেনে নিতে হবে। বেকারত্বের শিকার যে মেয়েরাও, সমাজে তার স্বীকৃতি দিতে হবে।

"একজন মহিলার থেকে একজন পুরুষের রোজগারের প্রয়োজন বেশি" / "মেয়েরা তো বিয়ে করে সেটেল হয়ে যাবে, আমাগো পুরুষদের কি হবে" - মার্কা পুরুষালি চটুল জোকসে দেবাংশুরাই বরং মজুক। আমরা বরং জেন্ডার নির্বিশেষে কর্মসংস্থানের দাবীতে আন্দোলন জোরদার করি। 

কর্মসংস্থানের দাবীতে নয়াউদারবাদী অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ার বৈপ্লবিক লড়াই হোক আগামীদিনের নারী আন্দোলনের দৃঢ় অঙ্গীকার।  

Picture Courtesy: https://www.shethepeople.tv/news/unemployment-rate-higher-among-urban-educated-women-2/

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার