হ্যারি বেলাফন্টে
বিমলকান্তি দাশগুপ্ত
যাঁর প্রয়াণে বেদনা প্রকাশের জন্য কলম হাতে নিলাম তিনি আমার সদ্য
পরিচিত। তিনি একজন বিশ্ববন্দিত গায়ক। হ্যারি
বেলাফন্টে। ২৬ এপ্রিল ২০২৩ বুধবার আমার রাখা খবরের সব ক’খানা কাগজে তাঁর চলে যাবার খবর। মোবাইলের
হোয়াটস অ্যাপ-এ মুখর হল সেই খবর। মৃত্যু তাঁর ২৫ এপ্রিল ২০২৩ মঙ্গলবার ছিয়ানব্বই বছর বয়সে। তিন-চার প্রজন্মকাল ব্যাপ্ত ছিল তাঁর জীবনকাল আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীতে। তাঁর
প্রয়াণ খবরে আমার দুঃখ যত না তার চেয়ে বেশি ব্যথা বোধ করছি তাঁকে আমার না জানার জন্য।
তিনি ছিলেন আমার জন্য ভালোবাসার মতোই
একজন সুন্দর মানুষ। তাঁর গান অভিনয় আর কাজের ধারা। তাঁর
সমাজচেতনা তাঁর নিজের সংগ্রাম আর মানুষকে সংগ্রামমুখী করবার জন্য বিস্তৃত কর্মকাণ্ড
ঘটিয়েছেন প্রায় সাড়ে নয় দশক ধরে এই দুনিয়ায়। আর এর
বিন্দু বিসর্গ জানা হয় নি আমার। এটা একটা অপরাধ। এর জন্য
দায় আমার নিজের সংকীর্ণতা। দুনিয়াকে জানবার আগ্রহের অপূর্ণতা।
পল রোবসন পিট সিগার এঁদের গান শুনেছি। সংগ্রামের
কথা শুনিয়েছেন। সংগ্রামে
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। রোবসনের গান নিজেরা গেয়েছি। অতি ঘনিষ্ঠ
দূরত্ব থেকে পিট সিগারের গান শুনবার সুযোগ হয়েছে আমার জীবনে। কিন্তু
হ্যারি বেলাফন্টের গান শুনিনি। ব্যথা সেখানে। দলিত নিগৃহীতদের সংগ্রাম আর আশা জাগানোর কথা নিয়ে এঁদের জীবন
আর শিল্পের চর্চা। ছিলেন সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের সাথি আজীবন।
হ্যারি বেলাফন্টে-র জন্ম ১ মার্চ ১৯২৭ সাল। হারলেম। নিউইয়র্ক সিটি। হারলেমে
মিশ্র জাতির বাস। সাদা কালো আর বিভিন্ন অভিবাসীর বাস। বাবা
হ্যারল্ড জর্জ বেলাফান্টি। ছিলেন জন্মসূত্রে জ্যামাইকান। অন্য
মতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্টিনিক যা ছিল ফরাসি অধিকৃত অঞ্চল। জীবিকায়
ছিলেন শেফ। তাঁর বাবা ছিলেন অ্যাফ্রো জ্যামাইকান মা আর বাবা ফ্রেডেরিক ছিলেন
ডাচ সেফারডিক ইহুদি বাবার সন্তান। (সেফারডিক ইহুদিরা হলেন স্পেনের ইহুদি সম্প্রদায়,
যাদের জোর করে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করানো হয়েছিল। বিকল্পে
স্পেন থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অনুমান করা হয় সংখ্যায় এরা ছিল এক লক্ষ থেকে তিন লক্ষের মতো। যারা
স্পেন ছেড়ে ইয়োরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়)। বেলাফন্টের
মা ছিলেন স্কটিশ জ্যামাইকান মাতা আর অ্যাফ্রো জ্যামাইকান বাবার সন্তান। শৈশবে
বেলাফন্টে তাঁর এক ঠাকুরমার সঙ্গে জ্যামাইকাতে ছিলেন। ওখানেই
তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। পরে তিনি চলে আসেন নিউইয়র্ক শহরে। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌ বাহিনিতে কাজ করেন।
জ্যামাইকা, আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের দক্ষিণে ক্যারিবিয়ান সাগরে এক দ্বীপ। জ্যামাইকা
অতি পরিচিত কিউবার অল্প দক্ষিণের প্রতিবেশী দ্বীপ। আয়তন
এগারো হাজার বর্গ কি মি। বাইরে থেকে জ্যামাইকা দেখতে পাহাড় অরণ্য নদী সমতল আর চার দিকে বেলাভূমিতে ঘেরা সুন্দর এক দ্বীপরাষ্ট্র। মাটিতে
মিশে আছে বক্সাইট জিপসাম চুনাপাথর। এরই মাঝে
বসত করে এক আদিম মানবগোষ্ঠী। মানুষের উৎপাদিত কৃষি ফসল, আখ কলা কফি। এগুলো
জ্যামাইকার বাণিজ্য ফসলও বটে। আছে নিজের ভাষা নিজের সংস্কৃতি।
কলম্বাসের আমেরিকা
আবিষ্কার জ্যামাইকাকে পরিচিত করল ইয়োরোপের কাছে। জ্যামাইকা
হল স্পেনের কলোনি। আফ্রিকা থেকে শ্রমিক চালান করে দ্বীপে শিল্প প্রতিষ্ঠা হল। চিনি
কোকো আর কফির বাণিজ্য করে স্পেন ধনী হতে থাকল। এরই মাঝের
ইতিহাস অনেক বিক্ষোভ বিদ্রোহ দমন পীড়ন আর হত্যার ঘটনার কাহিনি। এক সময় জ্যামাইকার দখল নিল ব্রিটিশ। দাস প্রথা
রদ করা হল। দ্বীপের আদি নাম জেইমাখা (XAYMACA) অর্থাৎ
বন এবং জলের দেশ। নাম বদল
করে রাখা হল জ্যামাইকা (JAMAICA)।
যুদ্ধ শেষ হলে
তার বেকার জীবন। এ সময় করেছেন ক্ষৌরকারের কাজ। ঘটনাক্রমে আমেরিকার নিগ্রো
থিয়েটারে একটা কাজ পেয়ে গেলেন। সেখানে বন্ধুত্ব হয় আরও এক ক্ষৌরকারের সঙ্গে। তিনি সিডনি পয়টার। বিখ্যাত অভিনেতা চিত্র
পরিচালক কূটনীতিবিদ। তাঁদের বন্ধুত্ব স্থায়ী ছিল জীবনভর।
এই থিয়েটারে
অভিনয়ের সুযোগ পান বেলাফন্টে। আর সেই সূত্রে পরিচিত হলেন পল রোবসনের সঙ্গে। আর এই
পরিচয় তাঁকে সুযোগ করে দেয় গানের জগতে। গান তাঁকে পরিচিত করে দেয় আর এক কিংবদন্তী
গায়ক পিট সিগারের সঙ্গে। এবং গান গেয়ে তাঁর রোজগার হতে থাকে। গানের গোড়া তাঁর
গাঁথা হয়ে আছে জ্যামাইকার লোকসংগীতসংস্কৃতির
গভীরে। তার সঙ্গে মিশেছে নিগ্রো লোকসংগীতের সুর। ধর্ম সংগীতের সুর আর সবার উপরে
নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের মানবিক সংস্কৃতি।
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত
পৃথিবী পাশ বদল করেছে। অন্ধকারে অদৃশ্য তলদেশ দৃষ্টির গোচরে এসেছে। মানব
সমাজে মন্বন্তর ঘটে গিয়েছে। বেলাফন্টের জন্মের দশ বছর আগেই। রুশ দেশে
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। এই আবহে সারা দুনিয়ায় নিচুতলার অবহেলিত শোষিত মানুষের শোর উঠেছে। বন্ধন
মুক্তির শোর। এই বাতাবরণে বেলাফন্টের যাত্রার শুরু। শ্রমজাত
ঘাম আর শব্দের মিশেলে যে কথা আর সুরের জন্ম তাকে ছিনতাই করে আটকে রাখা হয়েছিল রাজার
দরবারে। উচ্চাঙ্গের মুকুট পরিয়ে রানির সাজে। বেলাফন্টে
এই পরিবেশ আর পরিস্থিতির সৃষ্টি। সে কারণে তিনি একাধারে গায়ক এবং সংগ্রামী সমাজকর্মী।
গানের গোড়া
তাঁর গাঁথা জ্যামাইকার লোকসংগীতের সংস্কৃতির গভীরে। তার সঙ্গে মিশেছে নিগ্রো
লোকসংগীতের সুর ধর্মসংগীতের সুর আর শ্রমজীবী মানুষের মানবিক সংস্কৃতি। আফ্রিকার
সুর তাল ছন্দ এবং একটা বিশেষ কাহিনির আধারে তয়ের হয়েছে এই সংগীত। এ গান
কাজ করতে করতে গেয়ে থাকেন তার নিজের দেশের শ্রমিকেরা। তাঁর
ক্যালিপসো অ্যালবাম আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল শ্রোতাদের মহলে। জ্যামাইকার সংগীতকে এক
বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করেছে। বিক্রি হয়েছিল দশ লক্ষ কপি এক লপ্তে। তাঁর জনপ্রিয়
গানের মাঝে আছে ‘ কলায় বোঝাই আমার এই নাও/ হে মহাজন হিসেব মেলাও/ রাত শেষ হল সূর্য উদয়/
ঘরে ফিরবার হয়েছে সময়’। ‘সূর্যের দ্বীপে আমার গ্রাম/ সাত পুরুষের ধন আমার/
বাপ-পিতেমোর গায়ের ঘাম / দিয়ে গড়া এই খেত-খামার’। ‘ আহা পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয় / যেথা সময় থমকে থামে
বটের ছায়/ সন্ধ্যাদীপ জ্বালে তারার টিপ/ কত ফুলের গন্ধে মোর মন মাতায় / হায় কোন সুদূর সেই স্বপ্নপুর/
মোর মন যে গায় ঘরে ফেরার সুর/ মোর পথ চেয়ে আজও
সেই মেয়ে/ বুঝি স্বপ্নগুলি বোনে গান গেয়ে’ ---।
ক্যারিবিয়ান পরিবারে
জন্ম নেওয়া বেলাফন্টে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ যিনি এমি পুরস্কার জিতে ছিলেন। প্রথম
সংগীত শিল্পী যার এ্যালবাম দশ লক্ষ বিক্রি হয়েছে। তাঁর
জনপ্রিয়তা আর তাঁর মানুষের জন্য কর্মের উদ্যোগ তাঁকে মার্টিন লুথার কিংয়ের সান্নিধ্যে
পৌছে দিয়েছিল।
কেবল গান নয়। অভিনয়
নয়। অর্থ উপার্জন নয়। আশৈশব
অন্তরে বহন করা সামাজিক অবহেলা উপেক্ষা অপমান নির্যাতন আর দারিদ্র্যের যে সামাজিক রূপ
তিনি দেখেছেন সয়েছেন তারই অবসানের জন্য সংগ্রাম হয়ে উঠল তাঁর প্রধান কাজ। তিনি
সংগ্রাম করেছেন বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আর্থিক
অসাম্যের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে। দুর্গতদের
পাশে থেকেছেন তাদের আপন জন হয়ে। মানুষের ভালোবাসা তাঁকে এতোটাই সাহসী করেছিল যে জন্য জর্জ বুশকে
বলতে পেরেছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী। ট্রাম্প
প্রশাসনকে চতুর্থ রাইখ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। নিজের
সম্পর্কে তাঁর কথা, আমি শিল্পী থেকে সমাজকর্মী হইনি। সমাজকর্মী
থেকে শিল্পী হয়েছি।
এমনটাই ছিলেন হ্যারি বেলাফন্টে। বেঁচে ছিলেন ছিয়ানব্বই বছর। এই পৃথিবীর জল মাটি আলো বাতাসে গড়া মানবদেহ। মেধা তাঁর পুষ্ট করেছেন মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রামী ঐতিহ্যের রসদ থেকে। ইতিহাসের অনন্তকালের মাঝে ছিয়ানব্বই বছর সময় আলাদা ভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। যেখানে লেখা আছে মানুষের দ্বারা মানুষের নির্যাতন আর তার প্রতিরোধের কাহিনি।
Comments
Post a Comment