প্রথা ভাঙা রবীন্দ্রনাথ

বিমলকান্তি দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথের মাঝে একটা প্রথা ভাঙা প্রতিবাদী বৈশিষ্ট্য ছিল সাধারণ ভাবে সেটার চর্চা হয় না এর একটা কারণ আমার মনে হয়  চর্চা করলে যে দায় নিতে হয় এটা আমরা জানি আর সে কাজে রাজি নই বলেই এড়িয়ে যাওয়া  

দ্বিতীয় কারণ ভাত রুটি আর মকানের আয়োজন করতেই আমাদের দিনের বেশি অংশটা ক্ষয়ে যায়। মৃত্যুর পর স্বর্গসুখের যে আকাঙ্ক্ষায় সংসার করা মৃত্যুর আগেই তার একটু আস্বাদ পেতে চাওয়া কিছু দোষের হতে পারে না। দিনের শেষে ক্লান্ত দেহ শয্যাস্বর্গের দিকে এগিয়ে যায়। আর সেই স্বর্গ ধরণীতল থেকে মাত্র দেড়-দু ফুট  উচ্চতায় অবস্থিত। ফলে আমরা তখন পৃথিবীর বাইরে কল্পলোকের বাসিন্দা। ওখানে পাঁচ সাত ঘণ্টা সুখে বিচরণ করে সকালে মর্তে অবতরণ। এ ভাবে প্রতিদিন স্বর্গ মর্তে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে সংস্কৃতি চর্চার জন্য দিনের ভান্ডে সময়ের অবশেষ কিছু প্রায় থাকে না।

রবিঠাকুরের জীবনের প্রস্তুতি পর্ব থেকে অন্তিম পর্ব পর্যন্ত শুধু প্রথাবিরোধী  অংশগুলোর উপর নজর সীমীত করে দেখবার মতলবে এই লেখা  

কবিতা রচনা দিয়ে শুরু। নিজেই অনুমান করেছেন, শ্রোতা বা পাঠকেরা বিশ্বাস করবেন না, ওইটুকু বালকের এমন লেখা হতে পারে। তাই ছদ্ম নামে লেখা শুরু করলেন। প্রচলিত ভাব ছন্দের এমন নিপুন বিন্যাস অবিশ্বাস্য। বালকের মাপে জ্যাঠামি হতে পারে। কবিতায় তাঁর প্রথম প্রথাবিরোধিতা। শৈশবে পরিচিত হয়েছেন মধুসূদনের রচনার সঙ্গে। নতুন কাব্যধারা। ভাব ছন্দ ভাষা সকল অঙ্গে বাংলার জন্য অন্য রকমেরম্লেচ্ছ সংস্কৃতির অনুসারী নবীন কবির মনে যে অভিঘাত তয়ের করেছে তার প্রকাশ করেছেন মধুসূদনের সমালোচনা করে। রোয়াকের ভাষায় বললে ‘একেবারে ধুয়ে দিয়েছেন’উঠতিযৌবনের যা স্বভাব। দম্ভ বা ঔদ্ধত্য এমনি ভাষায় তাকে প্রকাশ করা যায়। আবার পরবর্তীকালে গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন এমন প্রথাও বিরল আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির সমাজে।

বাংলা কাব্য বলতে ছিল স্বর্গের দেবদেবী আর পুরাণের কাহিনির বর্ণনা। রবীন্দ্রনাথ তাকে নামিয়ে এনেছেন নিচু তলার মানুষের জীবন যাপনের বর্ণনাতে। তাঁর প্রথাভাঙা সত্তার সব চেয়ে বড় অবদান তাঁকে বিরোধীতা করে একদল তরুণ কবির আবির্ভাব হল বাংলা সাহিত্যের দুনিয়ায়। তিনি তাদের সরিয়ে দিলেন না। বরং নিজেকে মিলিয়ে নিলেন তাদের উপযোগী করে। এই না আমাদের বর্তমান বাংলা সাহিত্যের চেহারা। উঁচু নিচু সকল স্তরে যার অবাধ বিচরণ। বিশ্বের সুধী সমাজে বন্দিত। নিচের সাধারণ মানুষের সমাজে চর্চিত।

তিনি ছিলেন একমাত্র কবি, প্রথার ধারা উপেক্ষা করে পৃথিবীতে ভারতের বাণী প্রচার করেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ভারতের সংস্কৃতির দূত বলা ভুল হবে কি।

কবির কাজ শুধু কাব্য চর্চা করা। এটাকেই তো প্রথা বলে জানি। এখানেও রবীন্দ্রনাথ প্রথা বিরোধী। দেশের পরাধীনতা তাঁকে চেতনায় পীড়া দয়। আঘাত করে তাঁর বিশ্ববোধেদেশ ভাগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। মানুষকে সচেতন করতে আর রাজার কানে সেই কথা পৌঁছে দিতে তাঁর রাখীবন্ধন উৎসব। সন্ত্রাসবাদ দেশের স্বাধীনতা লাভের জন্য সঠিক পথ নয়। বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের দেশপ্রেমকে শ্রদ্ধা করেছেন প্রকাশ্যে। সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে একা প্রতিবাদ করেছেন। পাঞ্জাবের বৈশাখী উৎসবে হত্যার ঘটনা তার প্রমাণ। একাই করেছেন। কোনো নেতাকে সঙ্গে পান নি। রাজার দেওয়া খেতাব রাজাকে ফিরিয়ে দিলেন। প্রথা বিরুদ্ধ এমন সাহস এই প্রথম দেখা গেল। স্বদেশী আন্দোলন আর জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তিনি ভিন্ন মত পোষণ করতেন। সে জন্য রাজনৈতিক দল আর কর্মীদের কাছ থেকে অনেক নিন্দা নিগ্রহ জুটেছে তাঁর। পিছিয়ে আসেননি বিশ্বের যে রাষ্ট্র যেখানেই পররাজ্য অধিকারে যুদ্ধ করেছে তিনি প্রতিবাদ করেছেন বদলে অনেক সময় নিন্দিত হয়েছেন

নিজের অর্জিত অর্থ খরচ করে মানুষের শিক্ষা স্বাস্থ্য আর কারিগরি কাজ এবং সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মতো কাজ করেছেন এর কোনো কাজই কবিদের জন্য প্রথাগত কাজের তালিকায় পড়ে না তিনি কবি এই পরিচয়েই স্বদেশে বা বিদেশে পরিচিত তাঁর এই প্রথাবিরোধী কাজে অনেক নিম্নমেধার মানুষেরাও তাঁকে অপমান করতে দ্বিতীয়বার ভাবেন নি

এত কিছুর পরে আমাদের জন্য নিশ্চয় কিছু করণীয় থাকে আর না করবার লজ্জা ঢাকতেই দেবতার আসনে তাঁকে বসিয়ে বাৎসরিক পুজোর আয়োজন কিছু উৎসবের কোলাহল মন্দিরের বিগ্রহের মতোই তিনি স্থির আর তাঁকে ঘিরে ভক্ত নামের ব্যক্তিদের উৎসবের জমকালো আয়োজন

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views