পুঁজিবাদ আপনাকে নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে
কোলেট শেড
ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড, স্কুল অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক
প্রবন্ধটি ২৩শে অগাস্ট ২০২১ সালে 'জ্যাকোবিন' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত; 'Capitalism is Making You Lonely'
মূল প্রবন্ধের লিঙ্ক: https://jacobin.com/2021/08/capitalism-lonliness-social-evaluation-health-socializing-time
বঙ্গানুবাদ: ডিলিজেন্ট পত্রিকা
করোনা ভাইরাস অতিমারীর অনেক আগে থেকেই আমরা একাকীত্বের ক্রমবর্ধমান সংকটের মধ্যে ছিলাম। সমস্যাটা সোশ্যাল মিডিয়া, মূলধারার সংস্কৃতি বা শহুরে জীবনযাপন নয় - সমস্যাটা পুঁজিবাদ।
একাকীত্ব একটি বিশ্বব্যাপী সংকট। ‘ব্রিটেন’স ক্যাম্পেইন টু এন্ড লোনলিনেস’ অনুসারে, ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি “ইংল্যান্ডে মাঝে মাঝে বা প্রায়ই একাকীত্ব” বোধ করেন। ২০১৯ সালের একটি মতগ্রহণে দেখা গেছে যে ২০০০ পরবর্তী প্রজন্মের ২২ শতাংশ জানিয়েছে যে তাদের “কোনও বন্ধু নেই”। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী ইউরোপ থেকে ভারত থেকে লাতিন আমেরিকা পর্যন্ত অঞ্চলে ২০-৩৪ শতাংশ বয়স্ক ব্যক্তিদের একাকীত্ব প্রভাবিত করেছে। প্রাক্তন মার্কিন সার্জেন জেনারেল বিবেক মূর্তি ২০১৭ সালে সমস্যাটিকে একটি “মহামারী” বলে অভিহিত করেছিলেন, অর্থাৎ কোভিড-১৯ অতিমারী এবং এর পরিচারক লকডাউনের অনেক আগেই এবং এই অতিমারী-লকডাউন পুরো পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে।
একাকীত্বের সমস্যা শুধুমাত্র একটি আবেগগত সমস্যা নয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় আশি বছরের ব্যাপ্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে পরিবার, বন্ধুত্ব এবং সম্প্রদায় মানুষের স্বাস্থ্য এবং সুখের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের স্টাডি ডিরেক্টর এবং মনোরোগবিদ্যার অধ্যাপক ডঃ রবার্ট ওয়াল্ডিংগার বলেছেন, “আপনার শরীরের যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, তবে আপনার সম্পর্কগুলির প্রতি খেয়াল রাখাও এক ধরনের নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া”।
২০১৫ সালের একটি গবেষণায় মনোবিজ্ঞানী জুলিয়ান হোল্ট-লুনস্টাড দেখেছেন যে একাকীত্ব উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং বিষণ্নতার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। এই গবেষণা থেকে একটি বারংবার পুনরাবৃত্তি হওয়া তথ্য ফুটে ওঠে যে একাকীত্ব আপনার জন্য দিনে পনেরোটি সিগারেট খাওয়ার মতোই খারাপ।
এই তথ্যের প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য যে একাকীত্বের সংকট খুবই উদ্বেগজনক।
কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করেন। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ার দিকে আমি ফেসবুক, ইউটিউব এবং অন্যান্য সাইটে সময় কাটানো লোকেদের তাদের বাস্তব জীবনের বন্ধুত্বকে লালন করা বন্ধ করে দিচ্ছে কিনা বিষয়ক প্রচারিত নিবন্ধগুলি পড়তে শুরু করি৷ সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহার যেমন ক্ষতিকারক হতে পারে, বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার তেমন মানুষকে সংযুক্ত থাকতে সাহায্য করতে পারে – বিশেষ করে কোভিড-১৯ লকডাউনের মতো নির্দিষ্ট সময়ে। এবং ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা আছে, যা হল পুঁজিবাদ।
একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, অনেকের কাছে পরিবারের দেখাশোনা করার এবং বিদ্যমান বন্ধুত্ব বজায় রাখার সময় নেই — নতুন সম্পর্ক স্থাপন এবং তা লালন-পালন করার প্রসঙ্গ নয় বাদই দিলাম। যখন আপনি উদাহরণস্বরূপ, একাধিক কাজ করেন (প্রায়শই অনিয়মিত শিফটের মধ্যে দিয়ে), যাতায়াত করেন, বাচ্চাদের এবং পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা করেন, কিংবা রান্না করা, মুদি দোকানে যাওয়া, কাপড় কাচার মতো মৌলিক কাজ করেন, এবং কখনও কখনও এই সব কাজ একসাথে করেন, তখন লোকেদের সাথে দেখা করার জন্য সময় বের করা কঠিন। সামাজিক সময় অগত্যা করণীয় তালিকার নীচে চলে যায়। বিনামূল্যে বা সস্তায় সামাজিক সময় কাটাতে পাবলিক স্পেসগুলিও ক্রমশ বিরল হয়ে যাচ্ছে এবং যখন পকেটে টান থাকে, তখন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই অগ্রাধিকার পায়৷ এই কারণগুলো এটা বোঝায় যে ব্যস্ত সামাজিক জীবন ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের জন্যই সংরক্ষিত হয় যারা তা উপভোগ করার সামর্থ্য রাখে।
অবশ্যই, আপনার সামাজিকীকরণে সময় ব্যয় করার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য অনেকগুলি প্রচলিত উপায় রয়েছে। আপনি আপনার সময় পরিচালনার দক্ষতা উন্নত করতে পারেন, লোকেদের সাথে দেখা করার জন্য নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করে রাখতে পারেন এবং পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত না হলে আবার পরিকল্পনা করার পথ সদা অনুসরণ করতে পারেন। আপনি কোনও খেলাধুলোর সংস্থা, ধর্মীয় গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে নতুন লোকেদের সাথে মেলামেশা করতে পারেন। “একটা ক্লাবে যোগ দিন”-এর বিভিন্ন রূপ কম একাকী বোধ করার উপায়গুলির তালিকার মধ্যে আদর্শ।
কিন্তু এগুলি হল একটি প্রায়শই যৌথ সমস্যার ব্যক্তিগৎ সমাধান। বাস্তবে একটি দিনে মাত্র কয়েক ঘন্টাই থাকে এবং বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে সেই ঘন্টাগুলির বেশিরভাগই কোনও না কোনও ধরণের শ্রমের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে যায়, অল্প সময় - এবং অল্প শারীরিক ক্ষমতা - বন্ধুত্বের জন্য অবশিষ্ট থাকে। কাউন্সিলের বাজেটে বছরের পর বছর কাটছাঁট করার ফলে যুব কেন্দ্রের মতো জায়গাগুলি উদ্বেগজনক হারে বন্ধ হতে দেখা যাচ্ছে, “ক্লাবগুলির” জন্য জায়গাও বেশি করে কমে আসছে।
পুঁজির বিচরণ যেভাবে দীর্ঘস্থায়ী সম্প্রদায়গত বন্ধনকে ব্যাহত করেছে তার সাথে আরেকটি সমস্যা জড়িত। মফঃস্বল ও শিল্পোত্তর শহর থেকে পুঁজি পালিয়ে গেছে। এই জায়গাগুলির তরুণরা ভাল চাকরি খোঁজার জন্য লন্ডন বা নিউ ইয়র্কের মতো পুঁজির কেন্দ্রগুলিতে নিজেদেরকে টেনে নিয়ে যায়।
বড় শহরে চলে যাওয়া মানেই বিচ্ছিন্নতা নয়। প্রকৃতপক্ষে, অনেক এলজিবিটি লোকের জন্য, প্রধান শহুরে কেন্দ্রগুলি এমন জায়গা যেখানে তারা প্রথমবারের মতো সত্যিকারের নিজ সম্প্রদায়ের সন্ধান করতে পারে। কিন্তু বিপুল জনসংখ্যার বহিরাগমন, যারা চলে যায় এবং যারা থেকে যায় তাদের বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা রাখে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে, সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতা বিপরীতভাবে ঘটে। শহরের কেন্দ্রস্থলে বেড়ে ওঠা মানুষদের বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে নিম্ন পরিবেশে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা হয়তো তাদের নতুন সম্প্রদায়ের নতুন লোকেদের সাথে মেলামেশা করতে পারে, কিন্তু বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে একটি প্রজন্মের মধ্যে তৈরি হওয়া বন্ধনগুলি কখনই প্রতিস্থাপন করা যায় না।
সময় এবং স্থানের সমস্যার বাইরে, চরম অসমতা প্রকৃত সম্পর্ককে কঠিন করে তোলে। ‘দ্য ইনার লেভেল’-এ, মহামারী বিশেষজ্ঞ কেট পিকেট এবং রিচার্ড উইলকিনসন লিখেছেন যে মানুষ “সামাজিক-মূল্যায়নমূলক হুমকি”-র প্রতি দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখায়, যা অন্য লোকেরা কি ভাবছে সেই ভয় হিসাবেও পরিচিত। অর্থনৈতিক বৈষম্যের মাত্রা যত বেশি হবে, আমরা সামাজিক মর্যাদার জন্য তত বেশি আকুল হব এবং শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকব। কিন্তু সুস্থ সম্পর্কের জন্য পারস্পরিক দুর্বলতা এবং বিশ্বাসের প্রয়োজন: যা উল্লিখিত সমস্যাগুলির ঠিক বিপরীত।
আমরা যদি কম একাকী সমাজ পেতে চাই, তাহলে আমাদের মানবিক চাহিদা - এবং মানবিক সম্পর্কগুলি – দাবীসমূহের কেন্দ্রে রাখতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থার অধীনে এটি ঘটবে না।
Comments
Post a Comment