“রাষ্ট্র শিখছে” নাকি “আন্দোলনকারীরা শিখছে” নাকি উভয়ই? ভাঙর আন্দোলনের ক্ষেত্রে শাথে-র ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণ কাঠামো

শংকর

[মূল রচনা "Learning State" or "Learning Agitators" or Both? Sathe's Flawed Framework to Analyze the Bhangar Movement" রেড স্টার পত্রিকার মে ২০২৩ সংখ্যায় (Volume 24 Issue 5) প্রকাশিত। অনুবাদ: সুমিত ঘোষ]

‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-তে সাম্প্রতিক প্রকাশিত ভাঙর আন্দোলনের উপর একটি একাডেমিক স্টাইল গবেষণাপত্র (দ্য স্টোরি অফ ল্যান্ড অ্যাকুইজিশান ইন ভাঙর: আর থিংস চেঞ্জিং?/ধনমঞ্জিরি শাথে/ই.পি.ডব্লিউ/৬ই মে, ২০২৩) সম্পর্কে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। এটা লক্ষণীয় যে লেখক অনেক ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করেছেন, বেশিরভাগই শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক, এবং তাঁর পেপার তৈরির প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সংবাদপত্র ও জার্নালে প্রকাশিত মিডিয়া রিপোর্ট এবং নিবন্ধগুলি পড়েছেন, তবে, সি.পি.আই(এম.এল)-রেড স্টারের সাথে যোগাযোগ করেননি, যে দলটি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। সম্ভবত, তিনি আমাদের পার্টির দ্বারা প্রকাশিত পুস্তিকাগুলি পড়েননি যা তাঁকে আন্দোলন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য এবং সংগ্রামের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পৌঁছে দিতে পারত কারণ তিনি তাঁর পেপারে সেই পুস্তিকাগুলির উল্লেখ করেননি। 


তাঁর পেপার খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে তিনি একটি ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোর উপর ভিত্তি করে একটি পূর্বকল্পিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, যেন তাঁর এটা লক্ষ্য ছিল এটা প্রমাণ করার যে আমাদের দেশের কৃষকরা তাদের জমি বিক্রি করতে খুব ইচ্ছুক যদি এর জন্য তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় এবং যদি রাষ্ট্র (পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে) যথাযথ মর্যাদার সাথে প্রক্রিয়াটির পরিচালনা করে। তিনি সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের মতো জমি দখল বিরোধী আন্দোলনের কাঠামোতে ভাঙর আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। তাই তিনি এই সমস্ত আন্দোলনকে একই বন্ধনীতে রেখেছেন যদিও ভাঙর আন্দোলন কেবল জমি বাঁচানোর আন্দোলন ছিল না, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিল। 


একটি ভিন্ন আন্দোলন


 সিঙ্গুরে সরকার প্রায় এক হাজার একর এবং নন্দীগ্রামে দশ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করেছিল। যাই হোক, ভাঙরে সরকার সাবস্টেশনের জন্য মাত্র ১৩.৫ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। প্রকল্পের নাম ছিল “রাজারহাট-পূর্ণিয়া ৪০০ কেভি ডিসি লাইন”। অতএব, এটা স্পষ্ট যে লাইনের দক্ষিণ প্রান্তটি অবশ্যই কলকাতার কাছে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার রাজারহাটে অবস্থিত। এই পাওয়ার করিডোর স্থাপনের পরিকল্পনাটি ২০১২ সালে নয় বরং ২০১০ সালে প্রথম ভাবা এবং চূড়ান্ত করা হয়েছিল৷ শাথে তাঁর গবেষণাপত্রে বলেছেন, “২০১২ সালে ভাঙ্গর ২-এ ১৩.৫ একর জমিতে রাজারহাট পাওয়ার গ্রিড সাবস্টেশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল”। এটা সঠিক নয়। মিথ্যা তথ্য দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন শাথে। প্রথমত, ভাঙরে নয়, রাজারহাটে প্রাথমিকভাবে সাবস্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। শাথে হয়তো জানেন না যে রাজারহাট উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় এবং ভাঙর দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত। দুটি স্থান দুটি ভিন্ন জেলায় অবস্থিত, যদিও এই দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ২০১০ সালে নেওয়া হয়েছিল। সি.পি.আই(এম.এল)-রেড স্টারের দ্বিতীয় পুস্তিকা (যা সরকারের সাথে চুক্তির পরে প্রকাশিত হয়েছিল) শাথেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারত যদি তিনি এটি পড়ে দেখতেন। একটি নিবন্ধ (ভাঙর মুভমেন্ট: দা প্রজেক্ট, এগ্রিমেন্ট অ্যান্ড মিসকন্সেপশন্স/শংকর) যা ওই পুস্তিকাটিতে স্থান পেয়েছে তা বলছে: "ই.আর.এস.এস-৫ (ইস্টার্ন রিজেন স্ট্রেংদেনিং স্কিম - ৫) নামে প্রকল্পটি ০৪.১০.২০১০ তারিখে চূড়ান্ত করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক, পি.জি.সি.আই.এল, ই.আর.এল.ডি.সি এবং ডব্লিউ.বি.এস.ই.টি.সি.এল-এর গুরগাঁওয়ের একটি যৌথ বৈঠকে" (অনুবাদ)।  


যাই হোক, ২০১০ থেকে ২০১৩-র অক্টোবর পর্যন্ত, রাজারহাটে জমি অধিগ্রহণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সরকার ব্যর্থ হয়। তাই ২০১৩ সালের শেষের দিকে, রাজ্য সরকার রাজারহাট থেকে ভাঙরে সাবস্টেশনের জায়গা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নাম অপরিবর্তিত ছিল। এবার স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেসের বাহুবলী, জমি মাফিয়া ও প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম রাজ্য সরকারের প্রকল্পকে রক্ষা করতে এল। যাই হোক, এখানে, কিছু তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। মাছিভাঙা এবং খামারআইট নামে দুটি গ্রামের মাঝখানের যে জমিটি বেছে নেওয়া হয়েছিল, সেটি ছিল একটি নিচু জমি (পরবর্তীতে, যখন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তখন আন্দোলনের পক্ষে থাকা বিজ্ঞানীরা একাধিকবার দেখিয়েছিলেন যে এত নিচু জমিতে যেখানে প্রচুর ভয়াবহ বন্যার ইতিহাস রয়েছে সেখানে একটি বহুমুখী পাওয়ার গ্রিড স্থাপন করা ছিল যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার) যা জমির মালিকরা স্বেচ্ছায় যুক্তিসঙ্গত মূল্যের বিনিময়ে দিয়েছিলেন। উপরে উল্লিখিত পুস্তিকার ভূমিকায় বলা হয়েছে:

“এলাকার সার্ভে মারফৎ আমরা অনুধাবন করতে পারি যে যদিও ৯০ শতাংশ জমির মালিক যাদের জমি সাবস্টেশনের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তারা স্বেচ্ছায় তাদের জমি দিয়েছিলেন এবং বিনিময়ে চেক পেয়েছিলেন,...” (অনুবাদ) 


তাহলে, আন্দোলন কেন শুরু হল? শাথে লিখেছেন, “উপরে উল্লিখিত অনুযায়ী, ১৭ই জানুয়ারী ২০১৭-এ পরিস্থিতি একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে উপনীত হয়, যখন ভাঙর ২-এর পোলেরহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে খামারআইট, মাছিভাঙা, টোনা এবং গাজীপুর গ্রামের বাসিন্দারা পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। তাদের জনসংখ্যা যথাক্রমে ৩,৫০০, ১২,০০০, ১৫,০০০, ৪,৫০০। যদিও এই চারটি ছিল প্রধান গ্রাম যারা জমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হতে চলেছিল, মোট ১২টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্থ হতে চলেছিল”। 


যাই হোক, এই বিবেচনাহীন বিবৃতিটি ব্যাখ্যা করতে পারে না কেন মাছভাঙা এবং খামারআইটের মধ্যেকার একটি ছোট অংশ “১২টি গ্রাম”-এর বাসিন্দাদের প্রভাবিত করবে! এখানেই শাথের পেপারের মূল সমস্যা। এই সম্পর্কে কিছু কথা বলি। স্থানীয় তৃণমূল নেতারা প্রাথমিকভাবে গ্রামবাসীদের বলেছিল যে শুধুমাত্র একটি পাওয়ার সাবস্টেশন স্থাপন করা হবে যা উল্লিখিত এলাকায় বৈদ্যুতিক সরবরাহের মান বাড়াবে। তবে খুব শীঘ্রই পাঁচ-ছয়টি গ্রামের অনেক জায়গায় কৃষি জমিতে একের পর এক টাওয়ার স্থাপন করা শুরু হয়। তখন গ্রামবাসীরা জানতে পারলেন যে অধিগৃহীত জমিতে শুধু একটি সাবস্টেশনই স্থাপন করা হবে না, অধিগৃহীত হয়নি এমন জমিতেও প্রকল্পের অংশ হিসেবে অসংখ্য বৈদ্যুতিক টাওয়ারও স্থাপন করা হবে। এর জন্য জমির মালিকরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না। টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে গ্রামবাসীর সাথে কখনো আলোচনা হয়নি। পি.জি.সি.আই.এল কর্তৃপক্ষ বা রাজনৈতিক দল কেউই গ্রামবাসীদের সাথে পুরো প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেনি। ধীরে ধীরে এটাও জানা গেল যে টাওয়ারে যে বৈদ্যুতিক লাইনগুলো বসানো হবে সেগুলো থেকে চার লাখ ভোল্টের মতো অস্বাভাবিক উচ্চ ভোল্টেজ সরবরাহ হবে। 


মাছিভাঙায় উচ্চ শিক্ষিত এবং ইন্টারনেট সচেতন যুবকদের একটি অংশ রয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কৃষি জমিতে উচ্চ ভোল্টেজ পাওয়ার লাইনের পরিণতি সম্পর্কে তারা ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করেছিল। ফলে প্রকল্পটি নিয়ে তাদের সন্দেহ হয় এবং ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে। গ্রামবাসীরা স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কাছে প্রশ্ন করলে তারা বলে, এই প্রকল্পের বিরোধিতা করলে খারাপ হবে। তারা ভয়ানক পরিণতির হুমকি দেয়। তাই, আন্দোলন ও প্রকল্পের বিরোধিতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে সর্বত্র যেখানে টাওয়ার স্থাপন করা হচ্ছিল। ৩রা নভেম্বর, ২০১৬তে পুলিশ মাছভাঙা ও খামারআইট থেকে ছয়জনকে (তিনজন পুরুষ এবং তিনজন মহিলা) গ্রেপ্তার করে। একই দিনে, পি.সি.সি সি.পি.আই(এম.এল) নামে পরিচিত আরেকটি সি.পি.আই(এম.এল) ফ্যাকশানের একজন কমরেড আমাদের ফোন করেন। তিনি আমাদের সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং আমাদের হস্তক্ষেপ করতে বলেন কারণ তারা এ কাজ করার মতো অবস্থায় ছিল না। কয়েকদিনের মধ্যে রেড স্টার নেতৃত্বের একটি দল সেখানে পৌঁছে যায়। ভাঙরের স্থানীয় রাজনীতিতে আমাদের হস্তক্ষেপের সেই সূত্রপাত। এর আগে আমাদের সেখানে একেবারেই কোনো সংযোগ ছিল না। তাই, শাথে আবার বিভ্রান্ত হলেন যখন তিনি বললেন যে সি.পি.আই(এম.এল) রেড স্টার “২০১৩ সালের আগে ভাঙর এলাকায় সক্রিয় ছিল”। 


আমরা যখন ভাঙরে যেতে শুরু করি, সংগ্রাম সংগঠিত করার আগে আমরা প্রথমে প্রকল্পটির উপর পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করেছিলাম। আমরা জানতে পেরেছিলাম যে শুধুমাত্র একটি উচ্চ ভোল্টেজ পাওয়ার করিডোর, পূর্ণিয়া-রাজারহাট, পরিকল্পনা করা হয়নি বরং আরেকটি পাওয়ার করিডোর, রাঁচি-রাজারহাট-নিউ রাঁচিও পরিকল্পনা করা হয়েছিল যা ইস্টার্ন গ্রিডের সবচেয়ে বড় ট্রান্সমিশন প্রকল্প ছিল। এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ই.আর.এস.এস-১৫ বলা হয়। এই প্রকল্পটি সি.ই.এ (সেন্ট্রাল ইলেকট্রিক অথরিটি)-র পরিকল্পনা বিভাগ দ্বারা ২০১৪-র জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এর পরে আরেকটি প্রকল্পও চূড়ান্ত করা হয়েছিল যার নাম ছিল ই.আর.এস.এস-১৮। এসব প্রকল্পে এই গ্রিডে প্রথমবারের মতো ৭৬৫ কেভি (সাত লাখ পঁয়ষট্টি হাজার ভোল্ট) লাইন চালু হতে যাচ্ছিল। এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ভাঙর ২-তে ২০টি গ্রামের নেহাতই কম নয় এমন এলাকা জুড়ে ১৬টি উচ্চ এবং খুব উচ্চ ভোল্টেজ পাওয়ার লাইন স্থাপন করা হবে। এই লাইনগুলির জন্য এই সমস্ত গ্রাম জুড়ে অসংখ্য টাওয়ার স্থাপন করা হবে।


প্রকল্পের একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়ার পর আমরা মানব ও অব-মানবিক দেহে, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের উপর এবং উল্লিখিত এলাকার সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপর উচ্চ ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক লাইনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করি। এই গবেষণার ফলাফল আমাদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে। তবে এটা খুবই মজার যে, এলাকার স্থানীয় লোকজন প্রথম থেকেই আমাদের বলে আসছিলেন যে এই ধরনের প্রকল্প মানুষের জন্য এবং কৃষির জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাদের শঙ্কা তাদের জীবনের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা থেকে এসেছিল যা আমাদের স্বাধীন গবেষণা দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছিল। তখন আমরা যে কোনো মূল্যে প্রকল্পের বিরোধিতা করার দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলাম। ৩০শে নভেম্বর, ২০১৬-এ, জীবন, জীবিকা, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষার জন্য কমিটি গঠিত হয়েছিল, যা জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি (জে.জে.বি.পি.আর.সি) নামে পরিচিত।


অতএব, ভাঙর আন্দোলন শুধু ভূমি আন্দোলন নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিল। অধিগৃহীত জমি জমির মালিকরা স্বেচ্ছায় দিয়েছিলেন। কিন্তু বহু উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক টাওয়ার স্থাপনের বিষয়টি সামনে এলে জমির প্রশ্নটি আরও জটিল রূপ নেয়। সরকার গ্রামবাসীদের বলেছিল যে টাওয়ারগুলির জন্য কোনও জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন নেই এবং এই লাইনগুলি তাদের মাথার উপরে স্থাপন করা হলে কোনও ক্ষতি নেই। গ্রামবাসীরা রাজি হয়নি। তারা যুক্তি দিয়েছিল যে সমগ্র বাস্তুতন্ত্র, যার উপর তাদের জীবন ও জীবিকা (কৃষি ও মৎস্যচাষ) নির্ভর করে, তা প্রকল্পটির দ্বারা গুরুতরভাবে প্রভাবিত হবে। তাই, জমির প্রশ্নটি বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ, জীবিকা এবং জীবনযাত্রার গুণমানের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির সাথে আন্তঃসম্পর্কিত হয়ে ওঠে। এটাই ছিল ভাঙর আন্দোলনের তাৎপর্য। আমাদের দেশে এই প্রথম জমি, বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার মানের আন্তঃসম্পর্ককে সামনে রেখে একটি তীব্র গণসংগ্রাম শুরু হয়েছিল। শাথে এই দিকটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন, আমরা জানিনা তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কিনা। তিনি লিখেছেন,

“এটা মনে হয় যে পরিবেশগত প্রশ্নগুলির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না (দত্ত মজুমদার, ২০১৭), কিন্তু এই প্রশ্নগুলি উত্থাপিত হওয়ার সাথে সাথে, আরও অনেক লোক - যারা জমি হারাবে না, কোন জমির মালিক ছিল না, জমির উপর নির্ভরশীল ছিল না, যে কোনো উপায়ে - আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছিল কিনা তা আমরা নিশ্চিত করতে পারি না তবে এটি বিক্ষোভকে একটি মাত্রা দিয়েছিল যার কারণে এটি কেবল স্থানীয় নয়, জাতীয় মিডিয়াও কভার করেছিল”। (অনুবাদ) 


তবে আমাদের গবেষণা কাজের সময় আমরা সারা বিশ্বে স্বাধীন বিজ্ঞানীদের দুই হাজারেরও বেশি প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেয়েছিলাম যারা আমাদের মাথার উপর উচ্চ এবং খুব উচ্চ ভোল্টেজ পাওয়ার লাইনের বিপজ্জনক প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিল। বর্তমান সময়ে মানবজাতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল সংকট বোঝার জন্য শাথে কিছু ক্ষুদ্র সাংবাদিকের প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করেছিলেন। এটা ইচ্ছাকৃত ছিল কি না বলা মুশকিল কিন্তু এই অজ্ঞতা তাঁকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত উপসংহারে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।


রাষ্ট্র শিখছে? 


আমাদের স্বাধীন গবেষণার সময় আমরা আরও জানতে পেরেছিলাম যে এই সামগ্রিক প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য উল্লিখিত এলাকা বা এমনকি কলকাতা শহরের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন করা ছিল না। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য সহজতর করা। আমি আমাদের উপরে উল্লিখিত পুস্তিকা থেকে একটি দীর্ঘ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করতে চাই:


“অতএব, এন.আর.পি.সি, নয়াদিল্লিতে ২৭.০৮.২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত স্ট্যান্ডিং কমিটি অন পাওয়ার সিস্টেম প্ল্যানিং অফ ইস্টার্ন রিজেন-এর ২০১৩-র দ্বিতীয় সভার আলোচনার সারাংশের রেকর্ড বলছে: ‘ডিরেক্টর (এস.পি অ্যান্ড পি.এ, সি.ই.এ) জানিয়েছেন যে ফারাক্কা এস.টি.পি.এস-জিরাট-সুভাষগ্রাম ৪০০ কেভি এস/সি লাইনের এল.আই.এল.ও সমেত পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে নির্মাণাধীন একটি ৪০০ কেভি সুইচিং স্টেশন ৫০০ মেগাওয়াট এইচ.ভি.ডি.সি শক্তি ভারত ও বাংলাদেশের গ্রিড দিয়ে সীমানা মারফৎ পাঠানো সম্ভব হবে এবং এর ফলে ফারাক্কা-বহরমপুর-জিরাট-সুভাষগ্রাম ৪০০ কেভি সেকশনে ওভারলোডিং এবং পশ্চিমবঙ্গের জিরাট ও সংলগ্ন এলাকায় কম ভোল্টেজের সমস্যা হতে পারে। তিনি আরও বলেছিলেন যে ই.আর গ্রিডের ফারাক্কা-জিরাট এবং ফারাক্কা-মালদা সেকশনে যানজট কাটিয়ে উঠতে পরিকল্পিত আন্তঃরাজ্য রাজারহাট ৪০০/২০০ কেভি এস/এস এবং রাজারহাট-পূর্ণিয়া ৪০০ কেভি ডি/সি লাইনের পশ্চিমবঙ্গের গোকর্ণ এস/এস-এ এল.আই.এল.ও করা একটি সার্কিট এবং ফারাক্কায় এস.টি.পি.এস সার্কিট ‘পাওয়ারগ্রিড’ দ্বারা ই.আর.এস.এস-৫ স্কিমের অংশ হিসাবে তৈরি করা হবে...’। 


এই নথির পাঠ্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে যে পশ্চিমবঙ্গে একটি মসৃণ লোড প্রবাহ আঞ্চলিক বিদ্যুতায়নের সম্প্রসারণের জন্য নয় বরং সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের সাথে বিদ্যুৎ বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান হারে কার্যকর করতে ব্যাক আপ প্রদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ভারত ইস্টার্ন গ্রিড এবং নর্থ-ইস্টার্ন গ্রিডের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে যদিও বহরমপুর-ভেড়ামারা করিডোর ইস্টার্ন গ্রিড থেকে বাংলাদেশের সাথে একমাত্র আন্তর্জাতিক আন্তঃসংযোগ। এটি একটি সর্বজনবিদিত সত্য যে বাংলাদেশের সাথে বিদ্যুৎ বাণিজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেন্ট্রাল পাওয়ার মন্ত্রক, সি.ই.এ এবং ইস্টার্ন রিজিওনাল পাওয়ার কমিটির ২০১৭-১৮ বার্ষিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্টে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৩-১৪ সালে ইস্টার্ন গ্রিড থেকে ১৪৯২ এম.ইউ বিদ্যুৎ আমদানি করেছে, যার বৃদ্ধির হার ৪.২% এবং গত বছর, অর্থাৎ ২০১৭-১৮-এ এই সংখ্যা ৩৯৬৪ এম.ইউ-তে পৌঁছেছে। তাই ই.আর.এস.এস-৫ (রাজারহাট-পূর্ণিয়া করিডোর) নামক প্রকল্পের অন্তরালে ফোকাস ছিল আন্তঃসীমান্ত আন্তঃসংযোগের জন্য বহরমপুরে আরও বেশি করে বিদ্যুৎ পাঠানো”। (ভাঙর মুভমেন্ট: দা প্রজেক্ট, এগ্রিমেন্ট অ্যান্ড মিসকন্সেপশন্স/শংকর) 


আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে অনেক সময় গ্রামবাসী ও জমির মালিকরা এলাকার প্রকৃত উন্নয়ন কাজের জন্য অনেক সময় তাদের জমি দিয়েছেন এবং কখনও কখনও তারা বিনা ক্ষতিপূরণে জমি দান করেছেন। কিন্তু যখন জনগণের প্রকৃত উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন উদ্দেশ্যে জমি ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তখন প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। অতএব, সমাজে বিরাজমান উন্নয়নের দুটি পরস্পর বিরোধী ধারণা রয়েছে। অতএব, এটি উন্নয়নের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ধারণার মধ্যে লড়াই। ভাঙরও ব্যতিক্রম ছিল না। ভাঙরের মানুষ যখন প্রকল্পের আসল রূপ জানতে পেরেছিল তখন তারা উঠে দাঁড়ায়, আওয়াজ তোলে এবং পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পের বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রাম গড়ে তোলে। রাষ্ট্র কি করতে পারত এবং কি শিখতে পারত? সর্বাধিক তারা যা করতে পারত যখন তারা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়েছিল যে এই ধরনের প্রতিরোধের মুখে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করা যাবে না তা হল হয় এটির আকার কমাতে পারত বা এটিকে স্থানান্তর করতে পারত। তারা অবশেষে একটি চমৎকারভাবে মাপা পদ্ধতিতে প্রকল্পটি ছোট করল। কিন্তু তার আগে তাদের বোঝাতে হত যে তারা প্রকল্পটি সেখানকার মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। প্রচণ্ড সংগ্রাম ছাড়া পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝানোর কোনো মাপকাঠি ছিল না।


আমাদের দেশের জনগণ চায় না এমন প্রকল্প কি রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে পারে? না, এটা সম্ভব নয়। কারণ সমস্ত সরকার এবং সামগ্রিক রাষ্ট্র আমাদের দেশের শাসক শ্রেণীর স্বার্থে কাজ করে যাদের স্বার্থ জনগণের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের সবগুলোই জনবিরোধী। এখন, গণতান্ত্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উপায়ে কি তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন একটি প্রকল্প সম্পর্কে জনগণকে বোঝানো সম্ভব? না, এটা সম্ভব নয়। এই সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া একটি মধ্যবিত্ত উদারপন্থী কল্পনা যা শুধুমাত্র একাডেমিকদের দ্বারা প্রশ্রয় পেতে পারে। তাহলে আমরা কেন দাবি করলাম যে সরকারের গণতান্ত্রিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিৎ ছিল? এটা একটা কৌশলী খেলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমরা জানতাম সরকার ও পি.জি.সি.আই.এল-কে আলোচনার টেবিলে টেনে আনতে পারলে প্রকল্পের আসল রূপ জনগণের সামনে উন্মোচিত হবে। এই সরল সত্যটা কি সরকার জানতো না? হ্যাঁ, তারাও তা জানত। তাই তারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে ইউ.এ.পি.এ-এর মত মামলা দিয়ে আমাদের কারাগারের পিছনে ফেলেছিল। তারা ভালো করেই জানত যে, গণতান্ত্রিক পরিবেশে আমাদের প্রচার ও বিতর্কের অনুমতি দিলে প্রকল্পের আসল রূপ উন্মোচিত হবে। যাই হোক, আমাদের উচ্চতর এবং নমনীয় কৌশল আমাদের সমস্ত রাজনৈতিক দল (তৃণমূল এবং বিজেপি ছাড়া), সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী এবং জনসাধারণকে আন্দোলনের সমর্থনে একত্রিত করতে সাহায্য করেছিল। আমাদের উপর কঠোর ইউ.এ.পি.এ মামলা দেওয়া সত্ত্বেও তারা আমাদের ছয় মাসের বেশি জেলে রাখতে পারেনি। এটিও ছিল আরেকটি নজিরবিহীন ঘটনা।


যাই হোক, এক সময়ে পরিস্থিতি সরকার এবং পি.জি.সি.আই.এল-এর পক্ষে এতটাই প্রতিকূল হয়ে গেল, তারা পি.জি.সি.আই.এল এবং জে.জে.বি.পি.আর.সি-র মধ্যে একটি খোলা বিতর্কের আয়োজন করতে বাধ্য হল। আমি আমাদের পুস্তিকাটিতে উল্লিখিত নিবন্ধ থেকে আরেকটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করতে চাই যখন সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণকে স্বেচ্ছায় জনবিরোধী প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করে তখন আসলে কি ঘটে তা দেখানোর জন্য। ই.পি.ডব্লিউ-তে নিবন্ধটির লেখক সম্ভবত ঘটনাটি সম্পর্কে জানতেন না।


“সেপ্টেম্বর মাসে যখন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক তাদের আশা প্রকাশ করেছিল যে সম্ভবত রাজ্য এবং জেলা প্রশাসন অল্প সময়ের মধ্যে সমস্যাটি সমাধান করতে সক্ষম হবে, তখন রাজ্য সরকার আরাবুলের নেতৃত্বের বিপরীত ফ্যাকশানের নেতা কাইজার আহমেদকে দিয়ে পরীক্ষা শুরু করে প্রকল্পের বিরোধিতা থেকে জে.জে.বি.পি.আর.সি-কে সরিয়ে আনার জন্য। কাইজার আহমেদ পি.জি.সি.আই.এল কর্মকর্তা, সরকারপন্থী বিজ্ঞানী বনাম জে.জে.বি.পি.আর.সি-এর বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি উন্মুক্ত বিতর্কের প্রস্তাব দেয়। কমিটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭-এ বিতর্ক সভাটি পোলেরহাট হাই স্কুলে অনুষ্ঠিত হয় জেলা প্রশাসন এবং ২০০ জন গ্রামবাসীর (উভয় পক্ষ থেকে একশত) উপস্থিতিতে। পি.জি.সি.আই.এল-এর এগারো জন প্রকৌশলী এবং কর্মকর্তা ছিলেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ নয়াদিল্লির অফিস থেকে এসেছিলেন এবং কলকাতার দুটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রকল্পের পক্ষে বিতর্কে। জে.জে.বি.পি.আর.সি মাত্র পাঁচজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল (এই নিবন্ধের লেখক সহ)। বিতর্কে সরকারী পক্ষ করুণভাবে পরাজিত হয় এবং কার্যত বিতর্ক সভা থেকে পালিয়ে যায় যখন জে.জে.বি.পি.আর.সি-র প্রতিনিধিরা একের পর এক প্রশ্ন উত্থাপন করছিল প্রকল্প এলাকায় আর.ও.ডব্লিউ সীমাবদ্ধতার বিষয়ে এবং জানাচ্ছিল পি.জি.সি.আই.এল কিভাবে পুরো প্রকল্প জুড়ে তার নিজস্ব নির্দেশিকা লঙ্ঘন করেছে। কাইজার আহমেদের শিবির সম্পূর্ণ ভেঙ্গে যায় এবং বিতর্কের পর তার অনুসারীরা জে.জে.বি.পি.আর.সি-তে যোগ দেয়। পি.জি.সি.আই.এল সেদিন আন্দোলনের প্রকৃত শক্তি উপলব্ধি করেছিল”। (অনুবাদ) 


বিতর্কে পি.জি.সি.আই.এল কর্মকর্তারা স্বীকার করেছিল যে দেশের কোথাও তারা তাদের নিজস্ব নির্দেশিকা অনুসরণ করেনি। সেটা আমরাও জানতাম। তাদের দ্বারা প্রণীত নির্দেশিকাটি শুধুমাত্র লোক দেখানো, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দেখানোর একটি নিছক হাতিয়ার যে পি.জি.সি.আই.এল আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করছে। কিন্তু বাস্তবে তারা আসলে যা চায় তাই করে। যখন এই সব ভাঙরের জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়েছিল তখন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। তাই ‘লার্নিং স্টেট’-এর নামে শাথে যা প্রস্তাব করেছেন তা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। রাষ্ট্র যে কেন এই সব মতবাদে খুব মনোযোগ দেয় না তা স্পষ্ট। 


আন্দোলনকারীরা শিখছে?


সরকার এবং জে.জে.বি.পি.আর.সি দ্বারা স্বাক্ষরিত চুক্তিটি দেখিয়ে শাথে “লার্নিং স্টেট”-এর উপসংহারে পৌঁছেছেন। তিনি নিম্নলিখিত বক্তব্যটি লিখেছেন:

“ভাঙরের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি ছোট জমির প্রয়োজন ছিল। ব্যানার্জী সংঘাত এড়াতে যত্ন নেবেন এমন আশা করা অমূলক ছিল না। কিন্তু তা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘটেনি, যদিও শেষ পর্যন্ত তাই হল। এই সব ঘটনা দেখায় যে সমসাময়িক ভারতে কৃষকদের আন্দোলন বোঝার জন্য একটি নতুন বিশ্লেষণ কাঠামো তৈরি করা দরকার। শাথে (২০১৭:২০১) “লার্নিং স্টেট-এর ধারণা তৈরি করেছে”। 


আবারও আমরা বলতে চাই যে শাথের এই মন্তব্যগুলি স্পষ্টভাবে দেখায় যে তিনি ভাঙর আন্দোলন মোটেও বুঝতে পারেননি, যা আমরা ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা করেছি। দ্বিতীয়ত, এটা বুঝতে হবে যে ভারতের কোথাও পি.জি.সি.আই.এল সংঘাত ও সহিংসতা ছাড়া কাজ করছে না। তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মামলা চলছে। এটা শুধু বাংলার সমস্যা নয়। শাথে একেবারেই ভুল। যদি তিনি পি.জি.সি.আই.এল নিয়ে কিছু গবেষণা করেন তবে তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন যে একটি পি.এস.ইউ কতটা কুখ্যাত হতে পারে। ভাঙরে স্পষ্টতই দুই পক্ষ ছিল। একটি ছিল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার, আমলাতন্ত্র, প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ ইত্যাদি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র। অন্যদিকে ছিল জে.জে.বি.পি.আর.সি-র প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে থাকা ভাঙরের জনগণ, অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি, সুশীল সমাজ, গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী এবং গণতান্ত্রিক জনগণ। নিঃসন্দেহে, সি.পি.আই(এম.এল) রেড স্টার জে.জে.বি.পি.আর.সি-কে নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু সে কখনও জে.জে.বি.পি.আর.সি-র উপর নিজস্ব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি। জে.জে.বি.পি.আর.সি-র সাধারণ বডি দ্বারা সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পূর্ণ গণতন্ত্রের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল। তদুপরি, এটি উল্লেখ করা উচিৎ যে অলীক চক্রবর্তী এবং শর্মিষ্ঠা চৌধুরী আন্দোলনের মুখ ছিলেন কিন্তু তাঁদের পিছনে একটি সুসংগঠিত দল ছিল যারা নীরবে, পদ্ধতিগতভাবে এবং সাহসের সাথে কাজ করেছিল। তাছাড়া সমগ্র ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এত জটিল ও উচ্চ পর্যায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া এক বা দুই ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হত না। 


রাষ্ট্র একটি সুনির্দিষ্ট পথের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে, যদিও প্রাথমিকভাবে তারা নেতৃত্বকে ছোট করে দেখেছিল। কিন্তু যখন তারা বুঝল তাদের পক্ষে আন্দোলন দমন করা সম্ভব হবে না তখনই তারা তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করে। তাদের উপলব্ধির পথ বোঝার জন্য আমি আমাদের পুস্তিকা থেকে কয়েকটি লাইন আবার উদ্ধৃত করতে চাই:


“২০১৮ সাল পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতির সাথে শুরু হয়েছিল। জে.জে.বি.পি.আর.সি বছরের শুরু থেকেই জনভিত্তির কাজ শুরু করেছিল। অন্যদিকে সি.ই.এ এবং কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক রাজ্য সরকারের সংস্থাগুলি এবং এল.টি.টি.সি (লং টার্ম ট্রান্সমিশন কঞ্জিউমার)-কে বলেছিল ফেব্রুয়ারী, ২০১৮-এর মধ্যে ভাঙর সাবস্টেশন থেকে ৭৬৫ করিডোর ডিলিঙ্ক করার বিষয়ে তাদের মতামত জমা দিতে৷ তবে, রাজ্য সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এবং এল.টি.টি.সি দ্বারা ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রের সাথে কোনও যোগাযোগ করা হয়নি৷ এই পরিস্থিতিতে মতামত দেওয়ার সময়সীমা রাষ্ট্রীয় সংস্থা এবং এল.টি.টি.সি-র জন্য ১৫ই মার্চ, ২০১৮ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল”। 


“মার্চের মধ্যে জে.জে.বি.পি.আর.সি পোলেরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে সামগ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। মাসের শেষে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল এবং মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। তবে, ৩১শে মার্চের মধ্যে রাজ্য এজেন্সি এবং এল.টি.টি.সি ভাঙর সাবস্টেশন থেকে ৭৬৫ করিডোর ডিলিঙ্ক করার বিষয়ে তাদের মতামত জমা দিতে পারেনি। এর মানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যাই হোক, কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক, সি.ই.এ এবং পি.জি.সি.আই.এল এই সত্যটি বুঝতে পেরেছিল যে জে.জে.বি.পি.আর.সি অপেশাদার আন্দোলনকারীদের একটি সংস্থা নয়; এটি ছোট কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হতে পারে। তাই, সরকার এবং পি.জি.সি.আই.এল যদি কোনো ধরনের আপোষমূলক সমাধানে না পৌঁছায় তাহলে এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংঘর্ষের সুযোগ তৈরি হতে পারে যা কোনো কাজে আসবে না। অতএব, অবশেষে ৪ঠা এপ্রিল, ২০১৮-য় কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক, সি.ই.এ এবং পাওয়ার সিস্টেম প্ল্যানিং অ্যান্ড আপ্রেইজাল ডিভিশান ২-এর যৌথ সভায়, ভাঙর সাবস্টেশন থেকে দুটি করিডোরের মধ্যে সংযোগকারী ৪০০ কেভি লাইনগুলিকে একতরফাভাবে মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল”। (অনুবাদ) 


এই সিদ্ধান্তের ফলে মূল প্রকল্পটি ছোট করা হয়েছিল এবং ১৬ লাইনের পরিবর্তে শুধুমাত্র ৪ লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই চারটি লাইনের মধ্যে দুটি লাইন ছিল ৪০০ কেভি এবং দুটি লাইন ছিল ২২০ কেভি। দুটি ২২০ কেভি লাইনের মধ্যে একটি লাইন মাটির নিচে স্থাপন করা হবে। তাই মাথা নত করতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। কারণ এটি মোটেও তাদের প্রকল্প ছিল না। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি যখন প্রকল্পের আকার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় তখন রাজ্য সরকারের পক্ষে আপোষমূলক প্রস্তাব দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। 


পি.জি.সি.আই.এল-এর পুরো ইতিহাস দেখায় যে কোম্পানিটি সারা দেশে এই পদ্ধতিতে কাজ করে। প্রথমত তারা তাদের আইনী এবং বে-আইনি সমস্ত অস্ত্র প্রয়োগ করে। তারপর তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। এই সময়ের মধ্যে যদি তারা প্রতিরোধ ভাঙতে পারে তবে তারা এগিয়ে যাবে, অন্যথায় তারা তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করবে। “লার্নিং স্টেট” বা এরকম কিছুই আসলে নেই। 


শাথে তাঁর উপসংহারের শেষের দিকে আরেকটি বিষয় তুলে ধরেন, যদিও তিনি তা পুরোপুরি মেনে নেননি। সেটি “আন্দোলনকারীদের শেখার” সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন: 


“তবে, লেখকের কাছে নির্দেশ হিসাবে এই পর্বের একটি বিকল্প পাঠ থাকতে পারে৷ এই পাঠে বলা হয়েছে যে, নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট সরকারের দেওয়া ক্ষতিপূরণ প্যাকেজের সাথে তৃণমূল সরকারের ভাঙরে দেওয়া প্যাকেজের মধ্যে কোনও বড় পার্থক্য নেই; বরং নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর এলাকায় তৃণমূল পার্টির অত্যন্ত কঠোর অবস্থান এবং ভাঙর আন্দোলনে সি.পি.আই(এম.এল) রেড স্টারের নেতাদের অনেক বেশি সহনশীল অবস্থানে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। সম্ভবত তৃণমূলের রাজনৈতিক স্বার্থ তাকে সমঝোতা এড়াতে বাধ্য করেছিল এবং তারা আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সি.পি.আই(এম.এল) রেড স্টারের এমন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না এবং তাই তারা একটি মীমাংসা করতে ইচ্ছুক ছিল”। (অনুবাদ) 


কিছু ভুল যুক্তি দিয়ে শাথে অর্ধহৃদয়ে এই বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেন। আমরা বিস্তারিত যাচ্ছি না। কিন্তু আমরা বলতে চাই যে রেড স্টার আসলে কি হিসাব করেছিল। এটি বোঝার জন্য, আপনাদের বুঝতে হবে কেন পি.জি.সি.আই.এল প্রকল্পটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার পরিবর্তে ছোট করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আসলে, তারা একটি সুযোগ নিয়েছিল। রেড স্টার বুঝতে পেরেছিল যে ১৬টির মধ্যে ১২টি লাইন প্রত্যাহার করে এবং প্রস্তাবিত চারটির মধ্যে একটি লাইন ভূগর্ভে স্থাপন করলে, সংগ্রামী এলাকার প্রায় সমস্ত গ্রাম উচ্চ ভোল্টেজ লাইনের নিচে বসবাসের ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে যাবে। খামারআইটের মাত্র একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব, কমিটি যদি আলোচনা ভঙ্গ করে এবং এই আংশিক বিজয়কে মেনে নিতে অস্বীকার করে, ভবিষ্যতে যখন আন্দোলন আবারও রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হবে, তখন সংগ্রামী সৈন্যদলের মধ্যম ও পিছনের অংশ হয়তো ততটা সমর্থন দেবে না যা তারা আগে দিয়েছিল। এবং যদি সত্যিই এটি ঘটে তবে আন্দোলনটি চূর্ণ হয়ে যাবে, এবং রাজ্য সরকার ভাঙরের উপর ১৬টি লাইনই চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে যা ভবিষ্যতে আরও অনেক উচ্চ ভোল্টেজ লাইন চালু করার সুযোগ করে দেবে। সেই কারণেই সি.পি.আই(এম.এল) রেড স্টার প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিল। আসলে রেড স্টারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল ৮০ শতাংশ বিজয় মেনে নিয়ে নিজ রাজনৈতিক ভিত্তি ধরে রাখা। ইতিহাস আমাদের দলের সিদ্ধান্তের যথার্থতাই প্রমাণ করেছিল। 


উপসংহার


আমাদের দেশের গণআন্দোলনের ইতিহাসে ভাঙর আন্দোলন ছিল যুগান্তকারী। আন্দোলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে যা আরও অধ্যয়নের প্রয়োজন। যাই হোক, শাথে এটা না করে আমাদের দেশের কৃষকরা তাদের জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক তা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন যে স্বাধীনতার পর গত ৭৬ বছরে আমাদের দেশের শাসক শ্রেণী পরিকল্পনা করে একদিকে কৃষিকাজকে ব্যয়বহুল করে তুলেছিল এবং অন্যদিকে কৃষি উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য দেয়নি। এই জঘন্য এবং ক্ষতিকর প্রক্রিয়া কৃষকদের এমন এক কোণে ঠেলে দেয় যে এখন তাদের বেশিরভাগই তাদের জীবিকা পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক। যাই হোক, এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নয় বরং একটি সাবধানে তৈরি পরিকল্পনা যাকে সঠিকভাবে বলা হয় “আদিম সঞ্চয়ন”। মার্কস লিখেছিলেন যে এই আদিম সঞ্চয়নের ইতিহাস মানবজাতির ইতিহাসে রক্ত এবং আগুনের অক্ষরে লেখা আছে। অতএব, রাষ্ট্র যতদিন পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শ্রেণির শ্রেণী-শাসনের হাতিয়ার হিসেবে থাকবে ততদিন কোনো সংশোধিত রাষ্ট্র (“লার্নিং স্টেট”)-এর অস্তিত্ব থাকতেই পারে না।


[শংকর সি.পি.আই(এম.এল)-রেড স্টারের পলিটব্যুরো সদস্য।]


Picture Courtesy: Gauri Lankesh News

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার