প্রসঙ্গ জামাইষষ্ঠী

বিমলকান্তি দাশগুপ্ত 


এপার-ওপার জুড়ে দুই বাংলায় আজ জামাই ষষ্ঠীর উৎসব। বাংলা সৌর ক্যালেন্ডারের হিসেবে আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের চাঁদের তিথির ষষ্ঠ দিবস। আজকের দিনটি অরণ্যষষ্ঠী হিসেবেও পরিচিত। তবে জামাইষষ্ঠী নামেই এর পরিচয় বেশি।

বাংলায় আজকে ষষ্ঠী দেবী রূপে পুজো পা’ন। তার মূর্তিও গড়া হয় কোথাও কোথাও। সে মূর্তি মৃৎকারিগরের হাতে গড়া নান্দনিক মৃর্তি নয়। পুজোর দিন কাঁচা মাটির তাল বানিয়ে বাড়ির মহিলারা তয়ের করেন। মূর্তির আদল হল সামনের দিকে পা ছড়িয়ে বসে থাকা মায়ের মূর্তি। স্তন দুটি বেশ বড় আকারের। যেন অফুরন্ত দুধের ভান্ড। কোলে তার অনেক ছেলেপুলে। সঙ্গী তার দু’টি বেড়াল। একটির রং সাদা আর অন্যটির কালো। কালো বেড়াল ষষ্ঠীর বাহন। শুধু বাহনই বা বলি কেন। আজকের ভাষায় সিকিউরিটিও বটে। সে কথা ধরা আছে ষষ্ঠীর আখ্যানে।

মা ষষ্ঠীর পুজোয় দেওয়া ফল মিষ্টি খেয়ে নিয়েছিল গোপনে বাড়ির লোভী বৌ। বেড়াল সাক্ষী। শোধ নিয়েছিল বেড়াল এই দুষ্কর্মের। প্রসবকালে বৌয়ের সাত সাতটি বাচ্চা খেয়ে নিয়েছিল বেড়াল গোপনে। শেষে ষষ্ঠীর হাতে পায়ে ধরে তার পুজো করে তবে রেহাই। সন্তান ফিরে পেয়েছিল। এই ভাবে ষষ্ঠীদেবী পুজো আদায় করে ছাড়লেন ব্রাহ্মণ্য প্রভাবিত সমাজে। তার ভক্তরা হলেন প্রান্তবাসী জনগণ। সম্মান আদায় করবার এই কৌশল আজকের সমাজেও বর্তমান। বদল ঘটেছে এখন। দেবতার জায়গায় নেতা। প্রান্তবাসীরা যেখানে ছিলেন সেখানেই আছেন। বদল ঘটেছে শুধু সংখ্যায় যা বেড়েছে কয়েকশ’গুণিতকে। দরিদ্র জনগণ সম্পদ লাভের আশায় আজও ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করেন। তাদের কামনা, আরও সন্তান। সুস্থ সবল সন্তান, যে কি না দুঃখ দূর করবে।

ষষ্ঠীর পুজোর বিস্তর  নিদর্শন ছড়িয়ে আছে গ্রাম বাংলার স্থান নাম ষষ্ঠী তলার মাঝে। নেতাদের নজর পড়েনি এই দিকে। অথবা সাহস হয়নি নাম সংস্কারের।

মানব সভ্যতা যখন কৃষি প্রযুক্তিতে প্রবেশ করল, ষষ্ঠী দেবীর পুজো সেই কালের সৃষ্টি। উৎপাদন আর উৎপাদিত সামগ্রী সংরক্ষণ আর রক্ষার জন্য বাড়তি মানুষের প্রয়োজন এই আরাধনার পেছনের কাহিনি। “শতপুত্রের জননী হও” মায়েদের কাছে সেদিনের সমাজের এই আকাঙ্ক্ষার আড়ালে তার ইচ্ছা এবং চাহিদা লুকিয়ে আছে। আজকের উন্নত প্রযুক্তির যুগে ব্যক্তিগত ভোগ আর শোষণের যুগে এই পূজো অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু প্রান্তজনের সমাজে পরিবারে অধিক মানুষের প্রয়োজন আজও অব্যাহত। যেখানে একার শ্রম উৎপাদনে একা চলবার ক্ষমতাও দুঃসাধ্য। আর সে জন্য নগরে ছোট পরিবারে ষষ্ঠী যেমন টিকে আছেন অতীতের সুখ স্মৃতি হয়ে আবার প্রান্তজনের সমাজে প্রয়োজনের তাগিদেই মা ষষ্ঠীর আরাধনা হয়ে থাকে। নিষ্ঠার সঙ্গে আজও। বিসদৃশ হলেও যে ছবি সমাজের চোখসওয়া হয়ে গিয়েছে এত দিনে, তা হল রোজগেরে নিশ্চিন্ত মধ্যবিত্ত কর্মে ছুটির সুযোগ নিয়ে শাশুড়ীমায়ের আশীর্বাদ নিতে যান বেশ ঘটা করে। বিপরীতে মজুরানী মা নিজের দিনমজুরির কাজ সাঙ্গ করে কন্যা জামাতা আর সন্তানদের জন্য সাধ্যমতো কিছু আয়োজন করেন। তাঁর যে আরও সম্পন্ন স্বাস্থ্যবান মানুষের প্রয়োজন।            

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার