সুদানের গৃহ যুদ্ধের হাল হকিকত

সুরজিত মন্ডল 


২০২৩-এর এপ্রিল মাস থেকে সুদানে গৃহযুদ্ধ চলছে। দীর্ঘ দিন ধরেই সেখানে একটি সামরিক সরকার ক্ষমতাধীন রয়েছে। এই সামরিক সরকারে আবদেল ফাতেহ আল-বুরহান রাষ্ট্রপ্রধান ছিল এবং তার সহকারী হিসেবে কাজ করছিল মোহাম্মদ হামদান দাগালো হেমেদতি। বুরহান এবং হেমেদতি সুদানের দুটি আলাদা সেনাবাহিনীর নেতা। ২০২৩-এর ১১ই এপ্রিল দেখা যায় যে দাগালো হেমেদতি এবং তার সেনাবাহিনী অর্থাৎ RSF (Rapid Support Forces) সুদানের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ করছে এবং দখল নিচ্ছে। বর্তমানে যুদ্ধের যা পরিস্থিতি তাতে সারা দেশের খুব অল্প অংশই হেমেদতির দখলে রয়েছে। বাকি দেশটি এখনো আবদেল ফাতেহ আল-বুরহানের দখলেই রয়েছে। বুরহানই বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান এবং তার সেনাবাহিনী, যাকে সুদানের মূল সেনাবাহিনী রূপে ধরা হয়, তার নাম হল SAF (Sudanese Armed Forces)। Sudanese Armed Forces এই মুহূর্তে Rapid Support Forces-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। 

এই গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে গেলে আমাদের সুদানের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। লক্ষনীয়, সুদানে বহু আফ্রিকান এবং আরবের উপজাতিরা বসবাস করে এবং আরবের উপজাতিরা আফ্রিকান উপজাতিদের উপর বারবার প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে, যার ফলে বারবার গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে সুদান। ১৯৫৬ সালে সুদান যখন ইংরেজ এবং মিশরীয়দের যৌথ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে অর্থাৎ স্বাধীন হয়, তারপর থেকে এই দেশে মোট ১৫ বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে! এর বহু কারণ রয়েছে। জানজাউইদ নামে একটি সৈন্যবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই সুদানে উপস্থিত রয়েছে এবং এদেরকে মূলত সুদানের আরব উপজাতিদের একটি যৌথ সেনাবাহিনীর রূপে গণ্য করা হয় যারা বর্তমানে সুদান, ছাড, ইয়েমেন এবং লিবিয়ায় কাজ করছে। সুদানে তারা ল্যান্ড মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। লিবিয়ায় এরা একসময় সেখানকার একনায়ক মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফির ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে কাজ করত। ১৯৮৮ সালে ছাড লিবিয়াকে যুদ্ধে পরাস্ত করে নিজেদের স্বতন্ত্রতা জাহির করলে গাদ্দাফি এই জানজাউইদ সৈন্যবাহিনীকে ছাডে বেশি কার্যকর হতে নির্দেশ দেয়, সেখানকার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেতর থেকে নষ্ট করে দেবার জন্য। সুদানে এই জানজাউইদ বাহিনীর বর্তমান সংস্করণ RSF। RSF-এর প্রধান নেতা হেমেদতি দেশের বিভিন্ন সোনার খনি নিজের দখলে রেখেছে। 

সুদানে উমর আল বশিরের একনায়কতন্ত্র ক্ষমতাধীন থেকেছে ১৯৯৩ থেকে ২০১৯ অবধি। এই সময়ে বশির বিভিন্ন আরবের উপজাতিগুলির পক্ষে দাঁড়ায় যার ফলে দারফুর অঞ্চলের উপজাতিরা, যারা আরবের পূর্বতন অধিবাসী ছিল না বরং অনেকেই আফ্রিকার উপজাতি বলে গণ্য হয়, তারা অভ্যুত্থান করে। অভ্যুত্থানের প্রধান কারণ, তাদের উপর সরকারি রোষ এবং সরকার কর্তৃক তাদের মৌলিক অধিকারগুলি খর্ব করা। দারফুরের এই উপজাতিরা একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা করে একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট তৈরি করে, যার নাম Sudan Revolutionary Front বা SRF। SRF-এর সঙ্গে উমর আল বশিরের সরকারের যুদ্ধ লেগে যায়। এই গৃহযুদ্ধে বশির RSF-কে SRF-এর বিরুদ্ধে চালিত করে। এই যুদ্ধকে 'দারফুর যুদ্ধ' বলা হয় যা ২০০৩ থেকে ২০২০ অব্দি চলেছিল। বশির নিজে এই যুদ্ধ চলাকালীন হেমেদতির সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং ২০১৭ সালে RSF-কে একটি পৃথক স্বতন্ত্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর স্ট্যাটাস দিয়ে দেয়। দারফুর যুদ্ধ চলাকালীন বশিরের দিকের লোকজন অর্থাৎ Sudanese Armed Forces এবং Rapid Support Forces উভয়ই চীন, ইরান, রাশিয়া এবং সিরিয়ার দ্বারা সমর্থিত ছিল। এবং এই বাহিনী মূলত আফ্রিকান উপজাতিদের অধিকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। পরবর্তীতে RSF রাশিয়ার একটি প্রাইভেট মিলিটারি বাহিনী Wagner Group-এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। বশির RSF-কে ইয়েমেন এবং লিবিয়াতেও যুদ্ধে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে বশিরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পতন হয় কিন্তু সামরিক শাসন থামে না বরং Transitional Military Council প্রতিষ্ঠা করা হয়। অর্থাৎ দেশ মূলত সামরিক নেতাদের হাতেই থেকে যায়। এইরকম সময়ে RSF-এর নেতৃত্বে ২০১৯ সালে সুদানের রাজধানী খার্তুম অঞ্চলে গণহত্যা শুরু হয় কারণ সেখানকার মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষে লড়াই করছিল। কিন্তু সারা দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে তারা Transitional Sovereignty Council প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন আবদাল্লা হামদোক এবং এই সরকার ২০২৩ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া চালু করার আশ্বাসও দিয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে আবার সামরিক অভ্যুত্থান হয় যার ফলে এই Transitional Sovereignty Council-এর পতন হয় এবং দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষিত হয় Sudanese Armed Forces-এর আবদেল ফাতেহ আল-বুরহান এবং তার সহকারী বা ডেপুটি হিসেবে কাজ করতে থাকে Rapid Support Forces-এর মোহাম্মদ হামদান দাগালো হেমেদতি। হেমেদতির বাহিনী ১১ই এপ্রিল ২০২৩-এর অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বর্তমান সুদানের গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। এই পুরো ঘটনা থেকে এটাই বোঝা যাচ্ছে, আসলে সুদানে যে গৃহযুদ্ধ চলছে তাতে বাদী-বিবাদী উভয় গোষ্ঠী আসলে সেনাবাহিনীর দুটি অংশ এবং উভয়ই গণহত্যার জন্য দায়ী। ফলে উভয় বাহিনীকেই অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধ করে তাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের হাতে নতুবা সুদানের উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। 

আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে হেমেদতি বাহিনী আন্তর্জাতিক স্তরে চীন, রাশিয়া, ইরান, সিরিয়ার দ্বারা আর্থিক সাহায্য পায়। উল্টোদিকে বুরহানের Sudanese Armed Forces  চীন, ইরান, পোল্যান্ড, রাশিয়া, তুর্কির সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে রেখে নিজেদের আর্থিক চাহিদাগুলি পূরণ করে চলেছে। ফলে সুদানের গৃহযুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে চীন, রাশিয়া, তুর্কির যে একটা নির্দিষ্ট প্রভাব বলয় রয়েছে উভয় সেনাবাহিনীর মধ্যেই তা স্পষ্ট। Sudanese Armed Forces নিজে কিভাবে তৈরি হয়েছে সেটা দেখতে চাইলে লক্ষ্য করা যাবে যে তা ব্রিটিশদের হাতে তৈরি। ফলে বর্তমানের উভয় সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের দ্বারাই যে সুদানের উভয় গোষ্ঠী প্রভাবিত তা স্পষ্ট। 

সুদানের প্রধান কমিউনিস্ট পার্টি হল Sudanese Communist Party এবং তারা ২০০০ সাল থেকে National Consensus Forces-এর অংশ যা মূলত ডান এবং বাম উভয় দিকের বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের সমষ্টি। তারা সামগ্রিকভাবে দেশে সামরিক শাসন ও একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে সওয়াল করছে। ১৯৭১ সালে Sudanese Communist Party-এর নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং একনায়ক জাফর নিমাইরিকে ক্ষমতাচ্যুত করে চার দিনের জন্য সামরিক নেতারা ক্ষমতাধীন হয় কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যেকার পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে চার দিনের মাথায় তাদের এই ক্ষমতা দখল বিফল হয়। বামপন্থীদের সামরিক নেতা হাসান আল আট্টা সহ অন্যান্য শীর্ষ কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যা করা হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে যায়। নিমেইরি ১৯৮৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হলে আবার আস্তে আস্তে Sudanese Communist Party তার কার্যকলাপ শুরু করে। বর্তমানে এই পার্টি সমস্ত ধরনের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সওয়াল করে আসছে। সুদানের ইতিহাস এটাই বোঝায় যে বামপন্থীরা ক্ষমতা দখলে বিফল হলে কিভাবে সামরিক শাসন বিচ্যুত হতে পারে এবং তা জনগণের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। আরেকটি দিক হল, ইরাকের মতো সুদানেও কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা ক্ষমতা দখল করেও আবার পরাজিত হয়েছিল। শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে সাংগঠনিক বিস্তারের তুলনায় সৈন্যবাহিনী এবং দেশের আমলাতন্ত্রের উপর অতি নির্ভরশীলতা যে কি ভয়াবহ ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে পারে, সুদান সেই ইতিহাস বহন করছে। আমরা আশা রাখব যে সুদানের মানুষ তাদের বিপ্লবী চেতনা এবং সমাজ পরিবর্তনের প্রত্যাশায় যে নিরন্তর প্রতিবাদ কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে তার পরিণতিতে সুদানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে আগামীদিনে।

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার