ভবিষ্যৎ হিন্দুরাষ্ট্রের ‘বর্তমান’ ইমেজ

সায়ন্তন দত্ত 

সেঙ্গোল হাতে প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ভবনে প্রবেশের ভাইরাল হওয়া ইমেজ

বিশালাকার প্রাসাদোপম স্থাপত্যের সামনে ধূ ধূ করা রাজপথ, যার উপর দিয়ে হেঁটে আসছেন সাদা ধুতি পাঞ্জাবী এবং ঘিয়ে রঙের জহরকোট-উত্তরীয় পরিহিত ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী। সারা দেশ দেখতে পাচ্ছে তাকে – টেলিভিশন ক্যামেরা তো বটেই, সরকারি দূরদর্শনের একাধিক ক্যামেরাপার্সন নানান অ্যাঙ্গেল থেকে ফলো করছে এই হেঁটে আসা টুকু। সরকারি লাইভ ইউটিউব সম্প্রচারের (DD INDIA নামের ইউটিউব চ্যানেল) ভিডিওটি যদি দেখি, দেখতে পাবো এই হেঁটে আসার মধ্যে অন্তত পাঁচবার ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল বদল হয়েছে – চেষ্টা করা হচ্ছে বিশালাকার এই নতুন স্থাপত্যের সামনে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হেঁটে আসাটুকু ফ্রেম বন্দী করে রাখতে। ফ্রেমে দেখতে পাচ্ছি ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের, বিউগল হাতে কিছু মিউজিশিয়ানদের; আর ক্যামেরা যেহেতু সবসময়েই উদ্দিষ্টের চেয়ে বেশী দেখে, তাই মাঝে মাঝে দেখে ফেলছি গদার আকৃতির টেলিফটো লেন্স হাতে লোকজনদের দৌড়াদৌড়ি করতে। গতকাল, অর্থাৎ ২৯শে মে-র এই ইমেজগুলো যারা সকালবেলা লাইভ দেখছিলেন, তাঁদের কারো কারো কাছে তখনও বোধহয় একটু একটু খটকা লাগছিল একটা জিনিস – প্রধানমন্ত্রী হেঁটে আসছেন, নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন হবে, মহত্মা গান্ধীর বিশাল আকারের মূর্তিতে মাল্যদান হবে – এসব তো চমৎকার ব্যাপার, কিন্তু এই ভিডিও-র সাউন্ডট্র্যাকে মন্ত্রোচ্চারণের মতো ক্রমাগত কী বেজে চলেছে? ‘সমাজতান্ত্রিক’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রীয় প্রতীক উদ্বোধনে ক্রমাগত ধর্মীয় মন্ত্রোচ্চারণ হয়ে চলবে কেন?

এর পর কি হয়েছে তা মোটামুটি আমাদের সকলের জানা – একের পর এক ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে সংসদ ভবনে প্রবেশের আগে প্রধানমন্ত্রী যজ্ঞে বসে রয়েছেন, সাদা-গেরুয়া চেলী পরিহিত পুরোহিতরা প্রায় রাজ্য অভিষেকের ঢঙে প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করে নিচ্ছেন, প্রায় বারোজন গেরুয়া চেলী পরিহিত তামিলনাড়ুর পুরোহিতকে সঙ্গে করে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভবনে প্রবেশ করছেন – এবং এই সব কিছুর মধ্যে বিরাট এক গুরুত্বের জায়গা পাচ্ছে, সেঙ্গোল নামের একটি লম্বা লাঠি – যাকে রাজদন্ড বলে প্রচার করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে ‘৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক হিসেবে এই লাঠিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। আমর আবারও, ইমেজের মাধ্যমেই দেখতে পাচ্ছি, ঐ বারোজন গেরুয়া পরিহিত তামিলনাড়ুর পুরোহিতের সামনে এই বিশেষ লাঠি-টিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন প্রধানমন্ত্রী।



 

আমরা যারা বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির সমর্থক নই, তাদের অনেকের কাছেই একের পর এক ভাইরাল হয়ে যাওয়া ছবিগুলো বেশ অস্বস্তিকর। কাল সকালে প্রথমবার যখন এই ছবিগুলো দেখেছি, তখন থেকেই ভাবার চেষ্টা করছি, কেন এতখানি অস্বস্তি হচ্ছে, এই গোটা নাটকে নতুন কী এমন দেখলাম যাতে করে কিছুতেই অস্বস্তিটা মন থেকে যেতে চাইছে না। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী এই শাসক দল যে নতুন সংসদ ভবন রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি ছাড়াই (এই দুজন – দ্রৌপদী মূর্মু এবং জগদীপ ধনখড় – এঁরাও যে সরাসরি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সবাই জানে, তাও, সাংবিধানিক প্রোটোকলকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া খানিক নতুন বইকি) উদ্বোধন করে ফেলছে, এই নতুনত্বেই অস্বস্তি? সমান্তরাল ভাবে বিক্ষোভরত কুস্তিগীরদের যে টেনে হিঁচড়ে পুলিশ প্রিজন ভ্যানে তুলছে, তাতে অস্বস্তি? নাকি ‘৪৭ সালের প্রধানমন্ত্রী সহ পারিষদদের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে আজকের যে ছবি একসাথে দেখা যাচ্ছে, ছিয়াত্তর বছর পরে ভারতরাষ্ট্রের এই পরিণতিতে অস্বস্তি? 

সারাদিন এই অস্বস্তি নিয়েই চলতে চলতে, যৌক্তিক সমস্ত কারণ ভেবে দেখতে দেখতে রাতের বেলা অবশেষে সেঙ্গোল জিনিসটা একটু খতিয়ে দেখতে ইচ্ছে করল। বলতে দ্বিধা নেই, ভারতীয় ইতিহাসের একনিষ্ঠ ছাত্র / পাঠক ছাড়া চোলা সাম্রাজ্যের এই সেঙ্গোল-আখ্যান কেউই হয়তো একসপ্তাহ আগেও জানতেন না; বলা বাহুল্য, আমিও জানতাম না। এই একসপ্তাহের মধ্যে গুগল-ইউটিউব-ফেসবুক-ইন্সটা সেঙ্গোল বিশেষজ্ঞে ভরে গেছে – অজস্ব ভিডিও, নানান ক্লেম-কাউন্টার ক্লেম, ফ্যাক্ট চেকিং যে কেউ চাইলে সামান্য সার্চ করেই খুঁজে পেয়ে যাবেন। খানিককক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে যা বোঝা গেল, সেঙ্গোল নামক এই লাঠি-টি ‘৪৭ সালে নেহরুকে দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার সাথে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে গল্পটি সংযুক্ত করে ফাঁদা হচ্ছে, তা অনেকাংশেই মনগড়া, তৈরী করা ইতিহাস। কিন্তু আমি ঠিক ফ্যাক্ট চেকিং-র যুক্তিতে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে চাইছিলাম না – বিজেপির তৈরী করা অধিকাংশ ‘ইতিহাস’ই ফ্যাক্ট চেকিং-র আতসকাঁচে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে – এ আমরা সবাই জানি। বরং কাল থেকে ভাবার চেষ্টা করছিলাম, এত কিছু থাকতে খামোকা এই একখানা সেঙ্গোল এনে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে এত লাফালাফি করার মানেটা কী! তামিলনাড়ুতে নিজেদের ক্ষমতা বিস্তারের অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছে তো আছেই – কিন্তু শুধুই কি তাই? সেঙ্গোল সংক্রান্ত এই স্পেকট্যাকেলটিকে কি এত সহজেই পড়ে ফেলা যায়? 

দুটি বিষয়কে এই লেখায় হাইলাইট করতে চাইছি আমি – প্রথমত, সংসদ ভবন উদ্বোধনের অজস্র ভাইরাল ইমেজ নিয়ে ক্রমাগত ঘটে চলা অস্বস্তি, দ্বিতীয়ত, সেঙ্গোল নামক এক অহৈতুকি সিম্বল নিয়ে বাড়াবাড়ি করে স্পেকট্যাকল তৈরী করার কৌশল। বিজেপি নামক এই রাজনৈতিক দল এবং ভারত সরকারের কিছু স্ট্র্যাটেজি (এই দুইকে আলাদা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে) আর যাই হোক, এমনি এমনি হয় না। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে যাঁরা হালকা চালে শিশুতোষ অযৌক্তিক অতিরেক হিসেবে দেখতে চান, তাঁরা ভুলে যান এই দলটি তাদের আপাত অযৌক্তিক কথাবার্তা কিন্তু অত্যন্ত সিরিয়াসলি, স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে তৈরী করে।  প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে তারা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে নতুন প্রযুক্তিকে – উদাহরণ স্বরূপ অবশ্য উল্লেখ্য, নব্বই দশকে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে প্রথম ওয়েবসাইট তৈরীর কাজ কিন্তু এরাই করে ফেলেছিল। 

তাই সংসদভবন উদ্বোধনের ভাইরাল হওয়া অজস্র মুহূর্ত এবং সেঙ্গোল সংক্রান্ত অহৈতুকি এই বাড়াবাড়ি-র মধ্যে খুব জরুরী একটি বিষয় রয়েছে – তা হল ইমেজ। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, কাল থেকে যা কিছু আমরা দেখছি, সমস্তটাই দেখছি ইমেজের মাধ্যমে – বাস্তব আর আমাদের মাঝামাঝি ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র ইমেজ। আর ‘মিডিয়া’ নামক বস্তুটি নিয়ে সামান্য নাড়াঘাঁটা করলেই বোঝা যায়, বাস্তব আর দর্শকের মাঝে মিডিয়ার অবস্থান ঠিক নিরপেক্ষ সেতুর মতো নয় যে সে এক পক্ষের গল্প সুষ্ঠু ভাবে আরেক পক্ষের কাছে পৌঁছে দেবে। বরং মানুষের মুখে ‘ভাষা’র মতোই মিডিয়ারও নিজস্ব কিছু বয়ান রয়েছে, রয়েছে অর্থ তৈরী করার ক্ষমতা। তাই যে মুহূর্তে আপনি মিডিয়ার ‘মাধ্যমে’ কোনো ঘটনাকে দেখছেন, সেই মুহূর্তে বাস্তব ঘটনার অতিরেকে তৈরী হয়ে যাচ্ছে একাধিক পরত, একাধিক অর্থ। সেই সমস্ত অর্থের স্তর কিছু কিছু স্রষ্টাদের উদ্দিষ্ট, কিছু কিছু উদ্দেশ ব্যতিরেকেই স্বয়ংক্রিয় কাঠামোর নিয়মে তৈরী হতে থাকে। সমস্ত স্তর সরাসরি অর্থের আওতাতেও আসে না, থাকে আভাস, থাকে ইঙ্গিত। মিডিয়া এবং ইমেজের নিয়মই এই – যা শুধু চোখের সামনে দেখছি – অর্থাৎ সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী এবং বারোজন গেরুয়া চেলী পরিহিত পুরোহিত যারা কিনা নিছক একটি সেঙ্গোল দিতে এসেছেন – ইমেজের মধ্যে ঢুকে পড়ার পরেই তার অর্থ শুধুমাত্র এইটুকু থাকে না। অর্থের আভাসে থেকে যায় আরও অনেক কিছু। 

অন্যদিকে, ইমেজের জন্মের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তার সার্কুলেশন। অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রিত সমাজমাধ্যমে একটি ইমেজ আপনি কী কারণে পোস্ট বা শেয়ার করছেন, তা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ন কী ইমেজ নিয়ে সেটা করছেন। অর্থাৎ কোনো ইমেজের পক্ষে থাকা ঘোষিত রাজনীতির মানুষ তো সেই ইমেজ শেয়ার করবেনই – কিন্তু বিপক্ষের মানুষও যখন প্রতিবাদ জানাতে সেই একই ইমেজ শেয়ার করবেন – আসলে সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম সেই ইমেজকে আরও বেশী পপুলার করে তুলবে। অর্থাৎ চাইতে বা না চাইতেও আপনি স্বীকার হবেন এই ইমেজ সার্কুলেশনের – তাই দরকার কিছু স্পেকট্যাকুলার ইমেজের জন্ম দেওয়া – যা ঘেন্না হোক বা প্রেম, প্রয়োজন শুধু ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে দেওয়া। 

একটু ভাবলেই বোঝা যায়, গতকালের ঘটনায় আরএসএস এবং বিজেপি-র উদ্দেশ্য ছিল কিছু স্পেকট্যাকুলার ইমেজের জন্ম দেওয়া এবং ভাইরাসের মতো তাকে ছড়িয়ে দেওয়া – যে ইমেজ সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ চায় ভারতবর্ষকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে নির্মাণ করতে – এই তথ্যটুকু আমরা সবাই জানি, এও জানি সেই নির্মাণের পথে হিন্দুত্ববাদী দলগুলি কীভাবে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। নতুন ভাবে রামমন্দির উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী গেরুয়া পোশাক পরিহিত পুরোহিত-সেবাইতদের দ্বারা আবিষ্ট থাকবেন – এই ইমেজ আমাদের সকলের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সংসদ ভবন – যা কিনা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই নয় – তা উদ্বোধনের সময়ও যদি গেরুয়া পোশাক পরিহিত একাধিক মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর চারিদিকে ঘিরে রাখা যায় এবং সেই ইমেজ ছড়িয়ে যায় দেশের চতুর্দিকে – তাহলে সরাসরি না হলেও অন্তত আভাসে ইঙ্গিতেও অনেকগুলি জরুরী স্টেটমেন্ট সেরে নেওয়া যায়। একদিকে বলে ফেলা যায়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (যেমন রামমন্দির) এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান (যেমন সংসদ ভবন) – এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য ক্রমেই কমে আসছে – কারণ দুই ধরণের প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনেই একই রকমের ইমেজের জন্ম হচ্ছে – গেরুয়া পোশাক পরা একাধিক মধ্যবয়স্ক অর্ধনগ্ন পুরুষ ঘিরে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। অন্যদিকে, আগত হিন্দুরাষ্ট্র – যা কিনা সঙ্ঘের স্বপ্ন – তা এখনও অফিসিয়ালি না হলেও, আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ইমেজ। অফিসিয়ালি মোহন ভাগবত কিংবা গেরুয়া পরিহিত সঙ্ঘের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব নয় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে – কিন্তু তা বলে কি গেরুয়া পোশাকের পুরুষ আর প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ সৃষ্টি করা এবং ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়?

রাম মন্দির উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী

সংসদ ভবন উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী

আমার মতে, এইখানেই সেঙ্গোল নামক জিনিসটির গুরুত্ব – যা কিনা প্রায় চলচ্চিত্র বানাবার মতো করে রীতিমত চিত্রনাট্য ফেঁদে কালকের অনুষ্ঠানে হাজির করা হল। একটু ভেবে দেখুন – এই সেঙ্গোল নামক জিনিসটি ছিল বলেই তামিলনাড়ুর এই পুরোহিতদের উপস্থিতি জাস্টিফাই করা গেল – কারণ তাঁরা তো শুধুমাত্র এই দন্ডটি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে এসেছেন! অর্থাৎ এই দণ্ডটি না থাকলে এতগুলো গেরুয়া পোশাককে গতকাল সংসদ ভবনের ভিতরে নিয়ে আসা যেত না – তৈরী হত না আসন্ন হিন্দুরাষ্ট্রের সম্ভাবনা উসকে দেওয়া এত এত ইমেজ। ভেবে দেখুন, গতকাল সংসদ ভবনে ছিলেন বিজেপির সহ অনেকগুলি রাজনৈতিক দলের এমপি-রা। ছিলেন সরকারের সমস্ত মন্ত্রী। এতৎসত্ত্বেও, যে ইমেজ গুলো রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের সাহায্যে এবং আমার আপনার শেয়ারে ভাইরাল করা হল – সেখানে কেন শুধুমাত্র গেরুয়া পরিহিত পুরোহিত আবৃত প্রধানমন্ত্রীর ছবি? কেন সেখানে একটি ধর্মের উগ্র, বিকট, প্রায় বমি এসে যাওয়া উপস্থিতি সহ ছবিগুলিই একমাত্র? অন্য ছবি তুলতে কি ক্যামেরা কম পড়েছিল?

 

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ইণ্টারনেটে খুলে খুলে দেখছিলাম বিভিন্ন সংবাদপত্রের হেডলাইন। অন্তত দুটি বাংলা কাগজ – আনন্দবাজার পত্রিকা এবং এই সময় – প্রথম পাতায় একই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করেছে – পাশাপাশি রেখেছে সংসদ ভবনের উদ্বোধনের ছবি এবং কুস্তিগীরদের উপর পুলিশী বর্বরতার ইমেজ। সিনেমার ছাত্র আমি – এইরকম মন্তাজ দেখলে মনে না পড়ে উপায় নেই রুশ চলচ্চিত্রবিদ সের্গেই আইজেনস্টাইনের কথা – যিনি মন্তাজের শ্রেণীবিভাগ করতে গিয়ে সর্বোত্তম ক্যাটেগরিটির নাম দিয়েছেন ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ – যেখানে আপাতত সংযোগহীন দুই ইমেজের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে তৈরী হয় ফিল্মের ন্যারেটিভ। দর্শক আলাদা করে প্রথম বা দ্বিতীয় ইমেজের অর্থ গ্রহণ করে না – বরং তৃতীয় কোনো সম্ভাবনা, কোনো ‘আইডিয়া’ তৈরী করতে চায়। এখনও অবধি ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী না হয়ে যাওয়া সমস্ত মানুষ নিশ্চই কাল থেকে তৃতীয় এই সম্ভাবনার কথাই ভাবছেন। আইজেনস্টাইন বলতেন, এই তৃতীয় সম্ভাবনা উসকে দেবে সরাসরি রাজনৈতিক ক্রিয়াকে। আমরা জানি না, একশো বছর আগেকার রুশ চলচ্চিত্রবেত্তার সেই তত্ত্বায়ন একুশ শতকের ইমেজ সমুদ্রে ভেসে যাওয়া পৃথিবীতে আর নতুন করে গ্রাহ্য হয় কীনা।

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে

এই সময় পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে

কিন্তু কাল থেকে ক্রমাগত গেরুয়া পোশাকের এই অশ্লীল ইমেজ দেখতে দেখতে ঘুম না আসা রাত্রিবেলায় এক বন্ধুর পাঠানো অন্য এক ইমেজ দেখতে পেলাম – ২০১৯-র ভারতে, প্যান্ডেমিক পূর্ব সি-এ-এ বিরোধী মিছিলের ভারতে জামা মসজিদের সামনে থাকা জনসমুদ্রে হাত থেকে হাতে পাচার হয়ে যাচ্ছে বি আর আম্বেদকরের ছবি। আয়রনি হলেও সত্যি, সংসদ এবং সংবিধান নিয়ে ভাবতে থাকা সারাদিনে একটিবারেও সংবিধান প্রণেতার ইমেজ সারাদিনও ধাওয়া করেনি আমাদের। অশ্লীল এই রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডার সামনে মতো এই ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা নিষিদ্ধ ইস্তেহারের এই  ইমেজগুলি পাচার করতে থাকা ছাড়া আর কি কিছু করার আছে আমাদের?


যে মূল রচনার পুনঃপ্রকাশ: sayantankatha.wordpress

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views