Off with their heads!!??...

অঙ্কিতা সরকার 

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যু তৈরি হয় আর আমরা প্রতিবাদ করতে থাকি। চারিদিকে ইস্যুর ঘনঘটা, প্রতিবাদেরও ঘনঘটা, ইস্যুও আসতে থাকে, প্রতিবাদও চলতে থাকে, কিন্তু আসলে সমাজ বদল হয় না। আমরা ব্যস্ত থাকি তাৎক্ষণিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে নিজেদের বক্তব্য ব্যক্ত করার জন্য। এর পরিণতিতে একই ঘটনা বারংবার ঘটতে থাকে। তেমনই বারংবার আমদের দেশের বিচার প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের কথা উঠে আসে। আমরা জানি যে মৃত্যুদণ্ড এই মুহূর্তে সারা পৃথিবী জুড়ে একটি পরিত্যাজ্য বিষয়। কিন্তু এই মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও যুক্তি দেওয়া হয়। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে যেমনটা বলা হয় যে, বিরল থেকে বিরলতম ঘটনা এবং অপরাধের নৃশংসতার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে  অপরাধের প্রেক্ষাপট এবং কারণের চেয়ে তার বাহ্যিক রূপের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। 

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের ন্যায় বিচারের চাহিদাকে নঞর্থক দিকে পরিবর্তন করা হয় অর্থাৎ অপরাধী মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হলেই যারা সেই অপরাধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ তারা খুশি। আদতে একটি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে সারা সমাজে সেই অপরাধ টিকিয়ে রাখা হয়। এর বদল হওয়া প্রয়োজন। অপরাধের নৃশংসতার থেকে অপরাধের প্রেক্ষাপট এবং কারণ বুঝে সেই অনুযায়ী বিচার করা অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখি যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের কাণ্ডের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রসঙ্গ বারংবার সমাজে উঠে আসে। প্রশ্ন উঠবে, সেক্ষেত্রে একজন ব্যাক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিলেই কি ধর্ষণের যে প্রবৃত্তি তা বন্ধ হওয়া সম্ভব? আদতে ধর্ষণের প্রবৃত্তি বা পুরুষতান্ত্রিক দর্শন নির্মূলের চেষ্টা না করে ভয় দেখিয়ে তা কমিয়ে রাখার প্রক্রিয়া এটা। কিন্তু কমে কি? আবার, কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী, যে বহুকাল আগেই সশস্ত্র পথ ত্যাগ করে শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে, তাকে আবার আটক করে তার মৃত্যুদণ্ডের দাবী যদি তোলা হয়, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সে-ই ব্যক্তির হত্যার দাবি আসলে জনতার উপর প্রভাব ফেলার উদ্দেশ্যে করা। কি ধরনের প্রভাব? আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়ে প্রশ্ন করলে কি ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে তার বার্তা দেওয়া, ভীতির সঞ্চার করা এবং আঞ্চলিকভাবে যেখানে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করা। কিন্তু আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বদলে ব্যক্তির হত্যা কি এই বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে? এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।  

বলাই বাহুল্য, পুঁজিবাদের দর্শনজাত অপরাধের সংখ্যাগত বৃদ্ধি অপরাধকেই একটা দর্শনে পরিণত করে। এই পুঁজিবাদের উৎপাদন ব্যবস্থার নৈরাজ্য থেকেই জাত হয় ব্যাপক বৈষম্য এবং বর্তমানে নয়াউদারবাদী ব্যবস্থা সেই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এর পরিণতিতেই ক্রিমিনালাইজেশন নিজেই একটা দর্শন হিসেবে সমাজে দেখা দিয়েছে। তাই অপরাধীর বদলে আমাদের অপরাধকে ধ্বংস করতে হবে, ব্যক্তি হত্যার বদলে তার বক্তব্যের সমাধান খুঁজতে হবে। সংশোধনাগারকে অপরাধ প্রবৃত্তি বৃদ্ধির অট্টালিকায় পরিণত করা যাবে না। বরং প্রকৃত সংশোধনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অপরাধীদের নিয়ে যেতে হবে, তাদের সাংস্কৃতিক উত্তোলন ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক দাবীর ক্ষেত্রে তা নির্মূলের পন্থা হিসেবে ব্যক্তির মৃত্যুদন্ডের বদলে সামাজিকভাবে জনদরদী গণতান্ত্রিক সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। 

তাছাড়া, অপরাধী কারা? এটি অনেকটাই আপেক্ষিক বিষয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষকে যারা শোষণ ও নিপীড়ন করছে তারাই শ্রমজীবীদের চোখে প্রধান অপরাধী। ফলে আমাদের নয়া সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যেখানে হাড়িকাঠে মাথা নোয়াবে অপরাধী বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার