পঞ্চায়েতিরাজ: প্রকল্পভিত্তিক ভিক্ষার বদলে পরিকল্পনাভিত্তিক উন্নয়ন
প্রতীপ নাগ
আগামীকাল পঞ্চায়েত ভোট। গ্রাম বাংলার জনগণ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। মনোনয়ন জমা থেকে প্রত্যাহার, কোনটাই শান্তিপূর্ণ হয়নি। এখনও পর্যন্ত ১৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে, গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৮,৬৫০টি, পঞ্চায়েত সমিতির ৯২১৭টি আর জেলা পরিষদের ৮২৫টি আসনে কোন বিরোধী পক্ষ ছিল না, অর্থাৎ ৩৪% আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দল জয়লাভ করেছিল যা পঞ্চায়েত নির্বাচনের ইতিহাসে বিরল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের অর্থ হল সহিংসতা, ভয় আর আর্থিক লেনদেন। আর জেতা বিরোধী জনপ্রতিনিধিকে শাসকদলে নিয়ে নেওয়াকে তৃণমূল উচ্চাঙ্গ মার্গের শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। আয়ারাম-গয়ারামের রাজনীতি আমাদের রাজ্যে আমদানি করেছে তৃণমূল।
ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত:
চৌকিদারি পঞ্চায়েত আইন, ইউনিয়ন বোর্ড পেরিয়ে ১৯৭৩ সালে ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত আইন বিধিবিদ্ধ হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সরকার তা প্রথম কার্যকর করে। সেই নির্বাচনে গ্রামের ভূমিহীন, গরিব, দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সর্বহারা পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হয়। কাহার, হাঁড়ি, ডোম, বক্স, মোল্লা প্রভৃতি সমাজের আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীরা সামাজিক স্বীকৃতি আর আত্মসম্মান পেয়েছিল। গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজ ছিল গ্রামের উন্নয়ন, বিভিন্ন স্থানীয় সমস্যার সমাধান, স্থানীয় সম্পদকে ব্যবহার করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি গ্রামের মানোন্নয়ন ঘটানো। এই কাজ করতে গিয়ে গ্রাম সংসদে ঠিক হতো পরিকল্পনা, বাজেট, অডিট প্রভৃতি। গ্রাম সংসদে বা বুথে বছরে দুইবার গ্রাম সংসদের সভা হত। সব সংসদের সভা শেষ হলে গ্রাম পঞ্চায়েত ভিত্তিক গ্রাম সভা ডেকে সামগ্রিক পরিকল্পনা, রূপায়ণ, পর্যালোচনা, আয়-ব্যয় প্রভৃতি করা হত আইন মোতাবেক।
১৯৮৮- এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরেও সীমিত হলেও এই ব্যবস্থা কার্যকার ছিল। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পঞ্চায়েতকে নিজেদের বলে ভাবত। যত সামান্যই বরাদ্দ হোক না কেন, তা কোথায় ব্যয়িত হবে, তা নিয়ে বির্তক চলত। আস্তে আস্তে পঞ্চায়েতগুলির উপর দলতন্ত্র কায়েম হতে শুরু করল। সাধারণ জনগণের ইচ্ছার বিপরীতে পার্টির ইচ্ছায় পঞ্চায়েত চলতে থাকে। ছিঁটেফোটা যতটুকু আইন মানা হত বামফ্রন্টের সময়ে, ২০১১-এর পরবর্তী সময়ে তাও আর থাকল না।
অন্যদিকে, পরিকল্পনা খাতে আর্থিক বরাদ্দের বদলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার প্রকল্পভিত্তিক আর্থিক বরাদ্দ করতে থাকে। ফলে গ্রাম সংসদ স্তর থেকে মানুষের সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যকর করার যে ব্যবস্থা ছিল, তা ক্রমেই পরিষেবা বিতরণের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। নয়া-উদারবাদী অর্থনীতিতে পরিকল্পনাভিত্তিক উন্নয়নের বিপ্রতীপে চালু হয় প্রকল্পভিত্তিক পরিষেবা প্রদান।
৭৩ তম সংবিধান সংশোধন:
সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতিতে অনুচ্ছেদ ৪০-এ পঞ্চায়েতিরাজের কথা বলা হয়েছিল। এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে আরও সুদৃঢ় করতে মোটামুটিভাবে পশ্চিমবঙ্গের মডেল অনুসরণ করেই ৭৩তম সংবিধান সংশোধনী আইন সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হয়। এর ফলে পঞ্চায়েতি প্রতিষ্ঠানগুলি সাংবিধানিক সংস্থায় পরিণত হয় এবং রাজ্যগুলিতে পঞ্চায়েতি প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলক হয় (অনুচ্ছেদ ২৪৩-বি)। পঞ্চায়েতের মেয়াদ ৫ বছর। রাজ্য নির্বাচন কমিশনগুলি পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। এই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ২৯টি সরকারি দপ্তরকে পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সংবিধান সংশোধনীর ৭৩ নং ও ১১ নং তপশিলী মেনে ২৯টি সরকারি দপ্তরকে ((১) কৃষি ও কৃষি সম্প্রসারণ (২) ভূমি উন্নয়ন, ভূমি বণ্টন, ভূমি সংরক্ষণ ও কেন্দ্রীভবন (৩) ক্ষুদ্র সেচ, জল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা (৪) প্রাণী সম্পদ বিকাশ, ডেয়ারি ও পোল্ট্রি (৫) মৎস্য চাষ (৬) সামাজিক বনসৃজন (৭) ক্ষুদ্র বনাঞ্চল নির্মাণ ও বনজ সম্পদ উৎপাদন (৮) ক্ষুদ্র শিল্প ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ (৯) খাদি সহ গ্রামীণ কুটির শিল্প (১০) গ্রামীণ আবাসন (১১) পানীয় জল (১২) জ্বালানী ও পশু খাদ্য (১৩) রাস্তা, কালভার্ট, সেতু, জল পরিবহন সহ অন্যান্য পরিবহন (১৪) গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ ও বণ্টন (১৫) অপ্রচলিত শক্তি (১৬) দারিদ্র দূরীকরণ (১৭) শিক্ষা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সহ (১৮) কারিগরী বিদ্যা (১৯) বয়স্ক নিরক্ষর শিক্ষা ও অপ্রথাগত শিক্ষা। (২০) পাঠাগার (২১) সাংস্কৃতিক কার্যক্রম (২২) বাজার ও মেলা (২৩) স্বাস্থ্য ও বর্জ্য নিকাশি, হাসপাতাল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও বিতরণ কেন্দ্র (২৪) পরিবার কল্যাণ (২৫) নারী ও শিশু কল্যাণ (২৬) সমাজ কল্যাণ, প্রতিবন্ধী ও মানসিক অসুস্থদের কল্যাণ (২৭) দুঃস্থ, বিশেষতঃ তপশিলী জাতি উপজাতি কল্যাণ (২৮) গণ বণ্টন ব্যবস্থা (২৯) গোষ্ঠী সম্পদ সংরক্ষণ) অবিলম্বে পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দিতে হবে।
এত কিছু বলা হলেও পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় আছে অর্থের অভাব। তহবিল বরাদ্দের জন্য বা এক কথায় অর্থের জন্য তাদের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হল। ২৯টি দপ্তরকে পঞ্চায়েতের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হলেও, বাস্তবে তা কখনই হয়নি। পঞ্চায়েত স্তর থেকে জেলা পরিষদ অবধি কর্মীর অভাব। এমনকি যে দপ্তরগুলিই তুলে দেওয়ার কথা বলা হল, সেই দপ্তর তার কর্মচারীদের পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানে পাঠালো না।
আরো কিছু কথা:
বাম আমল থেকেই গ্রাম সংসদের সভা ক্রমেই বন্ধ হওয়া শুরু হয়। পঞ্চায়েতের উপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয় দলীয় আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ পঞ্চায়েত নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকে আর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত আইনের ধারা ১৬এ আর বিধি ৬৯ এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। এই দুটিতে গ্রাম সংসদ সভায় কোরাম (কোন বুথের ১০% ভোটার) না হলে মুলতুবি সভার কথা আছে। মুলতুবি সভায় কোন কোরামের প্রয়োজন হয় না। ফলে, মুলতুবি সভা দেখিয়ে দেওয়া খুবই সহজ এবং ইচ্ছে মত সব কিছুই পাশ করিয়ে নেওয়া যায়।
২০১১-এর পরবর্তী সময়ে দলতন্ত্র ও দুর্নীতি চরমসীমায় পৌঁছে যায়। পঞ্চায়েতি রাজের ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাত থেকে অনেকাংশে চলে গেছে বিডিও, এসডিও, জেলাশাসকের হাতে। আর ‘দুয়ারে সরকার’ ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েতকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে। পরিকল্পনার বদলে গোটা দেশের মতই আমাদের এই রাজ্যে প্রকল্পভিত্তিক কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাই ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতকে সহজেই এড়িয়ে ‘দুয়ারে সরকার' প্রকল্প চালু করা হল। ভাবখানা এমন যে এতে দলতন্ত্র ও দুর্নীতি কমবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে পরিকল্পনা, বাজেট গ্রহণ ও কার্যকর করার মাধ্যমে তৃতীয়স্তরে জনগণের স্থানীয় সরকার গড়ার যে কথা, তা কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
কাজ ও খাদ্যের নেটওয়ার্ক, পশ্চিমবঙ্গ-এর এক সমীক্ষায় জানা যায় যে, ৭১% মানুষদের পরিষেবা ও জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের সুবিধা পেতে একবারের বেশি দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে উপস্থিত হতে হয়। এর মধ্যে ৫৬% মানুষকে দুইবারের বেশি ক্যাম্পে যেতে হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে দ্রুত পরিষেবা প্রদান, কিন্তু সমস্যা সেই তিমিরেই। এই সমীক্ষায় আরও জানা যায় যে প্রকল্পের জন্য আবেদন যারা করেছিল, তা তারা হয় পাননি বা বাদ পড়েছেন। ফলে, পরিস্থিতি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার এই প্রয়াস আসলে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করে দলতন্ত্র, ব্যক্তিতন্ত্র ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে।
বামফ্রন্ট সরকার বহুবার পঞ্চায়েতি আইন সংশোধন করেছে। বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত আইন সংশোধন করে ‘গ্রাম উন্নয়ন সমিতি’ গঠন করেছিল ২০০৩ সালে। এই আইনে বলা হয়, পঞ্চায়েতে দ্বিতীয় হওয়া প্রার্থীকেও সদস্য হিসেবে নিতে হবে। ফলে পঞ্চায়েতিরাজ প্রতিষ্ঠানের একেবারে নীচের দিকে গণতন্ত্রের পরিসর ছিল।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরনের ক্ষেত্রে অর্থ, কর্মী খুবই প্রয়োজন। যেখানে কেরলে এই দপ্তরের বাজেট রাজ্য বাজেটের প্রায় ৪০%, সেখানে আমাদের রাজ্যে বাজেট মোট বাজেটের ৩-৪%।
তাই, সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন যেমন প্রয়োজন, তেমনি পঞ্চায়েতের হাতে অধিক ক্ষমতাও খুবই জরুরি। বিভিন্ন বামদলগুলি তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে পঞ্চায়েতের স্ব-শাসনের কথা বলেছে। গ্রাম সংসদ সভা নিয়মিতকরণের কথাও বলেছে তাদের ইস্তেহারে।দরকার আইনের পরিবর্তন, বিশেষ করে এই রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনের ধারা ১৬এ ও বিধি ৬৯।প্রকল্পভিত্তিক ভিক্ষার বদলে পরিকল্পনাভিত্তিক উন্নয়নকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে দলতন্ত্র, ব্যক্তিতন্ত্র ও দুর্নীতি বাড়বে বই কমবে না। শুধুমাত্র নির্বাচনের সময় দাবি না তুলে নির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে গ্রামীণ খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে নিয়মিত আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দলতন্ত্র, ব্যক্তিতন্ত্রকে অনেকাংশে নির্মূল করা সম্ভব। আর, বিজেপি-র শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতাই নয়, কেন্দ্রে আসীন ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকার যেভাবে সমস্ত দপ্তরের কেন্দ্রীভবন করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে লড়াইও জোরদার করতে হবে।
চিত্র সূত্র: Ideas for India
Comments
Post a Comment