নতুন সংসদ ভবন ও আসন্ন ডিলিমিটেশান

রক্তিম ঘোষ

[অপ্রচলিত, সংখ্যা ৩, বর্ষ ১, এপ্রিল-জুন ২০২৩-এ প্রকাশিত "নতুন সংসদ রহস্য ও কুস্তির প্যাঁচ"-এর নির্বাচিত অংশ; অপ্রচলিত পত্রিকার অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশিত; বর্তমান শিরোনাম নির্বাচিত অংশের নিরিখে নতুনভাবে দেওয়া হল।]

..."কেন নতুন সংসদ ভবন?          

কারণ ২০২৬ সাল হল ডিলিমিটেশনের বছর। মানে ২০২৬ সালের পরে প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যা হিসাব করে সেই অনুপাত অনুসারে কোন রাজ্যে লোকসভায় কটা করে সিট থাকবে সেটা নির্ধারণ করা হবে। অবশ্য সেটা করতে করতে ২০৩১ হবে। কারণ ২০৩১ অর্থাৎ ২০২৬-এর পর প্রথম জনগণনা হবার পর সেই তথ্যের ভিত্তিতে ডিলিমিটেশন হবে। কিন্তু তাতে মোদীর মনে লাড্ডু ফোটার কারণ কী? কারণ মহিলা প্রতি সন্তান উৎপাদনের হারে এগিয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার সহ অন্যান্য হিন্দিভাষী রাজ্য।

এই অভিযোগ আরএসএস এবং ওদের সব শাখা সংগঠন এবং বিজেপি ধারাবাহিক ভাবে তুলে চলেছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ওরা প্রচুর বাচ্চা পয়দা করে। জনসংখ্যা ওদের প্রচুর বাড়ছে। ওদের রাজনীতির ভিত্তি মুসলমান বিদ্বেষ তাই মুসলমানদেরই টার্গেট করে ওরা। যদিও এসব দাবির কোনও ভিত্তি নেই তাও, ওরা প্রচার করে যে মুসলমানরা জনসংখ্যা বাড়িয়ে দেশ দখল করে নেবে। হিন্দুরা ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছে। এসব বলে কৃত্রিম ভয়ের পরিবেশ বানিয়ে রাখে হিন্দু ভোট নিরাপদ করার জন্য। কিন্তু এসবের আড়ালে যে আসল সত্য ওরা লুকিয়ে ফেলে। সেটা হল এই হাতিয়ারটা ওরাই ব্যবহার করছে। কোন হাতিয়ার? জনসংখ্যা বৃদ্ধির হাতিয়ার।

মহিলা পিছু শিশু উৎপাদনের নিরিখে এগিয়ে রয়েছে গোবলয়। কার্নেজ এনডোমেন্ট অফ ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি পেপারে মিলন বৈষ্ণব ও জিমি হিন্টসন জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে ২০২৬ এ লোকসভার আসনের সংখ্যা ৮৪৬ হতে পারে বলে দেখিয়েছেন। বর্তমানে ইউপির আসন সংখ্যা ৮০, সেটা বেড়ে ১৪৩ হতে পারে। বিহারের বর্তমান আসন ৪০ সেটা বেড়ে ৭৯ হতে পারে। বিহার, ছত্তিশগড়, দিল্লী, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড এই কটি হিন্দি বলয়ের রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের লোকসভায় আসনের অনুপাত ৪২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৮ শতাংশ হতে পারে। কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ আর উত্তরপূর্ব ভারতের আসনের অনুপাত কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেরলার অনুপাত বর্তমানে ৩.৭ শতাংশ আসন সংখ্যার নিরিখে, সেটা কমে ২.৪ শতাংশ হতে পারে।

অর্থাৎ প্রায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিতে পারে যে কোনও সরকারকে শুধুমাত্র হিন্দি বলয়। একে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জোরের জায়গা গোবলয়, অন্যদিকে এখানেই প্রধানত বিজেপির রাজনৈতিক হিন্দুত্বের রমরমা আর তাদের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান প্রকল্প সব কটা ফ্যাক্টর একেবারে মিলেমিশে দেশে নিও লিবারাল কর্পোরেট হিন্দু রাজের সব পথের কাঁটা দূর করে দেবে। কায়েম হবে হিন্দুত্ব রাজনীতির বহু আকাঙ্ক্ষিত এক দেশ এক ভাষা প্রকল্প। হিন্দি চাপানো সহজ হয়ে যাবে সব জাতিসত্ত্বার ঘাড়ে। বাকি রাজ্যগুলিকে কয়েদখানা বানিয়ে চালানো যাবে কেন্দ্রের শাসন। আর গোটা দেশকে পরিণত করা যাবে জাতিসত্ত্বার কারাগারে … না সেসব এখন অতীত… বরং সমস্ত সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার এনআরসি ক্যাম্পে।

১৯৬৭ সালে তামিলনাডু রাজ্যের লোকসভার আসনসংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে ৪২ থেকে কমে ৩৯ টি হয়। ২০২১ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট ভারতের জনসংখ্যার বিন্যাস ও রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত জায়গা থেকে প্রশ্ন তুলেছে এক ব্যক্তির এক ভোট কি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর ক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়ন? হিন্দি বলয়ের শাসনে আর করুণার উপর নির্ভরশীল হয়ে ঝুলে থাকবে তামিল, কানাডি, সাঁওতাল, গোর্খা, মনিপুরি, নাগা, বাঙালি সহ সমস্ত জাতিসত্ত্বার ভবিষ্যৎ?

সেদিনের প্রতীক হল নতুন এই সংসদ ভবন। এর আসন সংখ্যা তাই অনেক বেশি। হিন্দি বলয়ের শাসন চূড়ান্ত রূপে কায়েম করার এই কৃতিত্ব বিজেপি এবং মোদী কারও সঙ্গে ভাগ করতে চান না। করেনওনি।

এপ্রসঙ্গ ঘুণাক্ষরেও না টেনে ডান-বাম-আঞ্চলিক একুশ দলের জোট হাওয়ায় হাওয়ায় আইডেন্টিটি রাজনীতির তাস খেলে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র এবং বিজেপি সমস্ত নিপীড়িত শ্রেণির মধ্যেই নিজেদের কিছু দালাল পোষে। পকেটে রাখে তাদের। এটা ২১ দলের প্রতিটি দল আঞ্চলিক ভাবে করে না নাকি? তাঁরাও করেন। পকেটে কিছু নিপীড়িত শ্রেণির মধ্যে থেকে দালাল রাখা আইডেন্টিটি রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। চেষ্টা করা হয় ওই দালালদের দেখিয়ে, তাদের উন্নতি দেখিয়ে নিপীড়িত শ্রেণিকে দেখানোর, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সেই খেলায় বিজেপি বাকিদের থেকে অনেক বড় খেলোয়াড় প্রমাণ করে দিয়েছে তারা। আর যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস করার এই খেলা নিয়ে কোনও শব্দ না তুলে নিজের নিজের অঞ্চল, ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলো ২১ দলের জোটে থাকা আঞ্চলিক আর বামপন্থি পরিচয়ে পরিচিত দলগুলো। কংগ্রেসের কথা বাদ দিলাম এই কারণেই, কারণ ওরাও বিজেপির মতোই এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ধারণায় বিশ্বাস করে। কিন্তু বাকিরাও কি তাই?"...

সূত্র (মূল প্রবন্ধের সূত্র নির্দেশ থেকে প্রাপ্ত):

https://scroll.in/article/1049779/modis-new-parliament-could-see-hindi-belt-gain-south-lose-power-at-the-centre


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার