ইতিহাস ফিস ফিস কথা কয়

সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়


ভারতবর্ষে ইতিহাস চর্চা এক অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী তথা যুগপৎভাবে জটিল ও সমস্যাবহুল একটি ধারা। সবথেকে বড় সমস্যা হল প্রাচীন ভারতে ইতিহাস ও পুরানকে একীভূত করে দেখার ফলে মৌখিক ইতিহাস ও নির্ভূল দলিল সহকারে ইতিহাস রচনা বেশ সমস্যা বহুল। একে তো মৌখিক ইতিহাসের কোনও মাথামুন্ডু থাকে না, তায় দলিল রচনাকারী নিজের শিক্ষা, সমাজ, পরিবার, গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির উর্দ্ধে উঠতে পারে না। ফলস্বরূপ ইতিহাস তার দ্বান্দ্বিক চরিত্র নিয়ে চলন কোনোভাবেই স্বাভাবিক পথে এগিয়ে যেতে পারেনি; যতই চেষ্টা হোক, সমস্যা রয়ে গেছে।

প্রাচীন ভারতে দলিল ধরে ইতিহাস রচনার সূত্রপাত ঘটে রাজতরঙ্গিনির লেখক কলহনের দ্বারা। সেই সময় অজস্র জীবনী গ্রন্থ রচিত হলেও তেমনভাবে নিরপেক্ষ রচনা সেগুলি ছিল না। অথচ বানভট্টের হর্ষচরিত, বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেব চরিত, সন্ধাকর নন্দীর রামচরিত, বৌদ্ধ, জৈন, বৈদিক সাহিত্য এমনকি পুরান ইতিহাসের উপাদান হলেও এগুলি সম্পূর্ন সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, এর একটা বড় অংশই রূপকার্থে লেখা, তাই এইসব গ্রন্থের টীকাগুলির প্রায় সবটাই কিন্তু পরবর্তীকালের ফলে প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব।

বৈদেশিক বিবরণী, প্রধানত গ্রিক, রোমান, চৈনিক ও মুসলিমদের রচিত বিবরণী প্রাচীন ভারত সম্পর্কে জানতে যথেষ্ট সহায়তা করে। যেমন - পেরিপ্লাস মারি এরিথ্রিয়ান সি, মেগাস্থিনিস রচিত ইন্ডিকা, হিউয়েন সাঙ রচিত সি-ইউ-কি, আরব পর্যটক আল মাসুদি এবং সুলেমানের রচনা, আলবিরুনির ''তহকক-ই-হিন্দ'', টলেমির জিওগ্রাফিকে হুফেগেসিস, প্লিনির রচনা, চৈনিক ঐতিহাসিক সু-মা-কিয়েন, আরিয়ান, কার্টিয়াস, প্লুটার্ক, হাসান নিজামি, আল মাসুদি, ডিওনিওসাস, ডিওডোরাস - প্রমুখ। কিন্তু সমস্যা হল - গ্রন্থের বিবরণ যা-ই থাক না কেন, তা সতত পরিবর্তিত হয়। অনেক সময় মূল গ্রন্থটি পাওয়া যায় না, ভাষান্তর করার সময় তার অনুবাদ মূল বিবরণীর পরিবর্তন ঘটায়, প্রথম পর্যায়ের লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে মেলে না। তাছাড়া গ্রন্থগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবস্থাপন্ন বা ক্ষমতাশালী মানুষের কথা লেখা হয় যা থেকে পূর্ণাঙ্গ সমাজের চিত্র পাওয়া যায় না। এবাদেও ভারতীয় সাহিত্যিকদের অতিরিক্ত আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃত ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে।

বৈদেশিক ঐতিহাসিকদের বিবরণীগুলি আরও সমস্যা বহুল। ভারত ভ্রমণ করতে এসে অল্প সময়ের মধ্যে পুরো ভারত সম্পর্কে জানা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তাদের জনশ্রুতি ও লোককথার উপর নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে বিবরণীগুলির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকে। সবথেকে বড় কথা হল, সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিকদের রচনা অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে থাকে।

মধ্যযুগে ভারতে প্রথম দলিল পত্রাদির ভিত্তিতে উন্নততর ইতিহাস রচনা শুরু হয় কিন্তু সেই যুগেও পক্ষপাতদুষ্ট রচনার কোনও সুরাহা হয়নি। এই যুগের ঐতিহাসিক গ্রন্থের মধ্যে মিনহাজ-উস-সিরাজের 'তবাকৎ-ই-নাসিরি', জিয়াউদ্দিন বরাউনির 'তারিখ-ই-ফিরুজশাহী' সামসউদ্দিন সিরাজ আফিকের 'তারিখ-ই-ফিরুজশাহী' প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও 'সিকান্দার-বিন-ই-রসিদি', গোলাম হুসেন সালিম রচিত 'রিয়াজ-উস-সালাতিন' ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে প্রাদেশিক ইতিহাস জানা যায়। এইসব গ্রন্থ থেকে তৎকালীন সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মজীবন সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়।এবাদেও বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ অর্থাৎ ইবন বতুতা, মার্কো পোলো, নিকলো কন্টি, আবদুর রজ্জাক, নুনিজ পায়েজ প্রভৃতির নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকারি আনুকুল্য ও উদ্যোগে কিছু ইতিহাস রচিত হয় - আকবরের সভাসদ আবুল ফজল রচিত 'আকবর নামা' ও আইন-ই-আকবরি' এই শ্রেণিতে পড়ে । 

নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদদের রচনার মধ্যে - খাজা নিজামউদ্দিন আহমদ, বদাউনি, ফেরিস্তা, আবদুল, হামিদ লাহোরি, কাফি খান প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জীবনীমূলক রচনার মধ্যে বাবরের 'তুজুক-ই-বাবরি', জাহাঙ্গিরের 'তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি' ও গুলবদন বেগমের 'হুমায়ন নামা' উল্লেখযোগ্য। বৈদেশিক পর্যটকদের মধ্যে রালফ ফিচ, বার্নিয়ের, ট্যাভারনিয়ে, মানুচি, স্যার টমাস রো প্রভৃতির বিবরণ থেকে ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপাদান সংগৃহিত হয়। দলিল ভিত্তিক আধুনিক ইতিহাস রচনা শুরু হলেও শাসকের পক্ষপাতদুষ্ট ও ধর্মীয় প্রবণতা সম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কোনও উন্নতি হয়নি।

ঔপনিবেশিক শাসনের গােড়ার দিকে ভারতে নিয়ােজিত ব্রিটিশ প্রশাসক ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ ভারত ইতিহাস চর্চা শুরু করেন। ওয়াটস, বােল্টস, স্ক্র্যাফটন, ওরমে ভেরেলস্ট ও শাের নিজেদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ভারত ইতিহাস লেখেন। আবার উইলিয়াম জোন্স, উইলসনের মতাে মানবতাবাদী পণ্ডিতগণ তাদের লেখার মধ্যে দিয়ে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার স্বরূপ উন্মােচন করেন। এরা সকলেই প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা সম্পর্কে উচ্চধারণা পােষণ করতেন। সেই যুগে সাম্প্রদায়িক ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে জেমস মিল তিন খণ্ডে বিভক্ত 'হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া' নামে ভারতের ইতিহাস রচনা করেন। এটিই ছিল ভারত প্রসঙ্গে লিখিত পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এই গ্রন্থে মিল সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ইতিহাস কালকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ এই তিন পর্বে ভাগ করেন। এ ছাড়া আলেকজান্ডার ডাফ, বিশপ হেবার প্রমুখ ব্রিটিশ লেখকগণ ভারতে হিন্দু-মুসলিম সভ্যতাকে পৃথক হিসেবে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। 

কোলব্রুক তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে প্রাচীনতম হিন্দু গ্রন্থ বেদের সঙ্গে ইউরােপীয়দের পরিচয় করিয়ে দেন। বার্নুফ ঋগ্বেদ ও জেন্দ আবেস্তার মধ্যে মিলগুলি উল্লেখ করেন ও আর্যজাতির ইতিহাসে সংস্কৃতের গুরুত্বগুলি বর্ণনা করেন। ম্যাক্সমুলার সেক্রেড বুকস অব দ্য ইস্ট গ্রন্থ রচনার দ্বারা সংস্কৃত সহ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় লেখা ধর্মনির্ভর সাহিত্যগুলির সঙ্গে ইউরােপীয়দের পরিচয় করান।

উনিশ শতকে ইতিহাস চর্চায় আলফ্রেড লয়াল, হেনরি জেইন, উইলিয়াম হান্টার প্রমুখ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবােজ্জ্বল দিকগুলির ওপর আলােকপাত করেন। এক্ষেত্রে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দোষ-ত্রুটিগুলি এড়িয়ে যান।ওয়ারেন হেস্টিংসের সহযােগিতায় উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় 'এশিয়াটিক সােসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপনের লক্ষ্যেই এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা শুরু হয় এবং বেশকিছু গবেষণামূলক পত্রিকাও প্রকাশিত হয় ও ভারতীয় ভাষায় লেখা বেশকিছু প্রাচীন গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। সেই সঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারিরা খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন ভাষা ও ইতিহাস চর্চায় হাত দেন। শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় বেশকিছু সাহিত্যধর্মী ইতিহাস রচিত হয়। উইলিয়াম কেরি রচনা করেন 'ইতিহাসমালা', রামরাম বসু রচনা করেন 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত’, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রচনা করেন 'রাজাবলি', তারিণীচরণ মিত্র রচনা করেন 'ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট' প্রভৃতি গ্রন্থ।

উনিশ শতকে লেখা ইতিহাস গ্রন্থগুলির মধ্যে জেমস মিলের 'হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া', ম্যাক্সমুলারের 'সেক্রেড বুকস অব দ্য ইস্ট', মেকলের 'এসেস অন ওয়ারেন হেস্টিংস’, জন ম্যালকমের 'পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া', উইলিয়াম হান্টারের 'অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। এগুলো সবই সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বলেই বিবেচিত।

বিংশ শতকে এই ধারায় উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হল ভিনসেন্ট স্মিথ রচিত 'আর্লি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' এবং 'অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' (১৯১৯ খ্রি.), পি. ই. রবার্টস রচিত 'হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া টু দ্য এন্ড অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' (১৯২১ খ্রি.), ডডওয়েল রচিত 'কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' (১৯২৯ খ্রি.), কিথ রচিত 'কনস্টিটিউশনাল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' (১৯৩৬ খ্রি.) প্রভৃতি।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস রচনায় দীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক আর বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গের আধিপত্য কায়েম ছিল। এই দুই গোষ্ঠী ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলে জন্ম নিলেও ক্ষমতার পালাবদলের মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় এবং আন্তর্জাতিক ও দেশীয় জাতীয়তাবাদী ধারার মধ্যে মিশে যায়। এরা সকলেই উচ্চবর্গীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন; নিশ্চিতভাবে তার আন্তর্জাতিক প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। এঁদের মূল লক্ষ হল এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা যে ভারত রাষ্ট্র গঠনে এবং তার সার্বিক চেতনা বিকাশে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা হল একচেটিয়াভাবে উচ্চবর্গের অর্জন। এই ইতিহাস রচনার একটি ধারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রাথমিকভাবে প্রেরণামূলক ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রণালী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। চূড়ান্ত সংকীর্ণ ফলিত ধারণার উপর ভিত্তি করে এটি জাতীয়তাবাদকে কিছু কর্মকাণ্ড ও ধারণার সমষ্টি হিসেবে উপস্থাপিত করে যেগুলো এঁদের তৈরী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। এই ধারা মতে রাষ্ট্রের কোনও আদর্শ নেই, সেটি সম্পূর্ন  সম্পত্তি, ক্ষমতা এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মান-সম্মানের ভাগ বাটোয়ারার একটি সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিযোগিতা যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করেছিল। এই ক্ষেত্রে আরেকটি ধারা হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রাথমিকভাবে এক ধরনের নির্ভেজাল আদর্শবাদী প্রয়াস হিসেবে উপস্থাপন করা যার মূল কথা হল পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার পথে জনগণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বদেশী উচ্চবর্গের নেতৃত্ব ও কর্মী। এই ধারার প্রেরণাশক্তি হিসেবে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ অথবা অভিজাত সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের উপর গুরুত্বারোপ করে। তবে বহু মত পার্থক্য সহ ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে গৌণ করে দেখাতে এরা সদাই উদগ্রীব, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রচিত ইতিহাস এদের কাছে ভারতীয় উচ্চবর্গের আধ্যাত্মিক জীবনবৃত্তান্ত। এই ধারাটি আমাদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাঠামো এবং ওই ইতিহাস রচনার পদ্ধতিটাকেই বুঝতে সাহায্য করে।

প্রথমে যারা ভারতীয়দের মধ্যে এগিয়ে এসেছিলেন এই পথে তারা হলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর প্রমুখ। অক্ষয় কুমার দত্তের প্রায় সমসাময়িক অথচ ইতিহাস তত্ত্বের ক্ষেত্রে অনেকটাই অন্য ধারার অন্যতম প্রথম ও প্রধান প্রবক্তা ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। তিনি প্রাচ্যবাদী জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাশ্চাত্য গবেষণা পদ্ধতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য লাভ করেন। কিন্তু তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদের নিরিখে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল্যায়ন করেননি, তাঁর উপনিবেশিক সত্তা ও প্রাচ্যবাদী গবেষক সত্তা এই দুই-এর টানাপোড়েনে গড়ে ওঠে তাঁর ইতিহাস তত্ত্ব।

আরো কয়েকজন বাঙালির এই প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের নাম করা যেতে পারে। যেমন - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নিখিলনাথ রায় ইত্যাদি। এই সকল ঐতিহাসিকদের ইতিহাস তত্ত্বের সব মিলিয়ে এক সংকীর্ণ বাঙালি হিন্দু স্বজাত্য বোধের জন্ম নিয়েছিল। এর পরবর্তী ধারায় আসেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সতীশচন্দ্র মিত্র, রমাপ্রসাদ চন্দ্র, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার যারা পজিটিভিস্ট ধারায় ইতিহাস রচনা করেন। আর্থিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা রমেশচন্দ্র দত্ত সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস আলোকে আলোচনা করেন রজনীকান্ত।

ড. আর. ভান্ডারকর,  কে. পি. জয়সওয়াল, হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী এরাও এই ধারারই পণ্ডিত। বলা হয় এই ধারার সবথেকে বড় ফসল হল সাম্প্রদায়িকতা। এরা রাজপুত, শিখ এবং মারাঠাদের সংগ্রামকে অতিরঞ্জিত করেছিল। মুসলমানরা এই ধরনের মূল্যায়ন পছন্দ করেনি।  জাতীয় আন্দোলনের উপর এই ধরনের ইতিহাস চর্চার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

ভারতে মার্কসীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিশ্লেষণের মার্কসীয় কৌশল ব্যবহার করা হলেও ক্রমাগত মার্কসবাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং নির্দেশিকা মানা হয় না। ভূপেন দত্ত এবং ডি. ডি. কোসাম্বিকে ভারতে মার্কসবাদী ইতিহাস রচনার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ধরা হয়। ডি. ডি. কোসাম্বি একজন নির্ভেজাল পলিম্যাথ, ভারতীয় ইতিহাসকে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম আলোচনা করেন। মার্কসীয় ইতিহাস রচনার অন্যান্য ভারতীয় পণ্ডিতরা হলেন আর. এস. শর্মা, ইরফান হাবিব, ডি. এন. ঝা এবং কে. এন. পানিক্কর। অন্যান্য ইতিহাসবিদ যেমন সতীশ চন্দ্র, রোমিলা থাপার, বিপান চন্দ্র, অর্জুন দেব এবং দীনেশচন্দ্র সরকারকে কখনও কখনও "ইতিহাসের প্রতি মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত" বলা হয়। ভারতের মার্কসীয় ইতিহাস গ্রন্থ ঔপনিবেশিক যুগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জমির মালিকানা এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতে শ্রেণী বিরোধ এবং ঔপনিবেশিক যুগে শিল্পবিন্যাসের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।

ভারতীয় ইতিহাসে একটি বিতর্ক হল ভারতে সামন্তবাদের প্রকৃতি নিয়ে। ডি. ডি. কোসাম্বি ১৯৬০-এর দশকে "নীচ থেকে সামন্তবাদ" এবং "উপর থেকে সামন্তবাদ" ধারণার রূপরেখা দেন, যা বৈশিষ্ট্যগতভাবে কিছুটা নির্ভূল হলেও অমার্কসীয় ধারণা। কোসাম্বির সামন্তবাদ থিসিসের উপাদানটি আর. এস. শর্মা তার ইন্ডিয়ান ফিউডালিজম এবং অন্যান্য বিভিন্ন বইতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তবে আর. এস শর্মাও তার অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোসাম্বির সঙ্গে বহুলাংশে একমত। বেশিরভাগ ভারতীয় মার্কসীয় ইতিহাসবিদরা যুক্তি দেন যে সাম্প্রদায়িকতার অর্থনৈতিক উৎস হল সামন্তবাদী অবশিষ্টাংশ এবং ভারতে ধীরগতির বিকাশের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা।

গত শতাব্দীর আশির দশকে তরুণ গবেষকদের নিয়ে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ শুরু হয়, বিশ্বজুড়ে আজ বিপুল জনপ্রিয় ও ইতিহাস পঠন-পাঠনের প্রতিষ্ঠিত এক অনন্য পদ্ধতি। ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহকে নিম্নবর্গের ইতিহাস অধ্যয়ন অথবা সাবলটার্ন স্টাডিজ গ্রুপের ‘গুরু’ হিসেবে মান্য করেন খোদ এই গ্রুপের তাঁর সহ–ইতিহাসবিদেরা।

প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী ইতিহাস ও তাত্ত্বিক-ঘরানার বিরোধিতা করেই সাবলটার্ন স্টাডিজ যাত্রা শুরু করে, ভারতবর্ষের ইতিহাস-চর্চার বিদ্যমান সমস্ত ঘরানাই উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাতী - এই ঘোষণা করে যাত্রা শুরু হয়। আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ এই দুই ধারায় দ্বিধাবিভক্ত এবং এই দুই ধারার মধ্যকার অস্থির-জটিল-বহুমাত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান, সাবলটার্ন স্টাডিজের এই বক্তব্যও আজতক অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে আছে। নিম্নবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনা করার গুরুদায়িত্ব ইতিহাসবিদদের নিতে হবে, গুহ যেন সেই অনিবার্য সত্যই মনে করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য সাবলটার্ন স্টাডিজ তিন দশক ধরে গ্রুপ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার গোটা সময়জুড়ে নানা বাঁকবদল ও নতুন নতুন ধারণা হাজির করেছে। নিম্নবর্গের চৈতন্য ও স্বকীয়তার গবেষণা থেকে শুরু হলেও এক পর্যায়ে উচ্চবর্গের রাজনীতিতে কিভাবে নিম্নবর্গের উপস্থাপন ও নির্মাণ হয়ে থাকে সেই দিকে এই গ্রুপকে বেশি মনোযোগ দিতে দেখা যায়।

তবে, ইতিহাসচর্চা, বিগত ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পেশাদার অ-পেশাদার ইতিহাসবিদদের দ্বারা এই ক্ষেত্রটি একটি ক্রমাগত জটিল গুরুগম্ভীর এবং যুগপৎভাবে অসম্ভব সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠলেও আমরা দেখেছি তা ক্রমাগত একধরনের “অনৈতিহাসিক” চরিত্র লাভ করছে এবং আগামীদিনেও করবে যদি না অশুভ উদ্দেশ্য সরিয়ে রেখে ইতিহাসের প্রতি বিষয়নিষ্ঠতার সাথে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এর চর্চা করা হয়। বিশেষ করে বিগত ৭০ বছর ধরে বামপন্থী ও প্রগতিশীল ইতিহাসবিদদের কাছে লড়াইয়ের ক্ষেত্রটি এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ একদল মৌলবাদী (সবরকমের) ইতিহাসবিদেরা ইতিহাসের নামে মিথ্যাচার করে চলেছে। সে জন্যই তাত্ত্বিকভাবে নতুন কোনো দিশা দেখানোর বদলে লড়াইয়ের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠছে (বিশেষতঃ গত ৩-৪ বছর ধরে বেশী করে) ইতিহাসের বিকৃতি সাধনের বিরুদ্ধে লড়াই।

ব্রিটিশ শক্তি ভারতে উপনিবেশ বিস্তার করার লক্ষ্যে ভারতীয় ইতিহাস চর্চা শুরু করে, যা ‘প্রাচ্যবাদ’-এর জন্ম দেয়। রাজপুতদের সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আঁতাতই রাজপুতানা প্রাচ্যবাদের আসল ভিত্তি। টড ও তাঁর রাজপুত সম্পর্কিত আখ্যান সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ভারত ও ভারতীয়দের চরিত্র নির্মাণ করে বিশ্বের কাছে। বিপরীতে এই বিকৃত নির্মাণটি ভারতের জাতীয়তাবাদী এলিট গোষ্ঠী ব্যবহার করে তাদের কর্তৃত্ববাদী জাতিসত্ত্বা গঠনে। আখেরে এই আপামর ‘ইউরোপীয় প্রাচ্যবাদ’ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে প্রাচ্যের সমাজ ও সংস্কৃতিতে জটিলভাবে গ্রন্থিত করে যা আজও ভারতের সমাজে গভীর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

এই অবস্থায় বামপন্থী ইতিহাসবিদদের যা করণীয় তা তারা কতটা করছেন বা করতে পারছেন তা বলা মুশকিল। কারণ মনে রাখতে হবে বহু বামপন্থী ‘পূর্বতন’-দের সংশোধন করার নামে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের বদলে আসলে বামপন্থা থেকেই সরে যাচ্ছেন, যা কিছু দিন বাদে আদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে অবধারিত সংকট তৈরী করবে। প্রথম প্রজন্মের প্রগতিশীল মার্কসবাদী ইতিহাসবিদরা মূলত মার্কসীয় শ্রেণি চেতনার ভিত্তিতে গবেষণা করলেও যথেষ্ট স্থূল দৃষ্টিভঙ্গী ছিল তাঁদের। দ্বিতীয় প্রজন্মের ইতিহাসবিদগণ এই স্থূলতা অতিক্রম না করলেও কিছু রাস্তা দেখান। তৃতীয় প্রজন্মের ক্ষেত্রে অবশ্য স্থূলতা কাটানোর প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে একটি হলেও অনেক সময় মূল মার্কসীয় কাঠামো থেকে তাঁরা সরে গেছেন। চতুর্থ অর্থাৎ বর্তমানে মার্ক্সীয় ইতিহাস চর্চায় বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে।

সবথেকে বড় সমস্যা তৃতীয় প্রজন্ম থেকেই দেখা দেয়। ভারতে সার্ভিস সেক্টরে বেতন বৃদ্ধির কারণে পেশাদার ইতিহাসবিদ অর্থাৎ অধ্যাপক, শিক্ষক ও গবেষকদের আয় বৃদ্ধি পায়। ফলত: সামাজিক-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে যান তাঁরা, যার স্বাভাবিক ফল হল দেশীয় ভাষায় ইতিহাস চর্চায় অনাগ্রহ ও ইংরেজী ভাষায় ইতিহাস চর্চার প্রবণতা। ফল - জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। তাছাড়া, গবেষণাপত্র শুধুই বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও গবেষণা সম্পূর্ণ করার একটি রাস্তা হয়ে দাঁড়ালে সেখানে বিভিন্ন বিচ্যুতি শুরু হয়, অ্যাকাডেমিশিয়ায় Peer রিভিউ জার্নালে ISSN নম্বর বা ISBN সম্বলিত গ্রন্থে প্রবন্ধ ছাপানোর প্রচেষ্টা স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি করে এক শ্রেণির জার্নাল মাফিয়াদের, যারা অনেক সময় নির্ধারণ করিয়ে দেয় গবেষকরা কি গবেষণা করবে। ফলত: শুধু মার্ক্সীয় নয়, সব ধারার ইতিহাস চর্চায় ব্যাপক ধ্বস, মানের পতন ও বিচ্যুতি এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করে 'জনগণের ইতিহাস' রচনার ক্ষেত্রে।

এই শূন্যতা পূরণ করে ঘুরপথে পপুলিস্ট রাজনীতির সমর্থক ও বার্তাবাহক একদল ব্যক্তি, এবং অবশ্যই দক্ষিণপন্থী, বিশেষত উগ্র দক্ষিণ পন্থীরা। স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাসচর্চার বিষয় থেকে বাদ পড়ে যায় জনগণ (যা প্রথম দুই প্রজন্মের মার্কসবাদীদের ইতিহাস চর্চার মুখ্য উপাদান ছিল, তৃতীয় প্রজন্ম ও সাব অল্টার্নরাও যাদের ১%ও উপেক্ষা করেননি)। দক্ষিণপন্থীরা শুরু করে একাধারে বিকৃতি, অন্যধারে মার্কসবাদী ইতিহাসবিদদের আক্রমণ। কারণ এঁদের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে অতুলনীয় লড়াই এঁরাই লড়ছিলেন। কিন্তু পেটি বুর্জোয়া জীবনযাত্রা ও আয় বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এই লড়াইকেও এলিট সমাজের বিষয় করে তুলেছে। অন্যদিকে বর্তমান উগ্র দক্ষিণপন্থীরা শুধুই সংখ্যালঘু শাসক না থেকে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে কনসেন্ট সৃষ্টি করে সর্বগ্রাসী সংখ্যাগুরু হয়ে ওঠে, ফলে সেই অতুলনীয় লড়াইয়ের বাহক হয়ে ওঠে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী।

এই অবস্থায় বর্তমানে একশ্রেণির স্বাধীন গবেষক উঠে এসেছেন, যাঁরা আগে লক্ষ্য স্থির করে তারপর তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গবেষনার (বই, পুস্তিকা বা গবেষণাপত্র) হেডিং বানায়, তারপর তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উপাদান সংগ্রহ করে গবেষণা শেষ করে। নিজেরা গৌণ (সেকেন্ডারি) উপাদান (সোর্স) ব্যবহার করে এমন ব্যক্তির সমালোচনায় নামে যিনি আবার প্রাথমিক (প্রাইমারি) উপাদানের ভিত্তিতে শুধু নয়, অনেক সময়ে সেই উপাদান নিজেই আবিষ্কার করে গবেষণা করেছেন। এঁদের সমালোচনা করলে সমালোচককে 'পেটি বুর্জোয়া' (যদিও এর একটি স্বল্প প্রচলিত কিন্তু উত্তর আধুনিক দৃষ্টি প্রভাবিত গোষ্ঠী দ্বারা ব্যবহৃত প্রতিশব্দ রয়েছে) বলে দাগিয়ে দেয়। এঁরা মূলত পপুলিস্ট ও অতি দক্ষিণপন্থীদের বিরোধিতা করে নিজেরাই আরেকটা গোঁড়া এক রৈখিক ধারার প্রবর্তক।

প্রয়োজন হল মুক্ত মনে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে ইতিহাসের নির্মোহ অনুশীলন। তবেই 'ইতিহাস' শিক্ষা নেওয়ার উপাদান হবে, নচেৎ শিকড়হীন সমাজের শিকড় গজিয়ে গেছে।

Picture Creation: Craiyon AI

 

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?