ফ্যাসিবাদ : একটি মতাদর্শগত বিবৃতি

সুখেন্দু সরকার


প্রতিযোগিতামূলক ধর্মমোহ : বিজেপি বনাম তৃণমূল :

এই মুহূর্তে কেন্দ্রের শাসকদের কাছে একমাত্র 'ইভেন্ট' 'রামমন্দির'। জনগণের টাকা অকাতরে ঢেলে যেভাবে মোচ্ছব করা হচ্ছে, তাতে মনে হতেই পারে গণতন্ত্রের মোড়কে ভারতবর্ষে যা চলছে তা বিশুদ্ধ রাজতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই  নয়। রাজতন্ত্রে যেমন রাজার ইচ্ছাই শেষ কথা, প্রজাকুলকে আমল দেওয়ার কোন দরকার নেই; ঠিক একই ভাবে দেশের 141 কোটি জনগণের 'ম্যান্ডেট' ছাড়াই চলছে এই বিপুল আয়োজন। সরকারের টাকা বলে তো আদতে কিছু নেই! সবই তো আসলে জনগণের টাকা! জনগণ কি  নরেন্দ্র মোদীদের বলেছে যে, তাঁদের টাকা এরকম একটা অনুৎপাদক খাতে দেদার খরচ করা হোক? 

যাঁরা মনে করছেন তৃণমূল কংগ্রেসের কোলে চেপে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তুলবেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই এ রাজ্যে মমতা ব্যানার্জিরাও একই কাজ করছেন। কি রকম? চলতি বছরের শুরুতে মমতা ব্যানার্জি নবান্নতে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন, তাঁর সরকার 700 কোটি টাকা খরচ করেছেন মন্দির নির্মাণ, সংস্কার ইত্যাদি খাতে। একটা লম্বা ফিরিস্তিও তিনি দিয়েছেন। ফিরিস্তিটা এই রকম :

দিঘার জগন্নাথ মন্দির তৈরীর জন্য : 205 কোটি টাকা।

কালীঘাট মন্দির সংস্কার :165 কোটি টাকা।

জলপেশ মন্দির : 31 কোটি টাকা।

নন্দীগ্রাম সিদ্ধিনাথ মন্দির : 17 কোটি টাকা।

গঙ্গাসাগর মেলা : 250 কোটি টাকা।

নন্দীগ্রামের ওঙ্কারনাথ মন্দির : 13 কোটি 17 লক্ষ টাকা। 

নানুরের শিবমন্দির ও নলহাটেশ্বরী মন্দির : 1 কোটি 17 লক্ষ টাকা।

বক্রেশ্বর, কঙ্কালীতলা, ফুল্লরা মন্দির : 1 কোটি টাকা। 

মায়াপুর ইস্কন মন্দিরকে দেওয়া হয়েছে : 700 একর জমি।

অনুকূল ঠাকুরের মন্দির নির্মাণের জন্য দেওয়া হয়েছে : 5 একর জমি। 

মেদিনীপুর শহরে তৃণমূল পরিচালিত মেদিনীপুর পুরসভার উদ্যোগে কাঁসাই নদীর গান্ধীঘাট পাড়ে রাম, সীতা, হনুমানজির মন্দির উদ্বোধন করেছেন তৃণমূল এম এল এ জুন মালিয়া। গত 15 জানুয়ারি। মন্দির উদ্বোধনের জন্য বারাণসী থেকে আনা হয়েছিল একাধিক পুরোহিত।

সরকার নয়, আমাদের শাসকশ্রেণীগুলির পরিকল্পনার গভীর রহস্যকেই উদ্ঘাটন করতে হবে। রহস্যটা হল এই যে, ব্যাপকতম জনগণকে প্রতিদিন ধর্মমোহের অন্ধকার যুক্তিবিচারশূন্য জলার মধ্যে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখা। যাতে তাঁদের মধ্যে অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইচ্ছেটুকুই চলে যায়। তাঁরা অসহায় অদৃষ্টবাদীর স্তরে অধঃপতিত হন। কেন্দ্র - রাজ্য কাজিয়া নয়, আমাদের অখণ্ড শাসকশ্রেণীর পরিকল্পনার উপরেই আলো ফেলতে হবে। রোগের উপর আলো ফেলতে হবে, তার উপসর্গের উপর নয়। 

মোদী জমানায় ফ্যাসিবাদ :

অনেকে এমন একটা ভাব করছেন যেন 2014 সাল থেকেই ফ্যাসিবাদের শুরু! তার আগে যেন দেশে ছুটকো ছাটকা ত্রুটি বাদ দিলে সাংবিধানিক গণতন্ত্র অটুটই ছিল! কাজেই 2014 - পূর্ববর্তী অবস্থায় ফেরত গেলেই কেল্লা ফতে। এটা একেবারেই ত্রুটিপূর্ন একটি অবস্থান। মনে রাখা দরকার, প্রথমত, 1947 সাল থেকে 2024 পর্যন্ত 77 বছরের মধ্যে জাতীয় কংগ্রেস কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় থেকেছে 55 বছর 7 দিন। নেহেরুর পর সবচেয়ে বেশি বছর প্রধানমন্ত্রী থেকেছেন ইন্দিরা গান্ধী : 15 বছর 350 দিন।  ইন্দিরার আমলেই প্রথম ঘোষিত ফ্যাসিবাদের সময়কাল ছিল 1 বছর 8 মাস 26 দিনের কুখ্যাত জরুরি অবস্থা, যার মধ্যে ফ্যাসিবাদের সমস্ত সম্ভাবনাই (Potential অর্থে) নিহিত ছিল। দ্বিতীয়ত, বুকের উপর চেপে বসা এই দশ বছরের ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন থেকে রেহাই পাওয়ার উদগ্র আগ্রহে আমরা যেন ভুলে না যাই যে, মোদিরা যে সমস্ত দমনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রায় প্রত্যেকটা পদক্ষেপের সূচনা করেছে কংগ্রেস, যারা আজ মোদী বিরোধিতার প্রধান মুখ হতে চাইছে। ফলে মোদী বিরোধিতার পাশাপাশি দু হাজার চব্বিশে যদি মিলিজুলি কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসে( যদিও সে সম্ভাবনা খুবই কম) যাবতীয় দমনমূলক আইন 'রোল ব্যাক' বা প্রত্যাহার করার দাবি এই মুহূর্তে বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া খুবই জরুরি। 

যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করেন সেই সি পি আই - সি পি আই  এম  এবং লিবারেশনপন্থী সি পি আই এম এল ইত্যাদিরা তাঁদের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে পুরোপুরি প্রচলিত ব্যবস্থার অপরিহার্য নাটবল্টু বা আরও নির্দিষ্টভাবে 'শাসকশ্রেণীর দল' হয়ে গেছে। ফলে তারা 'ইন্ডিয়া জোট'এর বাইরে আর কিছু দেখছে না। ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তোলা এদের লক্ষ্য নয় মোটেই। এরা ফ্যাসিস্ট কাঠামো নিজেদের ধরণে বজায় রেখে মোদীদের সরিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে চায়। ওদের রাজনীতির মধ্যে অন্য কোন গভীর সদর্থক কিছু খোঁজা একটি বিভ্রান্তিকর প্রয়াস বলেই মনে হয়।

মোদী শাসনের সমালোচনার যে খাত আমরা তৈরী করছি, তাতেও অগভীর চিন্তার ছাপ আছে। কি রকম? অনেকেই বলছেন, হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনই হল হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য। এখানটাতে সমালোচকরা 'লক্ষ্য' এবং 'লক্ষ্য অর্জনের উপায়' : এই দুইয়ের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছেন। আমার এবং আমার সমচিন্তকদের ভাবনা হল এই যে, হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ হল লক্ষ্য অর্জনের উপায় এবং সাম্রাজ্যবাদ পরিচালিত বড় বুর্জোয়া - জমিদার রাজ কায়েম করা হল ওদের লক্ষ্য। ফ্যাসিবাদ হল এক অতি -দক্ষিণপন্থী মতবাদ। ফ্যাসিবাদ বুর্জোয়াদের 'শক্তি' নয়, ঐতিহাসিকভাবে ফ্যাসিবাদ 'বুর্জোয়া সংকট'কেই প্রতিফলিত করে। 

2014 সাল থেকে 2024 সাল পর্যন্ত এই দশ বছরকে যদি স্ক্যানারের নিচে ফেলেন তো দেখবেন যে এই এক দশকে যেখানে 13টি  হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ মোদিরা গ্রহণ করেছে, সেখানে কর্পোরেট পুঁজি সহায়ক পদক্ষেপের সংখ্যা 20। মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘনকারী পদক্ষেপের সংখ্যা 5টি। একটু নির্দিষ্ট করে বলা যাক। হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপগুলির মধ্যে আছে : 2014 সালে গো মাংস ভক্ষণকারী মুসলমানদের উপর আক্রমণ, 2019 সালের জুলাই মাসে তিন তালাক বিল পাশ, আগস্ট মাসে কাশ্মীরের এতকালের স্বতন্ত্র সত্তা বিলোপ, ডিসেম্বর মাসে সাম্প্রদায়িক নাগরিক আইন পাশ, 2020 সালের 23-29 ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে মুসলিম গণহত্যা, একই বছরের 5 আগস্ট রামজন্মভূমির ভূমিপূজা, 30 সেপ্টেম্বর সি বি আই আদালতের দ্বারা বাবরি ভাঙার চক্রীদের রেহাই দান, একই সময়ে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে বন্ধ করতে বিভিন্ন রাজ্যে বিল পাশ, 2023 সালের 3মে থেকে মণিপুরে মেইতেই এবং কুকিদের মধ্যে সরকারি উদ্যোগে দাঙ্গার আগুন জ্বালানো, 31 জুলাই থেকে 4 আগস্ট হরিয়ানার নুহ'তে দাঙ্গা লাগানো, 11 ডিসেম্বর 370 ধারা বাতিলে সুপ্রিম কোর্টের আইনি সম্মতি, 24 ডিসেম্বর ব্রিগেড ময়দানে গীতা পাঠ, 2024 সালের 22 জানুয়ারি সাড়ম্বরে রামমন্দির উদ্বোধন। এই 13টি হিন্দুত্ববাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটিয়ে কর্পোরেট পুঁজিপতি সহায়ক 20টি কর্মসূচি রূপায়ণকে  মসৃণ এবং প্রতিরোধহীন করার লক্ষ্যে। যেগুলিকে  শাসকরা 'সংস্কার' বলে এবং যেগুলি  হল সারবস্তুতে 'পুঁজিবাদী সংস্কার', সেগুলির একটি তালিকা দেওয়া যাক : 2016 সালে নোটবন্দী, 2017 সালে জি এস টি, 2020 সালের 14 ফেব্রুয়ারি আমেদাবাদ, মাঙ্গালুরু এবং   লখনৌ বিমানবন্দর আদানির হাতে তুলে দেওয়া, 2020 সালে 25 মার্চ  থেকে 31 মে পর্যন্ত টানা 68দিনের লকডাউন, যাকে কাজে লাগানো হল কয়েকটি কর্পোরেট পুঁজি সহায়ক বিল ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো করে আইনে পরিণত করার জন্য, 17 এপ্রিল পাশ হল নয়া বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল, 17মে খনি বেসরকারিকরণ করা হল, 1 জুলাই 109টি রুটের 151টি ট্রেন বেসরকারিকরণ করা হল, 29 জুলাই পাশ হল পুঁজিবাদী এবং হিন্দুত্ববাদী বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি, 23 সেপ্টেম্বর পাশ হল তিন শ্রমকোড, 27 সেপ্টেম্বর পাশ হল তিন কৃষিবিল( যা ওদের কাছেই বুমেরাং হয়ে ফেরত আসলো ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের রূপ নিয়ে), 2021 সালের মার্চ মাসে পাশ হল বিমা সংশোধনী বিল, 2021 সালের 9 আগস্ট পাশ হল The Deposit Insurance and Credit Guarantee Corporation Amendment Bill 2021, যার মাধ্যমে ব্যাংক ফেল করলে আমানতকারীকে 5 লক্ষ টাকা ফেরত দিয়ে বাকি টাকা ব্যাংকগুলিকে হজম করার আইনি অধিকার দেওয়া হল, 2022 সালের মার্চ মাসে EPF'এর সুদের হার 8.5% থেকে কমিয়ে 8.1% করা হল, 17 মে (2022) LIC'র 35% শেয়ার কর্পোরেট পুঁজিপতির হাতে তুলে দেওয়া হল, 14 জুন পাশ হল অগ্নিপথ, 1 জুলাই কার্যকর  হল শ্রমকোড, 18 জুলাই মুড়ি সহ দুই ডজন নিত্যদিনের জিনিসের উপর জিএসটি 5% থেকে বাড়িয়ে 18% করা হল, 2023 সালে পাশ হল Forest Conservation Amendment Bill 2023,  পাশ হল The Mines and Minerals (Development and Regulation) Amendment Bill, 3 জানুয়ারি 2024 মোদী নিয়ন্ত্রিত  সুপ্রিম কোর্ট আদানির পক্ষে দাঁড়িয়ে তার কুকীর্তির তদন্ত SIT'এর হাতে তুলে দেওয়ার দাবি নাকচ করে SEBI'র হাতেই রেখে দিল। জনগণকে আড়াআড়ি সাম্প্রদায়িক লাইনে বিভক্ত করে পুঁজিবাদী কর্মসূচি রূপায়ণ : এই হল ফ্যাসিবাদীদের নীল নকশা। 

জনগণের প্রতিরোধ যাতে না গড়ে ওঠে তাই ওরা এনেছে 5টি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বিল :  অপরাধী শনাক্তকরণ আইন, UAPA আইনে সন্ত্রাসবাদীর সংজ্ঞা প্রসারিত করে 'ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদী' ধারা যুক্ত করা, দন্ডসংহিতা, Press and Registration of Periodicals Bill 2023 এবং Election Commission Bill। 

ফ্যাসিবাদিদের এই Composite Diet না বুঝলে আমাদের ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা হবে অন্ধ দিশাহীন বিরোধিতা। মনে রাখতে হবে ফ্যাসিবাদীরা যাকে 'সংস্কার' বলে থাকে, তার প্রধান দিক হল পুঁজিবাদী অন্তর্বস্তু-সম্পন্ন। 

প্রধান শত্রু বনাম একমাত্র শত্রু :

একটা কথা মনে রাখা দরকার : শত্রুর বিরুদ্ধে যদি ভুল পথে লড়াই গড়ে তোলা হয়, তাহলে তা শত্রুর হাতকেই শক্তিশালী করে। মোদী ব্র্যান্ড ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোন কোন মহল এই ফ্যাসিবাদকে 'একমাত্র শত্রু' বলে চিহ্নিত করছেন। ফলে তাঁরা মনে করছেন বিজেপি বিরোধী সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেই ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই সূত্রায়ণের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল এই যে, একেবারে নির্ভেজাল এবং যান্ত্রিক বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এনারা ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা করেন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই যে, একটি আদর্শগত লড়াই : এটা এনাদের মনে থাকে না। ফলে মোদী বিরোধী সমস্ত সংসদীয় দলকেই এনারা ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার শরিক বলে গণ্য করেন। এরা ভুলে যান যে, বিজেপি সহ সমস্ত সংসদীয় দলই দিনের শেষে জনগণের শত্রু শাসকশ্রেণীরই বিভিন্ন তরফ। বিজেপি - আর এস এস - সংঘপরিবার শাসকশ্রেণীর যে অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, তার সাথে কংগ্রেস সহ অন্য সমস্ত সংসদীয় বিরোধী দলগুলি শাসকশ্রেণীর যে অংশের প্রতিনিধিত্ব করে : এই দুই অংশের মধ্যে অবৈরীমূলক দ্বন্দ্বই রয়েছে। এদের দ্বন্দ্ব ফ্যাসিবাদকে ঘিরে নয়, ক্ষমতাকে ঘিরে। নিজ নিজ সময়ে এবং নিজ নিজ ক্ষমতার বৃত্তে এরাও অর্থাৎ বিজেপি বিরোধী সংসদীয় দলগুলিও স্বৈরাচারী। এদেরকে যদি বিজেপি'র বিরুদ্ধে নামাতে হয়, দু'হাজার চব্বিশের নির্বাচনকেই একমাত্র পাখির চোখ করতে হবে। কারণ রাজারা কখনো লাঙ্গলের মুঠি ধরে না। অন্য ধরণের কোন লড়াই এদের না- পসন্দ। এরা ফ্যাসিবাদকে নয়, বিজেপিকে উৎখাত করতে চায়। এবং মনে রাখবেন ফ্যাসিবাদের স্থূলতম সংজ্ঞা হল : 'বিজেপি' সমান 'ফ্যাসিবাদ'। 

হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদকে 'প্রধান শত্রু' বলে চিহ্নিত করলে কিন্তু আমাদের একশন প্ল্যান একেবারে বিপরীত হবে। এক্ষেত্রে প্রধান শত্রুর সাথে সাথে অপ্রধান শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়ও আমাদের নিতে হবে। ফলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে আমাদের সংসদের বাইরে এনে ফেলতে হবে। কারণ অপ্রধান শত্রুরা বিশুদ্ধ সংসদপন্থী। ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামকে সংসদ বহির্ভূত সংগ্রামের রূপই গ্রহণ করতে হবে : এটাই হল ঐতিহাসিক অনিবার্যতা।

ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের অভিমুখ :

প্রথম যে কথাটা বুঝতে হবে যে, ফ্যাসিবাদ ঘিরে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার মোড়কে যারা তাঁদের মধ্যে লাগাতার ' গেল গেল' রব তুলে আতঙ্ক ফেরি করছেন, তাঁরা জনগণকে আত্মরক্ষাত্মক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছেন। আমাদের এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে জোরালো ভাবে বলতে হবে যে, ফ্যাসিবাদ বুর্জোয়াশ্রেণীর সংকটেরই স্বাভাবিক পরিণতি। ওরা জনগণকে মরিয়া হয়েই মারছে। কাজেই জনগণকে সক্রিয় প্রতিরোধে নেমেই ওদের মোকাবিলা করতে হবে।

দ্বিতীয় কথা হল এই যে, ফ্যাসিবাদকে নির্বাচনের পথে পরাস্ত করা যাবে না। একটা জবরদস্ত বিজেপি বিরোধী জোট বানিয়ে বিজেপিকে যদি মসনদ থেকে টেনে নামানোও যায়, ফ্যাসিবাদকে নির্মূল করা যাবে না এবং জনগণের অবস্থার পরিবর্তন করাও যাবে না। কারণ বিজেপির জায়গায় যারা ক্ষমতায় আসবে তারা বিজেপি-বিহীন স্বৈরাচারী শাসনই কায়েম করবে। কংগ্রেস এবং অন্য আঞ্চলিক দলগুলির অতীত ট্রাকরেকর্ডও তাই বলে।

তৃতীয়ত, মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের সংবিধানে 1950 সাল থেকে 2023 সেপ্টেম্বর পর্যন্ত  শাসকশ্রেণী মোট 106 বার  ছুরি চালিয়েছে এবং প্রতিটি সংশোধনীই দেশের শ্রমজীবী মানুষ ও জনসাধারণের বিরুদ্ধে গেছে। পাশাপাশি, সংবিধানকেও সমস্ত মোহ দূরে সরিয়ে তার সীমাবদ্ধতা সহ জনগণের বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে আমাদের গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।

চতুর্থত, ফ্যাসিবাদীদের DEEP STATE প্রকল্পটিকে আমাদের গভীরে গিয়ে বুঝতে হবে। গত দশ বছরে শাসকশ্রেণী জনগণের ব্যক্তিগত পরিসর শতকরা একশ' ভাগ দখল করে নিয়েছে ( আধার কার্ড, বায়োমেট্রিক মারফত), রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মাথায় আর এস এস'এর লোকদের বসিয়েছে, প্রতিটি আইন এমন ভাবে বদলে নিয়েছে যাতে সরকার বিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্য আইনের পথেই তারা মানুষকে শাস্তি দিতে পারে, সরকার বিরোধিতাকেই এরা রাষ্ট্র বিরোধিতার পোশাক পরিয়ে অপরাধমূলক কাজ হিসাবে চিহ্নিত করছে, এরা প্রসারিত করেছে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা, ব্যক্তি সন্ত্রাসীর ধারণা প্রতিষ্ঠা, কলমধারী নকশাল শীর্ষক coinage : এই সবকিছু যদি আমরা জুড়ে জুড়ে ভাবি, তাহলে বুঝবো যে, ওরা একটি মিলিটারি রাষ্ট্র বানিয়ে দেশের জনগণকে দাস নাগরিকের স্তরে নামিয়ে আনতে চাইছে। এটাই হল Deep State প্রকল্প। আমাদের এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম হতে হবে বহুমুখী ( Multi-pronged)। আমাদের বিভিন্ন স্তরে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার কার্যক্রম নিতে হবে :

(এক) ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম কোন জনপ্রিয় কর্মসূচি নয়। অন্তর্বস্তুগতভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম হল শ্রেণীসংগ্রাম। কাজেই এই সংগ্রামে বুনিয়াদি শ্রেণী অর্থাৎ শ্রমিক - কৃষক - ব্যাপক শ্রমজীবী জনগণকে সক্রিয়ভাবে সামিল করতে হবে। শ্রেণীসংগ্রাম এবং জনগণের সংগ্রামের মাঠই হল আমাদের রণক্ষেত্র। আমরা ওদের মাঠে লড়বো না। আমাদের ওদেরকে আমাদের মাঠে টেনে আনতে হবে। আমরা কয়েক বছর আগের কৃষক আন্দোলন কিভাবে ফ্যাসিস্ট কণ্ঠস্বরকে চেপে দিয়েছিল, তা দেখেছি। এই ইতিবাচক শিক্ষাকে আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে ইতিহাসের এই শিক্ষা যে, যতক্ষণ না পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম বুনিয়াদি জনগণের শ্রেণী সংগ্রামের এজেন্ডা হচ্ছে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম প্রতিরোধ সংগ্রামের স্তরে উন্নীত হবে না। 

(দুই) ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম যেহেতু দেশের মানুষের নাগরিক অস্তিত্বের গোড়ায় কুঠারাঘাত করছে, তাই এই সংগ্রামে নাগরিক অংশগ্রহণের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। আমাদের এই সংগ্রাম গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতে হবে। 

(তিন) ফ্যাসিবাদ একের পর এক আমাদের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার ছেঁটে ফেলছে জটায়ু পাখির ডানা কাটার মতো করে। কাজেই সক্রিয় অধিকার আন্দোলনের পরিসরও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার একটি গুরুত্বপূর্ন পরিসর। কিছু কাল আগে অজিত ডোভাল ঘোষণা করেছে যে, অধিকার আন্দোলন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে আমরা আন্দোলনের একটি নির্দেশিকা অবশ্যই পাচ্ছি। 

(চার) ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম যাতে দেশব্যাপী গণবিদ্রোহের রূপ নেয়, আমাদের সে লক্ষ্যেও কাজ করতে হবে। আমাদের সামনেই আছে সাম্প্রতিক শ্রীলংকার জনগণের গণবিক্ষোভের দৃষ্টান্ত।

(পাঁচ) ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম এবং বিপ্লবী সমাজবদলের সংগ্রাম কি একে অপর থেকে বিযুক্ত (ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Mutually Exclusive)? আমার একেবারেই তা মনে হয় না। ফ্যাসিবাদের শিকড় যেহেতু প্রচলিত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার গভীরেই নিহিত থাকে, তাই এই ব্যবস্থা উৎখাতের মধ্য দিয়েই ফ্যাসিবাদের নির্ধারক পরাজয় ঘটে। ফলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম আমাদের তাৎক্ষণিক এজেন্ডা এবং বিপ্লব দূরায়ত বিষয়, এভাবে দেখা সঠিক নয়। ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণপ্রতিরোধ বরং বিপ্লবের কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে আমাদের এই বিপ্লবী চেতনার আয়ুধেই শান দিতে হবে। 

লেখক শ্রমিক কৃষক সংগ্রামী মঞ্চের সম্পাদক। 


(The views expressed by the author are his sole responsibility.) 


Picture Courtesy: https://www.indiatoday.in/india/story/agra-rss-new-uniform-skip-346019-2016-10-11

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার