রাম বিবর্তিত রাম বিতর্কিত

বিমলকান্তি দাশগুপ্ত 

আমাদের বাড়ির উঠানের চার দিকে চার খানা ঘর। ঘরগুলোর তিন দিক ঘিরে ছিল জঙ্গল। সে জঙ্গলে নির্বিঘ্ন নির্বাধ বিচরণ ছিল সাপ গোসাপ বেজির। শেয়ালও ছিল। তবে দিনের বেলায় এদের দেখা যেত না খুব একটা। ওদের একটা নিয়ম ছিল। ওরা কেউ পারতপক্ষে বাড়ির উঠানে আসত না। ব্যবস্থাটা ছিল ওরা অকারণে  আমাদের বিরক্ত করত না। আমরাও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া জঙ্গলে যেতাম না। 

দিন তো যেমন তেমন। সমস্যা হত রাতের বেলায়। বিশেষ করে আমাদের ছোটদের জন্য। দিনে যেমন নিছায়া আলোর প্রাচুর্য রাতে ঠিক বিপরীত। রাতের স্বাভাবিক ছায়ার সঙ্গে যোগ হত গাছের ছায়া জঙ্গলের ছায়া বাড়িঘরের ছায়া তাকে আরও ভয়াল করে তুলতো নিজের ছায়া। এর সঙ্গে যোগ হত নজর ফিরে আসা অন্ধকার জঙ্গলে  গা ঢাকা দেয়া ভূতের অস্তিত্ব। উঠোন পেরিয়ে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে ভয় এমন ভাবে জড়িয়ে ধরত যা ছিল শীতের চাদরের চেয়েও কঠোর। চাদরে তবু নাক আর মুখের জায়গায় একটু যদি বা ফাঁক রাখা যায় ভয়ের বেলাতে অসম্ভব। রাতের দুনিয়া নিশাচরদের দখলে। আমাদের জন্য ঘরের আশ্রয়। 

এই ভয়। বিশেষ করে ভূতের ভয় দূর করতে আমাদের জন্য একটা টোটকা ছিল। মন্ত্রের মতো আউড়ে যার পর নাই দ্রুত গতিতে আমরা অন্ধকারে পারি দিতাম। টোটকাটা ছিল এই রকমের --- ভূত আমার পুত। পেত্নী আমার ঝি। রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে। করবি আমার কী।। রামের সঙ্গে আমার অথবা আমার মতো গ্রাম্য বালকের প্রথম পরিচয় ঘটে ছিল এভাবেই। 

এর পর একটু বড়বেলাতে দেখেছি বয়স্করাও মনের নানা ভাব প্রকাশ করতে রামের নাম ব্যবহার করেন।  যেমন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন –এ রাম বলিস কী রে। হতাশ হলে কপাল চাপড়ে বলেন হায় রাম এ কী হল। আবার ঘৃণা আর তাচ্ছিল্য প্রকাশ করতে বলেন – আরে রাম ছি ছি। ওয়াক থু। শুচিবাইগ্রস্ত মহিলাদের দেখেছি রাম নাম উচ্চারণ করতে করতে পবিত্র জল ছিটাতে ছিটাতে দুপাশের অস্পৃশ্য এড়িয়ে পথ দিয়ে চলেছেন। কিছু হারালে রাম। আবার হারাধন ফিরে পেলেও রাম। আদর করে ছেলের নাম রাম বা রামানুজ। বড় বোঝাতে রাম। তুচ্ছ বোঝাতে রাম। স্থানের নামে রাম। জলাশয়ের নামে রাম। বড়দের কাছে শুনেছি। এ কথা লেখাও আছে পুঁথিতে রাম নামের মাহাত্য বর্ণনায়   ---- একবার রাম নামে যত পাপ হরে । জীবের কী সাধ্য আছে তত পাপ করে।।   

পাঠশালাতে পাঠ্য বইতে রামকাহিনি পড়েছি। দুষ্টমতি লঙ্কাপতি হরে নিল সীতা সতী। রামচন্দ্র গুণাধার ত্বরা গিয়ে সিন্ধুপার। ঘোরতর যুদ্ধ করে বধিলেন লঙ্কেশ্বরে। সীতা সহ পুনরায় ফিরিলেন অযোধ্যায় । ---  

এভাবে যুগ যুগ ধরে রামের যে চিত্র ভারতের বৃহত্তর সংখ্যার পরিবারের মনে চিত্রিত হয়ে হয়ে আছে  তা হল রাম একজন আদর্শ রাজা।  মহৎ তাঁর চরিত্রগুণ। ভারতের গরিষ্ঠ সংখ্যার পরিবারের কাছে তিনি একজন আদর্শ স্বামী। আদর্শ অগ্রজ ভাই। আদর্শ প্রজাপালক। সত্যাশ্রয়ী বন্ধুবৎসল সুন্দর মানুষ। ধর্মবিশ্বাসীরা রামকে অবতার বানালেও সাধারণ মানুষ রামকে নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছেন। এই চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে ভারতে। দেবতাদের শ্রদ্ধা জানাতে যখন মানুষ যান  মন্দিরে। রাম থেকে যান লোকালয়ে। যাত্রা পালাগান আর কথকথার আসরে। লোকসংস্কৃতির চর্চার ঘেরা টোপে।

এই রাম ভারতের বাইরেও বন্দিত। যেমন বালি সুমাত্রা যবদ্বীপ বা জাভা  সিংহল এমনই সব দ্বীপরাষ্ট্রে রামের আসন পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তা নিয়ে ভারতীয়দের কত না অহংকার। 

রামচন্দ্রের এই ভাবমূর্তি প্রথম ধাক্কা খেল উনবিংশ শতকে। এই বাংলায়। কবি মধুসূদন রচনা করলেন মেঘনাদ বধ নামের মহাকাব্য। রামকে চিত্রিত করলেন পররাজ্যগ্রাসী লোভী উদ্ধত রাজার মূর্তিতে। রামের চরিত্রের নিন্দিত দিকগুলির উন্মোচন করলেন কবি। এই ভাবনা থেকে জন্ম নিয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অংকুর। এই প্রথম (আমার জানা মতে) রামচন্দ্রকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সময় থেকেই রামচন্দ্র ভারতের রাজনীতিতে রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হলেন। এই প্রচেষ্টা লুফে নিলেন মোহন দাস গান্ধী। মানুষের মনে রাম সম্পর্কে আবেগকে আশ্রয় করে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার ডাক দিলেন তিনি। রামের বন্দনায় রচিত ভজন তার থিম সঙ হল। প্রতিদিন প্রার্থনা সভার আরম্ভ হত সেই ভজন গান দিয়ে। ---রঘুপতি রাঘব রাজা রাম / সবকো সম্মতি দে ভগবান/ ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম / সবকো সম্মতি দে ভগবান ---। জাতপাতের বাধা দূর করে ধর্মে ধর্মে ভেদকে গ্রাহ্য না করে এক রাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করলেন। ভারত স্বাধীন হল। কিন্তু তাঁর রাম্রাজ্য অধরা থেকে গেল। মারা গেলেন উগ্র ধর্মান্ধ আততায়ীর গুলিতে। মৃত্যুকালে তাঁর শেষ উক্তি --- হায় রাম। 

রামচন্দ্রকে নিয়ে রাজনীতি ধরে নিলেন হিন্দু রাজনীতিবিদেরা। তারা গান্ধীর কল্পিত রামরাজ্যের ধারণাকে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করে নিলেন। সমস্ত শক্তি সংহত করলেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার সাফল্য এল। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে তার পৃষ্ঠে রামচন্দ্রের মন্দির প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে। ২২ জানুয়ারি ২০২৪ সোমবার (৭ মাঘ ১৪৩০) ইতিহাসের পাতায় খোদাই হয়ে থাকল আগামী ভবিষ্যতের জন্য। রাষ্ট্রের উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা পেল অযোধ্যার রাম মন্দির।

Picture: Craiyon AI

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views