পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির আবহ - কিছু কথা

সৌভিক ঘোষ 


নকশালবাড়িতে যা ঘটেছিল তার পরে আর কোনওকিছুই আগের মতো রইল না- অপরিণত বয়সে নানা বইপত্র হাতে এসে পোঁছায়, তেমনি কোন এক বইতে ছাপা ঐ কথাটিতে চোখ আটকেছিল। ২০১১-তে পৌঁছে মঞ্চ বাঁধা থেকে বুথে বসার পরে ভোট গণনা কেন্দ্রে শেষ অবধি থেকে ‘সমস্ত’ নোট নিয়ে বেরিয়ে আসা একজন রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হয়েছি। সেদিন গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পরিচিত দুচারজন গাড়িতে বন্দোবস্তের কথা বলেন, হয়ত অনভিপ্রেত কোনও কিছুর দুশ্চিন্তা থেকেই। হাসিমুখেই সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এমনটা পেরেছিলাম কারণ ততদিনে আমি সিপিএম’র লোক থেকে সিপিআই(এম) কর্মী হয়ে ওঠার পথে সচেতন সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছি। আর প্রাথমিক পর্বের গণনা শেষ হতে না হতেই হাওড়ার ডুমুরজলা ইন্ডোর স্টেডিয়ামের ভিতরে যে ধরণের আচরণের সাক্ষী ছিলাম তাতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি- জনসাধারণ বলতে যাদের বোঝানো হয় তাদের জন্য দুর্দিন সমাগত।    

সেদিন বিকালেই এলাকার পার্টি দপ্তরে পৌঁছে সিদ্ধান্তমতো সমস্ত নোট জমা দিয়েছিলাম। বন্ধুবান্ধব যারা ‘এসব’ থেকে দূরে থেকে শান্তিতে থাকার ইচ্ছায় রীতিমত দড় ছিলেন তাদের অনেকেই এরপরে বেশ কয়েকদিন অবধি অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেসব উড়িয়ে দিয়ে পার্টির কাজে আগের চাইতে আরও বেশি করে যুক্ত হতে অসুবিধা হয়নি। আমার নিজস্ব উপলব্ধি ছিল ‘এই তো সময়!’।

পত্রিকা সম্পাদক সুমিত (বয়সে আমার চাইতে বেশ কিছুটা ছোটই হবেন, তাই পদবীটুকু আর উল্লেখ করলাম না) যখন জানালেন- ‘একটা লেখা দাও’, তখন স্রেফ এটুকু ভেবেই রাজি হলাম যে আজকের পশ্চিমবঙ্গে যা চলছে কিংবা তৃণমূল কংগ্রেস নামের দলটি আসলে কেমন সেসব লিখতে তো আদৌ পন্ডিত হতে হয় না। বাকি সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার-স্যাপারের জন্য তো তারা রইলেনই।

আমাদের দেশে অর্থনীতি চর্চায় যারা এখনও গরীব মানুষের জীবনের সমস্যাকে প্রাসঙ্গিক মনে করেন তারা বলছেন- বৈষম্যের জন্য দায়ী এমনসব কারনের মধ্যে অন্যতম হল উপার্জন বা আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট ফারাক। সেই ফারাকের শিকড় নিহিত রয়েছে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের পরিমাণে। নয়া-উদারবাদের জোরে প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধন সহজ হয়েছে, আগেকার চাইতে দ্রুততর হয়েছে। এর প্রভাবে উৎপাদনের হার বেড়েছে, উদ্বৃত্তের পরিমাণও বেড়েছে সেই অনুযায়ী। সকলেই জানি উদ্বৃত্ত উৎপাদনের উপরে মালিকানা একমাত্র পুঁজিপতির, যদিও উৎপাদনের চরিত্র সামাজিক। সুতরাং উদ্বৃত্ত উৎপাদনের হার যত বৃদ্ধি পায় মুনাফার হার বা বৈষম্যের হারও তদনুযায়ীই বেড়ে চলে। উদ্বৃত্ত সম্পদের উপরে একচেটিয়া ব্যাক্তি-মালিকানার বিষয়টিকে আলোচনার বাইরে রাখা হলে একমাত্র সঞ্চয়ের মাধ্যমেই সম্পত্তি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। প্রাথমিকভাবে এমন যুক্তি মেনে নিতে কারোর কারোর আপত্তি থাকতে পারে। তারা হয়ত বস্তুগত সম্পদে (ফিজিক্যাল অ্যাসেটস) বিনিয়োগকেই এমন সঞ্চয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রসঙ্গ বলে ধরে নেবেন। কিন্তু সেইসব বিনিয়োগ ব্যতিরেকেও সঞ্চয়ের আরেকটি কায়দার কথা মনে রাখতে হয়। কোনও একটি দেশের বাজারে নতুন কোন বিনিয়োগ নেই, তখনও সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে সেই কায়দাতেই। এতে এক দেশের সঞ্চিত অর্থ অন্য দেশকে ঋণ হিসাবে দেওয়া হয়, প্রাপ্য সুদ সহ সেই অর্থই সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম ভিত্তি। একটি দেশের মোট আয়ের পরিমাণে সেই দেশের অল্পসংখ্যক ধনীদের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি যে হারে হয়, তার চাইতেও দ্রুত হারে তাদের সঞ্চিত সম্পত্তির বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে দেশের মোট সম্পদ বৃদ্ধির হারের চাইতেও সেই দেশের পুঁজিপতিদের সম্পত্তি বৃদ্ধির হার বেশি হচ্ছে। অতএব, উপার্জন বা আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য সম্পত্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যকে বাড়িয়ে দেয়, তরান্বিত করে এমনটা কোনও কল্পনা নয়, এটাই বাস্তবতা। সূত্র - IDEAs (International Development Economics Associate)

তৃণমূল কংগ্রেস যদিও অর্থনীতি-ফিতির তোয়াক্কা করে না, কিন্তু সেয়ানার মতো এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিতে তাদের ভুল হয়নি। তাই শুধু আদানি-আম্বানি বলে-টলে গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লে চলে না, পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ অংশে নব্য ধনীদের কথাও সমানুপাতে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ব্যাপারটা এমনি এমনি ঘটেনি, পুঁজিবাদের বিকাশ ভারতের মাটিতে যে নির্দিষ্ট (পড়ুন ঐতিহাসিকভাবে উৎকট ও নিকৃষ্ট) পথে এগিয়েছে তারই ধারায় এইসব নব্য ধনীরা লুটের ধনতন্ত্রের অংশীদার হয়ে উঠেছে। রাজ্যে শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে কয়েকমাস ধরে সুসজ্জিত বাহিনী সমেত কখনো গাড়ির মাথায় আবার কখনো শামিয়ানা খাটানো শিবিরে মেলা গোছের কিছু একটা আয়োজন করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে কাদের কাছে গেছিলেন? মিডিয়া বলবে মানুষের কাছে, আমরা জানি ওসব ছেঁদো কথা, উনি আর খোকা নেই- আসলে খরচ তুলতেই অমন অভিযান। উনি আসলে হঠাৎ পয়সা করনেওয়ালাদের ‘ভরসা’ দিতেই হাজির হয়েছিলেন। বাকি রইল মাইক কিংবা ক্যামেরার সামনে যা কিছু- সবাই জানে ‘ওদের অসব করতে হয়’।

আরেকবার অর্থনীতির প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এ এক এমন বিজ্ঞান যাতে মানুষ কিংবা মানুষের নাম করে অমানবিক কোনও ব্যবস্থা সবেরই ভিতর অবধি পরিস্কার দেখা যায়।

আমাদের রাজ্যে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলির মধ্যে চাল, ডাল, আলু, ভুট্টা, তৈল বীজ ও বিভিন্ন শাকসবজিই প্রধান। তা স্বত্বেও কয়েকমাস আগেই আলুর দাম ৫০ টাকায় পোঁছেছিল, ভোজ্য তেল, ডাল সহ রোজকার খাদ্য হিসাবে শাকসবজির দাম রীতিমত আকাশছোঁয়া। এটিই পশ্চিমবঙ্গে আজকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার প্রেক্ষিত। সহজ যুক্তিতে যা উঠে আসে তা হল রাজ্যে উৎপাদনের ঘাটতি হয়েছে, বাইরের রাজ্য থেকে আমদানি করে চালাতে হচ্ছে তাই নাকি এমন বাড়তি দর। আচ্ছা, উৎপাদন কম হল কেন? এখানেই অর্থনীতির প্রসঙ্গ  কেউ মন্তব্য করতে পারেন কৃষিকাজ লাভজনক না থাকায় কৃষিজীবীরা অন্য পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন, বিরাট পরিমাণ চাষের জমি অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে তাই উৎপাদন কম হয়েছে। ফসলের দাম না পেয়ে অন্তত ২২০ জন চাষির আত্মহত্যার ঘটনার কথা জানিয়েছে রাজ্য কৃষক সভা (২০১৯ সাল পর্যন্ত হিসাব  সুত্রঃ দ্য হিন্দু) কোভিড অতিমারির সময়ে টেলিভিশনের পর্দায় বাইরের রাজ্যগুলি থেকে আমরা যাদের পায়ে হেঁটে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নিজেদের বাড়ি ফিরতে দেখেছিলাম তারাও মূলত এধরনের কাজের সাথেই যুক্ত শ্রমজীবী মানুষ।

কিন্তু রাজ্য সরকার নিজেই কৃষকসভার দেওয়া তথ্যকে অস্বীকার করেছে। এনসিআরবির প্রতিবেদনে ২০১৯ সালে মোট ১২৮৪ জন আত্মহত্যা করেছিলেন  তাদের মধ্যে একজনও কৃষক না। অর্থাৎ তৃণমূল সরকারের বয়ান অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে কৃষকদের এমন কোনও সংকট নেই যাতে তাদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য হতে হয়। তাহলে উৎপাদনে ঘাটতি হবে কেন? ফসলের লাভজনক দাম না হোক, অন্তত ন্যায্য দামটুকু পেলে কৃষক চাষ করতে অনীহা বোধ করবেন কেন?

যদি ঘাটতির সম্ভাবনা মেনে নিতে হয় তবে তো সরকারের অপদার্থতা প্রমান করতে আর কিছুই লাগে না। আর উৎপাদনে ঘাটতিকেই যদি অস্বীকার করা হয়? তবে যে সম্ভাবনাটি পড়ে থাকে তাতেও রাজ্য সরকারের মুখরক্ষা হয় না। অর্থনীতি সত্যিই বোঝেন এমন কেউ কেউ মন্তব্য করছেন এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী জনকল্যাণের নামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুপ্রাণিত যাবতীয় শ্রীপ্রকল্প। অর্থাৎ রাজ্য সরকার যেভাবে সর্বজনীন সহায়তা দিতে শুরু করেছে তাতে পরিকাঠামো খাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দের আর সংস্থান নেই এবং এরই ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যহত হয়ে মূল্যবৃদ্ধির সংকট ক্রমশ চেপে বসছে। মূল্যবৃদ্ধির অনুবন্ধী সংকট হিসাবেই বাড়ছে বেকারির সমস্যা, মনে রাখতে হবে এরা সবসময় একে অন্যকে বাড়িয়ে দেয়। চাকরি চেয়ে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বসে থাকা শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের ভিড় সেই কারণেই অর্থনীতি আলোচনার বাইরের প্রসঙ্গ নয়।

সংকটের মূল কারণ ও তদজনিত ফলাফল সবসময় একে অন্যের পরিপূরক হয়। কেউ আমাকে ডিটারমিনিজমে আক্রান্ত বলতে পারেন- বিতর্কে এগোতে আপাতত ওকথা শুনতে আমার বিশেষ সমস্যা নেই। ২০১১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে (MGNREGA) নিযুক্তির জব কার্ড এবং মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি সহ স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ফড়েদের কারসাজির শিকার হয়ে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারনে উদ্ভুত ক্ষোভকে চাপা দিতে বিভিন্ন শ্রীপ্রকল্পের প্রাথমিক পরিকল্পনা গ্রহণ। পরে আবার সেইসব প্রকল্পের সুবিধা ও পেলে আমিও পাব না কেন জাতীয় মনোভাবকে সামলাতে না পেরে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মোট খরচের হিসাব ২.৬১ লক্ষ কোটি টাকা, সরকারী আয় বাবদ প্রাপ্তি মাত্র ১.৯৮ লক্ষ কোটি টাকা  অর্থাৎ আয়-ব্যয়ের ঘাটতির পরিমাণ ৬২৩৯৭ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে সরকার চড়া সুদে বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে, আবার পেট্রোপন্যে বাড়তি সেস ইত্যাদিও চাপাচ্ছে। সম্প্রতি আয় বাড়াতে ট্রাফিক আইন ভাঙ্গার ঘটনায় অভূতপূর্ব জরিমানাও নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু সেইসব অর্থও সরকারী বয়ান অনুসারে যাবতীয় শ্রীপ্রকল্পেই খরচ হয়ে যাচ্ছে, অন্য কোন বরাদ্দ করা যাচ্ছে না। এমন হরেন্ডাস পরিস্থিতির জন্য সরকারের দূরদৃষ্টির অভাবকেও দায়ী করা যায় আবার সরাসরি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক যোগ্যতার প্রশ্নেও সন্দিহান হতে সাহস যোগায়। 

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারে বারে রাজ্যের প্রাপ্য অর্থ কেন্দ্র মঞ্জুর করছে না বলে অভিযোগ করেছেন। প্রাপ্য অর্থের একটা বিরাট পরিমানই জিএসটি বাবদ নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের ব্যালেন্স অ্যামাউন্ট। একথা সত্যি যে বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার জিএসটির ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্যগুলির প্রাপ্য দিতে অহেতুক ঢিলেমি করেছে। কিন্তু সেইসব প্রাপ্য যে শুধু পশ্চিমবঙ্গই পাচ্ছেনা এমনটা নয়, কেরালার এলডিএফ সরকার আর যাই হোক বিজেপি স্বাভাবিক মিত্র নয় একথা না বললেও সবাই জানে।

এই কারনেই মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় একেক রাজ্যের পরিস্থিতি একেক রকম। প্রতিটি রাজ্যেই রাজ্য সরকারকে নিজস্ব উদ্যোগে কিছু কাজ করতে হয়। তার কিছুটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আর বাকিটা দক্ষতা। যেমন হাল আমলে আমাদের রাজ্যে ‘সমবেত গীতা পাঠ’ কিংবা সারা দেশে ‘জ্ঞানবাপী মসজিদ সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচার আসলে বিজেপির মাস লাইন  সেই দক্ষতার প্রশ্নেই অর্থনীতি কাজ করে। একটা সরকার তাদের নিজেদের রাজ্যে ফসল উৎপাদনের ঘাটতি হবে কিনা আন্দাজ করতে পারে, বাজারে কোন জিনিস কতটা বাড়তি দামে বিকোতে পারে তা অনুধাবন করতে পারে এবং সেইসব ক্ষেত্রে জরুরী আগাম সতর্কতামূলক বন্দোবস্তও করা যায়  যদি সরকার আসলেই এমন কিছু করতে চায়।

আমাদের রাজ্যে পরিস্থিতি কিছুটা স্বতন্ত্র। কোনও কাজ করা হলে তার ঠিক ভুল বিচার করার বিভিন্ন স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে, যখন বাড়তি কর এবং বাজার থেকে বাড়তি ঋণ আদায় করা ছাড়া একটা সরকার আর কিছুই করেনি তখন তাকে সমালোচনার একটাই রাস্তা পড়ে থাকে– রাজনীতি।

২০০৬-র সরকারী সার্ভে অনুযায়ী আমাদের রাজ্যের কৃষিব্যবস্থা একদিকে অলাভজনক আরেকদিকে অপেক্ষাকৃত শ্রমনিবিড়তা কমে যাওয়ার জন্য সংকটগ্রস্থ। কৃষক পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম চাষের কাজে আগ্রহী নয় সেই জন্যই। তৃণমূল সরকার গলার শিরা ফুলিয়ে ‘জমি কেড়ে নেওয়া হবে না’ ইত্যাদি বলে টলে শেষে জমি থাকুক আর নাই থাকুক মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে বাধ্য করেছে। আসলে রাজ্য সরকার ফসলের মান্ডি নির্মাণের কথা ভুলে যেতেই চেয়েছিল, ভুলে গেছেও। কারণ ওরকমটা করলে কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে চলে যেতে হত। ফসলের দাম নেই, বারংবার রাস্তা জুড়ে আলু–পেঁয়াজ ফেলে রেখে চাষিরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কিছুদিন আগেই। অনেকেই এসব জানেন না, কারণ তারা টিভির পর্দায় আসল দুনিয়া দেখা যায় বলে বিশ্বাস করেন। গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে মিডলম্যানদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। এটুকু মাথায় রাখলেই শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগেরবার রাজ্যের সর্বত্র, সর্বস্ব লুটের ঘটনা কেন হয়েছিল সেকথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আসলে গ্রামীণ লুটেরা গোষ্ঠীই একজোট হয়েছে তৃনমূলের ছাতার তলায়, পঞ্চায়েতের সবকটি আসনে নিজেদের লোক বসাতে না পারলে সেই লুটের খবর ছড়িয়ে পড়বে, ভাগের টাকার নেটওয়ার্কটি আলগা পলেস্তারার মতো ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়বে। তাই যেখানে হোক, ছোট বড় যাই হোক, এমনকি তুচ্ছই হোক না কেন নির্বাচন হলে সবকটা আসনে তৃণমূলের জয় চাইই।

চাষের কাজে লাভ না হলে পরেরবার কৃষক (যিনি জমির মালিক) কি করবেন? চাষের কাজে নিজের তরফে গতর লাগাবেন বেশি। এর প্রভাবে খেতমজুররা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হবেন, একটা বড় অংশের শ্রমজীবীরাই কাজ পাবেন না। ঠিক সেটাই ঘটছে।

এর পরে গরীব মানুষের হাতে রোজগারের সুযোগ বলতে একশো দিনের কাজটুকুই ছিল। সেই খাতে বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রক মজুরি খাতে টাকা আটকে দিয়েছে- যদিও সেই পদক্ষেপ আদতে রাজ্যে বিজেপি’র প্রচারের স্বার্থে কার্যকরী হচ্ছে। একদিকে দিনের পর দিন বকেয়া মজুরি না পেয়ে, আরেকদিকে নতুন কাজের সুযোগ না পেয়ে মানুষ কি করবেন? আমাদের রাজ্য থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হওয়া শ্রমজীবীদের প্রধান অংশ এরাই।

শহরের মতো গ্রামেও সিন্ডিকেট রয়েছে। এসব তৃণমূল জমানারই ফসল। হাফ-পণ্ডিতগণ বলতে পারেন সিন্ডিকেট দুরবস্থায় লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংরক্ষিত রাখে। এমন মনোহারি ছেলে ভুলানো তত্ত্ব শুনতে ভালোই লাগে অস্বীকার করছি না। কিন্তু বাস্তব হল কাজের সুযোগ পেতে মরিয়াদের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকলে তবেই সিন্ডিকেটের বন্দোবস্তটুকু সামান্য কার্যকরী হয়। সার্বিক সংকটে সিন্ডিকেট আদৌ কার্যকরী নয়, কেননা সিন্ডিকেট কোনও সমবায় (কোঅপারেটিভ) নয়। এতে মুনাফার বেশিরভাগটাই কতিপয়ের হাতে কুক্ষিগত থাকে। সেই কতিপয়ই আজকের গ্রাম বাংলায় নব্য ধনীকবৃন্দ। এরা সবাই তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে স্রেফ বখরার সিস্টেমে চলে। ভোটের সময় শাসকদলের পক্ষে ঝটিকা বাহিনীর যোগানদারও এরাই। কোঅপারেটিভ না হয়েও মিউচ্যুয়াল হলে যেমন হয়, এ ব্যাপারটা সেরকমই।

এর পাশপাশি আরেক হুজ্জতি চলছে। চাকরি পেতে এবং দিতে কোটি কোটি টাকা তোলার এক সার্বিক ব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছিল- সেই মৌচাকে ঢিল পড়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্ত শুরু হয়েছে। একের পরে এক মন্ত্রী, নেতা, আমলারা জেলে যাচ্ছেন। এই প্রতিবেদন লেখার সময়েই সন্দেশখালিতে তৃণমূল নেতার বাড়িতে ইডি’র তদন্তকারী দল’কে সবক শেখাতে একদল বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে তৃনমূলকে আসলে তারাই ‘টাইট’ দিচ্ছে বলে বিজেপি নিজেকে বিরোধী বলে প্রমাণ করতে চাইছে। মুশকিল হল মুকুল রায়’কে নিয়ে। তিনি অনেকদিন আগেই সত্যি কথাটা বলে ফেলেছেন- তৃণমূল মানেই বিজেপি। আর মুকুল অসুস্থ বলে যদি মানবিক হওয়ার কথা বলেন তাহলেও কি অস্বীকার করা চলে টিভির পর্দায় বসে আজকের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন ওরা আমাদের ন্যাচারাল অ্যালাই! পাশের রাজ্য ত্রিপুরায় আজ যে বিজেপি’র কুকর্মে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত সেখানে কখনো একসাথে, কখনো চুপি চুপি মিলে এদেরই লোকজন তৃণমূল দলটাই লাটে তুলে দিয়েছে, তারাই এখন বিজেপি’র লোক। আমাদের রাজ্যেও এমন নির্লজ্জ আচরণ দেখছিনা আমরা?   

রইল পড়ে গরীব মানুষের যন্ত্রণা, দুর্দশা বনাম ‘এসব বলেই বিজেপি চলে আসবে’ গোছের রাজনীতির লড়াই। এই রাজ্যে বামেদের লড়াই এই দুয়ের মাঝে, এই দুয়ের সাথেও। প্রশ্ন হল এই পরিস্থিতিতে কে কোন ভুমিকা পালন করবে। তৃণমূল চাইবেই যেন-তেন-প্রকারেণ ভোটে জিততে, নাহলে ওদের গোটা দলটা ইতিহাসের আবর্জনাকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হবে। রাজ্য বিজেপি জানে গুটিকয়েক জেলা বাদ দিলে তারা কার্যত আরএসএস’র সাংগঠনিক দক্ষতার উপরেই নির্ভরশীল। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের একসাথে অনেককিছুর মোকাবিলা করতে হবে। অবশ্য আমরাই তো নির্বাচনকে সবসময় কঠিন লড়াই বলে এসেছি- কারণ নির্বাচন জিততে অন্যান্য দলেরা যা যা খুব সহজেই করে আমরা সেসব করি না, করতে পারি না। তবুও আমরা লড়ব, লড়বেন মানুষও। সেই দুই লড়াই মিলে গেলে আপদ বিদায় হতে দেরি নেই।

পরিকাঠামো খাতে যাতে কোন উন্নয়নমূলক, জনকল্যানমূলক ব্যয়বরাদ্দ না হয় তা মনিটর করার জন্য প্রতি বছর আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করে। ভারতে তাদের প্রতিনিধিরা বিজেপি চালিত কেন্দ্রীয় সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার উভয়ের পারফর্মেন্সেই খুব খুশি। কারণ উভয়েই নিজেদের জায়গায় আসলে যার বা যাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখছেন তাকে ফাটকাবাজ-মুনাফাখোর ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

পপ্যুলিজম বলুন, মডেল বলুন এসবের পিছনে আসলে বিচার করতে হয় যা চলছে তাতে কার লাভ, কাদের লাভ?   

এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া কঠিন না। আজকের পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে একথা বোঝাও শক্ত নয় যে রাজ্য সরকার আসলে নিজের সাধ্যানুযায়ী ফাটকাবাজির সুযোগ নির্মাণ করে চলেছে। সেই ফাটকাবাজি হল আন্তর্জাতিক লগ্নী পূঁজির প্রেসক্রিপশন। জনগণের জীবন-যন্ত্রণা বাড়িয়ে চলা নয়া-উদারবাদ নামের নরখাদক ব্যবস্থাটাকে বিজেপি কিংবা তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যেকেই নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী রসদ যুগিয়ে চলেছে বর্তমান প্রেক্ষিতে রাজনীতি বলুন বা অর্থনীতি এটুকুই আসল কথা।

এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত বেশ কিছু অংশ নাগরিক ডট কম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ধারাবাহিকে প্রকাশিত হয়েছিল। সে লেখার সময় পরিস্থিতি ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন, সেসবের কয়েক মাস পরে এসেও মূল কথাগুলি একইরকম প্রাসঙ্গিক। আর কে না জানে চাপে পড়লেই নিজেদের কথাবার্তা বেমালুম পালটে ফেলার রাজনীতিতে ওরা যেমন দক্ষ খেলোয়াড়, মূল ধান্দাটুকু অটুট রাখতেও ওরা ভালই পারে। রীতিমত ধান্দাবাজ নাহলে নিজেদের রাজনীতির প্রচারের প্রধান স্লোগান হিসাবে কেউ ‘খেলা হবে’ বলতে পারে?

এমন রুচী নিয়ে আমরা বেশি কিছু বলছি না, তবে ওরা যদি সবকিছুকেই শিশু ভুলানো খেলা বলে ভেবে বসেন তবে মনে রাখবেন এটা বাংলা, ‘আহারে’ কিংবা ‘আহা রে’ বাংলা কোনটাই নয়। 


Picture Courtesy: rediff.com

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার