কেন চেয়ে আছো গো মা

সুমিত গাঙ্গুলি

১৯৭৩ সাল। ‘কলরব’ পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরোতে শুরু করলো (অবশ্য দুই সংখ্যায় সমাপ্ত) ‘টেনিদার অজলাভ’। অথচ বছর তিনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে টেনিদার সৃষ্টিকর্তা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাহলে এটি কে লিখছেন? স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার স্ত্রী; আশাদেবী। সাধারণ মানুষ হয়তো চোখ কপালে তুলবে; কিন্তু সাহিত্যের ছাত্ররা জানে একে বলে pastiche। The Princeton Encyclopedia of Poetry and Poetics এ লেখা আছে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, থিয়েটার বা স্থাপত্যে পূর্বের কোনও কাজের অনুকরণ করলে তবেই তাকে pastiche বলে। প্যারোডির মতো ব্যঙ্গাত্মক নয় বরং মূল সৃষ্টিকে একপ্রকার সম্মান দিয়েই এই কাজ করা হয়। 

pastiche শব্দটি ফরাসি, এসেছে ইতালিয় (আধুনিক ইতালিয় ভাষা মানে হলো রোমান সাম্রাজ্যের আমলের ভালগার ল্যাটিনের আধুনিক সংস্করণ) ভাষার শব্দ প্যাস্টিচ্চিও থেকে। এটি আসলে প্যাস্টিচিয়ারে নামক একটি ভালগার ল্যাটিন শব্দের থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার; অর্থ হল মিশ্রণ। যদিও প্যাস্টিচ্চিও বর্তমানে বিশেষ্য হিসেবেই ব্যবহৃত; মূলত একটি ডাবলেট অর্থাৎ একই ধাতু (এক্ষেত্রে প্রাচীন ইন্দো ইয়োরোপীয় ভাষার নয়; আধুনিক ভাষার) থেকে একই নিয়ে উৎপত্তি হওয়া দুটি পৃথক শব্দের মিশ্রণ।

যাই হোক, pastiche ও তার এটিমোলজিক্যাল তত্ত্ব তালাশ বলছে হয় পুরোনো কোনও কিছুর অনুকরণ, না হলে পুরোনো কোনও বিষয়ের থেকে অংশ নিয়ে তাই দিয়ে বানানো কোনও নতুন কিছু অথবা মিশ্রণ। পুরনো আর মিশ্রণ বিষয়টা ঘুরে ফিরে আসছে। স্বভাবতই বিষয়টায় দ্বান্দ্বিক।

সাহিত্যে pastiche-র সূত্রপাত কবে থেকে বলা খুব মুশকিল। তবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই উত্তর আধুনিক মতের উত্থান থেকে pastiche লেখা বেড়ে যায় এবং সেটা খানিকটা হলেও ইচ্ছাকৃত। কারণ আধুনিক (দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে; ‘সাম্প্রতিক’ অর্থে নয়) সাহিত্যে যে সম্ভাবনা থেকে (বিটুইন দ্য লাইনস) তাকে অন্বেষন করে সেই সম্ভাব্যকে তুলে ধরা হলো pastiche-এর কাজ (অন্তত: সাহিত্যে); স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি মূল কাঠামো থেকে গুণগত ভাবে পৃথক; কিছুটা কেন্দ্রীয় প্রবণতাহীন, যা উত্তর আধুনিক মতের বৈশিষ্ট্য।

শার্লক হোমসের ক্ষেত্রে সম্ভবত সর্বাধিক pastiche রচিত হয়েছে। আর্থার কোনান ডয়েলের এই ভিক্টোরিয় গোয়েন্দা চরিত্রকে নিয়ে হওয়া pastiche-গুলিকে চারটে বড় গোষ্ঠীতে ভাগ করা যায়: (ক) শার্লক হোমসের কাহিনী, (খ) শার্লক হোমসের কল্পিত বংশধরের কাহিনী, (গ) ক্যামিও হিসেবে হোমস, (ঘ) শার্লক প্রভাবিত কিন্তু হোমস নিজে নেই। 

প্রথম গোষ্ঠীতে পড়ছে চার রকমের কাহিনী: (অ) স্বাভাবিক ধারায় তৈরী কাহিনী; যার মধ্যে ডয়েলের কাহিনীতে উল্লিখিত কিন্তু না লেখা ১০০টি কাহিনি আছে, (আ) সাম্প্রতিক সময়ে হোমসকে জুড়ে দেওয়া (যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ), (ই) অন্যান্য সাহিত্যিক চরিত্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া (যেমন ভ্যাম্পায়ার), (ঈ) হোমসের চরিত্রের কোনও দিক ধরে রচনা; যেমন - ড্রাগ সেবন।

প্রথম হোমস pastiche লেখা হয় ১৯০৬ সালে। John Kendrick Bangs রচিত R. Holmes & Co.: Being the Remarkable Adventures of Raffles Holmes, Esq., Detective and Amateur Cracksman by Birth। যাই হোক না কেনো, ঘটনা হলো ১৯৭০-এর দশক থেকেই হোমসের pastiche সব থেকে বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ইংরেজিতে নয়, বাংলাতেও হয়েছে। 

বাংলায় শুধু টেনিদা নয়, অন্যান্য চরিত্রের pastiche হয়েছে। যেমন অপু চরিত্রকে নিয়ে লেখা হয়েছিল পথের পাঁচালী ও অপরাজিত। অপরাজিত উপন্যাসের শেষে লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অপুর সন্তান কাজলকে দেখিয়ে যান। বিভূতভূষণের পুত্র তারাদাস এরপর কাজলকে নিয়ে উপন্যাস লেখেন। এমনকি কাজলের পুত্রকে নিয়ে লেখেন তৃতীয় পুরুষ। তিনি বিভূতিভূষণ রচিত তারানাথ তান্ত্রিককে নিয়েও pastiche লেখেন (উদাহরণ: অলাতচক্র)।

বিশ শতকের শেষে বাংলায় প্রবেশ করে pastiche; দ্রুত গতিতে নয়াউদারবাদী অর্থনীতির রাস্তায় হাঁটা ব্যাপক অংশের প্রকাশকরা এই ধারাকে গ্রহণ করেন।। ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যম ব্যাপক পরিমাণে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই সময়ে ব্যাপকভাবে রচনা শুরু হয় বাংলা pastiche। সবথেকে বেশি জনপ্রিয় হয় হোমস ও ফেলুদা। একে একে কবর খুঁড়ে বের করে আনা হয় হোমসের বিদেশি pastiche। শুধু ফেলুদা নয়, একে একে উঠে আসে ব্যোমকেশ, ড্রাকুলা, এমনকি বহু কমিকস চরিত্র।

ভারতের বাইরে হোমস ছাড়াও রচিত হয়েছে টিনটিনের কমিকস, তৈরী হয়েছে হোমসের ফিল্ম। বাংলায় সুশান্ত সিং রাজপুত অভিনীত ব্যোমকেশ বক্সী কিংবা জয় বাবা রুদ্রনাথ, সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া দীপক চ্যাটার্জীর ফিল্ম ‘বাদামী হায়েনার কবলে’ নিশ্চিৎ ভাবেই pastiche.

কাহিনীর আধুনিক সংস্করণ, সম্ভাবনাকে উস্কে দেওয়া, গতি পাল্টে দেওয়া, সব থেকে বড় কথা হলো কেন্দ্রীয় প্রবণতার ও অভাব এর লক্ষণ। অধুনা OTT প্ল্যাটফর্মগুলিতে এই জাতীয় ফিল্ম নিয়মিত হচ্ছে।

ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি" বা "আন্তঃপাঠ‍্য" হল একটা পাঠ‍্য থেকে অন্য পাঠ্যের প্রতি ইঙ্গিত করা ঘটনা।  দুটি ভিন্ন পাঠ‍্যের মধ‍্যে আন্তঃপ্রক্রিয়া এবং আন্তঃসংযুক্ততার একটা ধারা যেখানে একটি পাঠ‍্যের অর্থ অন‍্য পাঠ‍্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক দ্বারা 'আকৃতি' বা 'ফর্ম'-কে  তৈরী করে। এটি এমন একটা ধারা যার মধ্যে মৌলিকতার অভাবকে নানা রকমভাবে ঢেকে দেওয়া যায়। সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প ও সাহিত্যে এর উদাহরণ থাকলেও, বিশ শতকের শেষে সংখ্যা বেড়ে যায়।

ক্ষীণ হলেও রোলা বার্থ ও মিচেল ফুকোর তত্ত্বের খুব কাছাকাছি চেহারার এটি কারণ মূল লেখকের এখানে বাস্তবিক মৃত্যু ঘটছে। ধরা যাক 'লেখকের মৃত্যু' একটি সাহিত্য তত্ত্ব যা দেখায় যে একটি পাঠ্যের অর্থ লেখকের উদ্দেশ্য দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং পাঠকের ব‍্যাখ‍্যা দ্বারা নির্ধারিত হয়। এটা একটা পারস্পরিক সূত্রের দ্বান্দ্বিকতা। এই বিষয়গুলো সমকালীন পরিস্থিতিতে কেমন প্রতিক্রিয়া করে, সেটা পুনঃঅনুসন্ধান করা হলো এর কাজ। যে অনুসন্ধানের কেন্দ্রে রয়েছে একটি শিল্প বা সাহিত্য কিংবা পারফরম্যান্সের নানা বর্ণের কাঠামো যার ছড়িয়ে থাকা অবয়বের মুখোশ হল সমকালীন ইন্টার-টেক্সটুয়ালিটি, উত্তর আধুনিকতা এবং উত্তর নাট‍্য কৌশল ইত‍্যাদি, ইত্যাদি।

একজন লেখকের তিলে তিলে গড়ে তোলা চরিত্র যেভাবে পরবর্তী প্রজন্ম ভাঙছে সেটা অবশ্য ঠিক না ভুল সেটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও প্রাসঙ্গিক হল মৌলিকতার অভাব ও সেই অভাবের বাণিজ্যিকীকরণ; নয়া উদারবাদের হাতে পড়ে ব্যর্থতাও বাণিজ্যিক!

এই ভাবেই পাল্টে যায় গান, কখনও আগুনখোর গায়ক রবীন্দ্রনাথকে ধরে নিজের গান সৃষ্টি করেন, কখনও শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজার ও ডকের বেপথু যুবক মিশে যায় এক পুরোনো মসজিদে; কখনও শাসকের অঙ্গুলি হেলনে পাল্টে যায় ঐতিহাসিক গানের কথা; কখনও জার্মান/ ডাচ রূপকথা ব্যবহৃত হয় কমিকস থেকে বামপন্থী দলের বিরোধিতা করার নাটকে; সাব অল্টার্ন গানের ভাষায় আহ্বান আসে বড় জমায়েতের!!! কেবল একা পাঠক বসে থাকে… আর মিশে যেতে চায় কখনও বেলেঘাটার রুগ্ন যুবকের সঙ্গে - কখনও নিজনি নভগরদের আইকন নির্মাতারা হেঁটে যায়; আর বটবৃক্ষ ন্যায় ভারতীয় হেগেলের রচিত ভাষায় গেয়ে ওঠেন ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’...

['চলিত কুয়াশা' পত্রিকার দশম সংখ্যা, ২০২৪-এ প্রথম প্রকাশিত।] 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার