প্রসঙ্গ জলাতঙ্ক

ত্রিদীপ দস্তিদার 

সালটা ছিল ১৯৯৫। সেই বছরেই মার্চ মাসের ১৩ তারিখ, আনন্দবাজার পত্রিকায় অন্য অনেক লেখার মধ্যে একটি লেখা আমাদের নজরে আসে। লেখাটির বিষয় ছিল, জলাতঙ্ক প্রতিরোধে, প্রতিষেধক হিসেবে N.T.V (Nerve Tissue Vaccine) আর তেমন কার্যকরী নয়। তার বদলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও কার্যকরী T.C.V (Tissue Culture Vaccine) ব্যবহার করা উচিত। লেখাটিতে বেলেঘাটা আই.ডি. হাসপাতালের তৎকালীন সুপার ডা: কানুপ্রিয় দাস এ বিষয়ে উক্ত অভিমত প্রকাশ করেন। প্রসঙ্গত, সেই সময়ে N.T.V কলকাতায় পাস্তুর ইনস্টিটিউটে তৈরি হত। এবং, বাজারে আসতে শুরু করেছে, নানা বেসরকারী ওষুধ কোম্পানির তৈরি (T.C.V.)। এমন একটা সময়ে, বেলেঘাটা I.D. (Infectious Disease) হাসপাতালের মত একটি সরকারি হাসপাতাল, যেখানে তখনও পর্যন্ত মানুষকে বিনামূল্যে N.T.V. নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে, তার সুপার স্বয়ং এমন মন্তব্য করছেন,যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমাদের মনে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, ঐ সময়ে যে কয়টি বিজ্ঞান সংগঠন সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যকে তাদের অন্যতম প্রধান কর্মসূচী বলে চিহ্নিত করেছিল, তাদের রীতিমতো ভাবিয়ে তোলে একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত, একজন উচ্চপদস্থ সরকারি স্বাস্থ্য প্রশাসকের এমন অভিমত। তার প্রধান কারন, সে সময়ে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে A.R.V (অ্যান্টি রেবিস ভ্যাকসিন) হিসেবে মানুষের জন্য বিনামূল্যে যে ভ্যাকসিনটি সরকারী হাসপাতালে ব্যবহার করা হত, সেটা ছিল N.T.V। ঐ ভ্যাকসিনটি দেওয়া হত নাভির চারপাশে ঘিরে। হিসেব মত একটানা ৭ দিনে প্রয়োজনীয় মাত্রায় ৭টি। তারও আগে ঐ ভ্যাকসিনটিই প্রয়োজনীয় মাত্রায় টানা ১৪ দিন দেওয়া হত। ডা: দাস-এর ঐ অভিমত প্রকাশ্যে আসাতে, তৎকালীন, পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলো, মূলত গণবিজ্ঞান সংগঠনগুলোর সমন্বয়কারী সংগঠন, 'গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র (পশ্চিমবঙ্গ)'-এর পক্ষ থেকে, ডা: কানুপ্রিয় দাস-এর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়, সমন্বয় কেন্দ্রে'র মুখপত্র 'গণবিজ্ঞান সমন্বয়'-এ। সাক্ষাৎকারটির মূল জ্ঞাতব্য ছিল, ঠিক কী কী কারণে ডা: দাস N.T.V-র কার্যকারিতা নিয়ে এমন অভিমত পোষণ করছেন। সেই সাক্ষাৎকারে ডা: দাস-এর অভিমত অনুযায়ী N.T.V. সম্পর্কে যে যে কারণগুলো উঠে এসেছিল, সেগুলো বাস্তবে যাচাই করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে 'গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র'-এর পক্ষ থেকেও উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রচেষ্টাও শুরু হয়। সেই প্রচেষ্টার অন্যতম সরিক হয়ে পড়ে তৎকালীন 'গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্র'র অন্তর্ভুক্ত সংগঠন 'হালিসহর বিজ্ঞান পরিষদ'।

এক্ষেত্রে হালিসহর বিজ্ঞান পরিষদের ভূমিকা প্রধানত কী ছিল? সেটা বলতে গেলে বলতে হয়, পরিষদ শুরুতে যে কর্মসূচী নেয়, তা ছিল মূলত সমীক্ষাভিত্তিক এবং সেই কর্মসূচী নেওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল স্থানীয় যদুনাথবাটীর বাসিন্দা, বছর ২৩-এর গৃহবধু বাসন্তী সাহার জলাতঙ্কে মৃত্যুর মত একটি অনভিপ্রেত ঘটনা। জানা গিয়েছিল, বাসন্তী তাঁর জীবনসঙ্গী বিশ্বনাথকে উন্মত্ত কুকুরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই মারাত্মকভাবে জখম হন। সাথে সাথে তাঁকে নৈহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাসন্তীকে বিধিসম্মত প্রাথমিক চিকিৎসা না করেই ব্যারাকপুর ১ নম্বর ব্লকের 'নান্না ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র'-এ প্রতিষেধকের জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়। নান্না হাসপাতালে বাসন্তী  N.T.V-র প্রথম ডোজটি পান জখম হওয়ার ১৯ দিন পর। যদিও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম মাত্রার ডোজ। প্রয়াত হলেন বাসন্তী। প্রয়াত বাসন্তীকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে কেনো পড়তে হল? এটা কি জলাতঙ্ক প্রতিরোধী চিকিৎসার সামগ্রিক অবস্থা? বাসন্তীর ঐ মর্মান্তিক পরিণতি কি নিছকই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল? এসব জানতেই 'নান্না ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র’কেই সমীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। সেখানে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা নিতে যাঁরা আসতেন, তাঁদের কাছ থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই ছিল আমাদের অন্যতম কাজ। সেই সমীক্ষায় এমন কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে,যা রীতিমতো কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ার মত। যেমন, জানা গেল হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী টিকার যোগান ছিল অপ্রতুল। কেউই সময় মত জলাতঙ্কের প্রতিষেধক পেতেন না। পেলেও তা বিধিসম্মত ভাবে দেওয়ার ব্যবস্থাই ছিল না। এমন নানা রকম। কিছুটা অজানা, কিছুটা আগাম অনুমেয় তথ্য। পাশাপাশি আমাদের যেটা অবাক করেছিল, সেটা হল, পাস্তুর ইনস্টিটিউট নির্দেশিত জলাতঙ্কের প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা বিধি সম্পর্কে চিকিৎসকরাও যথেষ্ট অন্ধকারে!! সমীক্ষা চলাকালীন অনেক সময় পরিষদ কর্মীরাই জলাতঙ্ক প্রতিরোধী চিকিৎসার যথাযথ বিধি সম্বলিত পত্রপত্রিকা, পুস্তিকা, এমন কি, পাস্তুর ইনস্টিটিউট প্রচারিত চিকিৎসাবিধির কপি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সরবরাহ করতেন, যাতে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসকরা অবহিত হন এবং রেবিস আক্রান্ত প্রাণীর আঁচড় কামড়ে পীড়িত মানুষজন প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাটুকু পান।


NTV প্রসঙ্গে ডা: কানুপ্রিয় দাস-এর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এর বিরোধিতাও 
যাঁরা করেছিলেন তার কিছু নমুনা

সমীক্ষা চলাকালীন সংগৃহীত তথ্যসমুহ থেকে উঠে আসতে থাকে অনেক প্রশ্নও। পাশাপাশি তারও উত্তর পেতে পরিষদ উদ্যোগী হয়। তৎকালীন জলাতঙ্ক ও তার প্রতিরোধ বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী ও বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে বহু ঘরোয়া আলোচনা, সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করা হয়। সেখান থেকেই আমরা জানতে পারি, রেবিস আক্রান্ত প্রাণীর কামড়, আঁচড়, চেটে দেওয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও জানতে পারি, রেবিস আক্রান্ত প্রাণীর কামড়, আঁচড়, শরীরের উর্ধাঙ্গে, বিশেষ করে মাথার কাছাকাছি অংশে ক্ষত ও তার ধরন অনুসারে টিকার ডোজের মাত্রা নির্ভর করে। রেবিস আক্রান্ত প্রাণীর আক্রমণে গভীর ক্ষত, রক্তপাত ইত্যাদির ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত দ্রুত ও বেশি কার্যকরী অন্য কোনো টিকার প্রয়োগও জরুরী হয়ে পড়ে। এরকম অনেক কিছু আমাদের জানা হল। আর, সেই জানা বোঝাকে পাথেয় করে,পাড়ায় পাড়ায় চলল আমাদের প্রচারও। এই সব প্রচার থেকে উঠে আসে জলাতঙ্ক সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারনাগুলোর স্বরূপও।

মানুষের জলাতঙ্ক হলে পেটে কুকুর ছানা হয়, জলাতঙ্কগ্রস্ত মানুষ কুকুরে মত ডাকে, একবার কামড়ালে ২০/২৫ বছর পরও জলাতঙ্ক হয় ইত্যাদি। লক্ষ্য করেছি কুকুর বেড়াল সহ বিভিন্ন উষ্ণরক্তের প্রাণীর কামড়, আঁচড়, চেটে দেওয়া এগুলোর পরও প্রতিষেধক নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের এক ধরনের গা ছাড়া মনোভাব আছে। আমাদের মনে হয়েছে এর পেছনে যে কারণগুলো আছে তার অন্যতম হল, অনেক মানুষই মনে করেন যে, অনেকেই তো কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি প্রাণীর সংস্পর্শে রোজই আসেন। আঁচড়, কামড়, চেটে দেওয়ার ঘটনা তো অনেকই ঘটে। তার মধ্যে তেমন কাউকে তো চোখেই পড়ে না যিনি জলাতঙ্ক হয়ে মারা গেছেন!!

মানুষের পর্যবেক্ষণ একেবারেই ভুল, এমনটা বলা যায় না। তার কারন, একমাত্র রেবিস আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে আসলেই মানুষের জলাতঙ্ক হতে পারে। নচেৎ নয়। এমনকি তথাকথিত 'পাগলা কুকুর' বা অন্য প্রাণী, সেটি 'পাগলা' হলেও এর কামড়ে জলাতঙ্ক না ও হতে পারে। কারণ, কুকুরটি বা প্রাণীটি 'পাগলা' হলেও সে রেবিস আক্রান্ত না ও হতে পারে। কিন্তু, সমস্যা হল প্রাণীটি রেবিস আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং তার উপসর্গ না জানলে কারুর পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না। ফলে, কামড়ের ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রতিষেধক শুরু না করাটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, নানা সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানুষের জলাতঙ্ক হওয়ার ঘটনার প্রায় ৯৬% রেবিস আক্রান্ত কুকুরের সংস্পর্শেই হয়।

এই কথাগুলোও আমরা নানা সময়ে স্থানীয় এলাকায় নানা ভাবে প্রচারও করেছি। আমাদের সম্বল ছিল, জলাতঙ্ক বিষয়ে পোষ্টার ও নানা পত্রপত্রিকা, বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে পাওয়া তথ্য ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই সমস্যা সমাধানের বা প্রতিকারের দাবিও উঠতে লাগলো। অন্তত, প্রতিকারের চেষ্টা তো চালাতেই হবে, এমন কথাও আমাদের নিজেদের মধ্যে তো বটেই, এমনকি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যেও উঠতে লাগল।

এই প্রতিকার নিয়ে ভাবনার শুরুতেই শহর কলকাতাতে সেই সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রচেষ্টা আমাদের নজরে আসে। যদিও গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন আমাদের কাজের এলাকা তো বটেই, এমনকি হালিসহরের পৌরসভা পরিচালিত অঞ্চলেও জলাতঙ্ক প্রতিরোধে এমন কোনো উদ্যোগ কখনো চোখে পড়েনি। অথচ বাজার হাটে, রাস্তাঘাটে কুকুরের সংখ্যাও বাড়ছে। কুকুরের কামড়ের ঘটনাও ঘটে চলেছে, কিন্তু, শুধু এলাকার কোথাও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে,এমন তো কোথাও দেখা বা শোনা যাচ্ছে না! কিন্তু, শুধু এলাকার কোথাও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে না বলে প্রশাসনিক স্তরে এক রকম নিস্পৃহতা ও নিস্ক্রিয়তা লক্ষ্য করেছি আমরা। বিভিন্ন মহলে আমরা বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বলার চেষ্টা করেছি যে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছাড়া জলাতঙ্কের সম্ভাবনা আটকানোর অন্য কোনও  উপায়ই নেই। তাছাড়াও রাস্তাঘাটে বা জনবহুল এলাকায় বেওয়ারিশ কুকুর যত্রতত্র ঘুরে বেড়ালে মানুষের সাথে তার সংঘাতও তো অস্বাভাবিক নয়। ফলে, অপ্রত্যাশিতভাবে সারমেয়কুল যেমন মানুষের দ্বারা আক্রান্ত, তেমন উল্টোটাও ঘটে চলেছে। বিশেষ করে শিশুরাও আঁচড় কামড়ের শিকার হচ্ছে। এতে জলাতঙ্ক হোক না হোক, যন্ত্রনায় ক্ষত বিক্ষত তো হতে হচ্ছে!! একই সাথে ১০০% প্রাণঘাতী জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। অতএব বেওয়ারিশ সারমেয়দের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। একই সাথে তাদের রেবিস প্রতিরোধী টিকা'র আওতায় আনতে হবে। এটাই আমাদের অন্যতম দাবি হয়ে উঠলো। সেই সময়েই খবর পেলাম কলকাতার রাস্তাঘাটের বেওয়ারিশ সারমেয়কুল ধাপা'র কাছে পাঁচিল ঘেরা একটা অঞ্চলে আশ্রয় পাচ্ছে। পরিভাষায় যার পোশাকি নাম 'Dog pound'!! সহজেই অনুমেয় তারা কী অবস্থায় ওখানে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছিল!! এটাও জানি না, তাতে কলকাতা শহরে কুকুরের কামড়ের সংখ্যা কমেছিল কি না!! অন্তত কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের উপচে পড়া ভিড় দেখে তেমনটা মনে হয়নি। ঐ ভিড়ে অবশ্য মিশে ছিল মফস্বলে চিকিৎসা না পেয়ে, সেখান থেকে সারা দিনের মজুরি পাবার আশা ছেড়ে এখানে ভিড় করা মানুষ জনও!! এছাড়াও কলকাতার রাস্তায় যদি সারমেয়শুমারী হতে পারে, তবে হালিসহর অঞ্চলেরও এরকম নজির থাকা সম্ভব, এমনটা অনুমান করে ব্লক অফিসের দপ্তরে খোঁজ নিতে গিয়ে তো চোখ কপালে ওঠার অবস্থা!!.. জেটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার তথ্যে লেখা '০'!! এর মানে কি এলাকায় একটিও কুকুর নেই??.. না কি, কোনও সমীক্ষা করাই যায়নি? বোঝা গেল না!! অন্তত,তাঁদের রেকর্ড দেখে বোঝার উপায়ই ছিল না!! সমীক্ষক দলও এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেন নি!! রহস্যজনক '০'!! প্রতিদিন, প্রতিরাতে যাদের সাথে রাস্তাঘাটে,বাড়ি ফেরার পথে নরমে গরমে,শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় মোলাকাত হয়,তারা তাহলে কারা??? তারা আছে অথচ নেই?? বললে তো আর হবে না,কাগজে কথা বলে!! কাগজে থাকলে কিছু ভাবার দরকার হত। কাগজে কলমে নেই যখন, কারোরই কোনো দায় নেই!!

না, বিষয়টি ঠিক এমনও নয়! দায় ছিল আমাদের, আমরা, যারা এমন একটি সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাম, তাদের। আরও কয়েকধাপ এগোনোর ঝুঁকি নিতে হয়েছিল আমাদের। প্রথমত, আমরা দেখেছিলাম স্থানীয় নান্না ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকার চাহিদার তুলনায় জোগান কম। বিষয়টা আরেকটু তলিয়ে দেখার জন্য খোঁজ খবর শুরু করলাম। প্রাথমিক ভাবে একটি তথ্য জানা গেলো আমাদের এলাকারই একজন শুভানুধ্যায়ী ভ্যান গাড়ি চালকের কাছ থেকে। যিনি সপ্তাহে কোন কোন দিন টিকা হাসপাতালে পৌঁছোয়, কত দিন পর পর তিনি টিকা হাসপাতালে পৌঁছে দেন। এর থেকে অন্তত একটা আন্দাজ পাওয়া গেলো কোন কোন দিন,কতটা পরিমাণ টিকা, কীভাবে হাসপাতালে পৌঁছয়। জানা গেল হাসপাতালের নিজস্ব কোনো ডীপ ফ্রিজিং এর ব্যবস্থা নেই!! হাসপাতালের পাশের একটি বাড়িতে ঐ টিকা ও অন্যান্য কিছু ওষুধ রাখা হয়!! এখনকার মত ছাপানো বড় প্রেসক্রিপশনের কাগজ সাপ্লাই নেই হাসপাতালে। বদলে দুই ইঞ্চি চওড়া আর তিন ইঞ্চি লম্বা মাপের কাগজে যতটা স্পষ্ট করে লেখা যায়, সেরকম একটা প্রেসক্রিপশন!!

দ্বিতীয়ত, বারাসাতে 'ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ স্টোর', উত্তর ২৪ পরগনা থেকে জেলার বিভিন্ন জায়গায় মজুত টিকা (N.T.V.) সরবরাহ করা হত। টিকাগুলো তৈরি হত বেলেঘাটা আই.ডি. হাসপাতাল সংলগ্ন কলকাতার পাস্তুর ইনস্টিটিউটে। পরিষদের পক্ষ থেকে সেখানেও খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা তৈরি হলেও, মূলত সরবরাহ জনিত সমস্যায় টিকা সেখানে পড়েই থাকে। এমনকি সেখানকার কতৃপক্ষ এটাও স্বীকার করেন যে, সরবরাহের অনিয়মে মজুত টিকার 'এক্সপায়ারী ডেট' পেরিয়ে যেতে বসেছে!!.. অথচ, স্থানীয় ব্লক প্রাথমিক হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী যোগান নেই। প্রয়োজনীয় রিকুইজিশন পাঠানো সত্ত্বেও কেন নান্না ব্লক প্রাথমিক হাসপাতালে টিকা সরবরাহ অনিয়মিত? মজুত কম? না কি পাঠানোর অসুবিধা? উত্তরে ডিস্ট্রিক রিজার্ভ স্টোর জানায় যে নান্না হাসপাতাল থেকে কেউ না কি টিকা নিতেই আসে না!!.. তাঁদেরও নাকি মজুত পর্যাপ্ত। বোঝো কান্ড!!.. কে ঠিক বলছেন বোঝা যাচ্ছে না!!! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, তাঁরা রিকুইজিশন পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমান টিকা পাচ্ছেন না, ওদিকে পাস্তুর ইনস্টিটিউট, বারাসাত রিজার্ভ স্টোর থেকে শোনাচ্ছে অন্য কথা!! এই নিয়ে আমাদের অবজার্ভেশন 'আজকাল' পত্রিকায় চিঠি আকারে দেওয়া হয়। সেটা প্রকাশিতও হয়। তাতে গোলমাল একটু বাড়ল! চিঠিটি প্রকাশিত হওয়ার পর দিনই হাসপাতালের BMOH দিদির কাছ থেকে দেখা করার জন্য ডাক এলো!! "এসব লিখে দিলেন? আগে একবার জানালেন না!!"। বুঝলাম হাসপাতালে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার সুযোগ শেষ হতে চলেছে!!

স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের আওতায় এলো। স্বাভাবিকভাবেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে তথ্য সংক্রান্ত সহযোগিতা আর আগের মত অতটা নেই। তবুও এত দিন লেগে পড়ে থাকার ফল হল, কিছু চিকিৎসাকর্মী,এবং জনসাধারণের একাংশ,যাঁরা হাসপাতালে আসতেন কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা নিতে, তাঁদের পাশে পেয়েছি। মূলত, তাঁদেরই প্রেরণায় আমরা হাল না ছেড়ে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে পেরেছিলাম। সরকারী নানা আমলাতান্ত্রিক বাধা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে সম্ভাব্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাতে থাকি। এমনকি শুধু মানুষের জলাতঙ্ক প্রতিরোধে নয়,পথচারী,গৃহপালিত কুকুর,বেড়াল থেকে শুরু করে, মাঠে তৃণভোজী গবাদি পশুদেরও রেবিসের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়ে গেছি পাশাপাশি। গবাদিপশু, যা বহু মানুষের সম্পদ, বিশেষ করে গ্রামীন মানুষের অর্থনৈতিক কাজের সহায়ক। তারা মাঠেঘাটে ঘাস খেতে খেতে অনেক সময় কুকুরের কামড়ে আক্রান্তও হয়। ওদের ক্ষেত্রে এই কামড় অত্যন্ত বিপদজ্জনক, কারণ, ওরা মুখ নিচু করে ঘাস খায় বলে খুব সহজেই কুকুরের কামড়ের আওতায় চলে আসে এবং মস্তিষ্কের খুব কাছাকাছি জায়গা, মুখে কামড় খায়। ফলে সহজেই রেবিস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও ভীষণ বেড়ে যায়। এরকম একাধিক নিদর্শন আমরা সে সময়ে দেখেছি। ফলে, মানুষ ছাড়াও, গৃহপালিত পশুদেরও জলাতঙ্কের সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা সমানভাবে উদ্যোগী হই।


নান্না ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সংগৃহীত জলাতঙ্কের টিকা নিতে আসা 
মানুষজনের চিরকুটের মত প্রেসক্রিপশনের নমুনা ও ARV-র চাহিদা যোগানের চিত্র

আগেই উল্লেখ করেছি যে, মোটামুটি ৯৬% ক্ষেত্রে কুকুরের সংস্পর্শেই জলাতঙ্ক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের সাথে বার বার মত বিনিময় করে আমরা উপলব্ধি করি যে, জলাতঙ্ক প্রতিরোধে বাজার হাটে, পথে ঘাটে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। একই সঙ্গে কুকুরের যাতে রেবিস না হয়, তার জন্য তাদেরও রেবিস প্রতিরোধী টিকাকরণও প্রয়োজন। এতে কুকুর এবং মানুষ, উভয়েরই রেবিস বা জলাতঙ্কের আতঙ্ক থেকে অনেকটা রক্ষা করা যায়। স্থানীয় প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে তারাই এই কাজ করতে পারতেন। এবং সেটা তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু, আগেই বলেছি, স্থানীয় প্রশাসনের সেই পরিকাঠামো নেই এবং পরিকাঠামো গড়ে তোলার কোনোও উদ্যোগ ছিল না। এই পরিস্থিতি মাথায় রেখেই হালিসহর বিজ্ঞান পরিষদ, স্থানীয় এলাকায় একটি অঞ্চল জুড়ে কুকুরদের নির্বীজকরণ ও রেবিস প্রতিরোধী টিকাকরণের একটি মডেল শিবির আয়োজন করে। মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় প্রশাসনের কাছে একটি নমুনা তুলে ধরা যে, তারা ইচ্ছে করলেই এই কাজ করতে পারে। এবং এরকম উদ্যোগ নেওয়া মূলত প্রশাসনেরই কাজ। কিন্তু, স্থানীয় প্রশাসনের সেই পরিকাঠামোই নেই। অগত্যা আমরা কলকাতা পুরসভার দ্বারস্থ হই। কিন্তু, জেনে বিস্মিত হতে হয়,সয়ং কলকাতা পুরসভার একসময় এই পরিকাঠামো থাকলেও, সেই সময়েই সেটি পুরোপুরি পঙ্গু করে রাখা হয়েছিল। পুরসভা নিজেদের পরিকাঠামো পঙ্গু করে দিয়ে,সম্পূ্র্ণ বেসরকারী একটি সংস্থা C.S.P.C.A ('The Calcutta Society for the Prevention of Cruelty of Animals')-কে দিয়ে এই কাজ করায়। সেই মতো অগত্যা আমাদেরও C.S.P.C.A-র স্মরনাপন্ন হতে হয়। যাই হোক, স্থানীয় বেশ কয়েকটি ক্লাবের সহযোগিতায় আমরা হালিসহর পূর্ব পাড়ে জেটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এই মডেল শিবিরটি পরিচালনা করি। এলাকায় বেশ সাড়াও পেয়েছিলাম। পরবর্তীকালে, পরিষদের দাবিতে জেটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত নিজেদের আর্থিক ব্যয়ে একটি 'শো কার্ড'ও তেরি করে। যার দু’দিকের এক দিকে জলাতঙ্ক আর অপর দিকে সাপ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার স্থান পায়।

এছাড়াও, পরিষদ নানা সময়ে জলাতঙ্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে নিজেদের এবং আশপাশের মানুষজনদেরও জলাতঙ্ক প্রতিরোধে সচেতন করে গড়ে তোলার প্রয়াস নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় পরিষদ প্রকাশ করে 'জলাতঙ্ক' শিরোনামে একটি পুস্তিকাও। যেটি সর্ব স্তরের মানুষের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

এটুকু বলে শেষ করব যে, হালিসহর বিজ্ঞান পরিষদের সে দিনের সেই উদ্যোগের সাথে আজকের পরিস্থিতি তুলনা করলে তফাৎটা বেশ পরিষ্কার হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবাই বলি বা জনস্বাস্থ্যই বলি, আজকের মত সেদিনের সেই পরিস্থিতি এতোটা ভয়ঙ্কর বাণিজ্য সর্বস্ব হয়ে ওঠেনি। তবে তার ইঙ্গিত অবশ্যই ছিল। লেখার শুরুতে উল্লেখিত N.T.V.-এর কার্যকারিতা নিয়ে ডা: দাস যে মন্তব্য করেছিলেন, অনেক বিশেষজ্ঞ সেটার বিরোধিতা করে অনেক কথা বলেছিলেন। তাঁদের মতে N.T.V-এর কার্যকারিতা তার গুণমান কোনটাই হারায়নি। বরং, পরিবহনজনিত ত্রুটি, উপযুক্ত তাপমাত্রায় তাকে সংরক্ষণের ত্রুটি, ইত্যাদি তার গুণমানে কিছু ঘাটতি হলেও হতে পারে। এবং এটি মূলত সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরিকাঠামোগত ত্রুটি। বরং, কলকাতায় পাস্তুর ইনস্টিটিউটে তৈরি টিকা বিনামূল্যে সরকারী হাসপাতালে দেওয়া সম্ভব, উচিতও। এর ফলে অনেক মানুষ এই টিকা নিতে পারবে। এটা ঠিক যে, নাভির চারপাশে টানা সাত দিন ঐ টিকা নেওয়া সত্যিই কষ্টকর। এবং আরোও উন্নতমানের টিকা তৈরি'র চেষ্টা তখনও চলেছিল। তারই ফল স্বরূপ T.C.V. তৈরিতে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন ছিল। তবে এর সাথে দুঃশ্চিন্তারও কারণ ছিল। যা আজ স্পষ্ট হয়েছে। N.T.V-র জায়গায় অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের, T.C.V. এসেছে। কম যন্ত্রণাদায়ক এবং অনেক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন। বা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে। এমনকি সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যেই দেওয়া হয়। কিন্তু, সেটি বিদেশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে তৈরি। বাইরে থেকে অনেক বেশি দামে সরকারকে আমদানি করতে হয়। প্রশ্ন ওঠা কি অসমীচীন হবে? যদি বলি এক সময়কার জলাতঙ্কের টিকা তৈরিতে বিশ্বজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন কলকাতার পাস্তুর ইনস্টিটিউটে অপেক্ষাকৃত উন্নত মানের T.C.V. জলতঙ্কের টিকা তৈরি করা যাবে না কেন? কেন আমাদের নিজের দেশেই এই টিকা তৈরি সম্ভব নয়? প্রশ্ন তোলাটা কি নেহাতই বেয়াদপি হবে?

['চলিত কুয়াশা' পত্রিকার দশম সংখ্যা, ২০২৪-এ প্রথম প্রকাশিত।]  

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার