কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার
সুমিত ঘোষ
প্রতিটি সরকার তার নিজস্ব চিন্তাধারা বা আদর্শের
সমসাময়িক সমাজে বিরাজমানতাকে ব্যাপক করে তোলার উদ্দেশ্যে অনিবার্যভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায়
রদবদল ঘটায়। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে এর অন্যথা না হওয়াটাই সমাজ বিজ্ঞানের
নিরিখে স্বাভাবিক। এই রদবদল নিছকই দলীয় আধিপত্য বিস্তার করতে সহায়ক হয়ে ওঠে যদি না
নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণ
এই প্রক্রিয়াকে চালিত করে।
৮০-এর দশক থেকেই অন্যান্য ক্ষেত্রের মত শিক্ষা
ক্ষেত্রেও বেসরকারিকরণ জাতীয় কংগ্রেসের পলিসিগত অভিমুখ থেকেছে কিন্তু বহুবার জোট সরকার
পরিচালনার বাধ্যবাধকতায় তা বিভিন্ন ভাবে হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আঞ্চলিক
দলগুলি শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে খুব সদর্থক ভূমিকা রেখে এসেছে। বিহারের সর্বনিম্ন
সাক্ষরতার হার থেকে শুরু করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ের সংখ্যাগত অসমানতা,
হরিয়ানায় সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে মুখ্যমন্ত্রী ওম প্রকাশ চৌতালার ছেলের হাজত
বাস, উত্তর প্রদেশে অখিলেশ যাদব সরকারের আমলে দেশের সবচেয়ে খারাপ শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত
কিংবা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি, সবই শিক্ষা প্রসঙ্গে আঞ্চলিক
দলগুলির মনোভাবের পরিচায়ক। তবে বর্তমান কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০২০’
পূর্বতন সমস্ত শিক্ষা নীতির চেয়ে আলাদা এখানেই যে এর আগে এত ব্যাপক অর্থে ঔপনিবেশিক
শিক্ষা ব্যবস্থার ধারাবাহিকতার আমূল পরিবর্তনের পথে কোনও সরকারই হাঁটেনি। তাই প্রশ্ন
উঠবে যে এই পরিবর্তন দেশের সাধারণ জনগণকে কোন পথে টেনে নিয়ে যাবে। সেই আলোচনা করতেই
এই প্রবন্ধের অবতারণা।
যেহেতু বিজেপি সরকারের হাতেই এই নয়া শিক্ষা
নীতির অবতারণা, তাই শুরুতে দেখে নেওয়া যাক বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে শিক্ষার হাল
ঠিক কিরকম থেকেছে। অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশান রিপোর্ট সার্ভে অনুযায়ী ঝাড়খণ্ডে
বিজেপি সরকার থাকাকালীন ২০১৭ সালে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে পড়ুয়াদের উপস্থিতির
হার জাতীয় গড়ের চেয়ে কম ছিল। ২০১৩ সালে মধ্যে প্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে
৪০-এর উপর অভিযুক্তের রহস্য মৃত্যু সকলেরই জানা। কর্ণাটকে বিজেপি সরকারের আমলে মাত্র
২৩% বিদ্যালয়ে রাইট টু এডুকেশান অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ছিল, ৭৫.৪% সাক্ষরতা
হারের মাঝে পড়ুয়ার অভাবে ১৩০০০ বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এবং
তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের স্কলারশিপ প্রদান বিলম্ব করা বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই
বিজেপি-ই এনেছে এন.ই.পি, ২০২০। তাই আসুন, এবার দেখে নেওয়া যাক এই শিক্ষা নীতির মূল
বৈশিষ্ট্যগুলি।
এই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় ইউরোপীয় ধাঁচার
বদলে মার্কিন ধাঁচা আমদানি করা হয়েছে। স্কুল শিক্ষার স্তরে ১০+২ ব্যবস্থার বদলে ৫+৩+৩+৪
ব্যবস্থা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক ৫ বছরের প্রথম ৩ বছর হবে সম্পূর্ণ খেলাধুলো
সম্পর্কিত এবং পরের ২ বছরে ১ম এবং ২য় শ্রেণী অন্তর্ভুক্ত থাকবে। শেষ ৪ বছরে গুরুত্বের
নিরিখে একত্রিতভাবে ৯ম থেকে ১২শ শ্রেণীকে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আলাদা করে ১১শ ও ১২শ শ্রেণীর
স্ট্রিম নির্ধারণগত গুরুত্ব থাকবে না; ১০ম ও ১২শ-এর বোর্ড পরীক্ষার গুরুত্ব প্রাথমিকভাবে
কমিয়ে পরবর্তীতে এই প্রথা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার ভাবনা চিন্তা চলছে! পড়াশোনার পূর্ণাঙ্গ
স্ট্রিম নির্ধারণ হবে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে। প্রথম বর্ষের দুটি সেমিস্টারে বিষয় পরিবর্তনের
সুযোগ থাকবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের বর্তমান ৩+২ ব্যবস্থার বদলে আনা হচ্ছে মার্কিন
ধাঁচের ৪+১ ব্যবস্থা। স্কুল এবং কলেজ স্তরে পড়ুয়ারা যে কোনও সময় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে
আবার যে কোনও পরবর্তী শিক্ষা বর্ষে ছেড়ে যাওয়া পর্যায় থেকে পঠনপাঠন শুরু করতে পারবে।
স্কুল স্তর থেকেই পড়ুয়ারা নিজেদের পড়ার বিষয়ের কম্বিনেশান ইচ্ছা মতন পরিবর্তন করতে
পারবে। স্নাতক স্তরের ৪ বছরের প্রথম বর্ষে কেউ পড়াশোনা ছাড়লে সার্টিফিকেট পাবে, দ্বিতীয়
বর্ষে ছাড়লে ডিপ্লোমা, তৃতীয় বর্ষে ছাড়লে গ্র্যাজুয়েট এবং ৪ বছর সম্পূর্ণ করলে অনার্স
ডিগ্রি লাভ করবে। তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ৭৫% নম্বর পেলে পড়ুয়ারা চতুর্থ বর্ষে
প্রোজেক্টের কাজ করতে পারবে এবং ‘অনার্স উইথ রিসার্চ’ ডিগ্রী লাভ করে সরাসরি গবেষণার
কাজে যুক্ত হতে পারবে কিন্তু নির্ধারিত নম্বর না পেলে প্রোজেক্টের কাজে যুক্ত না থেকে
চতুর্থ বর্ষে ‘গ্র্যাজুয়েট উইথ অনার্স’ ডিগ্রি লাভ করে এক বছর স্নাতকোত্তর কোর্স সম্পূর্ণ
করে তবেই গবেষণার কাজে পড়ুয়ারা যুক্ত হতে পারবে।
সামগ্রিকভাবে এই নয়া শিক্ষা ব্যবস্থা কোনও
বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞানার্জনের বদলে ভোকেশনাল ট্রেনিং, ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্সের
উপর বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এটা মনে হতেই পারে যে এর ফলে পড়ুয়াদের অর্থ
উপার্জনের পথ মসৃণ করতেই সরকারের এহেন অবস্থান কিন্তু এই শিক্ষা নীতিতে শিক্ষান্তে
কর্মসংস্থানের বিষয়ে এক প্রকার মুখে কুলুপ এঁটেছে প্রণেতারা। বিষয় ও স্ট্রিম নির্ধারণে
শিথিলতা শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে থাকা পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের বুনিয়াদি শিক্ষার পথে
বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং সামগ্রিকভাবে পড়ুয়াদের ইংরেজি প্রবাদ ‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস, মাস্টার
অফ নান’-এর মর্মার্থে পরিণত করবে। আদতে এর ফলে দক্ষতার অভাবের অজুহাতে সরকারি এবং বেসরকারি
উভয় কর্মক্ষেত্রেই স্বল্প বেতনে বর্তমান পড়ুয়াদের কাজ করিয়ে নেওয়ার পথ মসৃণ হবে। মোদ্দা
কথা, স্বল্প বেতনে কাজ করিয়ে নেওয়ার নয়াউদারবাদী আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে এই শিক্ষা নীতি।
এই শিক্ষা নীতিতে ‘মাল্টিপেল এন্ট্রি অ্যান্ড
এক্সিট’-এর নামে আসলে যে কোনও সময় পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে কিন্তু
তারপর পড়ুয়াদের কি ধরণের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে তা নিয়ে কিছু বলা নেই। তাছাড়া আমাদের
দেশের বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্যের মাঝে একবার পড়াশোনা ছেড়ে দিলে পড়ুয়াদের আবার লেখাপড়ায়
ফিরে আসার কতটা সুযোগ থাকবে তা একটা বড় প্রশ্ন। মার্কিন শিক্ষা ব্যবস্থার ললিপপ জনগণকে
ধরানো হলেও মার্কিন ও ভারতীয় বাস্তবতা যে সম্পূর্ণ আলাদা তা বলাই বাহুল্য। ফলে এই শিক্ষা
নীতির কার্যক্ষেত্রে কাকের লেজে ময়ূরের প্যাখম মার্কা পরিণতির কথা ভাবা নিছক অলীক কল্পনা
নয়।
বর্তমানে কেন্দ্র সরকার জিডিপি-র মাত্র ৩%
শিক্ষা খাতে ব্যয় করে। এন.ই.পি-তে তা বাড়িয়ে ৬% করার কথা বলা হয়েছে। মনে হতে পারে যে
শিক্ষা খাতে ব্যয় দ্বিগুণ করার কথা তো বলা হয়েছে কিন্তু বর্তমান ব্যয় যেখানে খুবই শোচনীয়
এবং নতুন যা কিছু করার কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবায়িত করতে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন তা এতটাই
ব্যয় সাপেক্ষ যে আদতে কাগুজে দাবীগুলি কতটা শিক্ষাঙ্গনে প্রতিফলিত হবে তা প্রশ্নের
মুখে। ফলে কিছু সরকারি শহুরে বিদ্যালয়ে এগিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই সুযোগগুলো
সীমাবদ্ধ রাখা হবে আর বেসরকারি বিদ্যালয়ে এই সুযোগগুলো দেওয়ার নামে বর্ধিত ফি শিক্ষার
পণ্যায়নকে ত্বরান্বিত করবে। পড়াশোনার চাপ কমানোর নামে বোর্ড পরীক্ষাগুলো তুলে দেওয়ার
কথা বলা হচ্ছে যার ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনার গুরুত্ব হ্রাস পাবে
কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল-এর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো বহাল রাখা হচ্ছে।
অর্থাৎ বুনিয়াদি শিক্ষা সম্পর্কিত বোর্ড পরীক্ষার বদলে ব্যয়বহুল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো
এই শিক্ষা নীতিতে গুরুত্ব পাবে যা ঘুর পথে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা বেসরকারি শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলির আসন ভরাট করে শিক্ষার পণ্যায়নকে নয়া মাত্রা দেবে। এই নয়া শিক্ষা নীতিতে
সরকারি দায় ঝেড়ে ফেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির নামে এন.জি.ও ও বেসরকারি
প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর চাপানো নিয়মকানুন পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পি.পি.পি) মডেলের
মাধ্যমে শিথিল করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে এন.জি.ও
ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ কার্যকলাপের কথাও বলা হয়েছে যা ক্রমে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির
ঝাঁপ ফেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করবে।
স্নাতকোত্তর স্তরকে বিদ্যালয় থেকে কলেজ স্তরের
পাঠ্যক্রম নির্ধারণের বেঞ্চমার্ক ধরার প্রথা আজ বিলুপ্তির পথে কারণ স্নাতকোত্তর স্তরের
অস্তিত্বই এই শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশ্নের মুখে। ৭৫% নম্বর অর্জনের ভিত্তিতে দুই ধরণের
বৈষম্যমূলক ডিগ্রি চালু হতে চলেছে যা গবেষণার পরিসরে পড়ুয়াদের বিরাট অংশের ক্ষেত্রে
বাধা হয়ে দাঁড়াবে। স্নাতক স্তরে যে সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ কম, সেই বিষয়গুলোর
কি পরিণতি হবে তা বলা কঠিন। কলেজগুলিতে পরিকাঠামোর ব্যাপক অভাব এবং সরকারি অনুদান বৃদ্ধির
চিহ্ন মাত্র না থাকার মাঝে প্রোজেক্ট করানোর তাড়না বহু স্নাতকোত্তর বিষয়ের উপর নয়াউদারবাদের
খাঁড়ার ঘা ফেলবে। শিক্ষা অর্জনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ১ বছর হ্রাস সামগ্রিকভাবে বিদ্যালয়ের
পাঠ্যক্রমে বহু বিষয়ের মস্তিষ্কের বিকাশ অনুযায়ী বুঝতে পাড়ার সময়ের আগেই অবতারণা চাপ
ফেলতে চলেছে নিম্ন কক্ষের পড়ুয়াদের উপর। এই ব্যবস্থায় এর থেকে পরিত্রাণের উপায় সেই
বিষয়গুলো ইচ্ছা মতন বাদ দেওয়া এবং নিজেদের বিভিন্ন বিষয় করায়ত্ত করার ক্ষেত্রে জগাখিচুড়ি
পাকানো!
এই নয়া ব্যবস্থায় স্কুল স্তরে ৩য় শ্রেণী থেকে
‘থ্রি ল্যাঙ্গুয়েজ ফর্মুলা’ প্রয়োগ করা হবে যার মধ্যে ২টি ভাষা ভারতীয় হতে হবে। ৬ঠ
ও ৭ম শ্রেণীতে ভাষার কম্বিনেশান পরিবর্তন করা যাবে। ৬ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ‘এক
ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ প্রকল্পের অধীনে পড়ুয়াদের ভারতীয় ভাষার ইতিহাস শেখানো হবে; সংস্কৃত
ভাষাকে মূলধারায় নিয়ে আসা হবে। ‘সংস্কৃত লার্নিং সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং ভারতীয়
কলা ও সংস্কৃতি পড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ স্কলারশিপ দেওয়া হবে।
বিভিন্ন হিন্দি অপ্রধান রাজ্যে কেন্দ্র সরকারের
হিন্দি চাপানোর প্রচেষ্টা সকলেরই জানা। ফলে এই ‘থ্রি ল্যাঙ্গুয়েজ ফর্মুলা’-য় ইংরেজি
ও হিন্দিরই যে সরকারি গুরুত্ব থাকবে তা বলাই বাহুল্য। এই শিক্ষা নীতিতে সংস্কৃত ভাষার
গুরুত্ব বৃদ্ধি দ্রাবিড় ভাষাসমূহ এবং উর্দু ভাষাভাষীদের প্রতি বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি
সৃষ্টি করবে। ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’-এর নামে আদতে আর.এস.এস-এর সাম্প্রদায়িক মতবাদের
ভিত্তিপ্রস্তর পাঠ্যক্রমে প্রবেশ করবে! ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’-এর মাধ্যমে পড়ুয়াদের
নীতি শিক্ষা দেওয়ার নামে গেরুয়া রাজনীতির ভ্রান্ত সাম্প্রদায়িক মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী
দর্শনের সাথে পড়ুয়াদের পরিচিত করার চেষ্টা চলবে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে শিক্ষার
উপর রাজ্য সরকারের অধিকারকে খর্ব করে ‘সেন্ট্রাল অ্যাডভাইজারি বোর্ড অফ এডুকেশান’-কে
শক্তিশালী করার নিদান দেওয়া হয়েছে। পাঠ্য বই প্রকাশের ক্ষেত্রে এন.সি.আর.টি নির্ধারিত
পাঠ্যসূচী, বোর্ড পরীক্ষার পরিবর্তে ‘পারাখ’ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ক্ষেত্রে
এন.টি.এ-র গুরুত্ব প্রদান আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার ফ্যাসিস্ট কায়দায় কেন্দ্রীভবনে সাহায্য
করবে। এই শিক্ষা নীতির পরতে পরতে ডিজিটাল শিক্ষার তাড়না স্মার্ট ফোন না থাকা পড়ুয়ার
দুর্দশা বাড়াবে। এই সমগ্র ব্যবস্থায় পড়ুয়াদের নিজস্ব মতামত দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার
সম্পর্কে কিছুই বলা নেই বরং ‘অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট’ মারফৎ তাদের প্রতিবাদী
সত্তার উপর নজরদারির সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে!
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এই নয়া ব্যবস্থায়
নয়াউদারবাদী মিতব্যায়িতার ছাপ স্পষ্ট। স্কুল কমপ্লেক্স তৈরির নামে স্কুল ও শিক্ষক পোস্টের
সংখ্যা হ্রাস, স্কুলে পড়ানোর ক্ষেত্রে ৪ বছরের বাধ্যতামূলক ব্যয়বহুল বি.এড কোর্স, প্রতিবন্ধী
ছাত্রদের ক্ষেত্রে পার্ট-টাইম শিক্ষক রাখার নিদান, টেট পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ
ছাড়াও ‘মাস্টার ইন্সট্রাক্টার’-এর নামে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্বদের ক্লাস করানোর
প্রস্তাব সরকারি ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ার কফিনে শেষ পেরেকটুকু পুঁততে সাহায্য
করবে।
এই শিক্ষা নীতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হতে
চলেছে শ্রমিক, কৃষক ও পিছিয়ে পড়া অংশের পরিবারের পড়ুয়ারা। সংরক্ষণ প্রথা সম্পর্কে কোনও
কথা না বলে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের উন্নতিকল্পে শুধু ‘ওপেন স্কুলিং’-এর
উল্লেখ রয়েছে। তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ও.বি.সি-র সামাজিক উন্নতির জন্য দিশাপূর্ণ কিছুই
বলা হয়নি। মেয়েদের জন্য সাইকেল দানের তৃণমূল কংগ্রেসি নিদান বিজেপির শিক্ষা নীতিতেও
প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আর হিজড়ে ও অন্যান্য প্রান্তিক লিঙ্গের কথা বাদ রেখে কেবল ট্রান্সজেন্ডারদের
উদ্দেশ্যে ‘ইনক্লুসিভ ফাণ্ড’-এর ভণ্ডামি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তিনটি অভিমুখ – এক, বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সকলের জন্য শিক্ষা ও শিক্ষান্তে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কায়েমের লড়াই, দুই, অবিপ্লবী পরিস্থিতিতে বর্তমান বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার সীমিত পরিসরে বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার পথ অনুসন্ধান এবং তিন, এন.ই.পি রোধ করা না গেলে অন্তত গেরুয়া সাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রচারের পথে বাধাদান। পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে দুটি বৈশিষ্ট্য মাথায় রাখা দরকার – এক, বামফ্রন্টের শিক্ষানীতির ত্রুটি বিচ্যুতি কোনভাবেই বর্তমান তৃণমূল সরকারের শিক্ষা বিরোধী অবস্থানের সমতুল্য নয় এবং সেই আমলে বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রসার হলেও বর্তমান অরাজকতার নিরিখে দেখলে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার কোমর ভেঙে দেওয়া হয়নি এবং দুই, এ রাজ্যে বিজেপির শিক্ষা নীতি ১৮ই মার্চ মধ্যরাতে লাগু করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার যাদের শিক্ষাক্ষেত্রে লাগামছাড়া দুর্নীতি এই শিক্ষা নীতির পক্ষে জন সমর্থন আদায় করতেও সাহায্য করেছে। জনঅসন্তোষ আঁচ করতে পেরে নেপ-এর বদলে স্টেট এডুকেশান পলিসি চালুর নামে স্কুল স্তরে বোর্ড পরীক্ষার রীতি বহাল এবং রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিষয় হিসেবে বাংলা বাধ্যতামূলক করার ললিপপ প্রতিবাদী শিবিরকে ধরাতে চাইছে তৃণমূল সরকার। এর ফলে একদিকে অঞ্চল বিশেষে হিন্দি, উর্দু, সাঁওতালী, রাজবংশী, কুরুখ, কুড়মালি ও নেপালী ভাষার গুরুত্বের দাবী ফিকে হয়ে যাবে আর অন্যদিকে সেপ-এর নামে আদতে নেপ-এরই প্রচলন করা হবে। উল্লেখ্য, বিজেপির ‘এক দেশ, এক পাঠ্যক্রম’ স্লোগানকে নেপ চালুর অনেক আগেই এ রাজ্যে বাস্তবায়িত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস! ফলে এই রাজ্যে বিজেপির শিক্ষা নীতির বিরোধিতা করতে হলে তৃণমূলের শিক্ষা নীতিরও বিরোধিতা করতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রম নির্ধারণ (বিশেষ করে ভ্যালু অ্যাডেড কোর্স)-এর ক্ষেত্রে প্রগতিশীল শিক্ষকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। এই নয়াউদারবাদী আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে সংখ্যায় বাড়তে থাকা কন্ট্র্যাকচুয়াল শিক্ষকরাই বিজেপির শিক্ষা নীতি বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান সংগঠক। বৃহৎ বেতনভুক পার্মানেন্ট শিক্ষকদের সংগঠনগুলি কন্ট্র্যাকচুয়াল শিক্ষকদের অধিকারের দাবীগুলি না তুললে কন্ট্র্যাকচুয়ালদের নিজেদেরই লড়াই শুরু করতে হবে। পড়ুয়াদের মতামত রাখার অধিকার সুনিশ্চিত করার দাবীতে ছাত্র সংগঠনগুলিকে আন্দোলনে নামতে হবে। কর্মসংস্থানের দাবীতে যুব সংগঠনগুলিকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। নিজ সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে ট্রেড ইউনিয়ন এবং কৃষক সভাগুলিকে ছাত্র ও যুব আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে হবে।
[ঈশান পত্রিকার ডিসেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।]
Picture Courtesy: scoonews.com
Comments
Post a Comment