ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে বামেরা কোথায়?
শংকর
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। বামপন্থী দলগুলি এখনও সমস্বরে একটা খুব সাধারণ কথা বলে উঠতে পারেনি, যা কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বারবার বলে চলেছেন। কথাটা হল এই যে, এই নির্বাচন আর পাঁচটা নির্বাচনের মত নয়। এই নির্বাচন ফ্যাসিবাদের কবলে সম্পূর্ণভাবে আমাদের দেশ চলে যাবে কি না তা ঠিক করার নির্বাচন। ফ্যাসিকরণের যে প্রক্রিয়া ২০১৪ সাল থেকে ভারতে শুরু হয়েছে তা বর্তমানে সর্বোচ্চ বিন্দুতে আরোহন করেছে এবং এবারের নির্বাচনে বিজেপি জিতলে ভারতে ফ্যাসিবাদী শাসন পুরোদস্তুরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই সোজাসাপটা কথাটা বামপন্থীদের অধিকাংশ সংগঠন বলতেই পারছে না। কেন বলতে পারছে না? এর কারণ হল অন্তত দুটি বিষয় নিয়ে বামপন্থীদের একটা বড় অংশ, বিশেষ করে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীরা একেবারে বিভ্রান্ত ও ভ্রান্ত রাজনৈতিক অবস্থান ও ভাবনাচিন্তায় আছে। সেদুটি হল ফ্যাসিবাদ এবং নির্বাচনে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের কর্তব্য। আর যেহেতু এই ভ্রান্তি এবং বিভ্রান্তির কারণে তাঁরা ফ্যাসিবাদের বিপদকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছেন না তাই তাঁরা দেশের এই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে কার্যকরী কোনো ভূমিকাও রাখতে পারছেন না। সুতরাং, ফ্যাসিবাদ ও নির্বাচনে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের কর্তব্য নিয়ে বামপন্থীদের মধ্যে সিরিয়াস আলোচনার দরকার আছে। আমি প্রথমে ফ্যাসিবাদ নিয়ে কিছু আলোচনা করব। তারপর নির্বাচনে কমিউনিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে কয়েকটি কথা বলা যাবে।
ফ্যাসিবাদ
ফ্যাসিবাদ নিয়ে ভারতের বামপন্থী মহলে গত দশ বছর ধরে, নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হবার পর থেকেই, বহুপ্রকার আলাপ আলোচনা চলছে। এই আলোচনার শুরু থেকেই একটা বেশ কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বামপন্থীদের মধে যাঁরা অবিজেপি বুর্জোয়া দলগুলির সাথে হাত মিলিয়ে চলার পক্ষপাতী তাঁরা জোরেসোরে ফ্যাসিবাদের বিপদ নিয়ে কথা বলছেন। আর যাঁরা অবিজেপি বুর্জোয়া দলগুলির সাথে হাত মেলাতে চান না তাঁরা নানাভাবে, নানা ছুতোয় ফ্যাসিবাদের বিপদকে লঘু করে দেখছেন। এক্ষেত্রে আমাদের বুঝে রাখতে হবে, এই উভয়পক্ষই পরিস্থিতির বিচারের আগেই তাঁদের নিজ নিজ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আগে থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তকে যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ করার জন্যে তাঁরা বিচার প্রক্রিয়ায় ঢুকছেন। গোটা ব্যাপারটাই অমার্কসীয় এবং অসৎ। ফলে তাঁদের বিচার প্রক্রিয়াও দায়সারা, পালিয়ে বেরানো এবং জবরদস্তিমূলক।
কিন্তু রাজনীতির এই বদ্ধজলার বাইরেও অনেক সৎ বামপন্থী তথা কমিউনিষ্ট আছেন যাঁরা সত্যি সত্যি ফ্যাসিবাদ নিয়ে বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তি নতুন নয়। ফ্যাসিবাদের প্রথম দফাতেও, অর্থাৎ গত শতকের দুই বা তিনের দশকেও এই বিভ্রান্তি কমিউনিষ্ট মহলে প্রবলভাবে ছিল। আজ, প্রায় একশ’ বছর পরেও আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এইটি। কমিউনিষ্টরা এমন একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ধারা বলে নিজেদের প্রতিপন্ন করছেন যাঁরা একশ’ বছর ধরেও একটা সামান্য বিভ্রান্তি কাটাতে পারেন না।
১৯২৩ সালে ক্লারা জেটকিন ফ্যাসিবাদ নিয়ে প্রথম একটি লেখা তৈরি করেন তৃতীয় আন্তর্জাতিকের জন্যে। ফ্যাসিবাদকে নানা দিক থেকে সেই লেখাতে বিশ্লেষণ করা হয়। এটিই ছিল কমিউনিষ্টদের পক্ষ থেকে ফ্যাসিবাদ নিয়ে প্রথম সুচিন্তিত রচনা। আমি এই লেখার বিস্তারিত বিশ্লেষনে যাচ্ছি না। কিন্তু একটা বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ক্লারা এই লেখাতে বামপন্থীদের মধ্যে সংস্কারবাদী এবং পেটিবুর্জোয়া প্রবণতার লোকেরা ফ্যাসিবাদের মধ্যে শুধু বুর্জোয়াদের সন্ত্রাসমূলক আক্রমণের দিকটাই যে দেখে সেটিকে চিহ্নিত করেছিলেন। শ্রমিকশ্রেণির ওপর বুর্জোয়াদের যে কোনো অগণতান্ত্রিক, সন্ত্রাসী আক্রমণকেই এঁরা ফ্যাসিবাদ হিসাবে চিহ্নিত করেন, সে কথা ক্লারা খুব পরিষ্কার করেই বলেন। ক্লারা লেখেন,
The view that fascism is merely a form of bourgeois terror, although advanced by some radical forces in our movement, is more characteristic of the outlook of many reformist social democrats. For them fascism is nothing but terror and violence — moreover a bourgois reflex against the violence unleashed or threatened against bourgeois society by the proletariat.
আজকে প্রায় একশ’ বছর পরেও আমাদের দেশের কমিউনিষ্টদের মধ্যে এই যাকে ক্লারা জেটকিন বলেছিলেন ‘'ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে সংস্কারবাদী সমাজ-গণতন্ত্রী ধারণা’, সেটাই কিন্তু অনেক বেশি প্রধান্যকারী ধারণা৷ বুর্জোয়াদের যে কোনো সন্ত্রাস ও হিংসামূলক কার্যক্রমকেই নির্দ্বিধায় ফ্যাসিবাদী বলে বর্ণনা করা হয় এবং যে শক্তি সেটা করে থাকে তাকে ফ্যাসিবাদী বলে দেগে দেওয়া হয়। ফলে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থা জারি এবং সত্তর দশকের কংগ্রেসের সন্ত্রাসও অধিকাংশ বামপন্থীদের কাছে ছিল ফ্যাসিবাদ। সুতরাং, ২০১৪ পরবর্তী সময়ে যখন সত্যিকারের ফ্যাসিবাদ দেখা দিল তখন রণনীতি ও রণকৌশল যে বদলানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সে কথা অধিকাংশ কমিউনিষ্ট তথা বামপন্থী সংগঠনেরই ধারণায় আসে নি। এঁদের দশা হল সেই রাখাল বালকের মতো যে কিনা ‘'গরুর পালে বাঘ পড়েছে” বলে খামোকা চীৎকার করে লোকজন জড়ো করত, আর যখন সত্যি সত্যি বাঘ পড়ল তখন পাশে কাউকে পেল না।
ফলে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন যে কায়েম হয়েছে তার স্পষ্ট ঘোষণা করতে অধিকাংশ বামপন্থী শক্তিই ব্যর্থ বা অপারগ হয়েছেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই তো অনেক দূরের ব্যাপার। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ক্লারা জেটকিনের থিসিস রচিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে। তখনও ফ্যাসিবাদের সম্পূর্ণ চরিত্র পরিস্ফুট হয়নি। পরবর্তীকালে দিমিত্রভের থিসিসই ফ্যাসিবাদের চরিত্রকে সম্পূর্ণভাবে চিত্রিত করে এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঠিক রূপরেখাও প্রস্তুত করে। ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি অবশ্যই পুঁজিবাদের তীব্র এবং বিশ্বজোড়া আর্থিক সংকটের প্রেক্ষিতে ঘটে। ১৯৩০-এর বিশ্বমহামন্দা যেমন ছিল ফ্যাসিবাদের প্রথম পর্যায়ের উৎপত্তির কারণ তেমনি ২০০৮-এর পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশ্বমহাসংকট হল ফ্যাসিবাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের দুনিয়াব্যাপী উত্থানের কারণ ও পরিপ্রেক্ষিত। এটা অবশ্যই ঠিক যে, পুঁজিবাদের সমস্ত অর্থনৈতক সংকট বা মন্দাই ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটায় না। এটা নির্ভর করে সংকটের চরিত্রের ওপর, তার বিস্তৃতি, গভীরতা ও তীব্রতার ওপর। আর নির্ভর করে পুঁজিবাদীরা সাধারণ অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক পথে এই সংকটের মোকাবিলা করতে পারছে কিনা তার ওপর। সব রাস্তা যখন বন্ধ থাকে তখন অবশ্যই পুঁজিবাদকে বিকৃত রাস্তা ধরতে হয় যা আবার সকল পুঁজিবাদীদের কাছে গ্রহনযোগ্য থাকেও না। কারণ সেই রাস্তায় সকল পুঁজিপতিদের স্থান থাকে না। এটা একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি। সাধারণভাবে পুঁজিবাদের মধ্যে সকল পুঁজিপতিদের জায়গা স্থিরীকৃত হয় প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তীব্র অর্থনৈতিক সংকট কোনো কোনো সময়ে পুঁজিবাদকে এমন জায়গায় ঠেলে দেয় যখন প্রতিযোগিতা বজায় রেখে সে আর এগোতে পারে না। তখন শুরু হয় পুঁজিবাদের বিকৃত রাস্তায় গমন যা প্রতিযোগিতাকে লোপাট করে পুঁজিপতিদের একটা ছোট অংশকে শাসন ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। দিমিত্রভ একেই বলেছিলেন “লগ্নিপুঁজির সর্বাপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল অংশের শাসন”! এটি ফ্যাসিবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
২০০৮-র পরবর্তীকালে গোটা দুনিয়াজুড়ে ফ্যাসিবাদ উদ্ভুত হয়েছে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের আসনে বসার পর থেকেই ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী গৈরিক ফ্যাসিবাদীরা ধীরে ধীরে দেশের ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। প্রথম পর্যায়ের ফ্যাসিবাদের থেকে আজকের ফ্যাসিবাদের কি কিছু পার্থক্য নেই? অবশ্যই আছে। এই পার্থক্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আজকের ফ্যাসিবাদকে সঠিক বিচারে নয়া ফ্যাসিবাদ বলা আমাদের পক্ষে সঙ্গত হবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদের যে মূল বা মৌলিক বৈশিষ্ট্য তা অবশ্যই আজকের ফ্যাসিবাদের মধ্যেও আছে কারণ সেটা ছাড়া ফ্যাসিবাদ হয় না। তা হল ফ্যাসিবাদ সকল বুর্জোয়াদের শাসন নয়, বুর্জোয়া শ্রেণির শাসন নয়। তা বুর্জোয়াদের একটি অংশের শাসন, বুর্জোয়াদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল, সন্ত্রাসী অংশটির শাসন হল ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদের এই বৈশিষ্ট্য সেদিনও ছিল, আজও আছে। এ ছাড়া ফ্যাসিবাদ হয় না।
আমাদের পারষ্পরিক মূল্যায়ন যাই হোক না কেন সারা দেশে লোকের চোখে সিপিএমই প্রধান ও বৃহৎ বাম তথা কমিউনিষ্ট দল হিসাবে পরিচিত। দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও ক্ষমতায় আসা নিয়ে তাঁদের অবস্থান কী? এই দলের একটি অংশ, যাঁরা প্রকাশ কারাতের নেতৃত্বে সংগঠিত, তাঁরা ২০১৪-পরবর্তী সময়ে যখন জোর কদমে ফ্যাসিবাদ নিয়ে চর্চা হচ্ছে তখন দীর্ঘদিন ধরে বলে গেলেন যে, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে এমন কথা তাঁরা মনে করেন না। ‘ফ্যাসিবাদী ধরণের একটা শাসন’ চলছে বটে কিন্তু ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত নয়। কেন তাঁরা এমন সব অদ্ভুত কথা বলছিলেন? কারণ একদিকে বিজেপি/আরএসএসের ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে তাঁরা অস্বীকারও করতে পারছেন না, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান যে বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ অফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের ফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার রণকৌশল, তা তাঁরা নিতে চাইছিলেন না। ফলে তাঁরা ফ্যাসিবাদকে স্বীকার করতেও চাইছিলেন না। সকলেই জানেন, কংগ্রেস সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করাই ছিল কারাতের নেতৃত্বের একটি মাইলফলক। সুতরাং, আবার কংগ্রেসের হাত ধরতে গেলে কারাত সাহেবের তো রাজনৈতিক পরাজয় হয়ে যাবে। সুতরাং, কথার ছলচাতুরী দিয়ে ফ্যাসিবাদকে অগ্রাহ্য করার লাইন নেওয়া হল।
অন্যদিকে সীতারাম ইয়েচুরিরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের পক্ষপাতী ছিলেন। ফ্যাসিবাদের উত্থানের আগে থেকেই তাঁরা কংগ্রেসের পিছলাগু। ফ্যাসিবাদের উত্থান তাঁদের নতুন যুক্তি সরবরাহ করল। ফ্যাসিবাদকে ব্যবহার করে তাঁরা এবার আরও জোরেসোরে কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্যের কথা প্রচার করতে শুরু করলেন। এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস এবং অন্যান্য অফ্যাসিবাদী বুর্জোয়া দলগুলির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁরা 'ইন্ডিয়া’ জোটে সামিল হলেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে কোনো ধরণের কোনো বোঝাপড়ায় যেতে তাঁরা কখনই চাইলেন না। কী যুক্তি তাঁদের? তাঁরা বলে বেরাচ্ছেন যে, তৃণমূল আর বিজেপি নাকি একই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আরএসএসের দুর্গা’’! ‘তৃণমূলই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে এনেছে’, ইত্যাদি। কিন্তু তাঁদের বিচারে আবার কংগ্রেস নাকি একেবারেই অন্যরকম। কংগ্রেস ফ্যাসিবিরোধী, গণতান্ত্রিক ইত্যাদি। আবার দেখুন কেরালাতে কিন্তু সিপিএম আর কংগ্রেসের কোনো জোট নেই। সেখানে কংগ্রেস কি আর গণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবিরোধী রইল না? সেখানে চলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। আসলে সিপিএমের রাজনীতির পেছনে আর কিছু নেই, যা আছে তা হল খুব স্বল্পমেয়াদী পাতি দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ। এই ধরণের দলের পক্ষে কখনই জনগণের নেতা হিসাবে উঠে আসা সম্ভব হবে না, হয় না, হয়নি।
অন্যদিকে সিপিএমের বাইরেকার বাম দলগুলির অবস্থান কী? সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বাইরে এসইউসিআই একটা বড় শক্তি। তাঁরা নির্বিচারে যেখানে যেখানে পারছেন প্রার্থী দিয়ে লড়াই করছেন। আমাদের রাজ্যের সবকটি আসনেই তাঁরা লড়ছেন। ফ্যাসিবাদের সময় আর ফ্যাসিবাদ-পূর্ববর্তী সময়ের পার্থক্য তাঁদের মাথায় আছে বলে মনে হয় না। সিপিএমের মত তাঁরাও কোনো কোনো আসনে বিজেপি-বিরোধী ভোট কেটে বিজেপির সুবিধা করে দিতে পারেন। অন্তত তত্ত্বগতভাবে সে সম্ভাবনা আছে। তাহলে কি তাঁরা ফ্যাসিবাদের উত্থানকে স্বীকার করেন না? তাঁদের পত্রিকা ‘গণবার্তা’য় যা লেখালিখি তাঁরা করছেন তাতে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা মনে করেন ভারতীয় বুর্জোয়ারা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে যেমন বিজেপিকে ব্যবহার করে তেমনই কংগ্রেসকেও ব্যবহার করে। সেই অর্থে বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে কোনো ফারাক আছে বলে তাঁরা মনে করছেন না। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে তাঁদের গোটা আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, দিমিত্রভের থিসিস তাঁরা আদৌ মানেন না। জীবন কী বিচিত্র! এই এসইউসিআই কী ভয়ানকভাবেই না স্তালিন বন্দনা করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার স্তালিনীয় মহিমা-কীর্তন গাইতে এঁরা শতমুখে সরব। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্তদের পরাজিত করতে যে দিমিত্রভ থিসিস মুখ্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল তাকে ভারতের নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে প্রয়োগে তাঁরা রাজি নন। আসলে এখানেও কাজ করছে সেই সংকীর্ণ পার্টি স্বার্থ। এরা কীভাবে জনগণকে পথ দেখাবে?
নকশালপন্থীদের অবস্থাও কম চিত্তাকর্ষক নয়। প্রথমদিকে তাঁদের একটি অংশ বলে আসছিল, ভারতের মত দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে না। কারণ, দিমিত্রভ বলেছেন যে, ফ্যাসিবাদ হল লগ্নিপুঁজির সর্বাপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল অংশের শাসন। কিন্তু ভারত তো একটা ‘আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনবেশিক’ দেশ। এখানে লগ্নিপুঁজিই নেই তো লগ্নিপুঁজির প্রতিক্রিয়াশীল অংশ আসবে কোথা থেকে? অবশ্য বিজেপি/আরএসএসের তানাশাহী বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে এই ধরণের বক্তব্যের অস্তিত্ব হাল্কা হতে শুরু করে। অতঃপর শুরু হল, নির্বাচনী সংগ্রামে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক। এর যে কী অর্থ তা সম্ভবত ঈশ্বরও বলতে পারবে না। কথা হচ্ছে, এই লোকসভা নির্বাচনে আমরা কী করব! জনগণ তো তাঁদের নেতাদের কাছে জানতে চাইবেন যে, আমরা কী করব? কাকে ভোট দেব, কাকে দেব না, ইত্যাদি। নকশালদের একটা অংশ বলতে শুরু করল, গণ-আন্দোলন গড়ে তোলো। সাথে জুড়ে রাখল, বিজেপিকে হারাও। বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে বিজেপিকে হারানো সম্ভব, কিন্তু ইভিএম মেশিন দিয়ে গণ-আন্দোলন কীভাবে গড়ে তোলা যাবে সে এক রহস্য। আসলে এঁরা ভাবছেন, ওই গণ-আন্দোলনের “রক্ষাকবচটা” না থাকলে যদি তাদের কেউ “ভোটবাজ” বলে, “চটিচাটা” বলে! তাঁদের বিপ্লবীয়ানা এতই ঠুনকো, তাঁদের আত্মবিশ্বাস এতই কম, প্রাণে এতই ভয় যে, একটা ঠিকঠাক স্লোগান পর্যন্ত তাঁরা দিতে পারছেন না। নকশালপন্থীদের কেউ কেউ আবার মনে মনে বামেদের ভোট দেওয়ার আহ্বান রাখতে ইচ্ছুক। কিন্তু ফ্যাসিবাদ, দিমিত্রভ ইত্যাদির সঙ্গে ব্যালান্স করে কীভাবে সে ইচ্ছাকে তত্ত্বায়ন করবেন তা বুঝতে পারছেন না। ফলে আপাতত নীরব আছেন! এই তো অবস্থা!
নকশালপন্থীদের একটা বড় অংশেরই মাথায় নির্বাচনী সংগ্রামকে অবজ্ঞা করা, তুচ্ছজ্ঞান করা এইসব সমস্যাও আছে। শুধু নকশালপন্থীরাই নয়, ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলনে প্রথম থেকেই নির্বাচনী সংগ্রামকে কীভাবে দেখা দরকার তা নিয়ে ভয়ানক জট রয়েছে। একশ বছরের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কমিউনিষ্টদের ব্যর্থ হবার মূলে যে সমস্যাগুলি রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। তাই আমি এবার এই বিষয়ে দু-একটি কথা বলব।
নির্বাচন এবং কমিউনিষ্টরা
১৯৪৭ সালে আমাদের দেশ আংশিক ও খন্ডিত স্বাধীনতালাভের পর সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তেলেঙ্গানার লড়াই এবং তার অব্যবহিতকাল পরেকার সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন (১৯৪৮-৫০) প্রত্যাহৃত হবার পর কমিউনিষ্ট পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে শুরু করে। আমাদের দেশের ব্যবস্থানুযায়ী নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরকার গড়ার সুযোগ তৈরি হল। পার্টির মধ্যে নির্বাচন এবং সংসদীয় ব্যবস্থাকে পার্টি কীভাবে ব্যবহার করবে সে প্রশ্ন উঠল। এর মধ্যেই অতিদ্রুত ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে কেরালায় কমিউনিষ্ট পার্টি সরকার গঠন করে ফেলে। খেয়াল করবেন, তখনও পার্টির মধ্যে বা বাইরে এমন কোনো অংশ ছিল না যারা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরকার গঠনকেই সংশোধনবাদ বলে চিহ্নিত করত। এমনকি আজ যারা এমন ধারণা পোষণ করেন তারাও কিন্তু ১৯৫৭ সালের কেরালা সরকারকে কমিউনিষ্ট সরকার বলেই মনে করেন। কিন্তু কালে কালে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয় যে, নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরকার গঠন করাটাই একটা সংশোধনবাদী প্রকল্প। এই ধারণা কোথা থেকে এবং কীভাবে গড়ে উঠল তা বলা মুশকিল কিন্তু বর্তমানে নকশালপন্থীদের একটা বড় অংশের এটাই ধারণা৷ নির্বাচন নিয়ে বর্তমানে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের মধ্যে তিন ধরণের ধারণা আছে। এক, সিপিএম এবং বামফ্রন্টের অন্যান্য শরিকদলগুলি মনে করেন যে, নির্বাচনে সর্বাত্মকভাবে লড়তে হবে এবং সরকার গড়ার সুযোগ আসলে তা গ্রহণ করতে হবে, তা সে রাজ্যেই হোক আর কেন্দ্রেই হোক। নকশালপন্থীদের একটি অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটাকেই সংশোধনবাদী কাজ বলে মনে করেন। তাদের মতে নির্বাচন বহির্ভূত সংগ্রামই হল কমিউনিষ্টদের একমাত্র কাজ। আর এই দুইয়ের মাঝখানে একটি অংশ আছে যারা মনে করেন যে, যেহেতু নির্বাচন একটি রণকৌশলগত ব্যাপার তাই পরিস্থিতি বুঝে তাতে অংশ নেওয়া যেতে পারে কিন্তু তাতে বেশি মনোযোগ দেওয়া, সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলা উচিৎ নয়। আর সরকার গঠন করা তো একেবারেই একটি সংশোধনবাদী কাজ। সিপিএমের কথায় পরে আসছি। আগে নকশালপন্থীদের নিয়ে দুটো কথা বলে নেওয়া যাক।
নকশালপন্থীদের যে অংশ নির্বাচনে অংশ নেওয়াটাকেই সংশোধনবাদী কাজ বলে মনে করেন তাদের এই ধারণা এসেছে কোথা থেকে? এটা এসেছে চিনের কমিউনিষ্ট পার্টির রণকৌশল থেকে। সবাই এটা জানেন যে, চিনে কমিউনিষ্ট পার্টি একটা দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল। চিনে কোনো সংসদীয় ব্যবস্থা ছিল না। সুতরাং, সেখানে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলনে একটি অংশ বরাবরই এটা ভেবে এসেছেন যে, যেহেতু চিনের সাথে আমাদের কিছু কিছু সাদৃশ্য রয়েছে তাই চিনের পথেই আমাদের বিপ্লব করতে হবে। এরা চিনের সাথে আমাদের পার্থক্যগুলিকে অগ্রাহ্য করে, আর অন্য সমস্ত বিষয়ের দিকে না তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে চিনের পথের অনুসরণ করার পক্ষপাতী। এই অন্ধ অনুকরণ, এই তাত্ত্বিক অলসতা তাদের এই ভুল পথে পরিচালিত করেছে। অন্যদিকে, নকশালপন্থীদের যে অংশটি নির্বাচনে অংশ নেব কিন্তু সরকারে যাব না, বা এমনকি নির্বাচনী সংগ্রামকে সিরিয়াসলিই নেব না, এমনটা ভাবেন তাদের এই ধারণা এসেছে কোথা থেকে? এটা এসেছে রাশিয়ায় ডুমা ব্যবস্থায় বলশেভিকদের রণকৌশলের বিকৃত বোঝাবুঝির জায়গা থেকে। উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে, মুখস্থবিদ্যা আর অন্যের দেখে টোকা ছাড়া নকশালপন্থীরা আর কিছু ভেবে উঠতে পারেন নি।
১৯৭০-এ নকশালপন্থীদের সকল ধারাই ভোট বয়কটের পক্ষে ছিলেন। আন্দোলনের পরাজয়ের পর যখন পুনর্মূল্যায়ন ও ভুল সংশোধন শুরু হল তখন একাংশ ভোটে অংশ নিতে শুরু করলেন। কিন্তু মুশকিল হল যে, এই পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অর্ধপক্ক থাকার ফলে তারা ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি অনুসন্ধান করলেন না, বরং যান্ত্রিকভাবে রাশিয়ার ডুমাতে বলশেভিকরা যেভাবে এগিয়েছিলেন তা অনুসরণ করতে গেলেন। আবার, ডুমা নির্বাচন নিয়ে বলশেভিকরা ঠিক কী ভাবতেন অথবা কীভাবে এই নির্বাচন লড়তেন তার গভীর অনুসন্ধানও তারা করলেন না। ফলে নির্বাচন নিয়ে অধিকাংশ নকশালপন্থী গোষ্ঠীগুলির ভাবনাচিন্তা ও কর্মপদ্ধতি খুব গোলমেলে। বিষয়টির গভীরে যাবার জন্যে আমি প্রথমে একটি ডুমা নির্বাচনে বলশেভিকদের অংশগ্রহণের বিবরণ খুব সংক্ষিপ্ত আকারে রাখব। তারপর ভারতের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের প্রধান ধারাগুলির বিভ্রান্তি নিয়ে দু-একটি মন্তব্য করব।
সেন্ট পিটার্সবুর্গে ডুমা নির্বাচন, ১৯০৭
১৯০৭ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গের ডুমা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় ডুমা। প্রথম ডুমা গঠিত হয় ১৯০৫ সালের বিপ্লবের অভিঘাতে। তার আগে রাশিয়াতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু ১৯০৫-এর বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়ে জার দ্বিতীয় নিকোলাস প্রথম ডুমা গঠন করেন। কিছুদিন চলার পর তিনি আবার তা ভেঙ্গেও দেন। ১৯০৭ সালে গঠিত হয় দ্বিতীয় ডুমা। এই ডুমাও ১০২ দিনের বেশি চলে নি। প্রথম ডুমা ছিল একেবারেই জারের পরামর্শদাতা একটি সংস্থা। দ্বিতীয় ডুমার ক্ষমতা কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়। ডুমার অনুমোদন ছাড়া আইনকানুন লাগু করা যাবে না এই মর্মে একটি ঘোষণা করা হয়েছিল। যাই হোক না কেন, আজকের বিচারে ডুমা ছিল একটি হাস্যকর লোকদেখানো প্রতিষ্ঠান। ১৯০৫ সালে বলশেভিকরা ডুমার নির্বাচন বয়কট করলেও ১৯০৭ সালের নির্বাচনে বড় আকারে অংশগ্রহন করেছিল। অবশ্য মনে রাখতে হবে বলশেভিকদের সে সময়ে আলাদা পার্টি ছিল না। তাঁরা রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবর পার্টির অংশ ছিলেন। ডুমায় সর্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না। ভোটারদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা হত। এই গ্রুপগুলি কুরিয়া বলে পরিচিত ছিল। যেমন শ্রমিক কুরিয়া, কৃষক কুরিয়া, শহুরে লোকেদের (শ্রমিক বাদে) কুরিয়া এবং জমির মালিকদের কুরিয়া। শ্রমিকদের মধ্যে শুধুমাত্র বৃহৎ কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরাই ভোটদানের অধিকারী ছিলেন। ছোট শিল্পের শ্রমিকদের ভোটাধিকার ছিল না। শ্রমিক কুরিয়াতে ভোট তিনটি স্তরে পরোক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হত। ৫০ থেকে ১০০০ শ্রমিক আছে এমন ফ্যাক্টরীগুলির শ্রমিকরা ফ্যাক্টরী থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করত। ফ্যাক্টরী প্রতিনিধিরা আঞ্চলিক প্রতিনিধি নির্বাচন করত, আর আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা ডুমার সদস্য নির্বাচন করত। জমির মালিক এবং শহুরে (শ্রমিক বাদে) লোকেদের কুরিয়াতে দুই ধাপে এবং কৃষক কুরিয়াতে চার ধাপে নির্বাচন হত। নির্বাচন এমনভাবেই হত যে শ্রমিক কৃষকদের প্রতিনিধি যাতে বেশি হয়ে যেতে না পারে। এমন একটি হাস্যকর প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনকেও যে বলশেভিকরা কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন তা লেনিনের লেখাগুলির সযত্ন অধ্যয়ন করলে বোঝা যায়।
১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাস। রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গে ডুমা নির্বাচন। সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি ছাড়াও এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল বুর্জোয়াদের কাদেত পার্টি। নির্বাচনে বড় আকারে উপস্থিত ছিল ত্রুদোভিক পার্টি। ত্রুদোভিকরা ছিল প্রাক্তন নারোদবাদী। রাশিয়ার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে ছিল তাদের বিরাট জনপ্রিয়তা। আর ছিল কৃষ্ণশতক পার্টি। এই কৃষ্ণশতক বা ব্ল্যাক হান্ড্রেড পার্টি ছিল আজকের আমাদের বিজেপির মত খানিকটা ফ্যাসিবাদী জারতন্ত্রী পার্টি। যদিও সে সময়ে পুরোপুরি ফ্যাসিবাদী পার্টি হওয়া সম্ভব ছিল না কিন্তু ভয়ানক প্রতিক্রিয়াশীল, সন্ত্রাসী ছিল এই দল। সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচনী রণকৌশল নিয়ে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যে চরম বিতর্ক হয়। মেনশেভিকরা কৃষ্ণশতক উত্থানের বিপদকে বাড়িয়ে দেখতে থাকে এবং কাদেতদের সঙ্গে জোট গঠনের প্রস্তাব করে। লেনিনের বক্তব্য ছিল সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক এবং ত্রুদোভিকদের মধ্যে জোট হলে কাদেত এবং কৃষ্ণশতকরা হালে পানি পাবে না। এখানে এটা খেয়াল করা দরকার যে, মেনশেভিকদের কাদেতদের সাথে জোট প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে লেনিন কিন্তু জোট গঠনের নীতিগত বিরোধিতা করেন নি। তাঁর বক্তব্য ছিল কৃষ্ণশতক বিপদের যে আশংকা করা হচ্ছে তা অমূলক। সুতরাং, কৃষ্ণশতক বিপদটা যদি সত্যি থাকত তা হলে লেনিন বুর্জোয়াদের সাথে জোট গঠন করতেও পারতেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্কের ফয়সালা হয় না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় যে পিটার্সবুর্গ কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তাতে কেন্দ্রীয় কমিটি হস্তক্ষেপ করবে না।
জানুয়ারি মাসের শুরুতে পিটার্সবুর্গে সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের একটি কনফারেন্স হয়। সেখানে মেনশেভিকরা তাদের লাইন প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে কনফারেন্স ছেড়ে বেরিয়ে যায়। পরে তারা নিজেদের মত করে চলতে শুরু করে। ফলত, নির্বাচনের শুরুতেই পার্টিতে একটা ভাঙ্গন ঘটে যায়। এতে বুর্জোয়া মিডিয়া (কাদেত প্রেস) এবং কৃষ্ণশতকরা উল্লসিত হয়ে পড়ে। কিন্তু বলশেভিকরা নার্ভ শক্ত রেখে প্রচার চালিয়ে যেতে থাকে। তাঁরা ত্রুদোভিকদের সাথে জোট গঠন করে। আর মেনশেভিকরা কাদেতদের সাথে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা চালাতে থাকে। এক সময়ে কাদেতদের সাথে তাদের একটা সমঝোতা হয়েও যায় কিন্তু মেনশেভিকরা যতগুলি আসন আশা করেছিল ততগুলি কাদেতরা তাদের দিতে অস্বীকার করার ফলে সমঝোতা ভেঙ্গে যায়। এই সময়ে লেনিন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন যা সত্যিই প্রণিধানযোগ্য। লেনিন লেখেন,
“If the Mensheviks were really guided by the fear of the Black-Hundred danger, and not by a craving to gain a seat in the Duma from the Cadets, could they possibly have broken with the Cadets over the number of the seats? When a socialist really believes in a Black-Hundred danger and is sincerely combating it — he votes for the liberals without any bargaining, and doesn't break off negotiations if two seats instead of three are offered to him.” (V I Lenin/ CW/ Vol 12/ P 40)
লেনিনের কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি কৃষ্ণশতক বিপদটা সত্যিই থাকে তাহলে সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের উচিত বুর্জোয়াদের সাথে জোট গঠন করা। এবং সেক্ষেত্রে আসন সংখ্যা নিয়ে দরকষাকষি করে সে সমঝোতা ভেঙ্গে দেওয়া একেবারেই অনুচিত। দেখুন, ডুমার মতন একটা হাস্যকর প্রতিষ্ঠানেও কৃষ্ণশতকদের উত্থানের বিপদকে লেনিন এবং বলশেভিকরা কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন।
শতাধিক বছর পর
ডুমার সময় থেকে আমরা আজ বহুদূরে এসে গেছি। বর্তমানে অধিকাংশ দেশের মত আমাদের দেশেও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির বিধানসভা ভোটে এবং কেন্দ্রীয় সংসদের ভোটে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে তারাই যথাক্রমে রাজ্যে বা কেন্দ্রে সরকার গঠন করবে। বর্তমান ব্যবস্থায় এর তাৎপর্য বিপুল। ডুমার মত প্রতিষ্ঠানেই যদি বলশভিকরা অতটা গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনকে দেখতেন তাহলে এই ধরণের একটা ব্যবস্থায় আজ আমাদের কতটা গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনী সংগ্রামকে দেখতে হবে তা সহজেই বোধগম্য। অথচ নকশালপন্থীদের একটা বড় অংশই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাকে পরিস্থতি নির্বিশেষে একটি করণীয় পদক্ষেপ হিসাবে গ্রহণ করে রেখেছেন। আর যারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষেও আছেন তাদের বক্তব্য হল নির্বাচন বিষয়টি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ নির্বাচনে জেতা পার্টির গোটা সিস্টেমটি চলার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাই নেই। এদের বক্তব্য হল, যতক্ষণ রাষ্ট্রব্যবস্থাটি পুঁজিবাদী ততক্ষণ ভোটে যেই জিতুক রাষ্ট্র পুঁজিবাদীই থাকবে। ভোটে জেতা কোনো কাজ দেবে না। এই যুক্তিকাঠামো থেকেই সম্ভবত তারা ভাবেন যে, ফ্যাসিবাদী শক্তি ভোটে জিতলেই রাষ্ট্র ফাসিবাদী হয়ে যায় না। অথবা ফ্যাসিবাদী দলকে নির্বাচনে হারিয়ে দিলেই রাষ্ট্র ও সমাজের ফ্যাসিকরণকে রুখে দেওয়া যায় না। এদের ভাবনাচিন্তায় নির্বাচন ব্যাপারটা এতটাই উপরিস্তরের একটি ব্যাপার যার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবস্থার গোটা শরীরের কোনো সম্পর্কই নেই। অর্থাৎ, নির্বাচন ব্যাপারটা এতটাই একটা প্রহসন, একটা নাটক যে, তাতে কে হারছে কে জিতছে তা মূল্যহীন।
এটা ঠিকই যে, ডুমাতে কে হারছে বা কে জিতছে তার খুব একটা মূল্য ছিল না। ১৯০৭ সালের যে নির্বাচনটির কথা আমরা আলোচনা করছিলাম তাতে ত্রুদোভিকরা সংখ্যাগরিষ্ট পার্টি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। কাদেতরা দ্বিতীয় হয়। সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি তৃতীয় স্থান লাভ করে। লেনিনের কথাকেই সত্য প্রমাণ করে কৃষ্ণশতকরা দাঁড়াতেই পারেনি। কিন্তু তাতে করে জারতন্ত্রের কিন্তু কোনো পরবর্তন হয়নি। উলটে জার ১০২ দিন যেতে না যেতেই ডুমাতে সন্ত্রাসবাদীদের বিপুল উপস্থিতি রয়েছে এই অভিযোগে ডুমা ভেঙ্গে দেয়। কিন্তু আজকের ভারতবর্ষের পরিস্থিতি একই রকম নয়। কিন্তু মুশকিল হল লেনিনের বইতে লেখা আছে ডুমার ব্যাপারসাপার। আজকের ভারতের নয়। তাহলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নকশালপন্থীরা এখন কী করবে? তারা ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ডুমা কল্পনা করে কাজ চালানোর চেষ্টা করছেন। ফলে তাদের মাথায় রয়েছে নির্বাচনে কে জিতল আর কে হারল তা দিয়ে কিছুই নির্ধারিত হবেনা। অথচ বাস্তব তা নয়। মজার ব্যাপার হল, এই ধারণা শুধু নকশালপন্থীদেরই নয়, সিপিএমেরও মাথায় আছে। এমনকি অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টিতেও একটা বড় অংশ এই লাইনেই ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন।
১৯৫৭ সালে যখন পার্টি প্রথম কেরালায় ক্ষমতায় আসে তখন এটাই ভাবা হয়েছিল যে, সরকারে গিয়ে তো আমরা খুব কিছু করতে পারব না। তাই আমাদের কাজ হবে বড়জোর মানুষের দুঃখ-কষ্টের কিছু সুরাহা করা (রিলিফ দেওয়া)। একটি অঙ্গরাজ্যের সরকারে কমিউনিষ্টদের কাজ বলতে মোটের ওপর এটাই পার্টির সংখ্যাগুরু অংশ ভাবতেন। সরকারকে ব্যবহার করে, হাতিয়ার করে রাষ্ট্রক্ষমতার চরিত্রকেই পরিবর্তনের কোনো কর্মসূচি তাদের ছিল না, সরকারকে ব্যবহার করে শ্রেণিসংগ্রামকে বিকশিত করে তোলা, তীব্র করে তোলার ভাবনা তারা ভাবতে পারেন নি। এই না পারার পেছনে আছে ঐ ভুল ভাবনা যে, নির্বাচনে যেই জিতুক না কেন, তার কোনো প্রভাব রাজনৈতিক সিস্টেমে পড়ে না। এই ভাবনাই সিপিএম-সিপিআই ধরণের পার্টিগুলিকে সংস্কারবাদে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। বুর্জোয়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর দাসে পরিণত করেছে। কেরালা, বাংলা বা ত্রিপুরায় তাদের পরিচালিত সরকারগুলিকে বুর্জোয়া বা আঞ্চলিক দলগুলির দ্বারা পরিচালিত আর পাঁচটা সরকারগুলির মতই একই গোত্রের সরকারে পরিণত করেছে। অন্যদিকে এই একই ভাবনা নকশালপন্থীদের প্ররোচিত করেছে নির্বাচনকে গুরুত্ব না দিতে। নির্বাচনী সংগ্রামকে গুরুত্ব না দিতে। সরকার গঠনের চেষ্টা করার তো কোনো প্রশ্নই তাদের নেই।
শেষের কথা: উপায় কী?
পৃথিবীতে
এমন কোনো রণকৌশল নেই যা নিজগুণেই জয় হাসিল করতে সক্ষম। যে কোনো সফল, সঠিক ও প্রয়োজনীয়
রণকৌশল বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে অবশ্যই সংগঠন চাই, পার্টি চাই, বাস্তব শক্তি চাই।
বর্তমানে ভারতে কমিউনিষ্ট শক্তি দুর্বল। শতধা বিচ্ছিন্ন। সব থেকে বড় কথা হল ভারতের
কমিউনষ্ট আন্দোলন তাত্ত্বিক দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। ফলত, সে সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও কুৎসিত
দশায় রয়েছে। এই দশা থেকে বেরতে গেলে, ভারতে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে তাকে প্রতিষ্ঠিত
হতে গেলে দুই ফ্রন্টেই কাজ করতে হবে। একদিকে যেমন তাকে একটা তাত্ত্বিক উল্লম্ফন ঘটাতে
হবে, তেমনি অন্যদিকে তাকে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে যেতে
হবে। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে এই মুহুর্তে প্রধান কাজ হল তাকে তার ছড়ানো ছিটোনো শক্তিকে সংহত
করতে হবে। এই লক্ষ্যে লাল ঝান্ডার সমস্ত দলগুলিকে একটি সাধারণ বাম মঞ্চে সমবেত হতে
হবে। এই মঞ্চ গ্রিসের ‘সাইরিজা’ ধরণের হতে পারে, অথবা অন্য কোনো ধরণের হতে পারে। কিন্তু
মোদ্দা কথায় যেটা বুঝতে হবে বামপন্থীরা যাই করুক না কেন তাকে তার শক্তি বর্তমান অবস্থায়
একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। তবেই সে একটি প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী রণকৌশলকে সফলতার সাথে প্রয়োগে
নিয়ে যেতে পারবে। ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে অ-ফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের সঙ্গে হাত মেলানো
জরুরী। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই হাত মেলানো এমনই হবে যে তা যেমন একদিকে ফ্যাসিবাদকে
থামানোর কাজে ব্যবহৃত হবে, অন্যদিকে যার হাত ধরেছি তাকেও শক্তিহীন করার কাজে প্রয়োগ
করা যায়। কল্পনাহীন, প্র্যাগম্যাটিস্ট কমিউনষ্টদের পক্ষে এই কথাটি বোঝা কষ্টকর হয়তো।
কিন্তু বিষয়টির জটিলতাকে আমাদের অনুধাবন করতে হবে এবং তাকে বাস্তবে প্রয়োগের শিল্পকে
(আর্ট) রপ্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে যাঁরা ছিলেন প্রকৃত শিল্পী তাঁদের একজন হলেন কমরেড
লেনিন। একবার তিনি যখন ইংলন্ডে লেবর পার্টির সাথে হাত মেলানোর কথা বলেছিলেন তখন কেউ
কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “বলেন কী, আমরা ওদের উর্ধ্বে তুলে ধরব?” উত্তরে লেনিন বলেন,
“হ্যাঁ তুলে ধরব, তবে সেভাবেই তুলে ধরব যেভাবে ফাঁসির দড়ি তুলে ধরে দন্ডিতকে!” লেনিনের
কাছ থেকে কমিউনিষ্ট রাজনীতির জটিলতার পাঠ আমাদের নিতে হবে। আসলে মোটা দাগে, গোদা গোদা
‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান পলিটক্স’ করার যুগ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। জটিল বাস্তবকে বুঝে কিছুটা
উচ্চস্তরের রণনীতিকে প্রয়োগ করার দক্ষতা অর্জন না করলে আমরা এগোতে পারব না।
[লেখকের মতামত তাঁর একান্ত নিজস্ব। রাজনৈতিক কর্ষণের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত। 'ডিলিজেন্ট' পত্রিকার এই বিষয়ের বেশকিছু প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ পৃথক বক্তব্য রয়েছে। এই বিষয়ে সম্পাদকমন্ডলীর বক্তব্য শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।]
Comments
Post a Comment