ফিরে দেখা ১০টা বছর: প্রজাতন্ত্রের সংকট
অনন্যা দেব
ভারতবর্ষ
স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে
একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে
তুলতে ভারতবাসীকে শপথ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ভারতের ১৪তম প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে ভারতবর্ষের প্রজাতন্ত্র যে আজ সংকটে তা বলাই বাহুল্য। আজ
একইসাথে সংকটে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনাগুলিও। ২০১৪ সাল থেকে আজ অবধি
কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীনে ভারতবর্ষের হাল কিরূপ হয়েছে তা আরেকবার ফিরে দেখা
যাক এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে।
১।
২০১৬ সালের ৮ই নভেম্বর আমাদের প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ করেই ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট
বাতিলের ঘোষণা করেন। রাতারাতি সারা দেশ জুড়ে ডিমোনিটাইজেশন বা নোটবন্দী চালুর
ফলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক ইনসিকিওরিটি স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়। রাস্তায়
দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বয়স্কদের মৃত্যু, মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করলে ব্যাঙ্কের
সামনেই পুলিশের নাগাড়ে লাঠিচার্জ, হসপিটালের বিল মেটাতে না পারায় মৃত্যু, এসবের
টুকরো টুকরো ছবি সারা দেশ জুড়ে ভেসে ওঠে। এখন প্রশ্ন হল, কোন বিষয়গুলির ভিত্তিতে
প্রধানমন্ত্রী জোড় গলায় এত বড় সিদ্ধান্তের ঘোষণা করলেন তা দেখে নেওয়া যাক।
নিজের ভাষণের শেষে তিনি প্রকাশ্যে এও বলেছিলেন যে “৫০ দিনের মধ্যে যদি এর সুফল
দেখতে না পাওয়া যায় তাহলে তাকে জীবন্ত দগ্ধ করে দেওয়া হোক”। ডিমোনিটাইজেশন-এর
পক্ষে যে দাবিগুলো ছিল তার মধ্যে প্রধান হল ক্যাশলেস অর্থনীতির মাধ্যমে দুর্নীতি
মুক্ত দেশ গঠন। সমস্ত কালো টাকা উদ্ধার হবে, এরকমই ছিল দাবী। জাল নোট ছাপানো বন্ধ,
ঋণ খেলাপিদের অতি সহজে পাকড়াও করা, আতঙ্কবাদীদের কাছে ফান্ড পৌঁছানোকে আটকানো
ইত্যাদির দাবীও করা হয়েছিল। কিন্তু এসবই ছিল আসলে একটা বড় ভাঁওতা। আসলে জনগণের
টাকা তুলে নিয়ে RBI-এর “মার্কেট স্টেবিলাইজেশন স্কিম”-এর আওতায় গচ্ছিত রাখা হয় এবং
এর মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশের বড় পুঁজিপতি ও ফাটকা বাজারের
কারবারীদের রক্ষা করা হয়। এবার কালো টাকা নিয়ে কয়েকটা তথ্য তুলে ধরি। SBI-এর
হিসাবে ২.৩ লক্ষ কোটি কালো টাকা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ফেরার কথা কিন্তু কখনোই তা
আসেনি। সুইস ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী মোদী সরকারের আমলে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা
পড়েছে সেখানে। নীরব মোদী, মেহুল চোক্সির মত ঋণ খেলাপীদের কালো টাকা পাকড়াও করার
কথা ছিল কিন্তু তারা সেই টাকা পাচার করে খুব সহজেই বিদেশে পালিয়ে যায়। এর সাথে
পরের বছর যুক্ত হয় জিএসটি সিস্টেম অর্থাৎ গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স । ‘এক দেশ এক ট্যাক্স’
কনসেপ্টের মাধ্যমে ১৭টি আলাদা ট্যাক্সকে একত্রিত করে জিএসটি তৈরি হয়। এতে চরম
হারে ছোট ও মাঝারি ব্যবসার ক্ষতি হয়। নিত্য নৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম
এক লাফে বেড়ে যায়। আয় করের বদলে এই ব্যয় করের প্রাবল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়
ক্ষমতা কমিয়ে দেয় কিন্তু রক্ষা করে ধনকুবেরদের। ভারতের ৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির যে
ঢক্কানিনাদ বাজানো হচ্ছে তার ফলাফল এটাই যে ছোট মাঝারি ব্যবসাকে নষ্ট করে শপিংমল
বৃদ্ধি, PPP মডেল চালুর মাধ্যমে ধনীদের আরো ধনী করা এবং গরীবকে আরো দারিদ্র্যের
দিকে নিয়ে যাওয়া।
২। ২০১৯
সালে পুনরায় লোকসভা ভোটে বিজেপি নির্বাচিত হওয়ার পরে গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে
দাঁড়িয়ে অতি উগ্রতার সাথে অগণতান্ত্রিকভাবে জম্মু-কাশ্মীরের ৩৭০ এবং
৩৫ ধারার অন্তর্গত বিশেষ অধিকার
খর্ব করে এবং সেনা ঢুকিয়ে বলপূর্বক ওই রাজ্যের সাংবিধানিক অস্তিত্ব বিনষ্ট করে
দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল তৈরি করে। জম্মু ও কাশ্মীরকে ধর্মীয়ভাবে আলাদা করা থেকে
শুরু করে তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা, শিক্ষা, রাজনৈতিক অধিকার, নিজেদের স্বতন্ত্রতা,
স্বাধীনতা, চিন্তার অধিকার, মুক্ত কন্ঠের অধিকার - সমস্ত কিছুই পায়ের তলায় পিষে
ফেলা হয় গোটা দুনিয়ার সামনে। লাদাখের সাধারণ মানুষ রাজ্যের অধিকার চাইলেও তা
শুনতে নারাজ রামরাজ্যপ্রেমীরা।
৩। NRC,
NPR, CAA পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তিনটি উপায় যার মাধ্যমে এটা বোঝা
যায় যে দেশে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করলেও সে দেশের
নাগরিক নয়! নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষ কাগজপত্র দেখিয়ে পুনরায় নাগরিকত্ব প্রমাণ
করতে হবে তথাকথিত প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত শরণার্থীদের। আসামের ২০ লক্ষ মানুষকে
রাষ্ট্রহীন করে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী করেছে আসামের বিজেপি সরকার। ভারতের
মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে সস্তা শ্রমিক তৈরি করাই
বিজেপি-আরএসএস-এর প্রধান লক্ষ্য। বহু হিন্দু পরিবারের কপালেও এই কালা পদক্ষেপগুলোর
ফলে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করছে। এই পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে চলছে প্রতিবাদের
ডামাডোল।
৪।
২০১৯ সালে দিল্লির জাহাঙ্গীর নগরের দাঙ্গা থেকে শুরু হয়ে আজকের ভারতের রাজনীতিতে
যুক্ত হয়েছে বুলডোজার জাস্টিস।
এটাই নাকি সামাজিক সুবিচার। কখনো এমন বিচার শুনেছেন? হ্যাঁ, বুলডোজারের মাধ্যমে
উত্তরপ্রদেশ, আসাম, হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান জুড়ে গরীব খেটে খাওয়া মানুষের
সারা জীবনের রোজগারের অর্থে তৈরি বাড়ি মুড়মুড় করে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। ঘটনার
সূত্রপাত উত্তরপ্রদেশ থেকে গুন্ডা ভাড়া করে এনে ২০১৯ সালে সাম্প্রদায়িক হিংসা
ছড়িয়ে এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকে ভাঙার চেষ্টা করার মধ্যে দিয়ে। এরপর এই দাঙ্গার
ভিকটিম সংখ্যালঘু মুসলিমদেরকেই সরাসরি দোষী চিহ্নিত করে বিজেপি সরকার ও গোদী
মিডিয়া। প্রথমে ভুয়ো ভিডিও ছড়িয়ে তাদের দাঙ্গাকারী বানিয়ে প্রাথমিকভাবে তাদের
ঘর ভেঙে দেওয়া হয় বিনা বিচারে। অর্থাৎ এদেশে আইন/বিচারব্যবস্থা বলে কিছুই নেই?
এরপর ২০২২ থেকে শুরু হয় উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী জুড়ে বুলডোজার শাসন। বিশেষত যোগী
আদিত্যনাথের নেতৃত্বে বিনা নোটিশ এবং বিনা অপরাধে গরীব মানুষের ঘর ভেঙে তছনছ করা
হয়। পরবর্তীকালে কোর্ট অবধি লড়াই গেলেও ক্ষতিপূরণ সেভাবে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ
আমাদের দেশেরই গরীব মানুষদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে আজকের এই বৃহৎ
গণতান্ত্রিক দেশে নির্মমভাবে সকলের চোখের সামনে তাদের একমাত্র আশ্রয় কেড়ে নেওয়া
হচ্ছে। তাদের বাচ্চারা এই দৃশ্য সহ্য করে বড় হচ্ছে। পরিণত হচ্ছে পথ শিশুতে।
৫। লকডাউন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পাশ হয়ে গেছে চারটে নয়া শ্রমকোড। এই আইনগুলো শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী। এই আইন মোতাবেক ওভারটাইম ঐচ্ছিক না করে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের অধিকারগুলিকে আরও দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে, শ্রমিকদের সুরক্ষার দিকগুলো উপেক্ষিত হয়েছে, মহিলাদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা সহ যে বিশেষ সুবিধাগুলি প্রাপ্য সেগুলিকেও উপেক্ষা করা হয়েছে। মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে তাদের যখন খুশি ছাঁটাই, লে-অফ, কারখানা বন্ধের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। একই সাথে উল্লেখ্য, শ্রমিকদের লড়াইয়ের স্বাভাবিক দোসর কৃষকদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী সারা দেশজুড়ে ১১,২৯০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে! বিজেপি জমানায় শ্রমিক ও কৃষকের অবস্থা খুবই শোচনীয়।
৬।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নারী নির্যাতনের সর্বাধিক রেকর্ড রয়েছে। বিজেপির বহু
এমএলএ এমপি-ই ধর্ষণ সহ গুরুতর নারী নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত। মহিলাদের সুরক্ষা
আজ তলানিতে। শাসক দল কর্তৃক ধর্ষণ টিকে আছে বহাল তবিয়তে। প্রতিবাদ করলে বা থানায়
অভিযোগ জানানো হলে কখনো খুন হয়ে যান ধর্ষিতার পুরো পরিবারই। এরকম ঘটনার নজীর রয়েছে
উত্তরপ্রদেশের বুকে। তাছাড়া গুজরাত দাঙ্গার সময়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গণধর্ষিতা বিলকিস বানুর অপরাধীরা
মুক্তি পেয়ে গেছে যা বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের জন্য সর্বোচ্চ লজ্জার ঘটনা। মুখে
‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান দিলেও আসিফার ধর্ষণে অভিযুক্তদের বাঁচানোর
দাবিতে গলা তুলে চলেছে মিছিল, তাও আবার হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে। উন্নাও-র ঘটনায়
অভিযুক্তদের বাঁচানোর তাগিদে প্রমাণ নষ্ট করার জন্য রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে
দেওয়ার চেষ্টা হয় ধর্ষিতার দেহ। তাও আবার পুলিশি প্রহরায়। আইনের অপব্যবহার হবার
মতন যুক্তিকে সামনে রেখে বিজেপি আজও বৈবাহিক ধর্ষণকে দিয়ে রেখেছে সামাজিক বৈধতা।
মুখে ‘ভারতমাতা কি জয়’ বললেও চলছে ঠিক তার উল্টো কাজ।
৭।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যে উপজাতিদের মধ্যে হিংসা চলাকালীন গা শিউরে ওঠা
একটি ভিডিও ফুটেজ দেখে সকল দেশবাসী চমকে যায় এবং সেই গ্রাফিক হিংসা দেখে তারা
ক্ষোভে জ্বলে ওঠে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নীরবতার বিরুদ্ধে। এতবছর মণিপুরে
বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন কম, নাগা, মেইতি, কুকি ইত্যাদির মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ
থাকলেও তা নষ্ট হয়ে গেল কি করে? মণিপুরে প্রচুর পরিমাণে খনিজ সম্পদ আছে। এই সম্পদ
ও জমি দখল করতেই কি সংগঠিতভাবে হিংসার বীজ বপন করা হয়েছে? উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন
রাজ্যে ছাত্রছাত্রী মহিলারা রাস্তায় নামেন। প্রতিবাদ চললেও মণিপুরের ভবিষ্যৎ এখনও
অনিশ্চিত।
৮।
২০২৩ সালের শুরুতে বিজেপি সরকারের আমলে ভারতের ক্রীড়া জগতের সবথেকে কলঙ্কময়
অধ্যায় রচিত হয়েছে। দিল্লীর যন্তর মন্তরে অলিম্পিকে সোনা বিজয়ী কুস্তিগীর সাক্ষী
মালিক, বজরং পুনিয়া, দিনেশ ফোগাট সহ অন্যান্য এ্যথলিটরা ইয়ং এ্যথলিটদের উপর যৌন
নিপীড়নের বিচার চাইতে ধর্নায় বসেছিল। কেরালা ও মধ্যপ্রদেশের কুস্তিগীর শিবির থেকে
অভিযোগ আসে যে সাত জন মহিলা এ্যথলিটকে বিজেপির কুখ্যাত এমপি এবং কুস্তিগীর
ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ব্রীজ ভূষণ সিং যৌন নির্যাতন করেছে। এদের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল নাবালিকা। এই ঘৃণ্য
বর্বর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ব্রীজ ভূষণকে শাস্তি দেওয়ার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কুস্তিগীররা রাস্তায় বসে টানা আন্দোলন করে এবং পরবর্তীকালে
কুস্তি এ্যসোসিয়েশনকে বাঁচাতে সমগ্র দেশবাসীর সাহায্য চায়। বিজেপি সরকার আশ্বাস
দিলেও বাস্তবে এই অভিযোগ ধামাচাপা দিতে রিপোর্ট পেশ করতে যথেষ্ট দেরী করায়
কুস্তিগীররা চরম নিরাশ হয়। পরে তারা আন্দোলনের জোর বাড়ালে বর্বরভাবে পুলিশ তাদের
টেনে হিঁচড়ে আটক করে। অনুরাগ ঠাকুর এবং পি টি ঊষার পক্ষ থেকেও জানানো হয় যে সরকার
এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে অথচ বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শেষে সুপ্রিম
কোর্টের আদেশের ভিত্তিতে ব্রীজ ভূষণের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রুজু হয়। যথারীতি এখনো
পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
৯।
বিভিন্ন অজুহাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির মালিকানা পরিবর্তন আদতে
নয়াউদারবাদের নীল নকশা। ব্যাঙ্ক, বিমা, টেলিফোন পরিষেবা ব্যবস্থা, শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান, অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির মত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বিজেপি সরকারের আমলে
দ্রুততার সাথে বিনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে। রাইফেল-অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে
পার্মানেন্ট স্টাফ ও ওয়ার্কারদের ছাঁটাই করে ঠিকাদারি প্রথার মাধ্যমে চুক্তি
ভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করা হচ্ছে। BSNL-এর কর্মচারীদের মাইনে গ্র্যাচুয়িটি সমস্ত
কিছু বঞ্চিত করা হচ্ছে। রেল-কে আধা বেসরকারি করার উদ্দেশ্যে শূন্যপদে ভ্যাকান্সি
বার না করা, ছাঁটাই, স্টেশন বিক্রি, টিকিটের দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি চলছে। জাতীয় বিমা
কম্পানি LIC-র ২০% শেয়ার বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত
ব্যাঙ্কগুলিও বেসরকারিকরণের লিস্টে রয়েছে। সেই পথে বাধা এলে চলছে ব্যাঙ্ক মার্জার।
১০।
বর্তমান কেন্দ্র সরকারের শিক্ষানীতি (জাতীয় শিক্ষা নীতি/নেপ ২০২০) নিয়ে
আলোচনা করলেও উঠে আসবে কিছু ভালো ভালো কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নয়াউদারবাদী
শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারের দিকটি। এই ব্যবস্থায় ডিগ্রী অর্জনের থেকে ভোকেশনাল
কোচিং-এর দিকটিকে বেশী গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এই শিক্ষনীতিতে সবচেয়ে
ক্ষতিগ্রস্থ হবে শ্রমিক, কৃষক ও পিছিয়ে পড়া অংশের পড়ুয়ারা। ইন্ডিয়ান নলেজ
সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে গেরুয়া রাজনৈতিক মত প্রচার এবং আরএসএস-এর মনুবাদী,
সাম্প্রদায়িক, ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের সাথে পড়ুয়াদের পরিচয় করানোর পরিকল্পনা
করা হয়েছে যাতে আগামী প্রজন্ম দায়িত্বশীল নাগরিক হবার বদলে সাম্প্রদায়িক নাগরিক
হয়ে ওঠে। সাথে রয়েছে সস্তা শ্রমিক তৈরি করার কল। এই নেপ ব্যবস্থায় ‘মাল্টিপল
এন্ট্রি এন্ড এক্সিট’-এর মাধ্যমে পড়ুয়াদের মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াকে সহজ
করে দেওয়া হলেও তাদের কিরূপ কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে তা নিয়ে কিছুই বলা নেই।
বলাই বাহুল্য, ক্রমবর্ধমানভাবে বেকারত্ব বাড়ছে যে দেশে, সেখানে দাঁড়িয়ে
নয়াউদারবাদী অর্থনীতির যুগে সস্তার শ্রমদানই করতে হবে পড়ুয়াদের। একবার এক্সিট
হবার পর আরেকবার লেখাপড়ার জগতে এন্ট্রি নেওয়া যে কতটা কঠিন তা সবার জানা। অর্থাৎ
একমাত্র এগিয়ে থাকা কিংবা বর্ধিষ্ণু পরিবারের পড়ুয়ারাই পড়াশুনা কমপ্লিট করতে
পারবে। বাকিদের ছেঁটে দেওয়া হবে। নয়া মোড়কে ব্রাহ্মণ্যবাদ চলবে শিক্ষার জগতে।
কেন্দ্র সরকার জিডিপির ৩% বাড়িয়ে ৬% করেছে নেপ ব্যবস্থায়। এটা আদৌ খরচ হবে কিনা
তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। আর নতুন স্কিমগুলো বাস্তবায়িত করতে এটুকুই কি
যথেষ্ট? শিক্ষা ব্যবস্থার যে বেসরকারিকরণ হচ্ছে এবং বিপুল টাকা দিয়ে যে শিক্ষা
কিনতে হচ্ছে তার গতি আরও বাড়িয়ে দেবে নেপ। নেপ শিক্ষাব্যবস্থার এবং পড়ুয়াদের
উন্নয়নের কথা বললেও আসলে সর্বশিক্ষাকে আরো পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, শিক্ষার
বেসরকারিকরণকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই গবেষণার আসন কমানো, পড়ুয়াদের
স্কলারশিপ দেওয়ার সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং শিক্ষকদের স্থায়ী চাকরীর পদ তুলে দেওয়া
শুরু হয়ে গেছে যা সমগ্র পড়ুয়া সমাজের শিক্ষার অধিকারকে খর্ব করছে।
১১। অগ্নিবীর
প্রকল্পের অধীন সেনা নিয়োগে ঠিকা প্রথা প্রণয়নের ফলে গরীব ঘরের
তরুণেরা যারা জানত যে অন্য কোন কাজ না পেলেও এখানে তারা সরকারি মাস মাইনেতে
পার্মানেন্ট কর্মী হিসেবে কাজ করতে পারবে, তারাও আজ বুঝতে পারছে যে সেই সুযোগ বন্ধ
হয়ে যাবার জোগাড়।
১২।
নাগরিক নিরাপত্তা প্রদানের বদলে চলছে নাগরিকের তথ্য হরণ! পেগাসাস নামক
গোপন সফটওয়্যার দিয়ে বিভিন্নভাবে তথ্য চুরির অভিযোগ উঠেছে। সুতরাং আজ কারুর
ব্যক্তিগত তথ্য আদেও কি নিরাপদ?
১৩।
প্রতিবেশী দেশের সাথে যুদ্ধের ঢক্কানিনাদ ফুরিয়ে গেলে রাম
মন্দিরকে রাজনীতির
কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কোর্টও রাম লালার কাছে মাথা নুইয়েছে।
১৪।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের সমলিঙ্গের বিবাহের আইনি বৈধতার
প্রতি সমর্থনের বিরুদ্ধে বিজেপি সরাসরি ঝামেলা শুরু করে। LGBTQIA+দের
অধিকার-এর দাবিতে যখন গোটা
পৃথিবী সোচ্চার সেখানে আরএসএস-এর যুক্তি, ভারতের পারিবারিক সিস্টেম, সন্তান উৎপাদন,
সংস্কার সমস্ত কিছুকে ক্ষুণ্ণ করে প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষেরদের বিবাহের স্বীকৃতি
নাকি দেশের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর। অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক
সামন্তবাদী সাংস্কৃতিক কাঠামোতে যাতে কোনো ভাবে আঘাত না লাগে তার জন্যই আরএসএস-এর
এই বিরোধিতা।
১৫।
কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রনাধীন স্বতন্ত্র সংস্থা ইডি,
সিবিআই দ্বারা অতি সক্রিয়তার সাথে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের দুর্নীতিগ্রস্থ
নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। আদতে দেখা যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে
চার্জশিট দেওয়া তো দূর শুধুমাত্র মানুষকে বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আঞ্চলিক দলগুলো দুর্নীতিগ্রস্থ ঠিকই কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে ভারতের সবথেকে বড়
দুর্নীতি রাফায়েল কেলেঙ্কারি এবং ইলেকট্রোরাল বন্ড কেলেঙ্কারিতে নিমজ্জিত বিজেপির
নেতৃত্ব দিল্লীতে বসে থাকলেও এইসব সংস্থাগুলি কেন তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারছে
না। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে ইলেকট্রোরাল বন্ড-এর সমস্ত তথ্য আমাদের সকলের সামনে
এসেছে। কিন্তু চুরি ধরা পড়লেও চুরির শাস্তি তো মিলছেই না, উল্টে বিজেপি নামক
ওয়াশিং মেশিনে ঢুকে সাফ হতে চাইছে ওই সব চোরেরা!
১৬। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যক্তি জীবনের স্বাধীনতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। কখনও লাভ জিহাদের নামে তো কখনও গরু খাওয়ায় অপরাধে, কখনও বা দলিত হয়ে জল খাওয়ায় অজুহাতে, পিটিয়ে খুন করা হয়েছে শতাধিক নাগরিককে। চলছে মুসলমানদের প্রতি প্রকাশ্যে ঘৃণার উস্কানি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি চলছে ঘৃণার প্রচার। জনৈক ইউটিউবার নিজের প্রোগ্রামে একজন গেরুয়া আদর্শবাদীকে জিজ্ঞেস করছে কাদের কাদের দেশ থেকে বিতারণ করা উচিৎ! বিভিন্ন টিভি চ্যানেল আজ “গোদি মিডিয়া”। মিথ্যা তথ্য, হেট স্পিচ, মোদীর চাটুকারিতা আর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচার এদের মূল উদ্দেশ্য। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চলছে গভীর চক্রান্ত। মিথ্যা দাঙ্গার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে সত্যিকারের দাঙ্গার পটভূমি তৈরির প্রচেষ্টা সকলেরই জানা। খনিজ সম্পদ লুট করার উদ্দেশ্যে সারা দেশজুড়ে চলছে দলিত ও আদিবাসী জনতার উপর আক্রমণ। রোহিথ ভেমুলার আত্মহত্যা, দলিত যুবকদেরকে অত্যাচার ও হত্যা, বন সংরক্ষণ আইনে পরিবর্তন, পাথালগাড়ি আন্দোলন দমনের প্রচেষ্টা, বস্তারে ড্রোন হামলা ইত্যাদি দলিত ও আদিবাসীদের উপর বিভিন্ন ধারার আক্রমণের প্রভাব বা উদাহরণ।
১৭।
এযাবৎকালে সবচেয়ে বেশি প্রণীত হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ-এর পরিকল্পনা। ইউএপিএ নামক (বৃটিশ শাসনব্যবস্থায় তৈরি, পরবর্তীকালে
নাম পরিবর্তিত) কালাকানুনের মাধ্যমে সমাজসেবী, আন্দোলনকারী, মানবাধিকার কর্মী,
রাজনৈতিক কর্মীদের অধিকার হরণ করে তাদের জেলবন্দী করে রাখা হয়েছে। জেলের মধ্যে
অকথ্য অত্যাচারে দিন গুজরান করে চলেছেন বিভিন্ন আন্দোলনকারী। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের
বলে জেল বন্দীদের প্রায় ৬৭% দীর্ঘদিন জেলে পচার পর বেকসুর খালাস হয়। ফলে বিরোধিতার
কণ্ঠ রোধ করতেই এই আইনের প্রয়োগ। বিভিন্ন সময়ে জেলবন্দী জীবন কাটিয়েছেন তিস্তা
শেতলাবাদ, প্রবীর পুরোকায়স্থ সহ অন্যান্যরা। অনেকে আজও কাটিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে আইপিসি
তুলে দিয়ে তাকে আরো কঠোর করে লাগু করার জন্য আনা হয়েছে ভারতীয় ন্যয়সংহিতা।
অর্থাৎ কুশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই জুটবে গারদে যাওয়ার ফরমান!
এক
কথায়, কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন ব্যবস্থা বর্তমান দেশবাসীর জীবনকে জতুগৃহে পরিণত
করেছে। অতএব ভারতীয় প্রজাতন্ত্র আজ সংকটে!
আশার
আলো এখানেই যে কৃষক আন্দোলন বিজেপি সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছিল। তাই লড়াই
চালিয়ে যেতে হবে… সংবিধান বাঁচানোর লড়াই! গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই! প্রজাতন্ত্র
বাঁচানোর লড়াই!
Picture Courtesy: quora.com
Comments
Post a Comment