ফ্যান নিয়ে দু’চার কথা
বিমলকান্তি দাশগুপ্ত
ফ্যান চিনেছি সেই কোন ছোটবেলায়। হাঁড়িতে জল আর চাল ফোটালে যে বদল ঘটে তাতে চাল হয়ে যায় ভাত আর জল হয়ে যায় ফ্যান। খাবার আগে দুটোকে আলাদা করে নেওয়া হয়। এই আলাদা করার প্রক্রিয়ার নাম কারো কাছে গালা আবার কারো বুলিতে ঝরানো। অর্থাৎ কেউ ফ্যান ঝরিয়ে ভাত আলাদা করে, আবার কেউ ফ্যান গেলে ভাত আর ফ্যানকে আলাদা করে। ভাত পৃথবীর এক বড় অংশের মানুষের প্রধান খাদ্য।
স্বাস্থ্য বইয়ে লেখে, ফ্যানের পুষ্টিগুণ আছে। প্রবীণেরা বলেন বলকারক। ছোটদের ফ্যান খাওয়ানো হয়। ঘি মাখন মিশিয়ে নিলে মুখরোচকও বটে। সঙ্গে একটু ভাত ছড়িয়ে নিলে ফ্যানাভাত উপাদেয় এবং উপকারিও বটে। তবে বাংলায় ফ্যান খাওয়াটা সামাজিক মর্যাদায় একটু হীনতা প্রকাশ করে। গোরু থাকলে গোরুকে ফ্যান দেওয়া হয়। নয় তো ফ্যানের গতি নর্দমায়। ফ্যান থেকে চালের পাপড় হয়। সেটা মুখরোচক খাবার। ডালে ফ্যান মেশানোর অভিযোগ আছে পাইস হোটেলের নামে। ফ্যান অন্য নামে কাই। কাপড়ে দেওয়া হয়। নাম বদলে সে তখন মাড়। ধোপা-বাড়িতে তার কদর। সুতোকে দৃঢ় করতে ফ্যান ব্যবহার করেন তাঁতিরা। প্রখ্যাত ব্যায়ামবীর বিষ্ণুচরণ ঘোষের মতে বাঙালির স্বাস্থ্য বেরিয়ে যায়, রান্নাঘরের নর্দমা দিয়ে। মোদ্দা কথা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বাংলাতে ফ্যানের সামাজিক মর্যাদা নেই।
সেই ফ্যানের কদর দেখেছি ছোটবেলাতেই। সে ছিল বাংলায় দুর্ভিক্ষের কাল। একটু ফ্যানের জন্য মানুষ বাটি হাতে বাড়ি বাড়ি ফিরে বেড়িয়েছে। মুখে ক্ষীণ আওয়াজ, একটু ফ্যান হবে গো। একটু ফ্যান দাও।
এবার ফ্যান কলকাতায়। দশ বাই বারো ঘরে দশ জনের বাস। মাথাপিছু বরাদ্দ বারো বর্গফুট জায়গা। চৌকি আর টেবিল পেতে ওপর নিচে জায়গা বাড়িয়ে নেওয়া। এমনিতে চলাফেরার সময় ততটা মালুম হয় না। কিন্তু অসহ্য হয় রাতের বেলা। বিশেষ গরমের দিনে। ঘর তো নয়। যেন ফার্নেস। গা বেয়ে ঘাম কুলু কুলু। যেন পাহাড়ের গা থেকে বয়ে চলা অনেকগুলো ঝোরা আর ঝর্না। অসহ্য। অতএব ফ্যান খাও। এ ফ্যান মাথার ওপরে ঘরের সিলিং থেকে ঝুলছে। আর অবিশ্রান্ত ঘুরে বাতাস সরবরাহ করে চলেছে। আর সেই বাতাস বা বায়ু সেবনকে বাঙালি বলে ফ্যান খাওয়া। ঘরের সিলিং থেকে ঝোলানো আছে মোটর। সে মোটর চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। তার গায়ে জুড়ে থাকা তিনখানা কাঠের বা স্টিলের পাত ঘুরছে আর বাইরের বাতাস ঘরে এনে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই বাতাসের উৎস যে কারণে ফ্যান। তাই সংক্ষেপে ফ্যান খাওয়া। বারের ফ্যান মানুষ নিজেই। গায়ক বাদক অভিনেতা নেত্রী খেলোয়ারদের বিষয়ে অতি আবেগে আচ্ছন্ন, এদের বলে ফ্যান। আজকাল রাজনৈতিক নেতাদেরও ফ্যান তৈরি হয়। তবে মর্যাদায় তারা অন্য ফ্যানদের চেয়ে হীন। তাদের বলা হয় চামচা। সেটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা বরং থাকি আমাদের ফ্যান নিয়ে। নানা সংগঠন আর সমিতির মতো আজকাল ফ্যানদেরও সংগঠন গড়ে উঠছে নানা জায়গায় বিচ্ছিন্ন ভাবে। দেখার বিষয় কবে এই ফ্যানদের প্রতিনিধি যাবে প্রশাসনে অথবা দেশের নীতি নির্ধারণের সংস্থা যেমন লোকসভা বিধানসভা পৌরসভা নিতান্ত সবার নিচে থাকা পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে। ততক্ষণ ফ্যান নিয়ে ফ্যানানোর আপাতত এখানেই ইতি।
Picture Courtesy: iStock, Vector Stock, New18 Bangla
Comments
Post a Comment