বাংলাদেশের গণজাগরণ

প্রিয়াংশু দে


গত জুন মাসে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য ৩০% সংরক্ষণ ফিরিয়ে আনার পক্ষে ওই দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। এর আগে ২০১৮ সালে এই কোটা বিরোধী আন্দোলনের ফলে সরকার এই কোটা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রছাত্রীদের মনে হয় এই রায় যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরী পাওয়ার পথকে সংকীর্ণ করে দেবে। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের হিংস্র প্রতিক্রিয়া আর সামগ্রিকভাবে জনগণের সরকারের প্রতি অসন্তোষের ফলে আন্দোলন খুব শীঘ্রই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পরে। দীর্ঘদিনের আর্থিক দুরাবস্থা সামলাতে সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন আর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। 

স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার আন্দোলনরত ছাত্রযুবদের দাবীপূরণের পরিবর্তে আন্দোলন কঠরহাতে দমনে উদ্যত হয়। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য সংগঠন, যুবলীগ আর স্বেচ্ছাসেবকলীগ  আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হিংস্রতার সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পরে। এই সংগঠনগুলো আন্দোলন দমনে আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করে। সরকার পুলিশ, RAB (Rapid Action Battalion), বর্ডার গার্ড ও মিলিটারিকে নামিয়ে জাতীয়স্তরে 'shoot-at-sight curfew' ঘোষনা করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে বাংলাদেশকে গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালায়। পরে সরকার Facebook, Tiktok, WhatsApp সহ সকল সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেয়। ১৫ই জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্ল্যাকার্ড প্রদশর্নের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল, তাদের ওপর ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা রড, লাঠি নিয়ে আঘাত করতে আসে। সেদিন দেশের অন্যান্য প্রান্তেও একইরকম হামলা করা হয়। ১৬ই জুলাই বিকেলে আবু সায়েদের নেতৃত্বে রংপুরের বেগম রকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা একত্রিত হলে তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয় ও ব্যাটন দিয়ে চার্জ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২৫ বছর বয়সী ছাত্র আবু সায়েদ আক্রমণের বিপক্ষে বুক তুলে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশ ১২ গজ শ্যটগান ১৫ মিটার দূরত্ব থেকে চালিয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই আবু সায়েদের মৃত্যু হয়। শহীদ আবু সায়েদ এই আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে। ২রা আগস্ট পর্যন্ত ২১৫ জন শহীদ হন আর ২০,০০০ জন আহত হয়। ১১,০০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। UNICEF-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ৩২ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগরের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবী করে। দেশজুড়ে চলতে থাকা অত্যাচারের ফলে এই আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনের রূপ নেয়। আন্দোলনের দাবী হয় মন্ত্রীসভার পদত্যাগ ও আন্দোলনে শহীদ হওয়া মানুষদের প্রতি সরকারের দায়গ্রহন। ৩রা আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হয়। আন্দোলনের সমন্বয়সাধক নাহিদ ইসলাম পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে তারা কোনোরকম বোঝাপড়ায় আগ্রহী নয়। পরের দিন তীব্র সংঘর্ষে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়। ৫ই আগস্ট বিপুল জনগণ রাজধানী শহরের রাস্তায় নেমে কারফিউ অবজ্ঞা করলে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। 

আপাতভাবে আন্দোলনটিকে হাসিনা বা আওয়ামী লীগ বিরোধী লাগলেও এর পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের ছাত্রযুব সমাজের দীর্ঘদিনের বেকারত্ব, অনুন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দুর্নীতির বিরোধিতা এবং সার্বিকভাবে গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতার আকাঙ্ক্ষায় প্রচলিত ব্যবস্থার বিকল্পের দাবি। ৫ই আগস্টের বিবৃতিতেও সমন্বয়করা স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার করে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সরকার গঠনের দাবী তুলেছে। তবে সেটার জন্য শুধু সরকার না বদলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আর অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। হাসিনা পদত্যাগের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা ও ছাত্র আন্দোলনের এক অংশের আত্মতুষ্টির সু্যোগ নিয়ে হাসিনা ঘনিষ্ট সেনাপ্রধানের সাথে বিরোধী বিএনপি ও জামাত জাতীয় ইসলামিক মৌলবাদী দলগুলোর আন্দোলন সমন্বয়কদের ছাড়াই বৈঠকের মাধ্যমে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের রূপরেখা ঠিক করার প্রচেষ্টা অগণতান্ত্রিক। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর সংখ্যালঘুদের উপর হিংসা-আক্রমণ, দাঙ্গা লাগিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে চলমান আন্দোলনকে ধর্মীয় রূপ দিয়ে দিকভ্রান্ত করার প্রচেষ্টাকে তীব্র ধিক্কার জানাই এবং এরূপ ঘটনা প্রতিহত করতে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার্থে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়কদেরই প্রধান ভূমিকা নিতে হবে। আন্দোলনকারীরা যেভাবে বুক দিয়ে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করেছে, তা প্রশংসার যোগ্য এবং রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের বিরুদ্ধে এই প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে। গণহত্যাকারী হাসিনার প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত ও সমর্থন, একইভাবে কলকাতায় বাংলাদেশের আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন মিছিলে তৃণমূল কংগ্রেসের দলদাস পুলিশের আক্রমনকে ধিক্কার জানাই। পলাতক গণহত্যাকারী শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেবার তীব্র বিরোধীতা করা উচিৎ। একইসাথে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত সরকারের নাক গলানো এবং ভারত বাংলাদেশ অসম চুক্তির প্রতিবাদ জানানো হোক। এই আন্দোলন অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়েছে এবং তার ফলে সাংগঠনিক দিক থেকে যথাযথ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। তাই এই আন্দোলন স্রেফ হাসিনার পদত্যাগেই খানিক তুষ্ট হয়েছে। এমনকি মহম্মদ ইউনুসের মত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী ব্যক্তির নেতৃত্বে সরকার গঠনেরও ডাক এসেছে সমন্বয়কদের তরফে, যা আদতে কোনও সমাধান হতে পারে না। অথচ বেকারত্ব, দুর্নীতি ইত্যাদির মূল কারণ নয়াউদারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আজ সময়ের দাবী। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বৈরাচার ও সেনা শাসন স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এবারের নাগরিক স্বর সেনা ও মৌলবাদী শক্তিদের শাসন প্রত্যাখ্যান করেছে, যা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশা দেখায়। এই আন্দোলনে একদিকে যেমন মহিলারা, বিশেষত ছাত্রীরা ব্যাপকভাবে যোগ দিয়েছে, তেমনই অন্যদিকে সামাজিকভাবে শোষিত ও বঞ্চিত নারীদের ন্যায্য কোটা বাতিল করেছে তাদের সুপ্রিম কোর্ট। এই তীব্র আন্দোলনের পরও হওয়া লিঙ্গগত বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব হতে হবে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পড়শি দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক রেসারিসির মৃগয়া ক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে ওই দেশের আভ্যন্তরীণ স্তরে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের পর্যায়ে খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইয়ের উন্মেষ ও সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!