সি পি আই (এম)
বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত
সি পি আই (এম)। ভারতে মার্ক্সবাদীদের সব চেয়ে প্রভাবশালী সংগঠিত দল। ভারতে মার্ক্সবাদের ভালো-মন্দ-র দায় তাদের সব থেকে বেশি। কার্ল মার্ক্সকে তারা দুমড়ে মুচড়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দফতরের আয়তনে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। মার্ক্সকে সাধারণের বোধগম্য করতে তাদের প্রধান হাতিয়ার লেনিন। সে কারণে এঁদের যেকোন রচনা লেনিনের উদ্ধৃতিতে মুখর। বাংলায় একটা শব্দবন্ধ আছে ‘কর্তা ভজা’। এদের একটা সংগঠিত ধর্মীয় গোষ্ঠীও আছে। তবে দলের বাইরেও এদের অস্তিত্ত্ব চোখ এড়ায় না। বাংলাতে সি পি আই এম-এর এমন অনেক ভক্ত আছেন। এঁরা দলের জন্য অর্থ আর সাংস্কৃতিক কাজকর্মের যোগানদারের কাজ করে থাকেন।
উকিল মোক্তার পেশকার। বিচিত্র ধরণের কর্মজীবী। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত মাননীয় তর্কবিদেরা। আর কৃতী শিল্পী সাহিত্যিকদের ভিড় এড়িয়ে কোনও প্রকারে একবার যদি খোদ মার্ক্স-এর কাছে পৌঁছনো যায় তা হলে যা পাওয়া যাবে সে অতি সংক্ষিপ্ত আর সরল বিষয়। তাঁর উপদেশ অক্ষরজ্ঞানহীন হত দরিদ্র মানুষের বোধের বাইরে আদৌ নয়। হবেই বা কেন। মার্ক্স হলেন আমাদের কালের ঋষি। আবার ঋষিরা তো জ্ঞানীদের উপদেশ দেন না। তাঁদের উপদেশ সাধারণের ভাষা আর বোধের সীমানার বাইরে হয় না। বুদ্ধিমানেরা ওই কথাগুলোকে পুঁজি করে জটিল ব্যাখ্যা দিয়ে অর্থ আর সম্মান আদায় করেন। আর সমাজে এক বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি গড়ে সুখের রাজ্যে বাস করেন।
মার্ক্স-এর সরল উক্তি। উদয়াস্ত কায়িক শ্রম করেও যে সমাজে বাঁচার সুখ ভোগ করা যাচ্ছে না, সেই সামাজিক ব্যবস্থাটা পালটে নিতে হবে। যাদের উদ্দেশ্য করে তাঁর এই বাণী তাঁরা হলেন সেই শ্রেণির মানুষ,কায়িক শ্রম ছাড়া জীবন ধারণের বিকল্প কোনো পথ যাদের স্যামনে নেই। প্রশ্ন ওঠে, কে করবে কাজটা। তিনি বললেন, নিজেদেরই করতে হবে এই কাজ। আর করতে হবে সংঘবদ্ধ হয়ে। আর এটাই সাহিত্যের ভাষায় সর্বহারার ঐক্য। প্রচলিত শ্রেণি সমাজে সর্বহারাদের জন্য এই হল মার্ক্স-এর উপদেশ অথবা নিদান। তার এই উপদেশ নিপীড়িতদের যারা পীড়ন করে তাদের জন্য অবশ্যই নয়। মার্ক্স জানতেন আর ভালোই জানতেন সমাজে নিচে থাকা মানুষেরা নিজেরা উপোসি থেকেও সমাজের সকলের জন্য কাজ করেন। তাঁদের হাত ধরে সমাজে যে বদল আসবে সে বদল কখনও আংশিক হতে পারে না। সে বদলে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণ। এই হল মার্ক্সবাদের সার কথা। আর সেই কারণেই মার্ক্স হলেন সর্বকালের সেরা মানবতাবাদী।
পাল্টে দেওয়া শব্দের মাঝে ইশারায় আছে গতিময়তা আর শক্তির রোমাঞ্চ। যৌবনকে যা আকর্ষণ করে অতি সহজে। আর এই অদৃশ্য আকর্ষণ আর সামাজিক পরিবেশ আমাকে পরিচিত করেছে মার্ক্স-এর সাম্যবাদের ভাবনার সাথে। ঘনিষ্ঠ হই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির। মার্ক্স-এর সর্বহারা পরিচয়ে নয়। সামাজিক পরিচয়ে আমাদের পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত বাস্তুহারা। রাজনৈতিক কারণে দেশান্তরী আমাদের সামনে প্রেরণা ছিল মার্ক্স-এর ভাবনাকে বাস্তবে প্রয়োগ করে লেনিনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টান্ত। নেতা তখন স্তালিন।
আমার বালক কাল কেটেছে বিশ্বমানব সমাজের এক পরিবর্তনের ঘটনার মধ্য দিয়ে। দুনিয়া জুড়ে এমন ঘটনা মানুষের গড়া সমাজ ব্যবস্থায় এই প্রথম। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, যা সূচনা করল এশিয়া আর আফ্রিকা জুড়ে উপনিবেশগুলির মাঝে মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্য এক ব্যাপক আন্দোলনের। বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথম ঘটল বিপরীত ধর্মী দুই রাস্ট্রব্যবস্থার মুখোমুখী সংঘাত। যার সূচনা ঘটেছিল সতেরোশ’ ছিয়াত্তর সালে পৃথিবীর অন্য গোলার্দ্ধে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাস্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আবার অন্য দিকে ওই এক ই সময়ে সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতার দাবী নিয়ে ঘটে যাওয়া ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এবং সমাজতন্ত্রকে রুখতে আর নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে উপনিবেশের শাসক রাস্ট্রগুলির স্বার্থ রক্ষা করতে এক নতুন রাজনৈতিক তত্ত্বের আবির্ভাব। বিকাশ হল এক নতুন শক্তির। নাম তার ফ্যাসিবাদ। উনিশ শ; ত্রিশ থেকে পয়তাল্লিশ এই পনেরো বছর ছিল এই নজির বিহীন সময়ের জীবনকাল।
অন্যদিকে এই ঘটনা জন্ম দিল শতাধিক বছরের পরজাতির অধীনতা থেকে মুক্ত স্বাধীন জাতীয়তাবাদের আকাঙ্ক্ষা। সেই সঙ্গে শাসক কি বা শাসিত সকল দেশে মার্ক্সবাদকে আদর্শ মেনে গড়ে উঠল কমিউনিস্ট পার্টি। এখন থেকে সামাজিক রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বের বিকাশ ঘটতে থাকল পুঁজিবাদ আর সমাজবাদের দ্বন্দ্বের নিরিখে। ভারতেও গড়ে উঠেছে কমিউনিস্ট পার্টি। লেনিনের তত্ত্ব আশ্রয় করে। আর আধুনিক বিশ্বে মানব সমাজের বিকাশের প্রাথমিক শর্ত নির্ভর করল পুঁজিবাদ আর সমাজবাদের দ্বন্দ্বের ভিতর।
আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি মার্ক্স-এর তত্ত্ব অনুসরণ করে চীনের জনতা নিজেদের বদলে নিয়েছেন। নেতা মাও ৎসে তুং। মাওয়ের লেখা যা পড়েছি তাতে লেনিনের উদ্ধ্বৃতি খুব একটা নজরে আসে নি। চীনের পাশে কোরিয়া। নিজেদের মুক্ত করেছেন। নেতা কিম উল সুন। আয়তনে ছোট হয়েও দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবান আমেরিকাকে ধমকায় চমকায়। কিম উল সুন-এর লেখায় লেনিনের উদ্ধ্বৃতি ক’টা আছে জানি না। ভিয়েতনাম। নেতা হো চি মিন। লড়াই করেছেন ফরাসি উনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। লড়াই করেছেন সবচেয়ে ক্ষ্মতাবান অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। হো চি মিন-এর রচনায় লেনিনের উদ্ধ্বৃতি কত পরিমাণে আছে জানা নেই। আশিজন যুবকের সংঘবদ্ধ শক্তি কিউবাকে মুক্ত করল। নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। যিনি আদৌ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যই ছিলেন না। পরামর্শদাতা পরিযায়ী বিপ্লবী চে গুয়েভারা। আমাদের যৌবন কালের ঘটনা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। এ ভাবেও মার্ক্স-এর ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়। বিপ্লব বলতে আমাদের ধারণায় ছিল এক বিশাল ব্যাপক গণ অভ্যুত্থান। কিন্তু এ-ও তো বাস্তব। যা আমার জীবনকালে ঘটে যাওয়া ঘটনা।
কষ্ট পাই। যখন দেখি, সি পি আই (এম) পার্টি এর কোনো ঘটনাকেই মার্ক্স-এর সঠিক অনুসারি বলে মেনে নিতে পারে না। বিপরীতে নিজেরা এমন এক সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে, যা আজ তাদের নিজেদের সংগঠনকেই দোদুল্যমান এমন এক অবস্থানে নিয়ে এসেছে যেখানে জলে কুমীর তো ডাঙায় বাঘ। ওদেরই নেতার কথায় বলতে হয়, কলে পড়েছে। এমন এক রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে পার্টি পরিচালনা করেছে যেখানে শত বছরের পার্টিকে ষাট বছরেই অস্তিত্বের সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সর্ব ভারতীয় পার্টি। লোকসভা রাজ্যসভাতে যার প্রতিনিধি ক্রমশ কমছে। বদলে রেখে গেল পড়া-লেখা জানা সুবিধাভোগী সম্পন্ন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যারা শিক্ষা দীক্ষা আর আর্থিক সামর্থ্যে উচ্চবিত্তের জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আর সেই সঙ্গে পুঁজিবাদের নির্ভরযোগ্য এক বিশ্বস্ত পাহারাদার।
অন্যদিকে চৌত্রিশ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনার সাফল্যের অহংকারকে পিষে দিয়ে যে প্রোডাক্ট তৈরি হল তৃণমূল আর বি যে পি-র শাসনে আজ তা পূর্ণাঙ্গ চেহারা নিয়ে দৃশ্যমান। বাম সমর্থকরা রব তুলেছেন গেল গেল। পশ্চিম বঙ্গের কৃষ্টি সংস্কৃতি সব শেষ হয়ে গেল। অন্যদিকে তৃণমূলের সমর্থকরা বিজয়ের আনন্দে উল্লাস আর উৎসবে ব্যস্ত। তাদের সব চেয়ে বড় বিজয় মনে করছে সি পি আই এম-কে উৎখাত করে যেন মার্ক্সবাদেরই উচ্ছেদ করা গেছে। সি পি এম-এর আন্দোলনের লক্ষ্য হল তৃণমূলের তেরো বছরের শাসনের থেকে উদ্ভূত অবস্থা থেকে নিদেন আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া। অতীতে ফিরে যাওয়া, সে কি সম্ভব। না কি বাস্তব ভাবনা। তৃণমূলের নিচুতলার যে সমর্থকদের প্রতি বাম পন্থীদের ক্ষোভ কিছুদিন আগেও তারা বামেদের পাশেই ছিলেন।
নতুন প্রজন্মের মার্ক্সবাদীদের কাছে আশা করব, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে নিজেদের করণীয় স্থির করবেন। মার্ক্স-এর কাছে যান সরাসরি। নিবিড় অধ্যয়ন করুন। বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুয্য রেখে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। সমাজে যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের কাছে যান। তাদের সঙ্গে থাকুন। নতুন তত্ত্বের সন্ধান মিলবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্বের সকল যুদ্ধের বিজয়ের রহস্য লুকিয়ে আছে সেই অস্ত্রের মাঝে, যা আগে কেউ ব্যবহার করেনি। সব শেষে নিজেদের ব্যর্থতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আর আন্তরিক কামনা রইল আপনাদের সাফল্য। মার্ক্সবাদ দীর্ঘজীবী হোক। সর্বহারার বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
[বক্তার মতামত তাঁর একান্ত নিজস্ব।]
চিত্র সূত্রঃ The Hindu
Comments
Post a Comment