ট্রাম্পের ট্যারিফ যুদ্ধের উদ্দেশ্য বিধেয়

প্রিয়াংশু দে 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম প্রেসিডেন্সি জুড়ে বিভিন্ন দেশের থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর একের পর এক ট্যারিফ আরোপ করেছিলেন এবং আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর সেই একই নীতি প্রণয়ন করে চলেছেন। 

ট্রাম্প যখন ২০১৭ সালে প্রথম সরকারে আসেন তখন ট্যারিফ থেকে রাজস্ব আসত মোট আমদানির ১.৫%।  ২০১৯-এ সেটা হয়ে দাঁড়ায় ২.৯%।  এবার দেখে নেওয়া যাক এই ট্যারিফ আসলে কি আর কোন কোন দেশ ট্রাম্পের এই আগ্রাসী নীতির শিকার? 

ট্যারিফ হল অন্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ধার্য কর। যে কোম্পানি পণ্যটি দেশে আমদানি করছে তারাই সাধারণত সেটি সরকারকে দেয়। কোম্পানিরা এই করের কিছু অংশ বা পুরোটাই দামের সঙ্গে যোগ করে গ্রাহকদের থেকে আদায় করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। 

ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্সির সময়ে এহেন ট্যারিফ নীতির মূল লক্ষ্যই হল চীনকে পর্যুদস্ত করা। ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে প্রথমে ৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আর পরে তা বাড়িয়ে ৩৬০ বিলিয়ন ডলারের সমান মূল্যের পণ্যের ওপর ট্যারিফ ধার্য করে। ইলেকট্রনিক দ্রব্য, যন্ত্রপাতি ও ধাতু এর অন্তর্ভুক্ত।  চীনা পণ্য ছাড়াও কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আগত স্টিল আর অ্যালুমিনিয়াম, ইউরোপ থেকে আগত স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, বিমান আর খাদ্যদ্রব্যের ওপর ট্যারিফ লাগু হয়। উল্লেখ্য, এই সবের মাঝে ভারত তার মার্কিনী 'preferential trade status' হারায় আর আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপরেও ট্যারিফ ধার্য হয়। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা থেকে আসা স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামও ছাড় পায়নি। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের গাড়ির ওপর ট্যারিফ ধার্যের হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। 

এবার আসা যাক ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসনের ঘোষিত ট্যারিফের ওপর। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী চীন থেকে আগত সমস্ত পণ্যের ওপর ১০% ট্যারিফ ঘোষিত হলেও ৭ই ফেব্রুয়ারী $৮০০-এর নীচের পণ্যের ওপর ছাড় দেওয়া হয়। ৪ঠা মার্চ আবার চীনা পণ্যের ওপর ট্যারিফের হার ১০% থেকে ২০% করা হয় ও কানাডা এবং মেক্সিকো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫% ট্যারিফ ধার্য হয়। কিন্তু কানাডা থেকে এনার্জি আমদানির ক্ষেত্রে ১০% ট্যারিফ রাখা হয়। ৬ই মার্চ পটাশের ওপর ট্যারিফ ২৫% থেকে কমিয়ে ১০% করা হলেও ১২ই মার্চ স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর তা ২৫% করা হয়। ২রা এপ্রিল থেকে গাড়ির ওপর ২৫% ও মে বা তার পর থেকে গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপরও ২৫% ট্যারিফ লাগু হবে। এছাড়া ট্রাম্প বলেছেন ২রা এপ্রিল থেকে অন্যান্য দেশ থেকে আগত বিভিন্ন পণ্যের ওপর ট্যারিফ ধার্য হবে। ২৬শে ফেব্রুয়ারীর এক ক্যাবিনেট মিটিংয়ে তিনি জানান যে ইউরোপীয় বিভিন্ন পণ্যের ওপর খুব শীঘ্রই ট্যারিফ বসানো হবে। ইউরোপীয় মদের ওপর ২০০% ট্যারিফ ধার্যের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। 

ট্রাম্প এই সকল ট্যারিফ সমূহকে 'reciprocal tarrif' বলে নিজের অবস্থানের পক্ষে অজুহাত খারা করার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ "আমাদের থেকে যত নেওয়া হচ্ছে, আমরাও তত ফেরত নেব"। কিন্তু এটা সম্পূর্ণভাবে একটি মিথ্যা কথা আর ইউএস-এর আভ্যন্তরীণ পরিসরে রাজনৈতিক স্বার্থে প্রচারিত। এক্ষেত্রে দুটো জিনিস বুঝতে হবে। প্রথমত,  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে সকল পণ্য রপ্তানি করা হয় তার দাম আগে থেকেই এতো বেশি হয় যে ভর্তুকির পরেও তা কোনো উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। তাই প্রায় কোনো দেশের সরকারই তার ওপর ট্যারিফ বসাতে চায় না। তাছাড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও মার্কিন সামরিক শক্তির ভয় তো আছেই। দ্বিতীয়ত, যে ধরনের reciprocity-র কথা ট্রাম্প বারংবার বলে চলেছেন তা বাস্তব জীবনে তখনই সম্ভব যখন দুটি দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে পরস্পরের সমকক্ষ। ফলে এই অজুহাত নিজের দেশের লোকভোলানো ভুঁয়ো বুলি আর নিজের দেশের অর্থনৈতিক মন্দার ভার অন্যের ওপরে চাপানো ছাড়া আর কিছুই না। ট্রাম্পের এই ট্যারিফ নীতির আসল উদ্দেশ্য হল যতটা পারা যায় পণ্য আমদানি কমিয়ে দেশে পুনঃশিল্পায়ন ঘটানো। বিগত ৫০ বছরে মার্কিন দেশে ব্যাপকভাবে deindustrialization হয়েছে। ফলে বর্তমানে সে দেশে উৎপাদন শিল্প হাতে গোনা কয়েকটি। মার্কিন অর্থনীতি Global Supply Chain-এর ওপর বিশাল ভাবে নির্ভরশীল। আর এভাবে হঠাৎ করে দেশে ব্যাপকভাবে শিল্প গড়ে তোলা কি সম্ভব? যেখানে মার্কিন ধনকুবেররাই সস্তার শ্রমের জন্য দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশে পণ্য উৎপাদন করাচ্ছেন সেখানে তারা কি নিজ দেশে শিল্প পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য টাকা ঢালবেন? তাছাড়া ওই দেশে হঠাৎ করে ব্যাপকভাবে শিল্প স্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি বা পরিকাঠামো কি উপলব্ধ আছে? মার্কিন মুলুকের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। ফলে এইরকম ট্যারিফ নীতির ফলে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় মার্কিন নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেখানকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ...  

তথ্যসূত্রঃ

1. What are tariffs and why is Trump using them?; Jennifer Clarke; BBC News. 

2. How this trade war is different from Trump 1.0; Neil Irwin; Axios

3. https://youtu.be/o6M-Yxz73i8?si=FID1QdBWO2-RgJwb

Picture Courtesy: Craiyon AI

Comments

Popular posts from this blog

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!

ফিরে দেখা ১০টা বছর: প্রজাতন্ত্রের সংকট