রবীন্দ্রনাথ ২০২৫
বিমলকান্তি দাশগুপ্ত
পঁচিশে
বৈশাখ বারোশ’ আটষট্টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। ইংরাজি তারিখের হিসাবে আঠারোশ’
একষট্টির মে মাসের সাত তারিখ। পৃথিবীতে চলেফিরে বেঁচে ছিলেন তিনি আশি বছর। এই
সময়কালে বিশ্বের কাছে নিজেকে পরিচিত করে
ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির পরিচয়ে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন নিজের
জন্মভূমির মর্যাদা। আজ মৃত্যুর চুরাশি বছর পার হয়েও তাঁকে নিয়ে চর্চা বাংলার
মানুষের কাছে এক মর্যাদার সংস্কৃতি রূপে বিবেচনা করা হয়।
এবারের
পঁচিশে বৈশাখ তারিখে আমরা আছি এক যুদ্ধের পরিবেশের মাঝে। আমাদের দুই নিকট-প্রতিবেশী
পাকিস্তান আর বাংলাদেশ নিজেদের সমস্যা নিয়ে বিব্রত। অন্যদিকে আমাদের নিজেদের মাঝেও
নানা সমস্যায় রাষ্ট্র পরিচালকদের মাঝে চলছে বাড়তি তৎপরতা। মোদ্দা কথা, উপমহাদেশের
এই তিনটি রাষ্ট্র এই মুহূর্তে স্বাভাবিক শান্ত পরিবেশে রয়েছে এমন কথা বলা যাবে না।
যুদ্ধ
একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রকৃতিতে যেমন সমাজের বেলাতেও একই। সৃষ্টি আর ধ্বংসের
মাঝখানে টিকে থাকবার যে প্রক্রিয়া সেটাই যুদ্ধ। যুদ্ধের এক ফল জন্ম বা সৃষ্টি ।
অন্য পরিণাম ধ্বংস বা মৃত্যু।
আমাদের
আলোচনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তিনি আশি বছর বেঁচে ছিলেন। আঠারোশ’ একষট্টি থেকে উনিশ
শ’ একচল্লিশ। তিনি ছিলেন ভারতের সাংস্কৃতির ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তাঁর
প্রথম পরিচয় তিনি কবি। কবিতা তাঁকে বিশ্বস্বীকৃতি দিয়েছে। এর পরে যা আছে, গীতিকার
সুরকার নাট্যক গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ, সাহিত্যের যত রকমের শাখা আছে সবেতেই তাঁর
দক্ষতা প্রতিষ্ঠিত। তিনি চিত্রকর। বিশ্বের নানা দেশে তাঁর চিত্রকর্মের স্বীকৃতি। ছিলেন
একজন সমাজকর্মী। ছিলেন শিক্ষক। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে বিশ্বের নানা
প্রান্ত থেকে আবাসিক শিক্ষকদের এনে বিশ্বের সঙ্গে নিজের দেশের যোগ সাধনের প্রয়াস
করেছেন। কারিগরি শিল্পের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। কৃষি আর কুটির শিল্পের প্রকল্প
প্রতিষ্ঠা করেছেন। কৃষক প্রজাদের আর্থিক উন্নতির কথা ভেবে ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা
করেছেন। পৃথিবীর নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন। সেখানে ভারতের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
বিপরীতে সেই সকল দেশের বার্তা নিজের দেশের জন্য নিয়ে এসেছেন।
দেশের
স্বাধীনতার জন্য তাঁর নিজস্ব ভাবনা ছিল। প্রথম যার প্রকাশ ঘটেছে বঙ্গভঙ্গের
বিরোধীতা করে রাখীবন্ধন উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে। কোন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে না
থেকেও কুখ্যাত রাওলাট আইন আর জালিয়ানওয়ালা বাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন।
নিজের নাইট উপাধি ত্যাগ করে। মনুমেন্টের নিচে বক্তৃতা দিয়েছেন। বিদ্রোহী বীণা দাস
বিদ্রোহী কল্পনা দত্তর ফাঁসির হুকুম রদে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। জেলে বন্দী
অবস্থায় নজরুলের অনশন প্রত্যাহারের জন্য
তাঁর আগ্রহ অবাক করে দেবার মত। দেশের মুক্তির জন্য সশস্ত্র আন্দোলনে তাঁর
প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল এমন বলা যাবে না। আবার তাদের প্রতি তাঁর স্নেহের অভাব ছিল
এমনও বলা যাবে না। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তাঁর অতি স্নেহের পাত্র। গান্ধীজীর সকল
কাজ তিনি সমর্থন করতেন এমন নয়। কিন্তু শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল অকৃত্রিম। এক সময় তিনি
নিজেও গোয়েন্দাদের নজরে ছিলেন। মানুষের ভুল ত্রুটি তাঁর কাছে প্রধান বিচার্য ছিল
না। মানুষকে মাপতেন তিনি তার অন্তরের বিশ্বাসের প্রতি আন্তরিকতা আর আচরণ দিয়ে। সব
শেষে শহরের ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদ ছেড়ে পরিবার নিয়ে তিনি ছিলেন আশ্রমবাসী। শান্তিনিকেতন
ছিল তাঁর আত্মার শান্তি।
শুরু
করেছিলাম যুদ্ধের কথা দিয়ে। এর পর কবির নিজের জীবনের যে বৃত্তান্ত উল্লেখ করলাম তা
একান্তই রবীন্দ্রনাথের নিজের জীবনযুদ্ধের কাহিনি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে
মানুষটি এই যুদ্ধ করেছেন তাঁর নিজের জীবনে সামাজিক যুদ্ধ কী প্রভাব ফেলেছে অথবা
আদৌ ফেলে ছিল কি না সেটা পরখ করতে এই প্রচেষ্টা।
আদিতে
যুদ্ধ ছিল গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধ। এই যুদ্ধ অতীত হল রাজায় রাজায় যুদ্ধের
প্রতিষ্ঠা দিয়ে। সে ছিল ভূমি দখলের যুদ্ধ। পুরাণকথায় তার কাহিনি লেখা আছে। এর পরে
সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ। তার কথা আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। যুদ্ধের আধুনিক
সংস্করণ হল উপনিবেশবাদের যুদ্ধ। কালের হিসেবে যা ষোড়শ শতকের ঘটনা। পৃথিবীতে মানব
সভ্যতার অয়ন বদল ঘটেছে। পশ্চিমের সদ্য জেগেওঠা নব্য সভ্যতার উদ্ধত ঢেউ সমুদ্র পার
হয়ে পূর্বাচলের বেলাভূমিতে আছড়ে পড়েছে। সাগরের নিরাপদ বেষ্টনীর আশ্রয়ে পূর্বাচলের
হাজার বছরের নিদ্রিত সভ্যতা হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গে সচকিত। পশ্চিমের ছোট ছোট দেশ এশিয়া
খণ্ডকে নিয়ে ভোগের উৎসবে মেতেছে। উপনিবেশের যুগের সূচনাকাল এটা।
সতেরোশ’
সাতান্ন সালে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোপম্পানি বাংলা বিহার
উড়িষ্যার দখল নেয়। এর পর থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি অনেক যুদ্ধ করে অনেক রাজ্য দখল করে
প্রায় পঞ্চাশ বছর পর পাঞ্জাব দখল করে। সময় আঠারো উনপঞ্চাশ সাল। আর এর আট বছরের
মাথায় ঘটল সিপাহী বিদ্রোহ। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে যার উল্লেখ আছে
ইতিহাসে। আর আঠারোশ’ আটান্ন সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র। আর এখন থেকে ভারত
সরাসরি ব্রিটিশ সম্রাটের প্রজা।
এর পরের
ঘটনা আফ্রিকা। ইয়োরোপের ছোট ছোট দেশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘুমন্ত আফ্রিকার উপর। তার
দেহকে খণ্ড বিখণ্ড করে ভোগের রাজসূয় শুরু করেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় চটকা ভেঙে গেলে
শুরু হল প্রতিরোধ। ইতিহাসে উল্লেখ করা হল স্বাধীনতার যুদ্ধ নাম দিয়ে। প্রথম শুরু
হল আমেরিকায়। ইয়োরোপের কলোনিগুলো একযোগে বিদ্রোহ করে নিজেদের মুক্ত করল। আর
নিজেদের যুক্ত করল এক নতুন ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। রাজাবিহীন জনগণের শাসন। সময়
সতেরো শ’ ছিয়াত্তর।
এর মাঝে
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি সামাজিক চাহিদার অয়ন বদল করে দিল। জমির
দখল নয়। রাজ্য বিস্তার নয়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল অর্থনীতি। শুরু হয়ে গেল আর্থিক
বাজার দখলের লড়াই বা যুদ্ধ। এর পরিণতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। উণিশ শ’ চোদ্দ থেকে
আঠারো। এর একুশ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। উনিশ শ’ উনচল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ। রবীন্দ্রনাথের
মৃত্যু উনিশ শ’ একচল্লিশ।
এরই
মাঝে মানুষের সভ্যতা সরাসরি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। পুঁজিতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র। পুঁজিতন্ত্রের
ঘোষণা বিশ্বের যাবতীয় সম্পদ প্রাকৃতিক অথবা জৈবিক নির্বিশেষে পুঁজির নিয়ন্ত্রণে
থাকবে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের ঘোষণা, তাবত সম্পদের উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা প্রমাণিত হয়ে গেছে। রাশিয়াতে ‘ইউনাইটেড সোভিয়েত
সোসালিস্ট রিপাব্লিক’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
যুদ্ধের
ভালোমন্দ পরিণাম প্রত্যক্ষ করেছেন কবি। রাশিয়ায় গিয়ে নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন সেই
ঘটনা। প্রয়াণের আগে আশি বছরের জন্মদিনে কবি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ‘সভ্যতার
সংকট’ নামে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ। সোভিয়েত রাশিয়ায় নতুন সমাজ ব্যবস্থা নিজে
প্রত্যক্ষ করেছেন কবি। আর যুদ্ধ বিষয়ে এই প্রবন্ধটিই তাঁর শেষ রচনা। মৃত্যুশয্যা
থেকেও তিনি সোভিয়েতের খবর শুনতে আগ্রহী। আর এই যুদ্ধে সোভিয়েতের বিজয় বিষয়ে তিনি
তাঁর আস্থা প্রকাশ করেছেন। ‘ওরা জিতবে’। এই উক্তি দিয়ে।
(মতামত ব্যক্তিগত)
Picture Courtesy: Zee News
Comments
Post a Comment