নজরুল ইসলাম - ফিরে দেখা ২০২৫
বিমলকান্তি দাশগুপ্ত
আপৎকালে অর্ধেক ছাড় দেবার বিধান লেখা আছে শাস্ত্রে। অন্যদিকে প্রাপ্তিকালে ঊর্ধ্বপক্ষে পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ের বিধান অনুমোদন করে বণিকশাস্ত্র। কথাটা মনে এল ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রসঙ্গে। নিজের অঙ্গ ছেদন করে দেশ স্বাধীন হল। ছেঁড়া অংশ পাস্কিস্তান নাম নিয়ে এক পৃথক রাষ্ট্র হয়ে প্রতিষ্ঠিত হল। স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দুই রাষ্ট্রের মাঝে ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়া হল। এই ঘটনা কবিতা হয়ে প্রকাশ পেল অন্নদা শঙ্করের কলমে। "তেলের শিশি ভাঙল বলে" ---- ইত্যাদি পঙক্তি আশ্রয় করে। দুঃখের মাঝেও একটু সুখের আলো দেখেছেন কবি। লিখছেন, “ভুল হয়ে গেছে বিকুল। আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে। ভাগ হয়নিকো নজরুল"। ভাগাভাগির হরির লুঠে নজরুলকে নিয়ে কারো মাথা ব্যথা না। কেন—
নজরুলের সাহিত্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটেছে বাংলা সাহিত্যের নানা শাখা প্রশাখায় ভর করে। এখানে তাঁর কৃতিত্ব কর্তৃত্ব অবদান সাফল্য ব্যর্থতার দিকে নজর করলে কী দেখা যাবে। আমাদের জানা আছে বাংলা ভাষার আদি যুগ, কোন বিতর্কে না গিয়ে চর্যাপদ সাহিত্যের কালকে। সে তো আজ থেকে হাজার বছর আগের কথা। সেই সাহিত্যরস এযুগের বাঙালিকে ডিকশনারির সাহায্য ছাড়া গ্রহণ করা খুব একটা সহজ হবে না। একথা বলার মতলব, সমাজের বহমান স্রোতকে বিশেষ বিশেষ ঘটনার কালে ভাগ করা হয়। যে ভাগগুলির ছবি ধরা থাকে সেই সেই কালের কবি সাহিত্যিকদের রচনায়। আর সেই রচনা সমৃদ্ধ হতে থাকে নতুন নতুন ভাবনা আর শব্দের অলংকারে। অন্য দিকে এর অভাবে ভাষার স্রোত রুদ্ধ হয়। এমন কি মৃত্যুও ঘটে থাকে ভাষার।
এবার দেখতে চাইব, সমকালের বাংলা ভাষায় নজরুল কী অবদান রেখেছেন। যা নজরুলকে আলাদা করেছে পূর্বসুরিদের কাছ থেকে। লক্ষ্য করবার বিষয় হল, একই সময়কালে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ভাষা অনুরাগী এক সাহিত্যিক গোষ্ঠী। বিপরীতেও আছে এক বা একাধিক গোষ্ঠী। ব্যতিক্রম, নজরুল। তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী বা অনুসারি নন। বিরোধীও নন। তিনি রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। সাহিত্যের ভাষায় নজরুলের ব্যবহার করা নতুন নতুন শব্দ পাঠক মহলে আদর পেলেও তা স্থায়ী হলনা।
নজরুলের বাংলার বৈশিষ্ট্য হল, ইসলামি শব্দের অবাধ প্রয়োগ। বাংলা সাহিত্যে যা ছিল অভিনব। বাঙালির মননে সংস্কৃত ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা তার বহু বছরের অর্জিত সংস্কার। অন্য যে সকল বিদেশী শব্দ বাংলার সঙ্গে মিশেছে, তার সবগুলিরই পেছনে আছে বাণিজ্য সঙ্গ। আর বেশিটাই হল রাজশক্তির বাধ্যবাধকতা। সব চেয়ে বেশিদিন মুসলমান শাসনের অধীনে থেকেছে বাংলা। আর ইসলামি ভাষা সরকারি কাজ দলিলপত্র আর বিচার ব্যবস্থায় টিকে আছে আজও। বাঙালির মননে তার চিন্তা চেতনায় আরবি ফারসি আসে না। আর এই ভাবনাকে পুঁজি করে পুব পাকিস্তানের বাঙালি স্বাধীন বাংলা দেশ গঠন হলে নজরুলকে সে দেশের জাতীয় কবির সম্মানে প্রতিষ্ঠিত করল। যখন নজরুলের সৃজন ক্ষমতা বহু আগে থেকেই স্তব্ধ। তিনি তখন বাকরুদ্ধ। অসুস্থ।
বাংলার সমাজজীবনের একটা উত্তাল সময়ে নজরুলের উত্থান। এক দিকে দেশের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় স্বাধীনতার আন্দোলন। একই সঙ্গে চলছে বিশ্ব শ্রমিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বে সাম্যবাদের লক্ষে আন্দোলন। এই দুই আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করলেন যুদ্ধফেরৎ হাবিলদার কাজি নজরুল ইসলাম। আর উভয় ধারার যৌবন তাঁকে বরণ করে নিল আগ্রহের সঙ্গে। তিনি নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন বাংলার সাহিত্য সঙ্গীত আর সংস্কৃতির সমাজে। আর তা ছিল যেন একান্তই আকাশে ধূমকেতুর আসা আর যাওয়া।
বাংলায় মুসলমানের দুই ভাগ। এক ভাগ জন্মসূত্রে বাঙালি। তারা সংখ্যায় বেশি। অপর ভাগের জন্মের শিকড় রয়েছে আরবের মরুদেশে। তারা আগন্তুক। সংখ্যায় অল্প। বাঙালি মুসলমান আদিতে ধর্মান্তরিত নিচু বর্ণের হিন্দু অথবা বৌদ্ধ। সামাজিক মর্যাদায় হীন। বাংলার মুসলমানসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে আগন্তুক মুসলমানেরা। সামাজিক অবস্থানে তারা বনেদি। শিক্ষিত। আর্থিক অবস্থানে তারা ধনী। রাজা জমিদার অথবা ব্যবসায়ী। তারা বাংলাভাষায় কথা বলেন না। বাঙালি পোশাক পরেন না। বাঙ্গালির স্বাভাবিক খাদ্য খান না। তারা বাংলা স্কুলে পড়েন না। তাদের স্বাভাবিক ভাষা আরবি ফারসি। সে ভাষা আরব দুনিয়ার ভাষা। আচার্য সুনীতি কুমারের মতে ওই ভাষার উচ্চারণ বাঙালির জিভে সহজে উচ্চারিত হবার নয়। অনেক অনুশীলন সাপেক্ষ তা। বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন উর্দুতে। কর্মযোগ যে ভাষার উৎস। প্রকৃতিতে যার শিকড় নেই। সে সমাজে মেয়েদের মাঝে শিক্ষার চল নেই। তারা থাকেন পর্দার আড়ালে। বাইরে বের হলে থাকেন বোরখায় ঢাকা। ব্যতিক্রম বাদ দিলে এই হল বাংলার বনেদি মুসলমান সমাজের বাস্তব ছবি।
অপর দিকে ধর্মান্তরিত বাঙালি মুসলমানেরা যারা সংখ্যায় বেশি আদিতে বাংলার সমাজে নিচু তলার বাসিন্দা। বাংলার স্বাভাবিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। পৃথক এলাকায় তাদের বাস। সাধারণ ভাবে দরিদ্র। নিরক্ষর। শ্রমজীবী। কৃষিজীবী। মৎস্যজীবী। মাঝি মাল্লা। আর দিনমজুর। যারা সাক্ষর তাদের শিক্ষা সাধারণ বাংলা বিদ্যালয়ে। নজরুল নিজেও ছিলেন বাংলা স্কুলের ছাত্র। মাথরুণ হাই স্কুলে পড়েছেন। শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক। যদিও তাঁর বংশের শিকড় রয়েছে আরবের মরুদেশে। কাজিবংশে তাঁর জন্ম। এখানেও তিনি বিদ্রোহী।
দীর্ঘকালের মুসলমান শাসন বাঙালির এক অংশকে তার সমাজদেহ থেকে আলাদা করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিপরীতে হিন্দু ধর্মপ্রভাবিত বাঙালি নিজের দেহের বিচ্ছিন্ন অংশকে আপন ভাবতে ব্যর্থ হয়েছে। তার সেই ব্যর্থতা পূর্ণ হয়েছে বিভাজনের মধ্য দিয়ে। ইসলামের সাফল্য এখানে। যুগ থেকে যুগের অবহেলায় ক্ষুব্ধ বাঙালি পাকিস্তান নামে এক পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গৌরবের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আর এখানেই থেমে না থেকে নিজের নামেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। জন্ম নিয়েছে বাংলা দেশ নামে এক সার্বভৌম রাষ্ট্র।
আর এখান থেকে বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটবে দুই মুখে। এক পশ্চিমে হিন্দু আর সংস্কৃতের আধারে গড়া প্রাচীন বাংলা ভাষা। অন্য দিকে পুবের ইসলাম আর আরবি ফারসি ভাষার আধারে বিকাশ ঘটতে থাকবে এক নতুন বাংলা ভাষার। এটাকে ভাষার উপর ধর্মের আধিপত্য ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। আর এই কারণেই নজরুলকে বাংলা দেশ জাতীয় কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্য নয়। শ্রমজীবী মানুষের প্রতি তাঁর আনুগত্যের জন্য নয়। নারী স্বধীনতা। নারীমুক্তির প্রতি তাঁর সমর্থনের জন্য নয়। কোন ধর্মের প্রতি অনুগত না থাকার জন্য নয়। তাঁকে নির্বাচন করা হয়েছে কাব্যভাষায় আরবি ফারসি শব্দের ব্যাপক ব্যবহার। যুব সমাজে তাঁর অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা। এর আগে আর কোন বাঙালি মুসলমান কবি সাহিত্যিক জনপ্রিয়তার এতটা উচ্চতায় উঠতে পারেন নি। সব চেয়ে বেশি যা অনুকুলে ছিল তা হল তাঁর নিস্তব্ধতা। তাঁর অসুস্থতা। তাঁর অসহায়তা।
সাহিত্যিকেরা আত্মকথা লেখেন। কবিরাও লেখেন। সে লেখা গদ্যসাহিত্যের সম্পদ। কবিতায় আত্মকথা মধুসূদন লিখেছেন। তাঁর পরেই আমার মনে হয় নজরুলের আমার কৈফিয়ৎ কবিতার কথা। “পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে / মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি রয়েছে সোনার শত ছেলে / প্রর্থনা কর যারা কেড়ে খায় শিশুর মুখের ভাত যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ।।” - এই নজরুল বাংলার না। পাকিস্তানের না। ভারতের না। বাংলা দেশেরও নয়। এই নজরুল একান্তই বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কবি।
Picture Courtesy: DeviantArt
Comments
Post a Comment