কসবার কান্না থেকে রাজ্য রাজনীতি - গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র
রুমেলা দেব
"চোখ পড়েছে" - ব্রিটিশ শাসনে খাজনা বা বকেয়া দিতে না পারলে কিংবা জমিদারী শাসনে অসহায় প্রজার "সুন্দরী" মেয়ে থাকলে, তার উপর চোখ পড়ত তৎকালীন শাসকের। ফলস্বরূপ অসহায় "সুন্দরী" মেয়েটি নিজেকে অর্পণ করতে বাধ্য হত শাসকের হাতে। তাদের কুৎসিত চাহিদা মেটানোর পর কারুর ভাগ্য হত বাড়ি ফিরে যাওয়ার, কেউ বা পাকাপাকিভাবে রয়ে যেত লালসা মেটানোর ভোগ্যপণ্য হিসেবে। এই কাহিনী সাহিত্য, ভূতের সিনেমা ইত্যাদি মারফৎ আমাদের ভীষণ চেনা। হঠাৎ এসব লিখছি কেন? আসলে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতম, জনজোয়ারে ব্যস্ত, দ্রুতগতিতে চলা শহরের বুকে দিনের পর দিন ঘটে যাওয়া হাড়হিম করা নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলির ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার ট্রেস করতে চাইছি। প্রশ্ন উঠবে, আজকের পুঁজিবাদের বর্তমান সর্বোচ্চ দশা নয়াউদারবাদের নিয়ন্ত্রনাধীন পৃথিবীতে প্রযুক্তির বিজয় রথের মাঝে মহিলারা কি অর্ধেক আকাশ ছুঁতে পেরেছে? নাকি শাসক, বিরোধী সব শিবিরেই মেয়েরা আজও অসহায়, সহজলভ্যই থেকে গেছে!
একজন মহিলা নেত্রী পরিচালিত শাসক দলও নিজের দলের মহিলাদেরকে নিরাপত্তা দিতে কি ব্যর্থ? নাকি তা নিছকই অনীহা? ২০১১ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গে “মা(!)-মাটি(!)-মানুষ(!)”-এর সরকার গঠিত হচ্ছে, তখন একবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক চেতনা, বাংলার সংস্কৃতি, নারী ক্ষমতায়নের ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছিল। তারপর পার্ক স্ট্রীট, কামদুনি, আরজিকর প্রভৃতি মর্মান্তিক ঘটনা এবং শাসক দলের রক্তচক্ষুর সময়কাল পার করেছি আমরা। সংবাদমাধ্যমের ধারাভাষ্য অনুযায়ী ২৫শে জুন ২০২৫ দক্ষিণ কলকাতায় কসবার একটি ল কলেজে, এক ছাত্রীকে কলেজের ইউনিয়ন রুমে আটকে রেখে ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন ও তার ভিডিও করে রাখা হয় ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশ্যে। ঘটনাটি ঘটবার আগে কলেজ গেটে তালা মেরে, গার্ডকে দিয়ে রুম বন্ধ করে রেখে অতীব ঠাণ্ডা মাথায় এই ন্যক্কারজনক অপরাধ সংঘটিত করা হয়। প্রায় এক বছর আগে, আরজিকর মেডিকেল কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে অভয়ার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার, বিরুদ্ধে বিচারের দাবিতে আন্দোলনের ব্যর্থতা সমগ্র সমাজকে আবার নারী নিরাপত্তার প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ওই অভিযুক্ত ওরফে কলেজের কুখ্যাত গুন্ডার রাজনৈতিক অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে সে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের একটি শাখার প্রেসিডেন্ট ছিল। শুধু তাই নয়, বর্তমানে অফিশিয়ালি কোনো পদে না থাকলেও (অনেক সংবাদপত্রে কলেজের অস্থায়ী কর্মী লেখা হয়েছে), ওই কলেজের অনির্বাচিত ছাত্র সংসদের তৃণমূল কংগ্রেসি সংজ্ঞাধীন কার্যকলাপ - ভর্তি থেকে শুরু করে কলেজ ফেস্ট, এমনকি সিসিটিভি ফুটেজ অবধি তার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এই রাজনৈতিক ক্ষমতাবান স্বনিয়োগপ্রাপ্ত নেতার বিরুদ্ধে আগের একাধিক যৌন হয়রানি, শারিরীক-মানসিক অত্যাচার, ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে অকথ্য মারধর, ব্ল্যাকমেইল-এর অভিযোগ থাকলেও বুক ফুলিয়ে এলাকায় সে ঘুরত, কারোর তোয়াক্কা না করে। প্রশাসন থেকে দলীয় পর্যায় অবধি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়াও সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে যে ওই সমাজবিরোধীর সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের দহরম মহরম ছিল। ওর দুজন ১৯/২০ বছর বয়সী “সহযোদ্ধা(!)” ওরই আদেশে সমগ্র ধর্ষণের সময় পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল। তৃতীয় অভিযুক্ত কলেজের নিরাপত্তারক্ষী, যে পরোক্ষভাবে এই ঘটনা ঘটাতে সাহায্য করেছিল। ছাত্রীর অভিযোগ অনুযায়ী এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায় যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ সদস্যের ‘ফ্যাক্ট‑ফাইন্ডিং টিম’ কলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সিসিটিভি, ছাত্রসংগঠন, প্রশাসনিক সমন্বয় ইত্যাদি খতিয়ে দেখতে কলেজ পরিদর্শন করেছে। উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নির্দেশ মোতাবেক কলেজ কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট দাখিল এবং কলেজে নিরাপত্তা আরও বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনার বীভৎসতা উপলব্ধি করতে গেলে বিষয়টি গোড়া থেকে দেখা জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্যে ও দেশে নারী নিরাপত্তা এখন ভোট বৈতরণী পার হওয়ার মন্ত্র হয়ে উঠেছে কিন্তু বাস্তবে তা শুধুই শূন্য প্রতিশ্রুতির গালভরা বুলি।প্রতিটি নির্বাচনের আগে নারী উন্নয়ন নিয়ে রয়েছে প্রতিশ্রুতির পাহাড়, "কন্যাশ্রী" বা "রূপশ্রী" প্রকল্পের ঢাক-ঢোল আর বাস্তবে মহিলাদের জীবন যে কোনো মূহুর্তে 'আছে থেকে নেই' হওয়াটা হতবাক করার কিছু নয় - এ এক নির্মম দ্বিচারিতা! এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী, জাতীয় স্তরে ২০১৪–২০২২ সময়কালে দেশের “ক্রাইম এগেইনস্ট উইমেন” ৩.৩৭ লক্ষ থেকে ৪.৪৫ লক্ষে, অর্থাৎ ৩০%-এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নারী নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে গত তিন বছরে ৩২% (এনসিআরবি)। বেশিরভাগ ঘটনা বিচার বহির্ভূত রয়ে গেছে এবং ভয় দেখিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা আজও বর্তমান। মহিলা কমিশন পরিণত হয়েছে শাসকদলের শাখায় - স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করা তো দূর, প্রকাশ্যে সহযোগিতার কথাও শোনা যায় না। কসবার শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটা ন্যক্কারজনক ঘটনাটি যুগ যুগ ধরে নারী শরীরের ওপর দলীয় ও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য বিস্তারেরই ধারাবাহিকতা। বছরের পর বছর ধরে সাধারণ ছাত্রছাত্রী থেকে বিরোধী মতাদর্শের ছাত্রদের উপর নিগ্রহ চলছে আকছার; এমনকি শাসক দলের মহিলারাও নিরাপদ নয় তাদের নিজেদের দলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের হাত থেকে। মারধোর, তোলাবাজি, ভর্তি সংক্রান্ত দুর্নীতি, মহিলাদের উপর শারীরিক-মানসিক-যৌন নির্যাতন “নিউ নর্মাল” হয়ে উঠেছে কলেজ ক্যাম্পাসগুলি জুড়ে।
সাম্প্রতিককালে আমরা দেখতে পেয়েছি, গোটা রাজ্যজুড়েই ক্যাম্পাসভিত্তিক যৌন নিপীড়নের বিভিন্ন ভয়াবহ ছবি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেস্টের নাচের ভিডিও ভাইরাল হলে ছাত্রীরা অভিযোগ করে যে জোর করে অশালীন পোশাক পরিয়ে তাদের ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছে! অন্য একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী হোস্টেল সুপার ও ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে যৌথভাবে "শারিরীক সম্পর্ক"-এর বিনিময়ে রুম দেওয়ার অভিযোগ করে এবং এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অভিযোগকারীকেই বহিষ্কার করা হয়! বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক পিএইচডি গাইডের বিরুদ্ধে “থিসিস পাশ করিয়ে দেওয়ার বদলে যৌন সম্পর্কের চাপ”-এর অভিযোগ উঠেছে কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগগুলির সত্যতা অবশ্যই বিচার্য কিন্তু একই সাথে শাসক দল ঘনিষ্ঠদের অন্যায় করেও পার পেয়ে যাওয়ার একাধিক ঘটনাও জনমানসে রয়েছে। এই ধরণের ঘটনার ধারাবাহিকতা হিসেবে কসবা ল কলেজে ঘটে যাওয়া ধর্ষণকাণ্ড প্রমাণ করে যে এটি চরম প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, গণতন্ত্রহীনতা, ক্যাম্পাসের মাফিয়াকরণ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং সর্বোপরি ক্রমাগত নারী বিদ্বেষী সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। দলীয় সূত্রে “আইন নিজের পথে চলবে” - এই পুরনো স্ক্রিপ্ট তো সকলেরই জানা।
একটা সময় ছিল যখন বাংলার ছাত্র রাজনীতিকে বলা হত সমাজ বদলের হাতিয়ার। আজ সেই ক্যাম্পাসে হয় না সুষ্ঠু ছাত্র ভোট, নেই ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নামে দলীয় গুন্ডামি, তোলাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য এবং ভয়ের পরিবেশ। এই বিকৃত রাজনীতির ছায়া পড়েছে কসবা কাণ্ডেও - অভিযুক্তদের মধ্যে সকলেই কলেজের ছাত্রনেতা, যারা শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্বের অনুগামী। এটা স্পষ্ট যে বর্তমান শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের কাজ হল বিরাজনীতির বাতাবরণ তৈরি করা, তোলাবাজি করা এবং ঘুরপথে সরকারী ও আধা-সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে ব্যবহার করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় সহায়তা প্রদান।
বিশ্ববিদ্যালয় হল একটি দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিককে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণভূমি। সেখানে যদি গণতন্ত্র না থাকে, নাগরিকদের মধ্যে থেকেই উঠে আসা ভবিষ্যৎ শাসক হয়ে উঠবে স্বৈরাচারী, ভ্রষ্ট চরিত্রের বিকৃত মানুষ। মুক্ত চিন্তা, মতপ্রকাশ, প্রতিবাদ - সবই নিষিদ্ধ হলে, শুধু চলবে রাজনৈতিক আনুগত্য আর মঞ্চে স্লোগান। এমনকি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ইলেক্টেড নয়, সিলেক্টেড স্টুডেন্ট লিডাররাও বহু ক্ষেত্রেই তৃণমূল বা বিজেপি ঘনিষ্ঠ। সুতরাং, সকল সরকারি ও বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অবিলম্বে করতে হবে। তোলাবাজ ছাত্র নেতাদের বহিষ্কার ও শাস্তি দিতে হবে। ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাসে নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করতে হবে। পড়ুয়াদের তথ্য জানার অধিকার ও অভিযোগ জানানোর স্বাধীনতা দিতে হবে। ছাত্রীদের গোপন তথ্যভিত্তিক অভিযোগ জানানোর জন্য হেল্পলাইন ও মোবাইল অ্যাপ চালু করতে হবে। ইন্টারসেক্স, ট্রান্স ও কুইয়ার পড়ুয়াদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে একই সুরক্ষা সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলির (যদি আদেও নেওয়া হয়) আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
"ভবিষ্যৎ গড়ার জায়গা যদি ভয় আর তোলাবাজির দখলে চলে যায়, তবে জাতি দেউলিয়া হয়"। যদি ক্যাম্পাসে মেয়েরা নিরাপদ না হয়, তাহলে সেই ক্যাম্পাস আসলে চিন্তার মৃত্যুস্থল হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, পুলিশ ও প্রশাসনের গড়িমসি, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হলে তা সরকারি দায়বদ্ধতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে। বিজেপি শাসিত রাজ্যে হাথরাস কিংবা উন্নাও-এর গণধর্ষণের ঘটনা এবং বিচার চাইতে গিয়ে অভিযোগকারীদের মর্মান্তিক পরিণতি বুঝিয়ে দেয় এই রাজ্যেও বিজেপি কর্মীদের প্রতিবাদ আসলে কুমীরের কান্না এবং প্রগতিশীল মহলের আন্দোলন দমন করার প্রোজেক্ট। এ রাজ্যে বাম আমলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি এমন নয়, কিন্তু বর্তমান তৃণমূল জমানায় তা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই দমনের হাতিয়ার এবং সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অরাজনৈতিক আন্দোলনের স্বাভাবিক ব্যর্থতাই ধর্ষণ মানসিকতাকে তোল্লাই দিচ্ছে। তাই প্রয়োজন রাজনৈতিক আন্দোলন। প্রয়োজন প্রগতিশীল খেটে খাওয়া দর্শনের রাজনৈতিক বিকল্প।
Comments
Post a Comment