এসআইআর? নাকি ঘোমটার নীচে এনআরসি?

শর্মিষ্ঠা রায়

বিহারে আট কোটি ভোটারের স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা SIR হয়ে গেল গত এক মাসে। বিরানব্বই লক্ষ লোকের নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে তারা এবার আসতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে। গতির লড়াইয়ে তারা চিনকে টেক্কা দিয়েছে, মানতেই হবে। এতদিন জানা ছিল, যে কোনো কাজ চিন অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে আশ্চর্য সুষ্ঠুভাবে করে। কিন্তু সময় এবং সুষ্ঠু পরিচালনার বিষয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশন যে চিনকে দশ গোল দিয়েছে, তা হলফ করে বলা যায়। 

SIR এর ফর্মে আপনার নাম, ঠিকানা, ছবি রয়েছে। এগুলো কোথায় পেল নির্বাচন কমিশন? উত্তর, আপনার ভোটার কার্ড। কিন্তু ভোটার কার্ড তো নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র নয়। ওখানে আধার নম্বরও রয়েছে। কিন্তু আধারও তো নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। তাহলে এই দুই "অবৈধ" পরিচয়পত্র ব্যবহার করে আপনার নামে customized form তৈরি হল, তা কি করে বৈধ হয়? নির্বাচন কমিশন আপনাকে একটা 'অবৈধ' পরিচয়পত্র দিয়েছে। আরও একটি 'অবৈধ' পরিচয়পত্র আপনার সব কিছুর সঙ্গে লিঙ্ক করে দেওয়া হয়েছে। তার নাম আধার। দুই 'অবৈধ' পরিচয়পত্র যারা আপনাকে দিয়েছে, তাদের একজন নির্বাচন কমিশন যে কতখানি জালিয়াতি করছে, রাহুল গান্ধী তা হাতে কলমে দেখিয়েছেন। জাতীয় হোক, আন্তর্জাতিক হোক, যে কোনো আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের এই ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য। আর আমি আপনি যদি কাগজ নিয়ে এই ক্রিমিনালের আজ্ঞা পালন করি, তাহলে আমাদের আচরণও শাস্তিযোগ্য হবে তাই না? ডাকাতকে ডাকাতিতে সাহায্য  করার অপরাধ! 

একটা প্রতিষ্ঠান তার নিজের করা কাজকে নিজেই অবৈধ ঘোষণা করার পর কি করে কলার তুলে আরও একটি ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি করে জনগণের বিরুদ্ধে? এর একটাই কারণ, জনগণকে তারা ডাহা মূর্খ ও হাবাগোবা মনে করে। আর এমন দুর্নীতির উদ্দেশ্য? তা হল, আরও একটি কার্ড, তারা জনগণের জন্য ইস্যু তারা করবে। কিছুই যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ না হয়, তাহলে জনগণই দাবি তুলবে, এবার আমাদের সত্যিকারের একটা নাগরিকত্বের কার্ড দেওয়া হোক। আর সেই সুযোগে সরকার তাদের দেবে MNIC (Multipurpose National Identity Card) যার মধ্যে embedded অবস্থায় থাকবে একটি মাইক্রোচিপ, যাতে আপনার সমস্ত তথ্য ভরে দেওয়া থাকবে। যার মাধ্যমে আপনার সমস্ত গতিবিধি ট্র্যাক করা যাবে। 

এই 'অবৈধ' আধার কার্ডের বায়োমেট্রিক ডেটা কতদূর বেহাত হয়েছে একটু সচেতন মানুষ মাত্রেই বোঝেন। একই পথে আপনার সমস্ত প্রাইভেসিও বেওসাদারদের হাতে চলে যাবে। আপনার বেডরুমের প্রাইভেসিটুকুও। মেনে নেবেন তো সেদিন?

মনে রাখবেন, ভারতের সংবিধান আপনাকে Right to Privacy এই অধিকার দিয়ে রেখেছে। এখনো সংবিধানে জ্বলজ্বল করছে এই অধিকার। সে অধিকার যারা ছলে বলে কৌশলে কেড়ে নিতে চাইছে, তারা চূড়ান্ত অসাংবিধানিক কাজ করছে। এতবড়ো ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি আপনি হতে দেবেন? আপনি কেমন মানুষ তাহলে?

এর সঙ্গে আরো দু'টো কথা বলতে চাই। বিজেপির কথা বাদ দিন, আমাদের মধ্যেই অনেকে SIR বা NRC কে সমর্থন করেন। কেউ ভাবছেন SIR শুদ্ধ ভুয়ো ভোটার ধরার কল। তাদের জিজ্ঞাসা, ভোটার তালিকা রিভিশন তো বহুবার হয়েছে। এবারের মত বাবা মায়ের জন্মস্থান ও সার্টিফিকেট কোনোদিন চাওয়া হয়েছে? সমালোচনার মুখে পড়ে যদিও বলেছে, এক্ষুনি কিছু দিতে হবে না, কিন্তু যেটা উহ্য, তা হল, পরে দিতেই হবে। আপনি প্রশ্ন করবেন না? তুমি ভুয়ো ভোটার বের করছ করো, কিন্তু নাগরিকত্ব নির্ণয় করা কি নির্বাচন কমিশনের কাজ? 

আরো একটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বহু মানুষের ধারণা, অনুপ্রবেশকারী বিতাড়ন করা তো খুব দরকারি কাজ। তাদের কাছে একটা প্রশ্ন, আচ্ছা সংবিধানের মূল নাগরিকত্ব আইনের ৬ নম্বর সেকশন কি বাতিল হয়ে গেছে?  গুগল খুলে একবার দেখে নিন তো! নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ র ৬ নম্বর সেকশনে বলা আছে, দেশভাগের ফলে মূল ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়া নতুন দেশগুলোর মানুষেরা যদি ভারতে বসবাস করতে চায়, তাহলে কিছু শর্ত মেনে তারা নাগরিকত্ব পাবে। ভারতের এখনো খুব স্পষ্ট বর্ডার পলিসি নেই, বহু জায়গায় বর্ডার খোলা ও পার্বত্য টেরেইন অঞ্চলে বেড়া দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ ভারতে আসে, সংবিধান মানলে তাকে অনুপ্রবেশকারী বলা যাবে না। এই আইন এখনো অক্ষত আছে। সংবিধান বইয়ে জ্বলজ্বল করছে। ফলে বাঙালিকে বাংলাদেশী বলে ডিপোর্ট করা বা অনুপ্রবেশকারী বলা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধ। এটা কারো অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু এ আইন যেহেতু রয়েছে এখনো, এর প্রয়োগ করারও সুযোগ রয়েছে।

সৎ আইনজীবী ও সমাজকর্মীদের কাছে আমার আবেদন, এই উদার সংবিধানের মধ্যেই এমন কিছু রক্ষাকবচ এখনো আছে, যা মানুষকে আজকের এই অভূতপূর্ব দুরবস্থার হাত থেকে বাঁচাতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার উদ্যোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি। 





ডাঃ শর্মিষ্ঠা রায় এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক।   

Picture Courtesy: Google, Vecteezy, Craiyon AI 

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views