‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’! - বাম রাজনীতির পর্যবেক্ষণ

সুমিত ঘোষ

যুব আন্দোলন ও বাম সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে নেপালের বাম রাজনীতি সম্পর্কে বিপুল সমালোচনা ধেয়ে এসেছে। আর নেপালের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি করলে উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠছে। নেপালি দক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২০০০ সালে ছিল প্রায় ৬০,০০০, ২০১০ সালে প্রায় ৭৫,০০০ এবং ২০২০ সালে প্রায় ১২,০০০-এর কাছাকাছি। অদক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২০০০, ২০১০ এবং ২০২০ সালে যথাক্রমে ছিল প্রায় ৫৮,০০০, ৬০,০০০ এবং ১০৯,০০০। নেপালি পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজের আশায় মূলত যায় গাল্ফ অঞ্চল, মালেশিয়া ও ভারতে [Gautam, T.P. and Adhikari, B.R., 2025. Drivers of Skilled Workforce Migration from Nepal. State, Society and Development: PMPD Perspectives, 3, 135-156.]একই সময়ে কর্মহীনতার হার ছিল ২০০০ সালে ১০.৫%, ২০১০ সালে ১০.৫%, ২০২০ সালে ১২.৯৮% এবং ২০২৪ সালে ১০.৭১% [statista.com/statistics/422507/unemployment-rate-in-nepal/]। ২০২১ সালের জনগণনা অনুযায়ী নেপালে অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল ৯৭.২% [Of Open Borders and Cross-Border Kinship: Indian migrants in Nepal - Chitra Rawat – 2025 - themigrationstory.com]! ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী নেপালের ৮৫% মানুষ অমানবিক পরিস্থিতিতে বাস করে, পঞ্চাশ শতাংশেরও কম সাক্ষরতার হার, অপুষ্টি এবং হাজার জনের মধ্যে ৬২টি শিশু মৃত্যু একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ছবি তুলে ধরছে বিশ্বের সামনে [Nepalese Revolution – Alok Ranjan – Bigul Reprint Series 2 – Rahul Foundation] নেপালের সমগ্র কর্মসংস্থানের ৭৯% পূর্ণ হয় কৃষিকাজের মধ্যে দিয়ে [Chapters on ‘Maoism in Nepal’ by Rakesh Tyagi – Maoism Theory and Practice – Radical Socialist]। তাই শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের উত্তরণ, গঠনমূলক সমালোচনা এবং কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে সংহতি স্থাপন সময়ের দাবী।

রাজতন্ত্রী আন্দোলন এবং যুব সম্প্রদায়ের সামাজিক অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে কেপি ওলি-র সরকার মার্কিন সোশ্যাল মিডিয়া মঞ্চগুলোর উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আনার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নিতে গিয়ে মার্কিন সংস্থাগুলোর অবজ্ঞার সম্মুখীন হয়। একই সাথে চীনা সোশ্যাল মিডিয়ার সাম্রাজ্যবাদী চাপে একপ্রকার নতিস্বীকার করে মার্কিন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান করতে গিয়ে রোজগারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল যুব সম্প্রদায়ের রোষের মুখে পড়ে সরকার। যুব বিক্ষোভকে পথে নামাতে ভূমিকা পালন করে হামি নেপাল, বারবারা ফাউন্ডেশানের মত এনজিও-রা। দ্বিতীয় দিন থেকে সরকারী দপ্তর কিংবা নেতা মন্ত্রীদের বাড়িতে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে। ওলি পদত্যাগ করলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হন। এর আগেও ২০১৩ সালে সংবিধান রচনায় প্রথম কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির অসফলতার ফলে তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি খিল রাজ রেগমি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। রাজতন্ত্রী আন্দোলনের উপর পড়শি হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের প্রভাব, বিক্ষোভের দ্বিতীয় দিন থেকে হিংস্রতা, বিক্ষোভ আয়োজক হিসেবে এনজিও-দের ভূমিকা, এনজিও-দের ফান্ডিং সোর্স, আন্দোলন সম্পর্কিত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ডিস্কোর্ড-এর ভূমিকা, আর্থিক সহায়তা প্রদানে মার্কিন সংস্থা ‘ন্যাশনাল এন্ডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রাসি’-এর বিতর্কিত ভূমিকা [borderlens.com], বেছে বেছে মার্কিন হোটেল হিল্টন-এর উপর আক্রমণ, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ন্যায় বর্তমান সমস্যার ভিত্তিতে বিক্ষোভ শুরু হলেও ‘দুর্নীতি’-র মত বিমূর্ত বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিমুখ পরিবর্তন - হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং মার্কিন ও চীনা সাম্রাজ্যবাদের সাঁড়াশী আক্রমণের দিকে ইঙ্গিত করে। বলাই বাহুল্য, এর মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্নীতি বিরোধিতার নামে উগ্রডানপন্থীদের রাজনৈতিক ফসল তোলার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু সরকারী দুর্নীতি না থাকলে এই আন্দোলন দানা বাঁধাও সম্ভব নয়। নেপালের ক্ষেত্রেও তা সত্য। ফলে নেপালের বাম রাজনীতির গতি পথের পর্যবেক্ষণ ও গঠনমূলক সমালোচনার উদ্দেশ্যে এই রচনা…      

নেপালে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয় ১৯৪৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে মনমোহন অধিকারী বারাণসীতে পড়তে এসেছিলেন এবং এক সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পার্টি নেপালের ক্ষেত্রে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর নির্ধারিত করে। ১৯৫১ সালে দিল্লী অ্যাকর্ড-এর মাধ্যমে বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারী রানাদের প্রধানমন্ত্রীত্বের যুগের অবসান হয় এবং রাজা ত্রিভুবনের অধীনে বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম হয়। নতুন কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবী তুললেও কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৫ সালে পার্টি লিখিতভাবে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র মেনে নিলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ১৯৬০ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজা মাহেন্দ্র ক্ষমতা দখল করে সংসদীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটায় এবং পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রায়মাঝি এই নয়া ব্যবস্থাকে স্বাগত জানান! পার্টি এই সময়ে খ্রুশ্চেভপন্থী অবস্থান নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করে। ১৯৬১ সালে দ্বারভাঙ্গা প্লেনামে রাজতন্ত্রী এবং নেপালি কংগ্রেসপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ১৯৬২ সালে তুলসী লাল আমাত্য ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পুষ্প লাল শ্রেষ্ঠ-র নেতৃত্বে তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসে রায়মাঝিকে বহিষ্কার করা হয়। আমাত্য সংসদীয় ব্যবস্থার দাবী করলেও রাজতন্ত্রের অবসান প্রসঙ্গে নীরব থাকেন। রায়মাঝি ও আমাত্য গোষ্ঠীর বিভাজিত পার্টি দ্বয় পরবর্তী সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৯৬৮ সালে পুষ্প লাল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের ধারায় পার্টি পুনর্গঠন করলেও ডানপন্থী নেপালি কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করতে থাকেন। এমতাবস্থায় পার্টি থেকে সদস্যরা বেরিয়ে এসে প্রোলেটারিয়ান লেবার অর্গানাইজেশান, মুক্তি মোর্চা গ্রুপ, সিপিএন(এমএলএম) প্রভৃতি সংগঠন/পার্টি তৈরি করতে শুরু করে। ১৯৭৮ সালে মুক্তি মোর্চা গ্রুপের সাথে ঝাপা কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একটি নকশালপন্থী গোষ্ঠী সংযুক্ত হয়ে তৈরি করে সিপিএন(এমএল)। এই দল প্রথমে সিপিআই(এমএল)-বিনোদ মিশ্র গোষ্ঠীকে অনুসরণ করলেও পরবর্তীতে সংসদীয় পথ গ্রহণ করে। সামরিক অভ্যুত্থানের সময়ে কারারুদ্ধ হওয়া আদি কমিউনিস্ট পার্টির কিছু প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা ১৯৭১ সালে মুক্তি পেয়ে তৈরি করে ‘সেন্ট্রাল নিউক্লিয়াস’ এবং ১৯৭৪ সালে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বীকৃতি লাভ না করলেও পার্টি কংগ্রেসের মাধ্যমে নিজেদের সিপিএন(ফোর্থ কংগ্রেস) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮৫ সালে পার্টিতে ভাঙন হয় – মোহন বিক্রম সিং-এর গোষ্ঠী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও নেপালের আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়াকে প্রধান দ্বন্দ্ব, কেবল মাত্র আঞ্চলিক স্তরে অন্যান্য পার্টিদের সাথে যুক্ত ফ্রন্ট এবং নির্বাচনের বিরোধিতার লাইন নিয়ে তৈরি করে সিপিএন(মশাল) এবং নির্মল লামা ও প্রকাশের গোষ্ঠী কেবল নেপালের আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়াকে প্রধান দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তরে অন্যান্য পার্টিদের সাথে যুক্ত ফ্রন্ট এবং নির্বাচনী লড়াইয়ের লাইন নিয়ে সিপিএন(ফোর্থ কংগ্রেস)-এর নেতৃত্ব দিতে থাকে। পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে মোহন বিক্রমের অপারগতার ফলে তার গোষ্ঠী ভেঙে কিরণ ও প্রচন্ড-র নেতৃত্বে তৈরি হয় সিপিএন(মাশাল)। ১৯৭১ সালে কারামুক্তির পর মনমোহন অধিকারী সেন্ট্রাল নিউক্লিয়াস থেকে নিজেকে দূরে রেখে পৃথক পার্টি গঠন করেন। পুষ্প লালের মৃত্যুর পর তার পার্টি মনমোহন অধিকারীর গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত হয়ে তৈরি করে সিপিএন(মার্ক্সিস্ট) যা সিপিআই(এম)-এর সমতুল্য রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে। ১৯৯০ সালে এই সিপিএন(এম) ও সিপিএন(এমএল) সংযুক্ত হয়ে জন্ম নেয় সিপিএন(ইউনিফায়েড মার্কিস্ট লেনিনিস্ট)

১৯৯০ সালে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের সময়ে সিপিএন(ফোর্থ কংগ্রেস) সিপিএন(ইউএমএল)-এর সাথে যুক্ত ফ্রন্ট গঠন করে লড়াই শুরু করে। অন্যদিকে সিপিএন(মশাল), সিপিএন(মাশাল) ও সিপিএন(এমএলএম) একসাথে লড়াই শুরু করে। ১৯৯১ সালে সিপিএন(ফোর্থ কংগ্রেস), সিপিএন(মাশাল), প্রোলেটারিয়ান লেবার অর্গানাইজেশান ও অন্যান্য গোষ্ঠী সংযুক্ত হয়ে তৈরি হয় সিপিএন(ইউনিটি সেন্টার)। সিপিএন(মশাল) থেকে বাবুরাম ভাট্টুরাই গোষ্ঠী বেরিয়ে এসে সিপিএন(ইউসি)-তে যোগ দেয়। এই সিপিএন(ইউসি)-তে পূর্বতন সিপিএন(ফোর্থ কংগ্রেস) গোষ্ঠী মনে করত যে সমাজতান্ত্রিক উত্তরণের সময়ে শ্রেণী সংঘর্ষ চলতে থাকে এবং পুঁজিবাদের পুনর্প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা থেকেই যায়; রাশিয়াতে প্রতিবিপ্লবের কারণ ছিল পার্টির মধ্যে প্রলেতারীয় গণতন্ত্রের প্রসারের অভাব এবং সোভিয়েতগুলোর পরিবর্তে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পার্টির সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা। পূর্বতন সিপিএন(মাশাল) গোষ্ঠীর প্রচন্ড, কিরণ, ভাট্টুরাই-রা এর সাথে সহমত না হয়ে পূর্বতন সিপিএন(ফোর্থ কংগ্রেস) গোষ্ঠীকে বিলোপবাদী বলে দেগে দেয়। পরবর্তীকালে অবস্থান পরিবর্তন করে প্রচন্ড গোষ্ঠী এবং ‘প্রচন্ড পথ’ বিপ্লবী মতধারায় এই বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্বতন সিপিএন(ফোর্থ কংগ্রেস) গোষ্ঠী ১৯৯২-৯৪-এর সময়ে জনযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। উল্টোদিকে প্রচন্ড গোষ্ঠী মনে করেছিল যে ওই সময়েই জনযুদ্ধ শুরু করতে হবে। ১৯৯৪ সালে প্রচন্ড গোষ্ঠী সিপিএন(ইউসি) থেকে বেরিয়ে আসে এবং ১৯৯৬ সালে জন্ম নেয় সিপিএন(মাওইস্ট) [Nepalese Revolution – Alok Ranjan – Bigul Reprint Series 2 – Rahul Foundation]।

[এখানে কেবল প্রধান তিন কমিউনিস্ট পার্টি - সিপিএন(ইউসি), সিপিএন(ইউএমএল) ও সিপিএন(মাওইস্ট)-এর প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটই বিশদে তুলে ধরা হল।]

মদন ভান্ডারীঃ পিপলস মাল্টি পার্টি ডেমোক্রাসি

সিপিএন(ইউএমএল)-এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মদন ভান্ডারীর Janatako Bahudaliye Janabad অর্থাৎ People’s Multiparty Democracy সংক্রান্ত মতবাদ অনুযায়ী কেবলমাত্র সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব এমনটা নয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বহু দলীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মাধ্যমেও তা সম্ভব। তিনি এই যুক্তি দেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কসবাদী মতধারা সংকটের মধ্যে রয়েছে এবং তাকে টিকে থাকতে হলে নতুন গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। সংবিধান একমাত্র শিরোধার্য। আইনের শাসন, বহুদলীয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার কেবল পুঁজিবাদের অর্জন নয় বরং এগুলি জনগণের সংগ্রামের ফসল। এ অর্জনগুলিকে বৃহত্তর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচিতে যুক্ত করতে হবে। কমিউনিস্টরা প্রগতিশীল সংস্কার ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের ভিত্তি মজবুত করার জন্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগেই সরকারে অংশ নিতে পারে [wiki-global.org]

মদন ভাণ্ডারীর ইউরো-কমিউনিস্ট মার্কা এই মতবাদ সম্পর্কে কয়েকটা কথা লড়াইয়ের ইতিহাস আলোচনার শেষে করা হয়েছে…

প্রচন্ড পথ

[Problems & Prospects of Revolution in Nepal - Philosophical Concept of Prachanda Path - Com. Kiran – এই প্রবন্ধ থেকে কমঃ কিরণের কলমে প্রচন্ড পথ সম্পর্কে আলোচনার নির্বাচিত উদ্ধৃতি সংকলন নীচে দেওয়া হল।]

প্রচন্ড পথ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কিরণ বলছেন, “কপিল, যিনি বিশ্বের সামনে বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিকতার বার্তা দিয়েছিলেন এবং যিনি গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর প্রতিষ্ঠাতা বলে ধারণা করা হয়, তিনি নেপালের এক মহান দার্শনিকও বটে কিরণ দেখাচ্ছেন যে মার্কসবাদ–লেনিনবাদ–মাওবাদ (এমএলএম)-এর দার্শনিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রচণ্ড বলেন, “দ্বন্দ্বমূলক-বস্তুবাদী জ্ঞানতত্ত্ব অনুসারে, অভিজ্ঞতাগুলির এই সংশ্লেষণ এসেছে অনুশীলন, জ্ঞানার্জন, পুনরায় অনুশীলন এবং পুনরায় জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়া থেকে। এমএলএম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে এই চক্রটি অনন্তকাল চলতে থাকে
(দ্য গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড: অ্যান ইনেভিটেবল নিড অব হিস্ট্রি)। কিরণ এর সাথে সংযোজন করছেন, “মাও শ্রেণিসংগ্রাম, উৎপাদনের জন্য সংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। প্রচণ্ড বলছে, “এটা ভাবা যে, বস্তুগত অবস্থা নিজে থেকেই যান্ত্রিকভাবে বিষয়গত পরিস্থিতি তৈরি করে, আসলে মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতার পরিপন্থী। যদিও বস্তু চেতনার পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে বস্তুই প্রধান, কিছু পরিস্থিতিতে চেতনা প্রধান ভূমিকা পালন করে, এবং এই দুইয়ের মধ্যেকার পারস্পরিক প্রভাবের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান” প্রচণ্ড অন্যত্র বলছেন, “প্রত্যেক ঐতিহাসিক যুগে শ্রেণি সংগ্রামের মাত্রা ও প্রকৃতি নির্ধারিত হয়েছে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রকৃতির পর ভিত্তি করে। কিন্তু উৎপাদন শক্তির বিকাশের যে পর্যায়ই হোক না কেন, প্রতিটি ঐতিহাসিক যুগে শ্রেণি সংগ্রাম ঘটেছে ধারাবাহিকতার ছেদ হিসেবে — অগ্রগামী শ্রেণির পশ্চাদগামী শ্রেণির বিরুদ্ধে সচেতন সংঘর্ষ, অর্থাৎ বিপ্লব হিসেবে। এই সামাজিক বিপ্লবের প্রক্রিয়া কখনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা ধীরে ধীরে ঘটেনি, আবার কারও ইচ্ছানুযায়ী বস্তুনিষ্ঠ অবস্থার বিপরীতে ঘটেনি। বরং এটি নির্ধারিত হয়েছে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের বিকাশের স্তরের দ্বারা”। নেপালের রাষ্ট্রীয় শ্রেণী চরিত্র সম্পর্কে প্রচণ্ড দেখাচ্ছেন, “কেন্দ্রীভূত সামন্ত ক্ষমতা বিকশিত হওয়ার আগে নেপাল অসংখ্য ক্ষুদ্র রাজতান্ত্রিক ও উপজাতীয় প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। তখন রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রের রূপ আজকের মত ছিল না। ইতিহাসে দেখা যায়, প্রয়োজনে রাজা পরিবর্তন করা, অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়া ইত্যাদি প্রথা নেপালি সমাজের মানসিক গঠনের অংশ হয়ে আছে।... সমাজে শ্রেণি বিভাজন দেখা দেওয়ার পর তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী রাজারা নিজেদের দেবতার অবতার বলে ঘোষণা করতে শুরু করেন” (গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড)। এই বিষয়ে অন্যত্র তিনি আরও বলছেন, “আধুনিক নেপাল গড়ে উঠেছে পাহাড়ি অঞ্চলে নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও উপজাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে চাওয়া সরল ও নিরীহ মানুষের সঙ্গে প্রায় এক হাজার বছর আগে দক্ষিণ দিক থেকে আগত হিন্দুদের সংগ্রাম ও সংমিশ্রণের মাধ্যমে। এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় রাজপুত্র ও আদিবাসী প্রধানদের উত্থান এবং তাদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ জনগণকে লড়াইয়ে প্রশিক্ষিত করেছে — যার প্রমাণ ইতিহাসই দিয়েছে। নিজেদের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারায় প্রশিক্ষিত নেপালি জনগণ পরবর্তী সময়ে আধুনিক জ্ঞান, কৌশল ও অস্ত্রে সজ্জিত দক্ষিণের ব্রিটিশ ও উত্তরের চীনা বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল” (দ্য মাওইস্ট, ডিসেম্বর ১৯৯৫)। প্রচন্ড বলছেন, “নয়া উৎপাদন সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা যা প্রাথমিক উৎপাদন শক্তির বিকাশের দাবী জানাচ্ছিল, তা ক্ষুদ্র রাজা, প্রধান ও উপজাতীয় প্রজাতন্ত্রগুলির অস্তিত্বকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে। এই বস্তুনিষ্ঠ প্রয়োজনই একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত সামন্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলে” (গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড)। তিনি আরও উল্লেখ করছেন, “নেপালের কেন্দ্রীভূত সামন্ত রাষ্ট্র হিন্দু সামন্তবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী জাত্যাভিমান চাপিয়ে দিয়ে বিভিন্ন জাতি, আদিবাসী ও অঞ্চলের ভাষাগত, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলে প্রকৃত জাতীয় ঐক্য ও শক্তি বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। বর্তমান নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে সমতা ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পর নির্ভর করে শক্তিশালী জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করা আজ প্রয়োজনীয়”। প্রচন্ড আরও বলছেন, “যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে নেপালকে সার্বভৌম বলা হয়, বাস্তবে প্রায় ২০০ বছর ধরে দেশটি আধা–ঔপনিবেশিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ব্রিটিশদের সঙ্গে কুখ্যাত সুগৌলি চুক্তির পর এই অবস্থার সূচনা হয়, যা সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে পুঁজিবাদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। কিরণ এ বিষয়ে বলছেন, “সুগৌলি চুক্তির পর বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ নেপালের আত্মনির্ভর অর্থনীতিকে ধ্বংস করে এবং এই প্রক্রিয়া নেপালকে আধা–সামন্ততান্ত্রিক ও আধা–ঔপনিবেশিক দেশে পরিণত করেছে…”। তিনি আরও দেখাচ্ছেন, “এই ঘটনাক্রমে নেপালে জন্ম নেয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, যা ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। প্রচণ্ড একে বলেছেন সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের “অশুভ মিলনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া এক বিকৃত সন্তান”। এরপর প্রচন্ড বলছেন, “বিদেশি পুঁজির স্বার্থে কিছু ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে ওঠায় নেপাল ক্রমান্বয়ে সামন্ত অবস্থা থেকে আধা–সামন্ত অবস্থায় পরিণত হয়। এভাবে আজও নেপাল আধা–সামন্ততান্ত্রিক ও আধা–ঔপনিবেশিক অবস্থায় রয়েছে”। কিরণ ‘প্রচন্ড পথ’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন, “…বিশ্বব্যাপী অস্ত্র উৎপাদন ও বিতরণের সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা একদিকে জনযুদ্ধের প্রযুক্তিগত প্রস্তুতিকে পরোক্ষভাবে ত্বরান্বিত করছে। অন্যদিকে, সীমাহীন উৎপাদন ও বিশ্বায়ন আশ্চর্যজনকভাবে সামর্থ্য অনুসারে কাজ ও প্রয়োজন অনুসারে বণ্টনএর কমিউনিস্ট ব্যবস্থার জন্য বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করছে তিনি আরও বলছেন, “প্রচণ্ড পথ পার্টিকে বিরোধের ঐক্য হিসেবে দেখে। দলীয় জীবনে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রয়োগ করে দুই লাইনের সংগ্রামের সমস্যাগুলি সমাধান করা, লের ভেতরে গোষ্ঠীবাদ, বিভাজনবাদ, অপ্রলেতারীয় চিন্তাধারা ও কাজের ধরণগুলোর বিরুদ্ধে ক্রমাগত সংগ্রাম চালানো, শুদ্ধিকরণ অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, মহান প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উচ্চতায় পৌঁছে নয়া ঐক্য, নয়া উচ্চতায় দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া — সবই এক্ষেত্রে লক্ষণীয় এর বাইরে কিরণ প্রচন্ড পথের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন যে ‘প্রলেতারীয় ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সংমিশ্রণ এবং পড়শিদের সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধেদক্ষিণ এশীয় নয়া সোভিয়েত ফেডারেশন-এর প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। প্রচণ্ড বলেছে, “এখানে আমরা যে প্রশ্ন তুলেছি, তার কোনও সম্পর্ক নেই বিশ্বের নানা রঙের সংশোধনবাদী ও বিলুপ্তিবাদীদের সঙ্গে, যারা জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব বা প্রলেতারীয় একনায়কত্বের বিরোধিতা করে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকতার ফাঁদে পড়েছে। আমাদের প্রশ্নটি কেন্দ্রীভূত হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত করার লক্ষ্যে, যা বিপ্লবের ধারাকে অব্যাহতভাবে সংগঠিত করতে পারে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব বা প্রলেতারীয় একনায়কত্ব কেবল রাষ্ট্র ক্ষমতার ব্যাপক ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্রীকরণের প্রক্রিয়াতেই সংহত হতে পারে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার মত মহান বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আর কোনও অর্থ হতে পারে না। যে দলগুলি ক্ষমতা দখলের আগে সঠিকভাবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা প্রয়োগ করে ক্ষমতায় পৌঁছেছিল, পরে তারা কেন আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের শিকার হল? কেবল এটুকু বলা যে পার্টির ভেতরে সংশোধনবাদ প্রাধান্য পেয়েছিল, তা এই প্রশ্নের পূর্ণ উত্তর দেয় না। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগে যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল, সেগুলিও এর জন্য দায়ী” (প্রেজেন্ট সিচুয়েশন অ্যান্ড আওয়ার টাস্ক)। 

উল্লেখ্য, প্রচন্ড পথে একশৈলিক পার্টির বদলে পার্টিতে দুই লাইনের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের মতধারা স্বীকৃত হয়েছিল। ফলে গোঁড়াভাবে কোনো অবস্থান সেই সময়ে প্রচন্ড নেননি। বিভিন্ন প্রচলিত কমিউনিস্ট মতধারার মিশেল হিসেবে প্রচন্ড পথ সৃষ্ট হলেও তা নেপালের নিজস্ব বিপ্লবের পথ অনুসন্ধানের দ্যোতনা দেয়। প্রচন্ড পার্টির মধ্যে প্রলেতারীয় গণতন্ত্র এবং সংস্কৃতি প্রসারে প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও আদতে সিপিএন(মাওইস্ট) একটি নেতৃত্ব নির্ভরশীল বা নেতৃত্বের অন্ধভাবে আজ্ঞাবহ পার্টিতেই পরিণত হয়। প্রচন্ড পথে পার্টি পরিচালনা অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থাকে এক করে দেখার সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রয়োজন পার্টির মধ্যে তৃণমূল স্তরের কর্মীদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ঊর্ধ্বতন থেকে সর্বোচ্চ সমস্ত স্তরের নেতৃত্বের কাছে নিজেদের মতামত খোলামেলাভাবে তুলে ধরার পদ্ধতি ও সংস্কৃতির প্রচলন। গণসংগঠনগুলিকেও অন্ধ আজ্ঞাবহ হয়ে থাকার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করতে পার্টির নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টিদের প্রসঙ্গে এই কথাগুলো উঠলেও আদতে তা সারা বিশ্বের সকল কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। স্থলবেষ্টিত দেশ হিসেবে নেপালে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে বিশ্ব বিপ্লবের পরিকল্পনা করতে হয়েছে যদিও সমস্যা এখানেই যে সে ধারণা পুঁজিবাদের বর্তমান দশা স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে (gradualism) উঠে এসেছে। আর দক্ষিণ এশীয় সোভিয়েত গঠনের স্বপ্ন ততক্ষণ একটি অলীক স্বপ্ন যতক্ষণ না পড়শি দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্য শুরু হতে পারছে।   

লড়াইয়ের ইতিহাস

১৯৯২ সালে রাজতন্ত্রের অধীনে বহু দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে মাত্র ১ বছরের জন্য সিপিএন(ইউএমএল) সরকার চালাতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে রাজতন্ত্রের অবসানের লক্ষ্যে সিপিএন(মাওইস্ট) ১৯৯৬ সালে জনযুদ্ধের পথ গ্রহণ করে। ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেসের কাছে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে তারা দাবী করে যে পড়শিদের সাথে সমস্ত অসম চুক্তি অকার্যকর ঘোষণা করতে হবে এবং শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি (শাইনিং পাথ)-এর গঞ্জালো মতধারায় অনুপ্রানিত হয়ে প্রচন্ড, কিরণ, ভাট্টুরাই-রা লড়াই শুরু করেন। রল্পা, রুকুম, জাজারকোট, সাল্যান, প্যুথান ও কালিকোটে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ৭৫টি জেলার মধ্যে ৬৮টিতে মাওবাদী গেরিলারা ৭০% জমি দখল করে নেয়। পুলিশ ও সেনার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গেরিলা বাহিনী নিজেদের স্বশস্ত্রীকরণ করতে থাকে। পাহাড়ি অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে গেরিলা যোদ্ধারা সাফল্য লাভ করে। সিপিএন(ইউএমএল) ও নেপালি কংগ্রেস মাওবাদীদের বিরোধিতা শুরু করে। ২০০১ সালে রাজ পরিবারের আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে রাজা বীরেন্দ্র পরিবার সহ খুন হয় এবং জ্ঞানেন্দ্র পরবর্তী রাজা হয়। বীরেন্দ্র পড়শি দেশগুলির শাসক শ্রেণী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদত পায়। সরকারে থাকা নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্ব বদলের পর মাওবাদীরা কিছু মাসের জন্য যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। সিপিএন(ইউসি) সিপিএন(ইউএমএল)-এর সাথে মাওবাদীদের আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু করাতে সাহায্য করে। কিন্তু কোনও সদর্থক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো না যাওয়ায় মাওবাদীরা আবার যুদ্ধ শুরু করে। রাজা জরুরী অবস্থা জারী করে, ২০০২ সালে সংসদ অনির্দিষ্টকালীনভাবে মুলতুবি করে দেয় এবং পরবর্তীতে ২০০৫ সালে স্বৈরাচারী রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মাওবাদীরা এই সময়ে নিজেদের অবস্থা আক্রমণাত্মক মনে করলেও ওই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা পূর্ণ দখল অসম্ভব বলে গণ্য করে। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান রচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ সম্পন্ন করার দিকে জোড় দেয়। ২০০৬ সালে নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন(ইউএমএল), সিপিএন(ইউসি) সমেত ৭ দলের জোটের সাথে মাওবাদীদের আন্দোলনগত ঐক্য স্থাপন হয়। শুরু হয় পিপলস মুভমেন্ট ২.০। রাজা সংসদ অধিবেশন চালু করতে বাধ্য হয়। সংসদ রাজার সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার রেজোলিউশান নেয়। সদ্য ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেসের সাথে মাওবাদীদের শান্তি আলোচনা শুরু হয়। মাওবাদীরা রাজতন্ত্রের অবসান, অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান রচনা, নির্বাচন ও ফেডারেল প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপর জোড় দেয়। উল্টোদিকে দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলো মাওবাদীদের সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করা এবং জাতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্তির শর্তারোপ করে। মাওবাদীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করে। সম্প্রসারণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের মদতে তরাই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। অবশ্য সমস্ত নিপীড়িত জাতিদের স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে মাওবাদীদের প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের খসড়ায় বিশদ পরিকল্পনার উল্লেখ ছিল। এই সময়ই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মদতে হিন্দু মৌলবাদের প্রসার হতে শুরু করে। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের বদলে রাজতন্ত্রের পূর্ণ অবসানের দাবীতে মাওবাদীরা সরকার থেকে বেরিয়ে আসে এবং সংসদ রাজতন্ত্র অবসানের সিদ্ধান্ত নিলে ২০০৭ সালে তারা আবার সরকারে যোগদান করে। ওই সালেই অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান গৃহীত হয় [Nepalese Revolution – Alok Ranjan – Bigul Reprint Series 2 – Rahul Foundation]।

মাওবাদীদের প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের খসড়া 

শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন কনস্টিটুয়েন্ট ড্রাফট কমিটির কাছে ফেডেরাল ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অফ নেপাল প্রতিষ্ঠার জন্য যে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের খসড়া নেপালের মাওবাদীদের পক্ষে পাঠানো হয়েছিল, তাতে সমগ্র রাষ্ট্রের পুনর্গঠন, শোষিত শ্রেণী ও বিভিন্ন নিপীড়িত জাতি, অঞ্চল, লিঙ্গের সমস্যাগুলিকে লং টার্মে অ্যাড্রেস করা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে নিপীড়িত জাতিদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রস্তাবনায় উল্লিখিত ছিল রাজতন্ত্রের পূর্ণ অবসান সামন্ততান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র পূর্ণরূপে ধ্বংস করার বার্তা দেওয়া হয়েছিল; উল্লিখিত ছিল যে পূর্বতন আর্য-খাসা উচ্চবর্ণের স্বজাতিমত্ততা অভিষিক্ত সামন্ততান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে বিভিন্ন নিপীড়িত জাতি অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার স্বীকৃতির মাধ্যমে সারা নেপাল জুড়ে একটি ফেডেরাল শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হবে। শ্রমিক-কৃষক-ভূমিহীন ক্ষেত মজুর-কামাইয়া বা চুক্তি শ্রমিক-পশুপালকদের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ ব্যবস্থাপনার অঙ্গীকার করা হয়েছিল সমস্ত ধরনের অসম চুক্তির অবসান ঘটিয়ে পারস্পরিক সাম্য ও সদর্থক বোঝাপড়ার নিরিখে পড়শিদের সাথে নতুন চুক্তি সই করার উল্লেখ ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্মূলিকরণের উদ্দেশ্যেলাঙল যার জমি তার আদর্শের নিরিখে ব্যাপক ভূমি সংস্কারের প্রোগ্রাম নেওয়ার করার কথা বলা হয়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান-এর কথা বলা ছিল একই সাথে অস্পৃশ্যতা, নিপীড়ন, শোষণ, সামাজিক ভেদাভেদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সকল নেপালি জনগণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। মহিলাদের পারিবারিক সম্পত্তির উপর অধিকার এবং সকলের নিজ সম্পত্তির ঊর্ধ্বসীমা নির্দিষ্ট হয়েছিল। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে স্বীকৃত প্রতিবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচন, কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া প্রভৃতি অধিকারের সাথে সাথে উল্লিখিত প্রগতিশীল অবস্থানগুলি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের খসড়ায় স্থান পেয়েছিল। এছাড়া ওই অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানে ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়ালয়, অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কিত পরিকল্পনা জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে নেপালি আর্মি এবং পিপলস লিবারেশন আর্মি কিছু নির্দিষ্ট সমঝোতার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে কাজ করার কথা বলা হয়েছিল রাজতন্ত্রের প্রতি অনুগত নেপালি আর্মির পুনর্গঠন এবং তার গণতন্ত্রীকরণ একটি মিলিটারি কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। নিপীড়িত জাতি, দলিত, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি ও মহিলাদের জনসংখ্যা অনুপাতের নিরিখে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল ফেডেরাল দেশ হিসেবে সমগ্র নেপালকে নয়টি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যে বিভক্ত করার কথা বলা হয়েছিল - কিরান্ত, ধে, তামাং, নেওয়া, তামুয়ান, মাগারাত, থারুয়ান, ভেরি-কর্নালী শ্বেতী-মহাকালী প্রজাতন্ত্র [Maoist Information Bulletin No. 16, August 2006, CPN Maoist]।

২০০৮-২০১৫   

২০০৮ সালের কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে মাওবাদীরা সবচেয়ে বেশি আসন (২২০) পেলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে একপ্রকার নেপালি কংগ্রেস (১১০) এবং সিপিএন(ইউএমএল) (১০৩)-এর উপর নির্ভরশীল থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংবিধান রচনার কাজ শুরু করে। কিন্তু নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএন(ইউএমএল) যৌথভাবে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ঝামেলা চালাতে থাকে। প্রথমে তারা প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের জন্য দুই তৃতীয় অংশ সমর্থনের প্রয়োজনীয়তাকে খারিজ করার চেষ্টা করে তারপর তারা শর্ত দেয় যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে প্রচন্ডকে মাওবাদী সেনাবাহিনীর প্রধানের প থেকে সরে দাঁড়াতে হবে রাষ্ট্রপতি পদে নেপালি কংগ্রেসের প্রতিনিধিকে বসানো উপদেশ দেওয়া হয় কিন্তু মাওবাদীরা তা খারিজ করে কোন অরাজনৈতিক সম্মানীয় ব্যক্তিকে এই আনুষ্ঠানিক পদে বসানোক্ষে সওয়াল করে সিপিএন(ইউসি)-র দাবি মেনে মাওবাদীরা নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে প্রসঙ্গ মেনে নেয় কিন্তু এর তীব্র বিরোধ করে নেপালি কংগ্রেস সিপিএন(ইউসি) পার্টির মধ্যে তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রসারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মাওবাদীরা এই সমালোচনা গ্রহণ করে বিপ্লবের মধ্যেই বিপ্লব’-এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে ২০-এর কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির নির্বাচনের সময় সিপিএন(ইউসি) মাওবাদীদের সাথে জোট করলেও মাত্র সাতটি আসনে জয়ী হয়। নিজেদের তৃণমূল স্তরের কর্মীদের পার্টি লাইন বোঝানোর অক্ষমতাই এই ফলাফলের কারণ। মাওবাদী এবং সিপিএন(ইউসি)-এর সংযুক্তি প্রয়োজন কারণ তাদের মধ্যে রাজনৈতিক লাইনে আজকের দিনে কোন আর পার্থক্য নেই। সিপিএন(ইউসি)-ও জনযুদ্ধের লাইন নিয়েছিল কিন্তু সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে সঠিক সময় নির্ধারণের অপারগতাই তাদের বর্তমান রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মূল কারণ। ২০-এর নির্বাচনে মোহন বিক্রম সিংহ-এর রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা মাত্র চারটি আসন লাভ করে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্তে পৌঁছলেও সেই বিষয়ে কোন দলীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার একপ্রকার শাস্তি পায় তারা। এই নির্বাচনে সমস্ত বামপন্থী দল ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করলে সামগ্রিকভাবে তাদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব ছিল কিন্তু সিপিএন(ইউএমএল)-এর নেপালি কংগ্রেসের লেজুবৃত্তি এবং সামগ্রিকভাবে মাওবাদীদের সাথে অন্যান্য দলে ঐক্যের অভাব সমস্যা আর জটিল করে তোলে মাওবাদীদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে এবং বিরোধী পার্টিদের প্রভাবে দেশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর এবং ন্যায়ালয়ের বিপ্লবী পুনর্গঠন সম্ভব হয় না ভূমি সংস্কারও সম্ভব হয় না মাওবাদীদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে জাতীয় সেনাবাহিনীর সংযুক্তি কতটা যুক্তিসঙ্গত ছিল তা বামপন্থীদের অনুধাবন করা প্রয়োজন বুর্জোয়ারা এই সংযুক্তির মাধ্যমে বিপ্লবী সেনাবাহিনীকে বুর্জোয়া সেনাবাহিনীতে পরিণত করার চক্রান্ত করছিল। ভূমি সংস্কারে বাধা দিল সিপিএন(ইউএমএল) এবং মধেশী জনাধিকার ফোরাম অর্থাৎ কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি এখানে শ্রেণী সংগ্রামের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হল। সিপিএন(ইউএমএল) নিজেদের প্রার্থী মাধব নেপালকে বামপন্থীদের সাধারণ প্রার্থীতে পরিণত করার চেষ্টা করে অসফল হলে নেপালি কংগ্রেসের প্রার্থীকে সমর্থন করে বসে। ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় মাওবাদীরা রাষ্ট্রপতি পদে নিজেদের প্রার্থীকে জেতাতে অসফল হল। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মাওবাদীরা কিছু আজগুবি তত্ত্ব আমদানি করল মাওবাদীদের পক্ষে লক্ষণ পন্থ কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির এই শ্রেণী সংগ্রামকে ব্যাখ্যা করলেন বুর্জোয়া ও প্রোলেতারীয় শ্রেণীর যৌথ একনায়কতন্ত্র হিসেবে [Nepalese Revolution – Alok Ranjan – Bigul Reprint Series 2 – Rahul Foundation] !!!

কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিকে শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মাওবাদীরা ভূমি সংস্কার, নিপীড়িত জাতিদের স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি বিষয়ে লড়াইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে প্রোলেতারিয়েতের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে প্রচন্ডরা দ্বি-স্তর বিপ্লবের প্রথম ধাপ অনুযায়ী পুঁজিবাদকে বিকশিত করার লাইন নিল। এই পদক্ষেপ সেই তাত্ত্বিক অবস্থানের নিরিখে নেওয়া যেখানে পুঁজিবাদ মারফ উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে সেই বস্তুগত পরিস্থিতি তৈরি করা হবে যা প্রাচুর্যের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তি তৈরি করবে। নয়াগণতন্ত্রের পথ অনুসরণ করে মাওবাদীরা এই নব্য গঠিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ডানপন্থীদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি স্বপ্ন দেখেছিল। তাদের কাছে এটা ছিল দ্বি-স্তর বিপ্লবের প্রথম ধাপ। প্রথমে প্রচন্ড মাসের মধ্যে বিভিন্ন ডানপন্থী দলের দাবি মেনে পিপলস লিবারেশন আর্মির ক্যাম্পগুলো ফাঁকা করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তারা এই সৈন্যবাহিনীর ১৯,৬০০ সদস্যদের অভিমত জানা কথা বলেন দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলির কাছে - তারা জাতীয় সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে চা নাকি পুনর্বাসন চায়। এই বিশাল সৈন্যের সদস্যদের বিকল্প সশস্ত্রীকরণের কথা তারা ভাবেনিমাওবাদীরা বলেছিল যে তারা সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বে সংসদের মাহাত্ম্যকে তুলে ধরবে তারা গ্রামীণ রেভল্যুশনারি কাউন্সিলগুলিকে অকার্যকর করে দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে দখলিকৃত জমিগুলিকে ভূমি সংস্কারের বিপরীতে হেঁটে পূর্বতন মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে মাওবাদী নেতা গাজুরেল বলেছিলেন যে এরকম না করলে তারা নির্বাচনে জিতে সরকার চালাতে পারতেন না; তারা নাকি আঞ্চলিক ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নতুনভাবে নিজেদের জনভিত্তি বাড়িয়ে চলেছেন কিন্তু একই সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৬ সালে চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নয়া নিয়োগ চালু করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ২০০৯ সালে প্রচন্ডকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করতে হয় এমন এক পরিস্থিতিতে যখন রাষ্ট্রপতি রাম বরণ যাদব (নেপালি কংগ্রেস) বামপন্থী সরকারের জন সেনা কর্তার অবসর গ্রহণের নির্দেশকে উপেক্ষা করে সেনাপ্রধানকে তার কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। অর্থাৎ জনতার বিপ্লবী স্ফুরণ স্তিমিত হতেই সেনাবাহিনী মারফৎ বুর্জোয়ারা মাওবাদীদের শাসাতে শুরু করে। স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় জনমানসে বিক্ষোভের উদ্রেক হতে শুরু করে। যেমন কাস্কি অঞ্চলের সাধারণ মানুষ বিদ্যুতের আশায় মাওবাদীদের ভোট দিয়েছিল কিন্তু নির্বাচনের এক বছর কেটে গেলেও সেখানকার ১৮০ লক্ষ মানুষ খন বিদ্যুতের সুফল লাভ করেনি [Chapters on ‘Maoism in Nepal’ by Rakesh Tyagi – Maoism Theory and Practice – Radical Socialist]।  

২০০৯ সালে নেপালি কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের সাথে জোট করে সিপিএন(ইউএমএল)-এর তরফে মাধব নেপাল প্রধানমন্ত্রী হন। তিনিও সংবিধান রচনা সম্পন্ন করতে অসফল হন। তার আমলে পতঞ্জলি যোগ পীঠকে ঊর্ধ্বসীমা উল্লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে জমি দানের জন্য ২০২৫ সালে দুর্নীতি মামলা দায়ের হয়েছে! তিনি কাঠমান্ডুর রাস্তার ময়লা পরিষ্কারের পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটান [firstpost.com]। ২০০৬ সালে আন্দোলন যখন ঊর্ধ্বমুখী ছিল তখন প্রচন্ড অভ্যুত্থানের পথ অনুসরণ করেনি এবং নিজেদের যুব সংগঠনের বিপ্লবী অভিব্যক্তিগুলি উপেক্ষা করেছিলেন কিন্তু ২০১০ সালে এসে সেই তিনিই আন্দোলনের ভাটার সময়ে পার্টির সহযোগী ছাত্র সংগঠনকে বার্তা দিলেন যে আসন্ন বিদ্রোহের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব নির্বাচিত করতে হবে। ২০১০ সালে মাধব নেপালকে জোট সরকারের প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করানোর উদ্দেশ্যে রা মে থেকে মাওবাদীদের ডাকা অনির্দিষ্টকালীন সাধারণ ধর্মঘট সামগ্রিক চাপের মুখে তুলে নিতে হয় [Chapters on ‘Maoism in Nepal’ by Rakesh Tyagi – Maoism Theory and Practice – Radical Socialist]। মাওবাদীদের বিরোধিতার ফলে ২০১১ সালে মাধব নেপাল পদত্যাগ করেন।

২০০৯ সালে সিপিএন(মাওইস্ট) ও সিপিএন(মশাল) সংযুক্ত হয়ে তৈরি হয় ইউনিফায়েড সিপিএন(মাওইস্ট)। ২০১১ সালে মাধব নেপাল পদত্যাগ করলে সিপিএন(ইউএমএল) ও মধেশী জনাধিকার ফোরামের সাথে জোট করে ইউসিপিএন(মাওইস্ট)-এর পক্ষে ঝালা নাথ খনল প্রধানমন্ত্রী হন [firstpost.com]। নেপালে প্রথম বাম জোট ক্ষমতাসীন হল। কিন্তু তার সরকার মাত্র ৭ মাস টেকে। মাওবাদী সৈন্যদের জাতীয় সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে জোট সঙ্গী ও বিরোধীদের সাথে মত পার্থক্যের দরুণ তাকে পদত্যাগ করতে হয় [Nepal’s prime minister resigns - Al Jazeera - 2011]।

এরপর ১১টি দলের সাথে রামধনু জোট করে ইউসিপিএন(মাওইস্ট)-এর পক্ষে বাবুরাম ভাট্টুরাই প্রধানমন্ত্রী হন [firstpost.com]। প্রচণ্ড-র প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি শ্রেণী সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে কিছু জনকল্যাণকামী পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। পাব্লিক সেক্টরের উন্নতি সাধনের কোন পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই তিনি পাব্লিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ-এর কথা বললেন। পাব্লিক সেক্টর দুর্বল হলে এর ফলে প্রাইভেটেরই যে রমরমা হয় তা বলাই বাহুল্য। শ্রমিকের অধিকার খর্বকারী স্পেশাল ইকোনমিক জোন (SEZ) গড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। শ্রমিকের স্ট্রাইক ডাকার অধিকার পর্যন্ত খর্ব করা হয় ওই সময়ে! প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি মাওবাদী সৈন্যদের জাতীয় সেনায় অন্তর্ভুক্তির পথ প্রশস্ত করলেন। পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ভারতীয় বিনিয়োগ টানলেন। কাঠমান্ডু রিং রোডের সম্প্রসারণ ঘটালেন। দারিদ্র দূরীকরণ, জাতীয় সম্পদ ও প্রকৃতি সংরক্ষণের কেবল বার্তাই দিলেন। পড়শি দেশেদের সাথে অসম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিল করতে নারাজ রইলেন [Bhattarai's Power Trip - Down To Earth - 2011]। অর্থাৎ ভাট্টুরাই সরকার সবচেয়ে ডান ঘেঁষা পদক্ষেপগুলো নিল। কিন্তু এরপরেও ডানপন্থীদের বিরোধিতায় সংবিধান রচনায় অসফল হয়ে ২০১৩ সালে পদত্যাগ করলেন। প্রথম কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির মেয়াদ শেষ হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি খিল রাজ রেগমি প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেন।    

২০১৩-র নির্বাচনে নেপালি কংগ্রেস ১৯৬টি আসন, সিপিএন(ইউএমএল) ১৭৫টি এবং মাওবাদীরা মাত্র ৮০টি আসনে জয় লাভ করল [firstpost.com]। সংবিধান রচনা এবং গ্রামীণ অঞ্চলের আশা পূরণে অসফলতার শাস্তি পেল মাওবাদীরা। বিচ্ছিন্নতাবাদী পার্টিদের সাথে রাজতন্ত্রী হিন্দু জাতিয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির উত্থান হল। ২০১৫-র ভূমিকম্পের সময়ে নেপালি কংগ্রেস সরকার পীড়িতদের খুবই কম আর্থিক সাহায্য করে সমালোচিত হল। সিপিএন(ইউএমএল)-কে সাথে নিয়ে নেপালি কংগ্রেস বারংবার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে প্রথম কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিকে কাজ করতে দিল না। কিন্তু এবার নিজেরা দ্বিতীয় কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে ক্ষমতায় এসে নেপালি কংগ্রেস ডানপন্থীদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংবিধান রচনা করল। অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের বিপ্লবী উপাদানগুলোর অনেক কিছুই বাদ গেল। জোট সরকারে সিপিএন(ইউএমএল) থাকায় কিছু কিছু পূর্বের উপাদান রয়ে গেল।

নয়া সংবিধান, ২০১৫

দীর্ঘ টালবাহানার পর ২০১৫ সালে নেপালি কংগ্রেসের সরকারের আমলে নয়া সংবিধান কার্যকারী হল। অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের প্রগতিশীল অবস্থানের বেশিরভাগই বাদ পড়ল। শুধু রয়ে গেল দেশকে ধর্মনিরপক্ষ ও বহুদলীয় প্রতিযোগিতামূলক ফেডেরাল প্রজাতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার ঘোষণা, অস্পৃশ্যতা-নিপীড়ন প্রভৃতির বিরুদ্ধে সকল নেপালি জনগণকে রক্ষা করা এবং মৌলিক অধিকারের তালিকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান কর্মসংস্থান। আর থাকল নাগরিকত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা; রাষ্ট্র ভাষা  হিসেবে দেবনগরী হরফে নেপালি ভাষা ও অন্যান্য ভাষাকে জাতীয় ভাষার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের জন্য ভাষা কমিশন; নেপালি লোকসভায় ৬০% আসনে ভোট সংখ্যা (first-past-the-post) এবং ৪০% আসনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন; আদিবাসী, মধেশী, থারু, মুসলিম, মহিলা, দলিত কমিশন প্রতিষ্ঠার বার্তা; মহিলা, দলিত, শ্রমিক, যুবক প্রভৃতি গোষ্ঠীর পাশাপাশি ভারতীয় উগ্র দক্ষিণপন্থীদের EWS-এর অনুপ্রেরনায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া উচ্চবর্ণের খাস-আর্যদের ক্ষমতায়নের দ্যোতনা [Constitution of Nepal – Nepal Law Commission - Lawcomission.gov.np]।

২০১৫-২০২৫

সংবিধান রচনা সম্পন্ন করে নেপালি কংগ্রেসের সুশীল কইরালা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করলেন। সাংসদদের ভোটে জয়ী হয়ে সিপিএন(ইউএমএল)-এর পক্ষে খড়্গপ্রসাদ ওলি প্রধানমন্ত্রী হলেন [firstpost.com]। জোট সরকারে রইল মাওবাদী আর রাজতন্ত্রীরা! ব্যাপক দুর্নীতি, ভারতের সাথে সম্পর্কে অবনতি (ভারতের তরফে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারী), দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে সওয়াল, ভূমিকম্প পরবর্তী সরকারী অনুদান এবং চীনের সাথে ব্যবসা - তার প্রধানমন্ত্রীত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে রইল।

২০১৬ সালে মাওবাদীদের সাথে আরও কিছু বামপন্থী দল সংযুক্ত হয়ে তৈরি হল সিপিএন(মাওইস্ট সেন্টার)। জোট সঙ্গীদের সমর্থন হারিয়ে ওলি সরকারের পতন হলে সিপিএন(এমসি)-র পক্ষে প্রচণ্ড ওরফে পুষ্প কমল দহল দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন [firstpost.com]। এবার জোটে রইল নেপালি কংগ্রেস ও রাজতন্ত্রীরা! নেপালি কংগ্রেস ও মাওবাদীদের মধ্যে বাৎসরিক ক্ষমতা হস্তান্তরের সমঝোতা হল। আসন সংখ্যা নেপালি কংগ্রেসের থেকে অনেকটাই কম থাকায় গৃহ মন্ত্রক, ভূমি সংস্কার, পর্যটন, শ্রম, স্বাস্থ্য, সেচ মন্ত্রক রইল না মাওবাদীদের হাতে! তৎকালীন মাওবাদীদের পক্ষের অর্থমন্ত্রী কৃষ্ণ বাহাদুর মাহারার বিরুদ্ধে বর্তমানে সোনা পাচারের মামলা চলছে! প্রচণ্ড ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক স্থাপন করলেন। তার তত্ত্বাবধানেই দু’দশক পর আঞ্চলিক নির্বাচন সম্পন্ন হল। ভূমিকম্প পরবর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হল। জনজাতিদের ক্ষোভ স্তিমিত করতে তিনি প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। ২০১৭ সালে ক্ষমতা পরিবর্তনের শর্ত মেনে প্রচন্ড পদত্যাগ করলে এবার নেপালি কংগ্রেস সরকার গঠন করল। জোটে রইল সিপিএন(এমসি) ও রাজতন্ত্রীরা। 

প্রজাতান্ত্রিক দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হল ২০১৭ সালে। সিপিএন(ইউএমএল) ১২১, নেপালি কংগ্রেস ৬৩ এবং মাওবাদীরা মাত্র ৫৩টি আসনে জয়ী হল। কইরালার ভূমিকম্পে মানুষের ক্ষয়ক্ষতিকে উপেক্ষা করা, ওলি সরকারের দুর্নীতি এবং প্রচন্ড-র নিজ দলীয় স্বার্থে সরকার পতন করা ভোট বাক্সে পরিলক্ষিত হল। তিন প্রধান দলেরই আসন সংখ্যা কমল। সিপিএন(ইউএমএল) ও সিপিএন(এমসি)-র জোট সরকার তৈরি হল। তাদের মধ্যে বাৎসরিক ক্ষমতা হস্তান্তরের সমঝোতা হল। ওলি দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন। ২০১৮ সালে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও সিপিএন(ইউএমএল) ও সিপিএন(এমসি) একীভূত হয়ে জন্ম নিল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি। ওলি ও প্রচন্ড পার্টির যুগ্ম চেয়ারম্যান হলেন। বাৎসরিক ক্ষমতা হস্তান্তরের সমঝোতা বাতিল করা হল। পিপলস মাল্টি পার্টি ডেমোক্রাসি এবং কম্পিটিটিভ ফেডেরাল রিপাব্লিক-এর (২০০৮ পরবর্তীতে মাওবাদীদের দ্বারা গৃহীত; নির্বাচনী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিপীড়িত জাতিদের প্রতিনিধিত্বের লড়াই) লাইনের বদলে সমাজতন্ত্র কেন্দ্রিক পিপলস ডেমোক্রাসি-র লাইন গ্রহণ করা হল। বলা হল, এই সমাজতন্ত্র কেন্দ্রিক পিপলস ডেমোক্রাসিই কালক্রমে কমিউনিস্ট সমাজে পৌঁছতে সাহায্য করবে। ওলির দ্বিতীয়বারের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়েই ত্রিস্তর সরকারের ফেডেরাল ব্যবস্থা কায়েম হল। ৭টি আঞ্চলিক সরকার নির্বাচিত হল এবং তাদের বিশেষ প্রশাসনিক ক্ষমতা স্বীকৃত হল। রাস্তা সম্প্রসারণ, নতুন এয়ারপোর্ট প্রতিষ্ঠা, রেল লাইন, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ব্যবস্থার প্রসার হতে লাগল। লুম্বিনিকে বৌদ্ধ কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরে পর্যটন ব্যবস্থায় নয়া জোয়ার আনার চেষ্টা হল। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ চালু হল। লকডাউনের সময়ে সরকারী সাহায্যে উদাসীনতার জন্য ওলি সমালোচিত হলেন। লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরার মত বিতর্কিত অঞ্চলকে নেপালের অংশ হিসেনে মানচিত্রে দেখিয়ে ওলি ভারতের সাথে কূটনৈতিক স্নায়ু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। ২০২০ সালে প্রচন্ড ওলির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুললেন। ওলি পাল্টা প্রচন্ড-র বিরুদ্ধে উপদলীয় কার্যকলাপ ও গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের ন্যায় প্রক্রিয়ায় বাধাদানের অভিযোগ আনলেন। ওলি রাষ্ট্রপতিকে কাজে লাগিয়ে সংসদ ভেঙে দিতে চাইলেন কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা করতে পারলেন না। পার্টির নামের রেজিস্ট্রেশান নিয়ে কোর্টে সমস্যা দেখা দিল। সিপিএন(ইউএমএল) ও সিপিএন(ইউসি) পৃথক পার্টি হিসেবে কোর্টে গণ্য হল। অনৈক্যের বাতাবরণে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল। পৃথক দুই বিবদমান পার্টি পুনরায় জন্ম নিল। সিপিএন(ইউসি) সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিলে ওলি অন্যান্য কিছু ছোট দলের সাহায্য নিয়ে সংখ্যালঘু সরকার চালাতে থাকলেন। সংসদে আস্থা ভোটের দিন এগিয়ে এলে ওলি আবার রাষ্ট্রপতিকে কাজে লাগিয়ে সংসদ ভেঙে দিতে চাইলেন কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা করতে পারলেন না। কোর্টের নির্দেশে নেপালি কংগ্রেসের শের বাহাদুর দেউবা প্রধানমন্ত্রী হলেন।

২০২২-এর সাধারণ নির্বাচনে নেপালি কংগ্রেস ৮৯, সিপিএন(ইউএমএল) ৭৮ এবং সিপিএন(এমসি) মাত্র ৩২টি আসনে জয়ী হল। প্রধান ২টি বাম দলের আসন সংখ্যা আরও কমে গেল। রাজতন্ত্রী এবং অন্যান্য ছোট আঞ্চলিক দলের আসন সংখ্যা বাড়ল। ২০২১ সালে সিপিএন(ইউএমএল) থেকে বেরিয়ে এসে মাধব নেপাল ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করেন। রাজতন্ত্রী, ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্ট ও সিপিএন(ইউএমএল)-এর সমর্থনে সিপিএন(এমসি)-র তরফে প্রচন্ড আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। ২০২৩ সালে রাজতন্ত্রীরা ও সিপিএন(ইউএমএল) সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিলে নেপালি কংগ্রেস, ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্ট ও অন্যান্য দলের সাহায্যে প্রচন্ড সরকার টিকিয়ে দেন। বিদ্যুতের প্রসার, একাধিক জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, ডিলিটাল ব্যবস্থার পরিকাঠামো উন্নয়ন, ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্ট রেট কমানো, প্রাইভেট সেক্টরের উপর জোড় দেওয়া ছিল এই সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিছুটা ডান ঘেঁষাই…  

২০২৪ সালে প্রচন্ড আস্থা ভোটে হেরে গেলে নেপালি কংগ্রেসের সাথে জোট করে ওলি চতুর্থবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। ওলির এই পর্বের সরকার পরিচালনার সময়েই ঘটল যুব বিক্ষোভ…  

কয়েকটা পর্যবেক্ষণ

১। ১৭ বছরে ১৪ বার সরকার বদল হয়েছে কিন্তু সাধারণ কেটে খাওয়া মানুষের লাভের লাভ কতটা হয়েছে সেই প্রশ্ন প্রসঙ্গ অবশ্যই আসবে রাজধানী কেন্দ্রিক এবং বাণিজ্য কেন্দ্রিক কিছু পরিকাঠামোগত উন্নয়ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি বিশেষভাবে হয়নি। লক্ষণীয়, নেপালি সমাজে পিছিয়ে পড়া অংশ, গরিব নিম্নবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ও উচ্চ বর্ণের মানুষের উপস্থিতি রয়েছে মধ্যবিত্ত অংশ সেইভাবে নেই এই সুবিধার কারণে শ্রেণী সংগ্রাম ত্বরান্বিত করার বিশেষ সুযোগ ছিল। কিন্তু দ্বি-স্ত বিপ্লবের লাইন ঠিক ছিল কিনা কিংবা নেপাল রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্র সামগ্রিকভাবে বিপ্লবের স্তর নির্ধারণের সঠিকতা প্রসঙ্গে এত দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে কিছু বলা উচিৎ নয়। নেপালের ভূমিকে যারা ভালোভাবে চেনে, বিশেষ করে যারা ওখানকার বসবাসকারী অ্যাক্টিভিস্ট, তাদেরকেই সময়োপযোগী অবস্থান ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তবে কিছু রাজনৈতিক তত্ত্বগত প্রবণতা সম্পর্কে আলোচনা করব। শুরু থেকেই লক্ষ্য করা গেছে যে পিপলস মাল্টিপার্টি ডেমোক্রেসি, নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কিংবা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম ধাপ, কম্পিটিটিভ ফেডেরাল রিপাবলিক কিংবা সাম্প্রতিকতম সমাজতন্ত্রকেন্দ্রিক পিপলস ডেমোক্রেসি - কোনটাই খেটে খাওয়া মানুষের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ধাপ নয় বরং বুর্জোয়া গণতন্ত্রে টিকে থাকার তাত্ত্বিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। এই কারচুপি স্রেফ সুবিধাবাদ হিসেবে দেগে দেওয়া ঠিক নয় বরং এর পেছনে রয়েছে রাজতন্ত্রের অবসান পরবর্তী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অতিরিক্ত সদর্থক হিসেবে দেখা এই সমস্যা হয়তো দীর্ঘ সময় কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাব কিংবা সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে সংসদে ভূমিকা সীমাবদ্ধতা থেকে তৈরি হয়েছে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও আদতে বুর্জোয়া শ্রেণীর শাসন ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে যদি অর্থনীতি, আমলাতন্ত্র, কোর্ট, সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী প্রভৃতি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষাকারী অবস্থান নেওয়া চলতে থাকে। রাজতন্ত্রের অবসানের পর নেপালের রাষ্ট্র কাঠামোর পুনর্গঠন হয়নি। ফলে নেপালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রোলেতারিয়েত ও বুর্জোয়াদের যৌথ একনায়কতন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করা একটি সম্পূর্ণ ভুল পদক্ষেপ ছিল। একটি স্থলবেষ্টিত দেশ যার বিভিন্ন দিকে রয়েছে বৃহৎ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর পড়শি এবং যার উপর দুই সম্রাজ্যবাদী অক্ষেরই প্রভাব রয়েছে, সেখানে সশস্ত্র অভ্যুত্থান লেই যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল এবং তার পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে মানুষের স্বার্থে পরিচালনা করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অবশ্যই সংশয় থাকবে। কিন্তু তাই বলে, বামপন্থীরা সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের লড়াই জারি রাখবে না, খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলবে না, এমনটা নয় আবার পরিস্থিতি বুঝে তাদের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়াশীল পর্বে বুর্জোয়া পার্লামেন্টে ঢুকে অন্তর্বর্তীকালীনভাবে একটি প্রগতিশীল সরকার চালাতে হতেও পারে সরকার চালাতে গিয়ে নেপালের ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেছে যে আদর্শগতভাবে বিস্তর ফারাক থাকার ফলে লি প্রচন্ড-র পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারেনি তারা বারংবার পরস্পর পরস্পরের সরকারকে ফেলে দিতে চেয়েছে এবং নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ডানপন্থী নেপালি কংগ্রেস কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রীদের সাথেও হাত মিলিয়েছে। ফলে বারংবার সরকারের পতন হয়েছে সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে নেপালি কংগ্রেস সাধারণ জনতার জীবনের উত্তর ঘটেনি যা দেশের সাক্ষরতার হার এবং পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা থেকেই বোঝা যায় আবার ভাট্টুরাই, ওলি কিংবা প্রচন্ড-র কোন কোন বাৎসরিক সরকার ডান ঘেঁষা পদক্ষেপ নিয়েছে। এক পড়শির সম্প্রসারণবাদ থেকে বাঁচতে অন্য এক বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কবলে তারা স্বেচ্ছায় পড়তে গেছে। ফল হয়েছে এটাই যে নেপালের উত্তর সীমান্তের দিকে চীন নিজের সীমান্ত বন্ধ রাখলেও চীন থেকে নেপালে অবাধে আসার রাস্তাঘাট তৈরি হয়েছে চীনের সাহায্যে পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছে নেপালিরা আর ইঞ্জিনিয়ার পদে থেকেছে চীনারা। প্রযুক্তি হস্তান্তর হয়নি।

। পিপলস লিবারেশন আর্মি-কে বিপরীত মতাদর্শের জাতীয় সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের আদর্শ বিলোপের ডানপন্থী চক্রান্তের সাথে মাওবাদীরা আপোষ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিকল্প সশস্ত্রীকরণের পরিকল্পনা নেওয়া উচি ছিল দখলিকৃত এলাকাগুলিতে প্রতিষ্ঠিত রেভোলিউশনারি কাউন্সিলগুলিকে সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত না করে তাদেরকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া উচি ছিল যাতে দল ক্ষমতায় না থাকলেও খেটে খাওয়া মানুষের সমান্তরাল ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়। অন্যদিকে যদি এটা মনে করা হয়ে থাকে যে স্থলবেষ্টিত দেশ হিসেবে নেপালে এই মুহূর্তে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সম্ভব নয়, তাহলে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়াশীল পর্বে গণতান্ত্রিক উপায়ে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে সরকারেসার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র রিলিফ দেওয়ার রাজনীতি না করে ভেনেজুয়েলার মত আঞ্চলিক কমিউন কিংবা নিম্নবিত্ত বস্তি এলাকাগুলিতে বিকল্প/সমান্তরাল খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা উচি ছিল। এই বিকল্প/সমান্তরাল ক্ষমতার উৎসগুলো এই দীর্ঘ প্রতিক্রিয়ার পর্বে শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারত বা পার্টি সরকারে না থাকলেও খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইয়ের হাতিয়ারগুলো তখনও কার্যকর থাকত। আর চীনের লাইন অনুসরণ করে যদি নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে এগোতে হয়, তার প্রাথমিক স্তর হিসেবে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে, তা যে শুধু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই সম্ভব, এমনটা নয়, বরং বামপন্থীরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেও সেই কাজ করতে পারত, যেমনটা চেষ্টা করা হয়েছিল চীনে অবশ্য তাদের সেই এক্সপেরিমেন্ট বিশেষভাবে সফল হয়েছে এমনটা বলা যায় না বরং বর্তমানে সেখানে একদলীয় শাসনে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে পুঁজিবাদী মতাদর্শের প্রাবল্য লক্ষ্য করা গেছে। রাজতন্ত্রের যুগ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্রচন্ড আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। কিন্তু নেপালে রাজতন্ত্র এবং তার অবসান পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদের বিকাশ কিভাবে হয়েছে তা ফিরে দেখা প্রয়োজন নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন নিয়ে বামপন্থীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে এবং অনেকেই এই দ্বি-স্তর বিপ্লবের লাইনের বিরোধিতা করে রাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রসঙ্গ টেনেছেন এক্ষেত্রে দূর থেকে তত্ত্ববাগীশ না হয়ে নেপালের অ্যাক্টিভিস্টদের হাতেই পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া উন্মুক্ত রাখতে হবে। বাম আন্দোলনের ইতিহাসে এই দ্বি-স্তর বিপ্লবকে কেন্দ্র করে সমর্থন বা বিরোধ উভয়েরই ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৃহৎ শিবিরের সমর্থ রয়েছেএই বিষয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে আরেকটা বিষয় হল, খেটে খাওয়া মানুষের একনায়কতন্ত্রের পর্বে গণতন্ত্রের প্রশ্নকে খাটো করে দেখার ফলে তাত্ত্বিকভাবে পুঁজিবাদী বিকাশে সময়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উপরেই অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দেখানো হয়েছে এই ব্যবস্থায় অর্থের জোড়ে পুঁজিপতিরা তাদের ইচ্ছাগুলোকে জনতার উপর চাপিয়ে দিতে পারে। তাই বিকল্প গতন্ত্রের উপায়গুলো ভাবা উচিৎ। সীমাবদ্ধ পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় এলে খেটে খাওয়া মানুষের বিকল্প ক্ষমতার উৎস প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ। সশস্ত্র পথে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলেও সেক্ষেত্রে একদলীয় শাসনের বদলে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং ওয়ার্কার্স-র কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বহু দলের গণতান্ত্রিকভাবে জয়ী হওয়ার উপায়গুলো উন্মুক্ত রাখা উচিবিপ্লবী সংবিধানের মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়ে থাকলে, শ্রমিক কৃষকের অধিকারগুলো সুরক্ষিত হয়ে থাকলে, ব্যক্তি সম্পত্তির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকলে, তবেই একটি অর্গানিক ব্যবস্থা হিসেবে একদলীয় শাসনের বদলে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ কার্যের পর্যায়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব উল্লেখ্য, এটি একটি তাত্ত্বিক ধারণা মাত্র এবং এর কোন সরাসরি প্রয়োগ ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ীভাবে হয়নি সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্য শুরু করে প্রাথমিক পর্বেই সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণে জর্জরিত হয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে অন্য পথে হাঁটতে হয়েছিল। অন্যদিকে বিপ্লবী কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সামগ্রিকভাবে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও আঞ্চলিক স্তরে ওয়ার্কার্স পার্লামেন্ট কার্যকর করে সাধারণ জনতার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তারা তাদের সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্য এগিয়ে নিয়ে গেছে। তাই বহু তত্ত্ব, বহু পথ, বহু এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়েই লড়াই এগিয়ে চলবে।

৩। তত্ত্ব ও প্রয়োগে ব্যবধান তৈরি হলে ব্যক্তি জীবনের চাহিদাগুলো বড় হয়ে দাঁড়ায়। একদা গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেওয়া নেতাদের পারিবারিক ধনসম্পত্তির দৃষ্টিকটু বৃদ্ধি এই দিশাহীনতারই ফসল। তবে নেপালের বামপন্থীরা যেটাই করেছে, তার তাত্ত্বিক ধাঁচা দাঁড় করানোর চেষ্টা তারা করেছে। এই অভ্যাস ভারতের বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায় না। প্রচন্ড-র দল অন্যান্য দলের সাথে সংযুক্তির ক্ষেত্রে একশৈলিকভাবে নিজেদের মতবাদ চাপিয়ে দেয়নি। দলের নামও তাই পরিবর্তন হয়েছে বার বার। এই ঐক্যবদ্ধতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে সবসময়ে মধুর না হলেও সরকারে আসার পরও সংযুক্তির প্রক্রিয়া চালিয়ে গেছে তারা। কিছু করে দেখানোর জেদ থেকেই এই লড়াই এতদূর এগিয়েছে। তাই সাম্প্রতিক নিজের দলের কেন্দ্রীয় কমিটিকে ভেঙে দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে পার্টি কংগ্রেস সম্পন্ন করে লড়াইয়ের ময়দানে পুনরায় নামার ডাক দিয়েছে প্রচন্ড। ভারতীয় উপমহাদেশে খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইকে ঐক্যবদ্ধ রূপ দিতে, সমস্ত ডান-উগ্রডান আক্রমণকে প্রতিহত করতে এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে রুখতে হলে প্রয়োজন একটি নয়া আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা, যা ইউরোপীয় ও মার্কিন দলেদের লেজুড়বৃত্তি না করে এবং সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিদ্যমান আন্তর্জাতিকগুলোর আনুষ্ঠানিকতাকে বর্জন করে প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিকতাবাদী মতধারাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। বিদ্যমান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জোটগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যেকার সম্পর্কে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে উল্লিখিত নয়া আন্তর্জাতিকের। নইলে এই ধরণের সমস্ত আলোচনা নিছকই তর্কবাগীশ প্রবন্ধ হিসেবেই থেকে যাবে।     

 

 

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?