ঘুষপেটিয়া কে?


শর্মিষ্ঠা রায় 

বিতর্কিত এবং অত্যন্ত আপত্তিকর এই লব্জটি কয়েক বছর ধরে বিজেপি সরকারের কল্যাণে চালু হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, বাঙালির উদ্দেশ্যে যখনতখন এই নোংরা শব্দটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা ব্যবহার করে থাকলেও বাংলা থেকে এর বিরুদ্ধে সেরকম কোনো প্রতিবাদ শোনা যায় নি। এর থেকেই বাঙালির আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। সেই কবে ১৯৮৮ সালে নীরদ সি চৌধুরী তাঁর "আত্মঘাতী বাঙালী" র ভূমিকা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন, "আজ বাঙালী জীবনে যে জিনিষটা প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ সেটা এই: মৃত্যুযন্ত্রণারও অনুভূতি নাই; আছে হয় পাষাণ হইয়া মুখ বুজিয়া সহ্য করা, অথবা সংজ্ঞাহীন হইয়া প্রাণ মাত্র রাখা; আরেকটা ব্যাপারও আছে-জাতির মৃত্যুশয্যার চারিদিকে ধনগর্বে উল্লসিত বাঙালী প্রেত ও প্রেতিনীর নৃত্য।" আজও তা কত ভয়ঙ্করভাবে প্রাসঙ্গিক, তা বাঙালি না বুঝলেও ওরা যে বোঝে, তা বাংলাকে বাংলাদেশী ভাষা, বাঙালিকে ঘুষপেটিয়া বলার দুঃসাহসের মধ্যে থেকেই বোঝা যায়। আসলে বাঙালি নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে সে ঘুসপেটিয়া। সংবিধানটা পড়ে দেখার পরিশ্রমটুকু সে করে না, ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে তার কতটা অধিকার তা সোচ্চারে বলার সাহস সে দেখাতে পারে না, বরং বুকে হাঁটা প্রাণীর মত হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির গপ্পো বিশ্বাস করে হাঁটুতে মুখ গুঁজে জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। অথচ সংবিধানটা খুললেই সে দেখতে পেত, বাংলা ভাষায় কথা বলা একটি মানুষও ভারতে 'বিদেশি' হতে পারে না। 

The Constitution of India (edition 2025) বইয়ের নাগরিকত্ব আইনের ৬ ধারা টি এখানে উল্লেখ করছি।

6. Rights of citizenship of certain persons who have migrated to India from Pakistan.

Notwithstanding anything in article 5, a person who has migrated to the territory of India from the territory now included in Pakistan shall be deemed to be a citizen of India at the commencement of this Constitution if-

(a) he or either of his parents or any of his grand-parents was born in India as defined in the Government of India Act, 1935 (as originally enacted)

বাংলা করলে হয় -

৬. পাকিস্তান থেকে ভারতে আগত ব্যক্তিদের নাগরিকত্বের অধিকার।

৫ম অনুচ্ছেদে যা কিছু বলা আছে তা ছাড়াও, বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল থেকে ভারতের ভূখণ্ডে অভিবাসী ব্যক্তি নিজে অথবা তার পিতামাতা অথবা তার ঠাকুরদা ঠাকুরমা, বা দাদু দিদা কেউ ভারত সরকার আইন, ১৯৩৫  অনুসারে সংবিধানের প্রারম্ভে ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তিনি ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন ।

দেশে সংবিধান বিশেষজ্ঞ বাঘা বাঘা আইনজীবীরা আছেন। অথচ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত নাগরিকত্ব আইনের এই ধারাটি নিয়ে সবাই আশ্চর্যজনক ভাবে চুপ। পেশাজীবীদের বৃহত্তর দায়িত্বের কথা ভুলে গেলে চলবে কেন? কোন সাহসে, কোন অধিকারে দিনের পর দিন বাঙালিকে 'ঘুষপেটিয়া' র মত একটা নোংরা শব্দ শুনতে হচ্ছে, এটা কি করে কারো মাথায় এখনো ঢুকছে না?

দ্বিতীয় বিষয় হল অনুপ্রবেশ। আমাকে কেউ একটু বুঝিয়ে দেবেন, পৃথিবীর সাতটি দেশের সঙ্গে ভারতের যে ১৫,২০০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক স্থল সীমানা রয়েছে, তাতে ভারত সরকারের কোনো নির্দিষ্ট বর্ডার পলিসি আছে কিনা? ভারত বাংলাদেশ বর্ডার সমস্যা নিয়ে যেখানে এত তোলপাড় চলছে, সেখানে পাশের রাজ্য মিজোরামের একটা ঘটনা বলি:

ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তরেখার মধ্যে ৩০০ কিলোমিটারের মতো একটা জায়গা আছে, যেখানে কাঁটাতারের কোনো বেড়া নেই! 

২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারির ডেকান হেরাল্ডের  একটি খবরে জানা গেল, ভারত সরকার ঠিক করেছে, এই প্রাচীরবিহীন 'অরক্ষিত' স্থানে বেড়া দেওয়া হবে। 

কিন্তু, সেটা করা যায় নি। বরং, এখানে ঘটে গেছে এক অদ্ভুত ঘটনা। মিজোরামের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা তাঁর প্রথম বৈঠকে দিল্লী গিয়ে বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করকে বলে এসেছেন, এটা হতে পারে না। ইন্দো মায়ানমার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু করা যেন না হয়। এটা হওয়া মানে ব্রিটিশদের অসৎ উদ্দেশ্যকে সফল করে দেওয়া! এটা মিজোরামবাসীরা কিছুতেই মেনে নেবেন না। প্রসঙ্গত জানাই মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী একজন প্রাক্তন আইপিএস। ফলে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, অপরাধ, সীমান্ত সমস্যা - এ সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান নেই এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করেরও সহপাঠী ছিলেন। 

মায়ানমার একদা ভারতের অংশ ছিল না। ব্রিটিশরা তাদের শাসিত রাজ্য বার্মা বা ব্রহ্মদেশকে ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল। পরে তা আবার আলাদা করে দিয়ে যায়। এতে মিজোরাই সীমান্তের দুই পারে ভাগাভাগি হয়ে যায়। ব্রিটিশদের অসৎ উদ্দেশ্যকে পাত্তা না দিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে মিজোরাম সরকার এই সীমান্ত খোলাই রেখেছে এতদিন। সেখানে অসম রাইফেলস্ এর গেটপাশ নিয়ে সীমান্তের দুই পারের মানুষজন অবাধে দুই দেশের ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারে। ২০২১ সালে হুন্তা (Junta) বা সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে গন্ডগোল শুরু হয়, তখন মিজোরাম প্রায় ৪০০০০ জন চিন শরণার্থীকে দেশে আশ্রয় দিয়েছে। এই সুসম্পর্ক নষ্ট করতে তারা কোনোমতেই রাজি নয়। মিজোরা বুঝতে পারছেন, এই পরাজয়ের ফল বহুদূর পর্যন্ত যাবে। বেশ কিছু এনজিও ও এই দাবিকে সমর্থন করেছে।

এবারে আসি দুই বাংলার সীমান্তের কথায়। ১৯৪৮ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই সীমান্তও খোলা ছিল। দাঙ্গার আগুনে ঝলসে যাওয়া মানুষের দল তখন জানমাল নিয়ে এপারওপার করছেন। বহু মানুষ ভেবেছেন, পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলে ভিটেমাটিতেই ফিরে যাবেন। 

তাঁরা কেউ যেতে পারেন নি। এক জাতি এক ভাষার মানুষ হয়েও। উল্টে, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে তাঁদের ওপর এসআইআর, এনারসি, এনপিআর, সিএএ র ষড়যন্ত্র নামিয়ে এনেছে ভারত সরকার। 

এদিকে, চুপিসারে এই সংসদ এই ২০২৫ সালের এপ্রিলে আরো একটি নতুন আইন পাস করেছে যার নাম ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ফরেনার্স অ্যাক্ট, ২০২৫। এই আইন এফেক্ট হওয়ার পর সিএএ ২০১৯ গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। এই আইনের বলে ভারত সরকারের পুলিশ ও বিএসএফকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাংলায় কথা বলা যেকোনো মানুষকে বাংলাদেশী বলে দাগিয়ে দিতে, এবং বৈধ পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া অন্য কোনো ডকুমেন্ট যা ভারতের বৈধ নাগরিক বহন করে তা গ্রাহ্য না করতে। একদিন বাঙালির অনুমতি না নিয়েই তার বুকের ওপর কাঁটাতার পুঁতে দিয়েছিল, আর আজ তার অর্ধমৃত দেহটাকে সেই কাঁটাতারের ওপারে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। 

বাংলার সঙ্গে এত বড়ো ষড়যন্ত্রে বাঙালি চুপ করে থাকবে, আর হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির গপ্পো গিলে হা হা দেবে? ধিক ধিক এই অস্তিত্বকে। নীরদ সি চৌধুরীকে দিয়েই শেষ করি। আত্মঘাতী বাঙালীতে তিনি তিনবার বাঙালির পুনর্জন্মের কথা বলেছেন। আর-একবার কি পুনর্জন্ম নেবে বাঙালি?

ডাঃ শর্মিষ্ঠা রায় এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক। 

Photo Courtesy: সাম্প্রতিক কলকাতার SIR বিরোধী মিছিলের একটি ফ্লেক্স


Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?