কেরালার রাজনীতি এবং অবিপ্লবের চোরাস্রোত
অদ্রিরাজ তালুকদার
কেরালায় সম্প্রতি হয়ে যাওয়া পৌর এবং গ্রামীণ নির্বাচনের ফলাফল লোকমাধ্যমে শোরগোল ফেলে দিয়েছে। বিশেষত বামেদের লক্ষ্যনীয় ক্ষয় এবং বামদূর্গ তিরুবনন্তপুরমে বিজেপির জয় নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে। কিন্তু কেরালার রাজনীতির গভীরতা না বুঝে কোনো জল্পনাই বস্তুনিষ্ঠ হবে না। এই লেখায় কেরালায় ঘটে যাওয়া আপাত বিষয়টির কতগুলো আঙ্গিক পাঠকের কাছে তুলে ধরব।
কেরালা একটি লিবারেল স্বর্গ
জনমানসে কেরালাকে বাম স্বর্গ ভাবার প্রবণতা আছে। অন্তত বাংলার লোকেরা বহুলভাবে মনে করে কেরালায় সকলেই কম্যুনিস্ট। যারা তাদের মধ্যে ভোটের রাজনীতির খবর রাখেন তারা জানেন যে ১৯৮০ থেকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউডিএফ এবং সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে এলডিএফ পালাবদল করেই ক্ষমতায় এসেছে। এর অন্যথা হয়েছিল শেষবার, ২০২১-এ।
ঐতিহাসিক কারণের বর্ণনায় না গিয়ে কেরালায় জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে একটি প্রতিপাদ্য দেওয়া যায়। ভারতীয় গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে যে মূল্যবোধগুলো বর্ণিত আছে তা ভারতের অধিকাংশ জনগণের কাছে এখনও স্বপ্নিল। ভারতে অধিকাংশ গ্রামীণ এবং শহুরে জনতা তাদের নাগরিক অধিকার, আইন-কানুন তাদের কি করার বা পাওয়ার সুবিধা দিয়েছে, পুলিশ-প্রশাসনের কাছে তারা কিভাবে ন্যায্য দাবী আদায় করতে পারবেন, সে বিষয় অসচেতন। এখনও মূলস্রোতে "পুলিশ" শব্দটা নিরাপত্তার চেয়ে ভয়ের সূচকই বেশি। এই দেশের কোন কোন অঞ্চলে প্রচন্ড লিঙ্গবৈষম্য, জাতপাতের ভেদাভেদ বর্তমান, কোথায় "গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র" ব্যবস্থা কার্যত অনুপস্থিত, তা পাঠককে আলাদাভাবে বলে দিতে হবে না। কিন্তু কেরালা এ বিষয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম।
প্রথমত, ঐতিহাসিকভাবেই কেরালায় বিভিন্ন সম্প্রদায় পাশাপাশি বসবাস করেছে - প্রায় দু'হাজার বছর ধরে।
দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর থেকেই বাম এবং কংগ্রেস সরকার উভয়েই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়নে বিশেষভাবে সদিচ্ছা দেখিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রাচীন কসমোপলিটান সংস্কৃতি এবং সরকারের "সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক" প্রকল্পায়নের সুফল হিসেবে কেরালা সামাজিক উদারিকরণ, নাগরিক সচেতনতার নিরিখে অগ্রগণ্য হয়েছে।
ফলে, প্রশাসন বা সরকারের থেকে জবাবদিহিতা দাবী করে থাকে সাধারণ নাগরিক। সে কারণেই যেমন কোনো দল দীর্ঘদিন শাসন করতে পারে না, আবার একই কেন্দ্রে যে দল লোকসভায় বেশি ভোট পায়, প্রার্থীভেদে বিধানসভায় তত ভোট পায় না।
তার মানে এটাও যে বিপ্লবী স্লোগান দেওয়া বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টও কোনো বিপ্লবী প্রকল্পের মূর্তি নয়। বরং দু'টো লিবারেল, "প্রগতিশীল" অসাম্প্রদায়িক পক্ষ হিসেবে এলডিএফ বা ইউডিএফ নির্বাচিত হয়। অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি কেরালা রাজনীতির প্রাথমিক প্রতিপাদ্য। এই স্থানীয় ভোটে তারই ছায়া আমরা দেখতে পেয়েছি। আবার পরিসংখ্যান বলছে তিরুবনন্তপুরমের নির্বাচনে বিজেপির ভোট বাড়েনি। বরং, কংগ্রেস ও সিপিআই(এম)-এর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাঝে সিট পিছু তারা এগিয়ে গেছে।
স্বপ্ন নয় বাস্তব
উপরের অনুচ্ছেদে আমি একটা মিথ্যাচার করেছি। কেরালাকে আমি লিবারেল স্বর্গ বলেছি। কিন্তু পুঁজিবাদের স্বপ্ন বাস্তবের মাটিতে সবসময়ই কূটাভাস হয়েই থেকে গেছে। বাস্তবতায় প্রবেশ করার আগে আমাদের মনে করে নিতে হবে বিজেপি আর আরএসএস আলাদা। হ্যাঁ, কেরালার রাজনীতিতে বিজেপি কখনোই প্রাসঙ্গিক হয়নি। আবার এটাও মাথায় রাখতে হবে, আরএসএস-এর অন্যতম পুরনো ও স্থায়ী সংগঠন রয়েছে কেরালাতেই। আবার সত্যের অপলোপ হবে এ কথা বললে যে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কোনো টানাপোড়েন নেই, বা কেরালায় দলিত, বহুজন, আদিবাসীদের দারুণ অগ্রগতি হয়েছে, বা নারীরা ঘরে ও বাইরে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হন না।
কেরালায় বাম সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে কেরালা সম্পূর্ণভাবে প্রবল দারিদ্র্য মুক্ত হয়েছে। আচ্ছা, দারিদ্র্যের সংজ্ঞা কি? কম্যুনিস্ট মতধারায় বিশ্বাসীরা এই ধরণের সংজ্ঞা বা "অর্থনৈতিক বিজ্ঞান"কে মার্ক্সীয় চশমায় কিভাবেব্যখ্যা করেন? বস্তুত, কেরালায় বামদলগুলি, এমনকি কংগ্রেস থেকে বেরোনো বিভিন্ন ফ্যাকশন ও ছোট বুর্জোয়া দলগুলি পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এলডিএফ বা ইউডিএফ জোটে সামিল হয়েছে। নির্বাচনের বাইরে কারুরই কোনো প্রোগ্রাম চোখে পড়ার মত নয়। নির্বাচনী ধারাবাহিকতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সিপিআই(এম) উদারবাদ ও জনপ্রিয়তাবাদের সঙ্গে আপস করে নিয়েছে। সোশ্যাল ডেমোক্রেসির শিরোপাধারী সিপিআই(এম) ধীরে ধীরে এক ধরনের রাজনীতিহীন অবস্থায় পৌঁছেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিপিআই(এম)-এর নব্যউদারবাদী ও কর্পোরেটমুখী নীতি আপন করে নেওয়া। কেরালার বাম সরকার বিনিয়োগ নির্ভর উন্নয়ন, ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’-এর উপর জোর এবং দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজিকে আকৃষ্ট করার নীতি গ্রহণ করেছে। জিএসটি-কে পূর্ণ সমর্থন, আদানির সাথে চুক্তি, এনইপি লাগু করা, কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্পোরেটবাদী প্রকল্পকে সাদরে আমন্ত্রণ, বহুজাতিক পরামর্শদাতা সংস্থার উপর নির্ভরতা, বাজারভিত্তিক ঋণগ্রহণ এবং বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদারিত্ব - এই সব সিদ্ধান্ত নব্যউদারবাদী উন্নয়ন মডেলের প্রতি ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতার ইঙ্গিত দেয়। ফলে শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতি ও কাঠামোগত বৈষম্যের প্রশ্ন ক্রমশ আড়ালে চলে যাচ্ছে।
সেই ফাঁকা জায়গা দখল করছে জনপ্রিয়তাবাদ। বিভিন্ন সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিদের প্রতি ঢিলে নীতি গ্রহণ করে সরকার। ধর্মগোড়া, বর্ণবাদি, নারীবিদ্বেষী ব্যক্তিবর্গের প্রতি সহনশীলতা, এমনকি তাদের ব্যবহার করা, অন্যদের সুযোগ করে দিচ্ছে। তার সাথে আছে শাসকদলের পেশী আস্ফালন। শাসকদলের নেতারা বিভিন্ন সামাজিক, এমনকি ধর্মীয়, বিষয়ে দাদাগিরি ফলানোর চেষ্টা করেন। অগত্যা এরকম বাতাবরণে আরএসএস-এর মত শক্তিরাও জ্বালানি পাচ্ছে। লকডাউনের সময়কালে পৃথিবীর সব সরকারই সাময়িকভাবে সমাজবাদী হয়ে গিয়েছিল। ফলে স্বভাব সমাজতান্ত্রিক শাসকদল যথেষ্ট সাফল্যের সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিল। তার ফলস্বরূপ ২০২১-এ এলডিএফ ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরে এলডিএফ ও বিশেষ ভাবে সিপিআই(এম) অব্যবস্থা ও দুর্নীতির অভিযোগে বারবার অভিযুক্ত হয়েছে। এবছর স্বভাবসিদ্ধভাবে কেরালা পরিবর্তনের দিকে যেতে পারে, তেমন সম্ভাবনা প্রবল।
বামেদের স্মর্তব্য
প্রথমত, পরিসংখ্যান থেকে আমরা জানতে পারছি কেরালার রাজনীতিতে বিজেপি এখনও তেমন দাগ কাটতে পারেনি। কিন্তু বেশকিছু গ্রামীণ ও পৌর এলাকায় পঞ্চায়েত ও ওয়ার্ডভিত্তিক ভোট তারা বাড়াতে পেরেছে। এর সুদূরপ্রসারী ফল তারা পাবে কি না, সেই ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। তার চেয়ে বড় কথা, আরএসএস শুধু একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন নয়, তারা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল অঙ্গবিশেষ। তাদের প্রকল্পে প্রয়োজনে যে কোনো দলকেই তারা ব্যবহার করতে পারে। সিপিআই(এম)-এর নব্যউদারবাদী আপস তাদের সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্যের দিকেই সাহায্য করবে। এবং সামাজিক স্তরে প্রতিক্রিয়াশীলতার সঙ্গে আপস করাও আরএসএসকে সুমিষ্ট ফল দেবে।
বাম সরকারের বর্তমান কর্মসূচী প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) বিপ্লবী পরিস্থিতির অনুপস্থিতিতে বস্তুগত অবস্থার উন্নতির কথা বলে। একথা সত্য যে আশির দশক থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণে অনেক অগ্রগতি হলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বাণিজ্যের দিক থেকে কেরালা মধ্য মানেই থেকে গেছে। বিশ্বায়িত পুঁজির সংকটকালে তাই কেরালার জনগণের মধ্যেও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, বেকারত্ব, শিল্পের অভাব ইত্যাদি বিষয়ে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। এমতাবস্থায়, এই কর্মসূচীকেই একমাত্র পথ বলে ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সীমাবদ্ধতাগুলিকে উপলব্ধি করার সঠিক সময় এখন। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে দীর্ঘমেয়াদী সহাবস্থান করতে মুক্তবাজার এবং নয়াউদারবাদের সঙ্গে আপস করা বাধ্যতামূলক। ব্যবস্থার সংস্কার করা যায় একটা ঊর্ধ্বসীমা পর্যন্তই। কিন্তু আসল পরিবর্তন এই ব্যবস্থার সাথে একটা ঐতিহাসিক ছেদ ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে সিপিআই(এম)-কে নির্ণয় করতে হবে যে তারা নির্বাচনে জেতার বাইরে আরেকটি বৃহত্তর লড়াইয়কে লক্ষ্য বানাবে নাকি সাম্রাজ্যবাদ আর আরএসএস-এর প্রকল্পে অংশীদার হবে।

Comments
Post a Comment