মরিয়া না মরে রাম
বিমলকান্তি দাশগুপ্ত
১৯৬৭ সালের
মে মাসে নকশালবাড়িতে মার্ক্সবাদীদের নেতৃত্বে কৃষকদের এক অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তার ক’মাস আগে নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে। এবং সি পি আই (এম) পার্টির নেতৃত্বে
রাজ্যে প্রথম বামপন্থীদের যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন হয়। এই ঘটনার পর টানা দশ বছরের জন্য পশ্চিমবঙ্গের তাবৎ মানুষ
এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী।
বিপ্লবীরা
এই দশককে চিহ্নিত করেছেন ‘মুক্তির দশক’ নামে। বিদেশ থেকে সমর্থন
এলো ‘বসন্তের বজ্র
নির্ঘোষ’ বলে। বস্তুত মার্ক্সবাদী
দর্শনের এত ব্যাপক আলোচনা, তথ্য প্রয়োগ, তর্ক-বিতর্কে এই সময়টা ছিল যেমন মুখর আবার অন্যদিকে প্রতিরোধ, প্রতিশোধ, বিশ্বাস ভঙ্গ, বিশ্বাসঘাতকতা, খুন-জখম-হত্যা, গুলি-বন্দুক-বোমার ধোঁয়ায় ছিল
অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সমাজের নিম্নতম কোটির
দিনমজুর থেকে উচ্চতম কোটির সমৃদ্ধজন। সাক্ষর-নিরক্ষর নির্বিশেষে
বালক-কিশোর-তরুণ-যুবক মায় প্রৌঢ়-বৃদ্ধ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জীবনে মননে প্রভাব
ফেলেছিল এই ঘটনা। অতএব সে সময়ের সকল মানুষের মনে সঞ্চিত আছে সেই আবেগ, সময়ের অক্ষয়
স্মৃতি হয়ে।
ঘটনার পর
পঞ্চাশ বছর পার হয়ে এসেছি। এখনও আনাচে কানাচে কথায় কথনে নকশালবাড়ি প্রসঙ্গ উঠে
আসে। অভিজ্ঞতায় জেনেছি, এখনও বঞ্চিত মানুষ বঞ্চনাকারীর ওপর ক্ষোভ উগরে দিয়ে বিড়
বিড় করে উচ্চারণ করেন, এদের জন্য নকশালরাই ছিল ঠিক ঠিক ওষুধ।
যাঁরা এই
আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন, যাঁরা হত হয়েছেন, যাঁদের হত্যা করা
হয়েছে, দলমত নির্বিশেষে তাঁরা মৃত। তাঁদের সঙ্গে তাঁদের স্মৃতিরও মৃত্যু ঘটে গেছে।
অতএব তাঁদের প্রসঙ্গ থাক। কিন্তু যাঁরা
বেঁচে
আছেন, এবং সক্রিয় রাজনীতি বা অন্য সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের
অনেকেই সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখছেন। যা অবশ্যই আগামীকালের গবেষকদের জন্য
বিচার এবং বিশ্লেষণ, তর্ক এবং বিতর্কের সুযোগ করে দেবে।
যে
প্রসঙ্গে এই কথনের শুরু তা হল, সাম্প্রতিক প্রকাশিত একখানা জীবন কাহিনীর দুটি
মূল্যায়ন। বই-‘রাজনীতির এক জীবন’। লেখক- সন্তোষ রাণা। প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স।
দাম চারশো টাকা। মূল্যায়ন করেছেন তাপস সিংহ। আনন্দবাজার পত্রিকার ১৫ জুলাই ২০১৮
রবিবাসরীয় পৃষ্ঠার পুস্তক পরিচয় কলমে। দ্বিতীয় মূল্যায়ন করেছেন সুদর্শন রায়চৌধুরী।
গণশক্তি পত্রিকার ১৪ জুলাই শনিবার ২০১৮-র উত্তর সম্পাদকীয় কলমে। এখানে বলে রাখা
ভালো, মূল বইখানা আমি পড়িনি। দু’টি মূল্যায়ন পড়ে আমার যেমন মনে হয়েছে সে কথাই
নিবেদনের প্রয়াস এ লেখা।
আনন্দবাজার এবং গণশক্তি কোন পত্রিকাই আদর্শ বা
নীতির দিক থেকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতার দাবী করে না। এই দুই পত্রিকায়
সন্তোষ রাণাকে নিয়ে উৎসাহ প্রথম বিবেচনা। কে ছিলেন সন্তোষ রাণা? সুদর্শন রায়চৌধুরী
তাঁকে পরিচিত করেছেন-“রাজনীতির নানান আলোড়ক
ঘটনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত…, একটি ধারার আন্দোলন-সংগঠনের একেবারে সামনের সারির নেতা…”।
নকশালবাড়ির
আন্দোলনকে “হঠকারী” বা “বালখিল্যের চপলতা’’ ইত্যাদি যে নামেই খাটো করে দেখাবার
চেষ্টা হোক না কেন, তার ভেতরের বিস্ফোরণ ক্ষমতার কিছু তো অনুমান করা যায়, তাকে
নিকেশ করবার সরকারি আয়োজনের মধ্যে।
সাধারণ
কনস্টেবল। বন্দুকধারী আর্মড পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, নৌ
বাহিনী শেষমেশ ইস্টার্ন কমান্ডের মিলিটারি বাহিনী দিয়ে ঘিরে ধরা হয়েছে।
ইমার্জেন্সি জারি করে নতুন আইন করে ধরার মারার অবাধ ক্ষমতা পুলিশকে দিয়ে অবশেষে জবরদস্তি
জালি ভোটে সিদ্ধার্থশংকর রায়কে মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে নির্বিচারে খুন জখম গ্রেপ্তার
অপহরণ লাশগুম ইত্যাদি করে নকশাল দমন করতে লাগল পুরো এক দশক।
সেই আন্দোলনের
সক্রিয় যোদ্ধা-নেতা পরাজয়ের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আত্মসমীক্ষা করেছেন “রাজনীতির এক জীবন” নাম দিয়ে বই রচনা
করে। সে পুস্তকের সার সংগ্রহ করে লিখনে
প্রকাশ করেছেন তাপস সিংহ। তাঁর মতে সন্তোষ
সিদ্ধান্তে এসেছেন, নিজের আশৈশব দেখা সমাজের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাঝেই আছে সুস্থ সমাজের দিশা। লিখেছেন-“আসলে ভারতের বাস্তব অবস্থা বিচার না করে কেউ যদি যান্ত্রিকভাবে মার্ক্সবাদী
তত্ত্বকে প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে সে ভুল সিদ্ধান্তেই পৌঁছবে”। বাস্তব অবস্থা বিবেচনা না করে যান্ত্রিকভাবে
প্রয়োগ করে সফল হওয়া যায় এমন কী তত্ত্ব আছে জানা নেই। “দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক পথে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই
চিন্তন প্রক্রিয়ায় একটা আস্তরণ পড়ে। কেবল মনে হতে থাকে, আমি যে রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে
এই পথ বেছে নিয়েছি, সেই বিশ্বাস থেকেই ভেবেছি, এখনও ভাবছি, এটাই উন্নয়নের পথ; মানুষের
মুক্তির পথ” “কিন্তু সন্তোষ রাণা তা করেননি। বরং বারবার গণতান্ত্রিক পরিসরের কথা বলেছেন।
বাস্তব সম্মত অবস্থার কথা বলেছেন”।
ভিন্ন ধারার
রাজনীতির পথে থাকলে চিন্তন প্রক্রিয়ায় আস্তরণ পড়ে। কিন্তু মূলধারার রাজনীতির পথে হাজার বছর চলেও তা স্বচ্ছ থাকে
কেমন করে!
“যে
যত পড়ে সে তত মূর্খ হয়”। ছাত্র যুবদের মিটিংয়ে চারু মজুমদার
বলেছিলেন। শিক্ষা সম্পর্কে
চারু মজুমদারের ভাবনার কথা লিখেছেন এক সময় তাঁর সহযোদ্ধা, নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা
সন্তোষ। এবং বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন “দেশবাসী”-কে। নেতা এবং আন্দোলন সম্পর্কে কোন বার্তা
দিতে চেয়েছেন তিনি?
বইখানা পড়ে
সুদর্শন রায়চৌধুরী যা জানাতে চেয়েছেন তা হল—রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে এম টেক্ পড়ার সময় মার্ক্সবাদী
আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সন্তোষ। তার আগে রাজনীতির
সঙ্গে ওঁর কোন যোগাযোগ ছিল না। অর্থাৎ যথেষ্ট দেরিতে
তাঁর রাজনীতিতে যোগদান। সন্তোষকে উল্লেখ
করে আরও জানাচ্ছেন, মার্ক্সবাদী তত্ত্বে তাঁর দীক্ষা মাও-সে-তুং-এর ‘দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে’, ‘প্রয়োগ প্রসঙ্গে’ আর ‘হুনান কৃষক আন্দোলনের
তদন্ত রিপোর্ট’ পড়ে। দ্রুত তিনি নকশালবাড়ি
আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা হয়েছিলেন।
জানতে ইচ্ছে
করে, কত বছর বয়স
থেকে এবং কোন সিলেবাস অনুসরণ করলে ঠিক ঠিক মার্ক্সবাদী হওয়া যাবে।
এর পর বইতে
আছে ‘নকশাল বাড়ির
ডাক”, পথ বদল, ভাঙন, জেলখানা, জেলজীবন ইত্যাদি
ইতিবৃত্ত। তাঁর স্মৃতিচারণে
আছে মূর্তি ভাঙা এবং গণসংগঠনের প্রতি চারু মজুমদারের ঔদাসীন্য। আর খতম অভিযানের বিরুদ্ধে লেখকের অবস্থান। “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের
চেয়ারম্যান” এই স্লোগানের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন। মাওয়ের রেডবুক পড়ার ফতোয়া
ইত্যাদি।
এত
ত্রুটি নিয়ে কোন আন্দোলনের সফল হবার কথা নয়। নকশালবাড়ির আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তা
হয়নি। পরাজয়ও শিক্ষিত করে মানুষকে কোনও না কোন ভাবে। এ ক্ষেত্রে জীবনীকার কী
শিক্ষা গ্রহণ করেছেন সে বিষয়ে সুদর্শন জানাচ্ছেন- “অবশ্য আজকের পটভূমিতে তাঁর
সারকথাটি বইয়ের উপসংহারে স্পষ্ট। “দেশের বহুত্ববাদী
ধারাটিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে এক ব্যাক্তি-এক দল-এক ধর্ম-এক জাতি গঠনের যে সাম্প্রদায়িক
স্বৈরতান্ত্রিক কর্পোরেট পুঁজির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা মতাদর্শ (আজ) বলশালী হয়ে উঠেছে তার
বিরুদ্ধে… বামপন্থাই গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষক-এই ভাবধারাকে জনসাধারণের মধ্যে প্রসারিত
করেই বামপন্থা নিজেকে এই ভারতবর্ষে রক্ষা করতে পারে”
।
এতো সেই
গণতন্ত্র! গ্রামজীবনে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশে লেখক নিজে পালিত পোষিত হয়ে উচ্চ
শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উঠে এসেছিলেন ‘ব্যতিক্রমী’ হিসেবে! এ তো সেই
গণতন্ত্র, যেখানে শোষক শোষিত একসঙ্গে বসত করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সামাজিক
বিবাদহীন জীবনে! এই উপসংহারে সেই অতীতে ফিরে যাবার আহ্বান শোনা যাচ্ছে না কি?
বইখানা
প্রকাশ হয়েছে ২০১৭-র ডিসেম্বরে। নলশালবাড়ির ঘটনা ততদিনে পঞ্চাশ বছরের অতীত কাহিনী।
ইতিমধ্যে চৌত্রিশ বছরের গণতান্ত্রিক বামশাসনের পরিণতি স্ফুট হয়েছে উপসংহারে ঘোষিত
বর্তমান পরিস্থিতির চেহারায়। যখন মার্ক্সবাদীরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন ‘বাম
গণতন্ত্রী’ হিসেবে!!!
বিমলকান্তি দাশগুপ্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, নাট্যব্যক্তিত্ব এবং একদা নকশাল আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।
Comments
Post a Comment