আইএসএফ কতটা ধর্মনিরপেক্ষ?

সায়ন নন্দী 

ধর্মকে স্তম্ভ করে বিধানসভা ২০২১-এর নির্বাচন যে সংঘটিত হতে চলেছে তা হয়তো অতি নির্বোধেরও বোঝা বাকি নেই। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু বা মুসলমান সম্প্রদায় মানুষের অবস্থা যে শোচনীয় তা বলতে দ্বিধা নেই। বাম আমলে সাচার কমিটির রিপোর্ট থেকে তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সে সময় মমতা সংখ্যালঘুদেরকে নিজের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মমতা ব্যানার্জীর কাছে শুধুমাত্র এক বৃহৎ ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে পরির্বতনের হাওয়া রাজ্যে বাড়ন্ত হওয়ার সময় থেকেই। বিভিন্ন ধর্মগুরুকে অযথা আদিখ্যেতার মাধ্যমে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা হতে থাকে তৃণমূলের হাত ধরে। মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক উন্নতির বদলে সুযোগসন্ধানী ধর্মগুরুদের তোষামোদের ফলে বিজেপির সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ প্রশস্ত হতে থাকে। বাংলাদেশী ঘুষপেটিয়ার ট্রাম্প কার্ড খেলে বিজেপি রাজ্যে সংগঠনের বিস্তার শুরু করে। দোসর হয় বামেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং তৃণমূল সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি। অপরপক্ষে, বিজেপির বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত, রাম মন্দির রায়, এনআরসি-এনপিআর-এর মত পদক্ষেপের ফলে মুসলমান সম্প্রদায় ভীত সন্ত্রস্ত হতে থাকে। 


এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বচ্ছল ও দীনদরিদ্র অংশের দ্বন্দ্বের মাঝে যখন নিজস্ব দাবিদাওয়াগুলি তুলে ধরার জন্য প্রতিনিধির খোঁজ চলছে, ঠিক সে সময়ে ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী নামল ঘোলা জলে মাছ ধরতে। তার মুখে শোনা যেতে লাগল গরীব, দলিত, তফসিলি, আদিবাসী মানুষের কথা। যারা রাজ্য রাজনীতির খোঁজ রাখে তারা আব্বাসের পূর্ববর্তী বিভিন্ন ভাষণ শুনলেই খোঁজ পাবে যে সে ধর্মনিরপেক্ষতার ভেক ধরে রাজনীতির ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে। তার নিজের আসল সংগঠন 'ফুরফুরা শরিফ আহালে সুন্নাতুল জামাত (আব্বাস)' ইসলামিক জলসাতে মজে থাকে (https://www.facebook.com/104457684981482/posts/116027440491173/?sfnsn=wiwspmo)। এই জলসায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মহিলাদের আসা বারণ। এমনকি মহিলাদের বোরখা পড়ার পক্ষে কঠোরভাবে সওয়াল করতে শোনা যায় তাকে (https://www.youtube.com/watch?v=xq5-EbqrS3g)। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার ভেক ধরতে আব্বাসের রাজনৈতিক দল 'ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট' (আইএসএফ)-এ কিছু দলিত, তফসিলি এমনকি হিন্দু ব্রাক্ষণদের রাখা হয়েছে। 

বিজেপি যখন কোনো রাজ্যতে বিস্তার লাভের নীল নকশা তৈরী করে, তারা সর্বপ্রথম তাদেরই পেছন দরজার জোট সঙ্গী আসাদুদ্দিন ওয়াইসিকে পাঠায় সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর জন্য। ওয়াইসির ধর্মীয় এবং সংকীর্ণ গরমাগরম বক্তব্যই রাজনৈতিকভাবে বিজেপির পথ প্রশস্ত করে। কিন্তু ওয়াইসির সংগঠন মূলত উর্দুভাষী  মুসলমানদেরকে সংগঠিত করেই গড়ে উঠেছে। অপরদিকে বাংলাতে ৩৩% মুসলমানের মধ্যে মাত্র  ৯ % মুসলমান উর্দুভাষী, বাকি ২২% বাংলাভাষী; সেক্ষেত্রে ওয়াইসির অসফলতা প্রায় একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। এই কারণেই ওয়াইসির আব্বাসের হাত ধরা এবং আব্বাসের মাধ্যমে ওয়াইসি তার কার্যসিদ্ধি করতে থাকছে (https://frontline.thehindu.com/cover-story/new-muslim-parties-asaduddin-owaisi-aimim-and-abbas-siddiqui-indian-secular-front-break-secular-vote-in-west-bengal-assembly-elections-2021/article33642950.ece)। আব্বাসের বিভিন্ন সভা থেকে মিছিল, সবকিছুর অর্থভান্ডার ওয়াইসিই। গত জানুয়ারীতে তাদের জোট সম্পর্কে রাজ্য রাজনীতি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল। ওয়াইসির দল আইমিমের পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক মাজিদ হোসেন ফেব্রুয়ারী মাসে প্রেস কনফারেন্স করে তাদের মধ্যেকার এই বোঝাপড়া স্পষ্ট করে দিয়েছে (https://www.facebook.com/watch/?v=898238287666492)। কিন্তু বর্তমানে বামফ্রন্ট সেই জোট সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট অবস্থান না রেখেই সংযুক্ত মোর্চা গঠন করে বসেছে। 

আব্বাসের বক্তব্যতে মানবতা, গরীবী হঠাও-এর স্লোগান একদিকে থাকলেও, অপরদিকে তাকে একজন চরম নারীবিদ্বেষী এবং সংকীর্ণ ধর্মগুরু হিসেবে স্পষ্ট রূপে পাওয়া যায়। তৃণমূল সাংসদ নুসরত সম্পর্কে তার নোংরা শব্দচয়ন এবং নারী সমাজকে যে সে সমাজে অগ্রাধিকার দিতে চায়না তা স্পষ্ট। পার্ক স্ট্রীট কান্ডের অভিযুক্তকে পালাতে সাহায্য করা কিংবা আমফানের সময়ে বসিরহাটের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে না দাঁড়ানো নিয়ে কোনো কথা না বলে, আব্বাসের আক্রমণের নিশানা ছিল, কেন মুসলিম হয়ে নুসরত হিন্দু মন্দিরে ঢুকছে (https://www.youtube.com/watch?v=YDdxnfwf9vo)! (এ ছাড়াও করোনা মহামারীতে প্রচুর মানুষের মৃত্যুতে সে রসিকতার ছলে মন্তব্য করে বসে যে এটা আল্লার দোয়া; এতে করে বিশাল জনসংখ্যার হ্রাস ঘটার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি ফিরে আসবে। তাছাড়া বাম-কংগ্রেসের সাথে জোটে সম্মতি দেওয়ার পরেও সে বলে যে তারা ভোট পরর্বতী সময়ে বাম কংগ্রেসকে বুঝে নেবে। ফ্রান্সের এক শিক্ষক আল্লার ছবি দেখাতে জেহাদীরা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সে সমস্ত জেহাদীদের সে আল্লার দূত হিসেবে স্বীকৃতী দেয় এবং তাদের বিরুদ্ধে ফরাসী জনমানসের প্রতিবাদের বিরোধিতা করতে শোনা যায় তার মুখে (https://www.youtube.com/watch?v=xq5-EbqrS3g)। এমত অবস্থা থেকেই বোঝা যায় যে আব্বাস আদতে একটি মৌলবাদী চরিত্র। একজন ধর্মগুরুকে রাজ্য রাজনীতির আঙিনাতে নিজের বিস্তারের সুযোগ পেতে খুব যে কষ্ট করতে হয় না তা যোগী আদিত্যনাথকে দেখলেই বোঝা যায়; যোগী আর আব্বাসের পার্থক্য এখানেই যে যোগী সংখ্যাগুরুর রাজনীতির অংশীদার হিসেবে নিজের নৃশংস মনভাব ব্যক্ত করতে ডরায় না কিন্তু সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি হিসেবে আব্বাস তার সংকীর্ণতাকে ঢেকে চলে মানবতার কথার ভেকের আড়ালে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু বছরের ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক অবস্থান এবং তৃণমূলের ধর্মগুরুভিত্তিক তোষণের রাজনীতি আব্বাস সিদ্দিকির মতো সুযোগসন্ধানীদের রাজ্যপাট বিস্তারের মাধ্যম খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। তার সাথে সাথেই বিজেপির উত্থান আর অপরদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর সংগঠন বিস্তারের চেষ্টায় তৃণমূল এবং সিপিএমের সীমাবদ্ধতার কারণে আব্বাস নওশাদের মতো নেতারা "ভাইজান"-এর রূপ নিয়েছে। তাছাড়াও মুসলিম সংখ্যালঘু মানুষদের দুঃখ দুর্দশা ঘোচানোর জন্য একজন মুসলিম ধর্মগুরুকেই কি প্রতিনিধির পদে বসাতে হবে, সে প্রশ্ন উঠছে মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকেই। 

বর্তমান নির্বাচনে বিহারের রাষ্ট্রীয় সেকুলার মজলিস পার্টির নাম ভাড়া করে আইএসএফ-এর ভোট ময়দানে অবতীর্ণ হওয়া জনমানসে এই গজকচ্ছপের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন বিভক্ত সংকীর্ণ শ্রেণি প্রতিনিধিত্বের গজকচ্ছপ মার্কা মেলবন্ধন ঘটিয়ে বিজেপিকে হারানোর এই লড়াইয়ে আইএসএফ-এর নেতৃত্বের ধর্মনিরপেক্ষতাই প্রশ্নের মুখে; তাছাড়া সিপিএমের কর্মী ভাড়া করে তাদের প্রার্থী দাঁড় করানোর নীল নকশা আর ভাঙ্গড়ের মত গণআন্দোলনের ভূমিতে আন্দোলনকারীদের সাইড করে ধর্মঘুরুকে প্রার্থী দাঁড় করানোর রাজনীতি আদতে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে দীর্ঘদিনের সামাজিক উন্নতির অভাব এবং বর্তমান বিজেপি-র বিরুদ্ধে সমগ্র মুসলমান সমাজের ভীতিকে কাজে লাগিয়ে এই অর্থনৈতিকভাবে দিশাহীন রাজনীতি বিজেপির পথই প্রশস্ত করতে উঠে বসে লেগেছে... 

প্রশ্ন ওঠে, এটা তবে কি ফ্যাসীবাদেরই পিছনের দরজায় কড়া নেড়ে ঘরে ঢোকার রুট ম্যাপ??? 

Picture Courtesy: The Economic Times 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার