ভবিষ্য ভারত

মুজফফর আহ্‌মদ

গণবাণীঃ ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৬


[ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের এই মুহূর্তে ফিরে দেখা যাক পরাধীন ভারতবর্ষে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের জন্য আন্দোলনরত কমিউনিস্টদের স্বাধীন দেশের স্বরূপ সম্পর্কে কিরকম দাবী বা ধারণা ছিল। এই প্রবন্ধে উত্থাপিত বক্তব্যের সঙ্গে আজকের দেশের অবস্থার তুলনা করলে সহজেই বোঝা যায় যে সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাকি নিমজ্জিত হয়েছে কতিপয় ধনিকের 'কিয়জ্জন-তন্ত্র'-এ।]



আমরা এর আগে এক প্রবন্ধে বলেছি যে আমরা ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে নয়, বাহিরে। আজ সে কথাটা আরো খানিকটা পরিস্ফুট করে তুলতে চেষ্টা করব। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে আসতে পারলেই যে স্বাধীনতা লাভ আমাদের হয়ে যাবে তা নয়। তখন যদি দেশের শাসনকার্য দেশের কিয়জ্জনের ইচ্ছানুযায়ী নির্বাহ হয় তাহলে আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না যে সত্যিকারের স্বাধীনতা লাভ দেশে হয়েছে। সে অবস্থায় বিদেশি কিয়জ্জন-তন্ত্রের পরিবর্তে স্বদেশী কিয়জ্জন-তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে মাত্র, স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা হবে না। কাজেই স্বাধীনতার প্রথম শর্ত হবে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। কাজের সুবিধার জন্য সমগ্র ভারতবর্ষকে ভিন্ন ভিন্ন স্টেটে বিভক্ত করে সে সকল স্টেটকে সমসূত্রে আবদ্ধ রাখতে হবে। অর্থাৎ এই স্টেটগুলো আপন আপন সরকারের কাজ স্বাধীনভাবে নির্বাহ করলেও তাদেরকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে একে অন্যকে সাহায্য করার জন্য। ইংরেজিতে যাকে বলে Federative Democratic Republic ঠিক তাই হবে আমাদের স্বাধীনতার আদর্শ।


সার্বজনীন ভোটাধিকার

গণতন্ত্র গণমতের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে, একথা বলাই বাহুল্য। বয়স্ক ব্যাক্তি মাত্রেরই ভোটাধিকার থাকতেই হবে এবং সেই ভোট নিয়ে সকল কার্যের পরিচালনা করা হবে।


জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ

বর্তমান সময়ে দেশে নানা প্রকারের জমিদারি প্রথা বিদ্যমান রয়েছে। এই জমিদারি প্রথার ইতিহাস নিয়ে আমরা আলোচনা এখানে করবো না। আমাদের একমাত্র বক্তব্য হচ্ছে এই যে সমাজের হিতের জন্য এ প্রথা থাকার কোন প্রয়োজন নেই। স্টেট (সরকার) ও কৃষকগণের মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগীরা কেন থাকবেন? এখন ভারতবর্ষে গভর্মেন্টের খাস মহাল আছে। এই খাস মহালের ব্যাপারে কৃষকের সহিত গভর্মেন্টের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ রয়েছে, এবং রয়েছে বলে কাজের অসুবিধা এতটুকুও হয়নি। সুতরাং বিনা মধ্যস্বত্বভোগীতেও যখন কাজ চলতে পারে তখন মধ্যস্বত্বগুলো থাকার কোন প্রয়োজন নেই। কৃষক ফসল উৎপাদন করবে এবং সরকার তার অংশ নেবে দেশের নানাবিধ কাজের জন্য। কিন্তু, কৃষকের শ্রমের ধনে মধ্যস্বত্ববান লোকেরা কেন যে ভাগ বসাবেন এবং সে ভাগ বসানোটা কি প্রকারের সুবিচার, তা আমরা বুঝে উঠতে পারছিনা। কথায় বলে "যে এল চষে, সে রইল বসে"। আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা হয়েছে ঠিক তাই। কৃষকেরা তো খেটে খেটে মরছে আর মধ্যস্বত্বপ্রভুরা তার অংশ নিচ্ছেন কোনো পরিশ্রম না করে। সমাজে পরাশ্রিত ও পর-রক্তপিপাসু লোক যত থাকবে ততই তাতে বিশৃঙ্খলা ও ব্যভিচার বাড়তে থাকবে। এবং দেশের সর্বসাধারণের অবস্থা ততই বেশি শোচনীয় হয়ে উঠবে।

মাটির বুকে যে ফসল উৎপন্ন হয় সে ফসল খেয়ে সকল মানুষ বাঁচে, সকল প্রাণী বাঁচে। এ মাটি কিছুতেই কেবলমাত্র সমাজের কতিপয় লোকের সম্পত্তি হয়ে থাকতে পারে না। যে মাটির ফসলে দেশের প্রত্যেক লোকের প্রয়োজন আছে, সে মাটি দেশের প্রত্যেক লোকেরই সম্পত্তি হবে। অর্থাৎ ভূমিকে দেশের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করতে হবে, এখনকার মত ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। যে কৃষক এ ভূমি থেকে ফসল উৎপাদন করবে একমাত্র তারই সাথে থাকবে ভূমির সাক্ষাৎ সম্বন্ধ।


শ্রমিকগণের বেতনের হার ও কাজের সময়

কারখানায় যে সকল শ্রমিক কাজ করে বেতনের নিম্নতম হার বেঁধে দিতে হবে। এমন একটা হার নির্দিষ্ট করে দিতে হবে যাতে তারা সত্যিকারের মানুষের মত জীবনযাপন করতে পারবে। বর্তমান সময় শ্রমিকগণ যে পরিশ্রম ধনীর নিকটে বিক্রি করে তার অতি সামান্য মূল্য মাত্র তারা পায়। তাদের শ্রমের অতিরিক্ত মূল্যটা যায় ঝিলমিল পকেটে। এই অতিরিক্ত মূল্য পেয়ে ধনিক বিলাসে গা ঢেলে দেয়, আর শ্রমিক দু'বেলা দু'মুঠো পেট পুরে খেতেও পায় না। ভারতবর্ষের শ্রমিকের ন্যায় দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাদের জীবনযাত্রা দেখে বিশ্বাসই করা দায় হয়ে পড়ে তারা মানুষ না আর কিছু। কিন্তু, এই প্রবঞ্চনার অবসান করতেই হবে। তারই জন্যে বেতনের একটা নিম্নতম হার বেঁধে দেওয়া একান্ত আবশ্যক। তার কম বেতন দিয়ে কেউ কোনো শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করতে পারবে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কাজের সময় শ্রমিকরা আট ঘন্টা করতে চাইছে। এই আট ঘন্টা সময় নির্দিষ্ট করাটা শ্রমিকদের একটা আন্তর্জাতিক দাবি হয়ে পড়েছে। কিন্তু, আমাদের মনে হয় ভারতবর্ষের ন্যায় গরম দেশে কাজের সময় আট ঘণ্টারও কম নির্দিষ্ট হওয়া উচিত, অন্তত আট ঘণ্টারও বেশি তো কোনক্রমেই নয়। মানুষের হাতে গড়া কলেরও যখন বিশ্রামের প্রয়োজন হয় তখন প্রাণবন্ত মানুষেরও জীবনে প্রয়োজন আছে। কিন্তু বর্তমান সময় মানুষকে কলেরই মতো খাটানো হচ্ছে। কেননা, শ্রমের অতিরিক্ত মূল্য যতই পকেটস্থ করা যায় ততই ধনিকের লাভ।


সামাজিক কুপ্রথা

ভারতবর্ষ সামাজিক গ্লানি ও কুপ্রথার জন্যে সুবিখ্যাত হয়ে পড়েছে।
কুসংস্কারের জন্যে, কুপ্রথার জন্যে এমন অন্ধ মমত্ববোধ দুনিয়ার আর কোন দেশের লোকের আছে কিনা সন্দেহ। সংস্কার ও প্রথার এমর ঘৃণিত দাসত্ব আর কিছুতেই হতে পারে না। দেশ যদি স্বাধীন হয় এবং তখনো দেশে কুপ্রথা ও অন্ধ সংস্কার বিদ্যমান থাকে তাহলে সে স্বাধীনতার আমরা কিছুতেই উপভোগ করতে পারবো না। এই সমস্ত গ্লানির আওতায় থেকে মন কখনো কোনো ভালো জিনিস, বড় জিনিস গ্রহণ করতে পারবে না। তাই সামাজিক গ্লানিগুলো দূর করতে হবে, এবং আইন করেই করতে হবে।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা
অন্যান্য সভ্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা, ভারতবাসীরা কোনও শিক্ষা পাইনি বললেও অত্যুক্তি হয় না। আমাদের দেশের জনসাধারণের অক্ষর জ্ঞান পর্যন্ত নেই। এত পিষ্ট, দলিল ও শোষিত হয়েও আমাদের কৃষক ও শ্রমিকেরা যে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে এতটুকুও সচেতন হচ্ছে না তার একমাত্র কারণ শিক্ষাহীনতা। বর্তমান সময়ে যে গভর্মেন্টের অধীনে আমরা বাস করছি সে গভর্মেন্ট আমাদের শিক্ষার জন্য কিছুই করতে পারেনি। প্রায় পৌনে দুশো বছরের ইংরেজ রাজত্বে ভারতবর্ষে স্বাক্ষর লোকের সংখ্যা শতকরা সাতজনের উপরে ওঠেনি। জাপানে স্বাক্ষর লোকের সংখ্যা শতকরা আটানব্বই জন। ইউরোপের দেশসমূহেও কোথাও শিক্ষিতের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি, আর কোথাও বা সামান্য কম। শিক্ষা বাধ্যতামূলক না হলে এবং স্টেট শিক্ষার সমূহ ভার গ্রহণ না করলে কখনো দেশের সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার হতে পারে না। অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং তার সম্পূর্ণ ভার নিতে হবে সরকারকে।


প্রেস ও বক্তৃতার স্বাধীনতা

মানুষের মন বড় করার জন্য, ভাব বিনিময়ের জন্য, চিন্তাধারার স্ফূরণের জন্য, প্রেস ও কথার স্বাধীনতা থাকা একান্তই আবশ্যক। কোন জাতির চিন্তাকে গলা টিপে মেরে ফেললে সে জাতি কখনো জগতের কোনো সত্যই গ্রহণ পারবেনা। আমাদের স্বাধীনতার আদর্শের সহিত প্রেসের স্বাধীনতা স্বাধীনতা ও কথার স্বাধীনতা অতপ্রোতভাবে বিজড়িত থাকা উচিত।


নারী পুরুষের সমানাধিকার

নারী আর পুরুষকে নিয়ে সমাজদেহ গঠিত হয়েছে। ভারতবর্ষে কিন্তু সকল কাজে আমরা নারীকে বাদ দিয়ে চলেছি। তারই জন্যে আমাদের সমাজের অঙ্গ বিকল হয়ে আছে। এ বিকলাঙ্গ নিয়ে আমরা কোনদিনই স্বাধীনতা লাভ করতে পারবোনা। সমাজ ও দেশ কিছু পুরুষের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। এই দুয়ের উপরে পুরুষ ও নারীর ঠিক একই অধিকার রয়েছে। নারীর অধিকারের উপর এতকাল আমরা অনধিকার চর্চা করে এসেছি। তাদের অধিকার তাদেরকে ছেড়ে দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক অধিকার (civil rights) যতটুকু পুরুষের থাকবে, ঠিক ততটুকু থাকবে নারীর।


সাধারণ হিতকারী জিনিস

খনি, রেলওয়ে, ট্রামওয়ে, স্টীমার ও টেলিগ্রাফ প্রভৃতি সাধারণের হিতকারী জিনিসগুলো কতিপয় ব্যক্তির লাভ লোলুপতার উপায় না হয দেশের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত হবে। সংক্ষিপ্তভাবে আমরা উপরে যা হওয়া উচিৎ বলেছি তার একটিও ছাড়া দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। এসব ছাড়াও দেশ যদি কখনো পর-শাসন মুক্ত হয তাহলে দেশে কিয়জ্জন-তন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে,- গণতন্ত্র নয়। 

Picture Courtesy: https://www.thebetterindia.com/31526/life-of-a-kid-sellings-flags-on-independence-day/

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার