বিজেপির জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন প্রসঙ্গে
অনন্যা দেব
[1st PUBLISHED: 08.08.2021; UPDATED: 10.08.2021]
পুঁজিবাদের মূল সমস্যা হল ইনপুট আউটপুটের সমস্যা কারণ এই ব্যবস্থায় ইনপুট এবং আউটপুট সমান থাকেনা। অর্থাৎ, যে মজুরী শ্রমিককে দেওয়া হয় এবং শ্রমিকের দ্বারা উৎপাদিত পণ্যের বাজার দাম তা সমান হয় না; পণ্যের দামই বেশি। ফলে, সামগ্রিকভাবে সমস্ত উৎপাদিত পণ্য সমগ্র সমাজের দ্বারা কেনা বা উপভোগ করা সম্ভব নয়। এটাকেই কার্ল মার্ক্স "উৎপাদনের মহামারী"-র আখ্যা দিয়েছিলেন। এই উৎপাদনের মহামারী হল পুঁজিপতির দিক থেকে মহামারী, কারন তাদের সমস্ত পণ্য পুরোপুরি বিক্রী করা যাচ্ছে না। উল্টোদিকে, সাধারণ জনগণের অত্যাবশ্যকীয় বা অন্যান্য ভোগ্য পণ্য সঠিক পরিমানে পাচ্ছে না।
করোনা পরিস্থিতির আগেই অর্থাৎ ২০১৯ থেকেই সারা পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দার পরিস্থিতি চলছিল যা ২০২০তে করোনা পরিস্থিতির ফলে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আমাদের দেশে ঐতিহাসিকভাবেই উৎপাদনের মহামারী কিংবা অর্থনৈতিক সংকটের পরিস্থিতিকে আড়াল করতে জনসংখ্যার তত্ত্বকে নঞর্থকভাবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমান ফ্যাসিস্ট কেন্দ্রীয় সরকারও একই পথে হাঁটছে। বিজেপি সরকার উত্তরপ্রদেশ এবং অসমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করছে। এই আইন অনুযায়ী, কোনো দম্পতি দুইয়ের অধিক সন্তান প্রসব করলে তাদের বিভিন্ন সরকারি সুবিধা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করা হবে!
বুর্জোয়া মহলে কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রক আইনগুলি উঠে আসছে,তা দেখে নেওয়া প্রয়োজন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রক এই ধরনের আইন চীন দেশেও অতীতে প্রনীত হয়েছিল, আবার তা থেকে কিছুটা সরে আসার প্রক্রিয়াও তারা চালিয়েছে। এই মূহুর্তে চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাধীন থাকলেও সেখানকার সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ সম্পর্কে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বর্তমানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আধিক্য এবং বাজার অর্থনীতির নিয়ম চালু থাকার মাঝে, চীনের এই পদক্ষেপও একটি বিতর্কিত বিষয়।সামগ্রিকভাবে উল্লেখ্য, আমাদের দেশের অনেক বামপন্থী সংগঠন ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলি বিজেপির জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রক আইনের বিরোধিতা করতে গিয়ে নারী সমাজের কিছু অধিকারের প্রশ্ন তুলে ধরেছে; প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকারের কথা তুলে ধরেছে। কিন্তু উল্টোদিকে, এই প্রশ্নও তৈরী হতে পারে যে, যদি নির্দিষ্ট অধিকারগুলি নারী এবং প্রতিবন্ধী সমাজকে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রক আইনগুলি যুক্তিসম্মত হয়ে যাবে?
প্রথমত, উৎপাদনের মহামারীকে আড়াল করতে বা অর্থনৈতিক সংকটের ফলে উৎপন্ন জনগণের রোষকে ধামাচাপা দিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রসঙ্গ আনা হয়, যার মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিক কারচুপি, মুনাফাখোরদের ব্যাপক আর্থিক লুঠের কথা, জাতীয় সম্পদ দেশের একটি ক্ষুদ্র শিল্পপতি গোষ্ঠীর হাতে নিয়ন্ত্রন - এ সবই ধামাচাপা পড়ে যায়। এসবের ফলে আসলে দেশের ব্যাপক সংখ্যক জনগণ অন্ধকারের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে; তারা খেতে পাচ্ছে না, সম্মানজনক জীবনধারণ করার মতন সুযোগ পাচ্ছে না। লক্ষণীয়, আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রককে বলা হয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক অর্থাৎ মানুষকে সম্পদ হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে। যেখানে মানবসম্পদ এত বেশি, সেখানে সেই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বহুমুখী নির্মাণের পথে এগোনো যেতে পারে, যার ফলে ব্যাপক সমৃদ্ধির সম্ভাবনাও রয়েছে।
লক্ষণীয়, ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে যখন শিল্প বিপ্লব শুরু হয়, সেই সময় ব্যাপকভাবে নগরায়ন বা নতুন নতুন শহরের পত্তন হতে শুরু করে। একইসাথে গ্রাম থেকে বহু মানুষ কাজের আশায় শহরে আসতে থাকে। তারা কৃষক থেকে শ্রমিকে পরিণত হয়। এই শ্রমিকদের জীবনের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল - যৎসামান্য মজুরি, ব্যাপক দরিদ্রতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে জীবন কাটানো এবং অনাহার ও অপুষ্টি; যার ফলে 'মাছির মতন মৃত্যু'। এই মৃত্যুর হার পরিলক্ষিত করে মানুষের দুর্দশার কারণ হিসেবে ম্যালথাস জনসংখ্যাকেই দোষারোপ করা শুরু করেন। ম্যালথাসের বক্তব্য অনুযায়ী, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জিওমেট্রিক প্রগেশানে (গুনোত্তর প্রগতি) এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় অ্যারিথমেটিক প্রগ্রেশানে (সমান্তর প্রগতি)। ফলে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে উৎপন্ন খাদ্য সামগ্রী জনতার মুখে আহার তুলে দিতে সক্ষম হবে না। অর্থাৎ জন প্রতি খাদ্য উৎপাদনের হার কমবে। এটা হচ্ছে ম্যালথাসের মূল তত্ত্ব।এই তত্ত্বের সমালোচনা করলে দুটো দিক উঠে আসে। প্রথম, এই তত্ত্ব মানুষের দুর্দশার কারণ হিসেবে উৎপাদন ব্যবস্থাকে, তার অর্থনৈতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক প্রবণতাগুলোকে তুলে ধরে না। আর দ্বিতীয়, এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে জীববিদ্যার জগতের বহু বিজ্ঞানী, বিশেষ করে জনসংখ্যাতত্ত্ববিদেরা নিজেদের গবেষণার কাজে বারংবার দেখিয়েছেন যে জীবজগতের বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে কিভাবে এই মাছির মতো মৃত্যুর প্রবণতা দেখা যায় যখন তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তত্ত্বটা এরকম ধাঁচের যে, প্রাকৃতিকভাবে যে পরিমান সম্পদ রয়েছে, তার ধারণ ক্ষমতার থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে সেই জনসংখ্যা ব্যাপক হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কথাটা একটা আঙ্গিকে ঠিক (সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে) কিন্তু এই চিন্তাধারার মধ্যে একটা ত্রুটিও রয়েছে। লক্ষনীয় যে, মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণী জগতের একটা নির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য প্রাণীরা নিজেরা ব্যাপক হারে উৎপাদন করতে পারে না। ব্যাপকহারে বলার কারণ হচ্ছে, বাবুই পাখি নিজের বাসাটুকু শুধু তৈরি করতে পারে কিন্তু সেটা কোনো ব্যাপক হারে বা কোনো উন্নত মানের উৎপাদন নয়; যেটা মানুষ পারে। ফলে অন্যান্য প্রাণীজগতের থেকে মানুষের যে উত্তরণ এঙ্গেলস তাঁর "বানর থেকে মানুষে রূপান্তরে শ্রমের ভূমিকা" প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, জীববিদ্যার অন্তর্গত জনসংখ্যাতত্ত্ববিদরা গবেষণা করার সময় কিন্তু সেটা মাথায় রাখেননি, যার ফলে তাঁরা অন্যান্য প্রাণীজগতের সাথে মানব সমাজকে এক করে ফেলেছেন। এই কারণে ব্যাকটেরিয়া বা চোখে দেখতে না পাওয়া বিভিন্ন জীবাণু বা মাইক্রোবের জনসংখ্যাগত প্রবণতাগুলিকেই মানব সমাজের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য হিসেবে তাঁরা ধরেছেন।
ম্যালথাসের মূল তত্ত্বানুযায়ী, মানবজাতির উপরে নিষ্ঠুরতম আচরণ করো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে। তিনি বুর্জোয়াদের দ্বারা শ্রমিক শোষণ ও নিপীড়নের ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন এই যুক্তিতেই। তাঁর তত্ত্বের অবতারণা ঘটে, রাজতন্ত্র বা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় যে শ্রেণী ক্ষমতাধীন রয়েছে, তারা যে অন্যান্য শ্রেণীকে শোষণ করছে, এই নঞর্থক দিকটা আড়াল করার উদ্দেশ্যে। আজও জীববিদ্যার অন্তর্গত বিভিন্ন উচ্চশিক্ষার অলিন্দে ম্যালথাসের তত্ত্বটি ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরা হয়। বুর্জোয়া নিপীড়নের অর্থনৈতিক প্রভাব যা মানুষের দৈনন্দিন দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার তাড়নার মধ্যে দিয়ে প্রতিভাত হয়, এই তত্ত্ব তা আড়াল করার চেষ্টা করে। এর কিছু প্রভাব সাংস্কৃতিক পরিসরেও দেখতে পাওয়া যায়। নারায়ণ সান্যাল "আজি হতে শতবর্ষ পরে" গ্রন্থে জনসংখ্যাকেই মানব সমাজের সংকট হিসেবে তুলে ধরেছেন। আবার ইংরেজি সিনেমার জগতে ইনফারনো (ড্যান ব্রাউনের উপন্যাসকে কেন্দ্র করে) নামের একটি সিনেমায় একটি নির্দিষ্ট ভাইরাস ছড়িয়ে জনসংখ্যার অর্ধেককে ধ্বংস করে ফেলার কথা বলা হয় মানব সমাজের উত্তরণের জন্য। অন্যদিকে মিশন ইমপসিবল-৪ সিনেমাতেও দেখানো হয়েছে, একটি সন্ত্রাসবাদী সংস্থাকে যা জগতকে পুনর্নির্মাণের জন্য অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যাকে ধ্বংস করতে উদ্যত। এগুলিকে ম্যালথাসের তত্ত্বের সাংস্কৃতিক প্রয়োগ হিসেবে ধরা যেতে পারে। সিনেমাগুলিতে বারংবার এই ধরনের প্রবণতাগুলিকে রোধ করার প্রচেষ্টা সিনেমার হিরো বা হিরোইনের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দেখানো হলেও সেই প্রচেষ্টার যে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বা সামাজিক কারণ তা তুলে না ধরায়, দিনের শেষে যা মনে হতে পারে, মানবিকতার খাতিরেই জনসংখ্যার এই বিষয়টিকে আমাদের আড়াল করে বা মুখ ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। কিন্তু স্রেফ মানবিকতার ভিত্তিতে কোনো তত্ত্ব দাঁড়িয়ে থাকেনা, তার আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন। অপরদিকে এটাও লক্ষণীয়, ম্যালথাসের তত্ত্বের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে এমনকি আমাদের নিজেদের দেশেও জন প্রতি খাদ্য উৎপাদনের হার বেড়েছে (করোনা পরিস্থিতির আগে)। ২০১৭-১৮ সাল নাগাদ আমাদের দেশের তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি লোকসভায় দাঁড়িয়ে বাজেট সংক্রান্ত ভাষণ দেওয়ার সময় বলেছিলেন রেকর্ড হারে ফসল উৎপন্ন হয়েছে কিন্তু দেখা গেল যে ওই একই সালে ভারতবর্ষের কৃষক আত্মহত্যার হার ছিল ৭.৭% -৮.২%। অর্থাৎ সমস্যা লুকিয়ে অর্থনীতিতে এবং গণবন্টন ব্যবস্থায়।
এরপরের প্রসঙ্গ জন্মহার বিষয়ক। আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো যে, ধনবান পরিবারে শিশু জন্মানোর হার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারের থেকে কম। জীবনের অসুরক্ষার থেকে নিজের বংশকে বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া প্রয়াস অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলির অলিন্দে কাজ করে বলে ধরে নেওয়া হয়। জনমানসের মধ্যে বুর্জোয়াদের দ্বারা বহুল প্রচারিত এই মতের দ্বারা গরীব মানুষের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক ঘটে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি স্কোয়ার কি.মি.তে ৫৩ জন মানুষ বাস করে থাকেন। আফ্রিকাতে এই সংখ্যাটা হল ৩৫, নেদারল্যান্ডসে এটি ৪৯৩। লক্ষনীয়, নেদারল্যান্ডস হল সারা বিশ্বে সর্ববৃহৎ কৃষিজ পণ্য রপ্তানিকারক রাষ্ট্র। নেদারল্যান্ডসের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার জনসংখ্যা অনেক বেশি। এখান থেকেই প্রমানিত হয়, বুর্জোয়াদের মতে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর জনসংখ্যার ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্কে রয়েছে, সেই তত্ত্বায়নে ভ্রান্তি রয়েছে।
আমরা দশম শ্রেণীর জীববিদ্যার বই থেকে জানি যে, সুষম আহার বা ব্যালেন্সড ডায়েটে দিন প্রতি পুষ্টির পরিমান প্রয়োজন ৩২০০ কিলোক্যালোরি। ১৯৬০ সালে দিন প্রতি প্রাপ্ত কিলোক্যালোরি ছিল ২২২০, যা সুষম আহারের প্রয়োজনীয়তার থেকে কম। ২০১৩ সালে সারা বিশ্বে জন প্রতি খাদ্য উৎপাদনের হার গিয়ে দাঁড়ায় দিন প্রতি ৫৩৫৯ কিলোক্যালোরি। এর থেকে সহজেই ৩২০০ কিলোক্যালোরির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। মুর ল্যাপি, জোসেফ কলিন্স, পিটার রজেট রচিত "ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার: টুয়েলভ মিথস" নামক বই থেকে জানা যায়, বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনের হার জন প্রতি খাদ্যের চাহিদার থেকে প্রায় দেড়গুণ বেশি, যার ফলে প্রায় ১০,০০০ কোটি মানুষকেও দুবেলা পেটপুরে খাবার দেওয়া সম্ভব; যা পুরোপুরি ম্যালথাসের তত্ত্বের বিপরীত। ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ সারা পৃথিবীতে জনসংখ্যা পৌঁছাবে ১০,০০০ কোটিতে। ফলে, বর্তমানে যা খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, তার মাধ্যমে ২০৫০ সালের বর্ধিত জনসংখ্যারও ভরনপোষণ সম্ভব।
"সেভ দ্য চিলড্রেন"-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ভারতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার ২০ লক্ষ, অর্থাৎ ভারতে প্রতি ৫ সেকেন্ডে পাঁচ বছরের কম বয়সী একজন শিশুর মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালে শিশু মৃত্যু হয়েছে প্রতি হাজারে আনুমানিক ৪১.১ জন। সদ্যোজাত শিশু মৃত্যুর হার সারা ভারত জুড়ে ৪৭%, যার মধ্যে গ্রামের হার ৫১%, শহরের হার ৩১%। এ দেশে অপুষ্টিতে শিশু মৃত্যুর প্রবনতা ভয়াবহ।ভারত সরকারের রাশিবিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রক থেকে "চিল্ড্রেন ইন ইন্ডিয়া" নামক একটি রিপোর্ট ২০১২ সালে বের করা হয়। ২০১৬ সালে এই মন্ত্রক একটি তথ্য দিয়েছে যে, ভারতের শিশুদের মধ্যে প্রায় ৬ কোটি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম, প্রায় ৪৫% শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির হার স্বাভাবিকের তুলনায় কম, ২০% অপুষ্টিতে ভোগে, ৭৫% শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে, ৫৭% ভিটামিন এ-র অভাবে ভোগে। ভারতবর্ষে ২০০১-এর আদমসুমারি অনুযায়ী, ১,২৬,০৭,০০০ শিশু (যাদের বয়স ১৪ বছরের কম) তারা শ্রমিকে পরিনত হয়েছে। ইউনিসেফের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা (যাদের বয়স ৫-১৪ র মধ্যে) প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। লক্ষনীয়, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরপরই শিশু শ্রমিক হওয়ার বয়সগত সীমারেখা ১৪ বছরে কমিয়ে দিয়েছে। ফলে, আমাদের মতন গরীব দেশগুলোতে একের অধিক শিশু জন্মানোর অর্থ খাবার দিতে হবে এমন আরেকটা নতুন পেটের জন্ম নয় বরং আরো অধিক দুটো হাত কাজ করে পরিবারকে অর্থ এনে দিতে পারে। এই যুক্তির প্রযোজ্যতা এভাবেও দেওয়া যায় যে, এই কারণেই উন্নত দেশগুলিতে শিশু জন্মানোর সংখ্যা কম।
সারা বিশ্বের তথ্য সাপেক্ষে দেখলে, গোটা পৃথিবীর ৮৩% মালিকানা ৮.৩% জনসংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ। গোটা পৃথিবীর ৭০% গরীব মানুষ গোটা পৃথিবীর সম্পদের মাত্র ৩%-এর মালিক। অক্সফ্যাম ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের ধনী ১%-এর সম্পদ দরিদ্রতম ৭০%-এর মোট সম্পদের ৪ গুণ বেশি। তাই ক্ষুধা এবং বাসস্থানের প্রশ্নের কারণ খুঁজতে হবে জনসংখ্যায় নয় বরং উৎপাদনের উপায়-উপকরণ, উৎপাদিত পণ্য এবং সম্পদ বণ্টনের যে বিন্যাস মানবসমাজে রয়েছে তার উপর; উপর ব্যক্তিগত মালিকানার উপর। তাই শ্রমিক বিপ্লবই হলো সামাজিক উত্তরণের একমাত্র পথ।
এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকারী আইনের আলোচনার মধ্যে দিয়ে মহিলাদের অধিকারের কিছু প্রশ্ন উঠে আসে কারণ আমাদের দেশের ফ্যাসিস্ট সরকার ভ্রু কুঁচকায়, যখনই সন্তান প্রসবের সম্পূর্ণ অধিকার মহিলাদের নিয়ন্ত্রনাধীন হবার দাবী ওঠে। আমাদের দেশের মহিলাদের নিজেদের শরীরের উপর কোনো অধিকার নেই কারণ সন্তান প্রসব সে করবে কি করবে না সে অধিকার সমাজ তাকে দেয় না। আবার অন্যদিকে মহিলাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রগুলো পূর্ণরূপে এই পুরুষশাসিত সমাজ সামাজিকভাবে স্বামীর ওপর ছেড়ে রেখেছে। সে কারণে নিয়ন্ত্রণমূলক কোনো ব্যবস্থা মহিলা নিজে আদৌ নেবে কিনা বা সঙ্গমের সময় সহধর্মিনীর শারীরিক চাহিদা বা সমস্যাগুলি পুরুষ আদৌ মেনে চলবে কিনা, সেই প্রশ্নগুলি এখনও আমাদের সমাজে ঠিক করে অ্যাড্রেসড নয়। সেই কারণে ম্যারাইটাল রেপ বা বিবাহিত জীবনেও শ্লীলতাহানীর প্রশ্ন বারংবার উঠে আসে। এটা একটা দিক। দ্বিতীয় দিক, এই আইনগুলি অনুযায়ী কোনো পরিবার দুইয়ের বেশি সন্তান প্রসব করলে তাদের বিভিন্ন সরকারি, সামাজিক সুরক্ষা-নীতি থেকে, সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হবে ইত্যাদি; যা সম্পূর্ণভাবে সংবিধান বিরোধী। জীবনের যে অধিকার সংবিধান স্বীকৃত, এই আইন তারই মূলগতভাবে বিরোধী। আবার একই সাথে এটাও লক্ষণীয় যে, আমাদের দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির মূল সমস্যা হল যে কৃষি অলাভজনক; এই অর্থনৈতিক সমস্যা আসলে পুঁজিবাদী সমাজের নয়াউদারবাদী সংকটের। তাই নতুন করে ভূমি সংস্কারের প্রয়োজন কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে কিন্তু বর্তমানেও যা উৎপাদনশীলতা রয়েছে সেখান থেকেও সমগ্র জনগণের মধ্যে সুষম আহার পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। খাদ্যের সুষম বন্টনের ব্যবস্থাকে বিকল করে রাখার জন্য যা সকলের কাছে পৌঁছায় না। ব্যাপক বেকারত্বের কারনে জন প্রতি ক্রয়ক্ষমতা দেশে কমছে। এগুলি মূলগতভাবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকটের ফল যে কারনে লকডাউনের সময় সাধারণ মানুষ কাজের জন্য দোরে দোরে ঘুরলেও দেশের শিল্পপতিরা ফাটকা বাজারে ফার্মেসি কোম্পানি এবং অন্যান্য ই-রিটেল ক্ষেত্রগুলিতে টাকা বিনিয়োগ করে কোটি কোটি টাকা লাভ করছে। ফলত কোনও দোষই জনসংখ্যার ওপর চাপিয়ে লাভ নেই।
২০১৫ সালের ভারতবর্ষের পারিবারিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দপ্তর কর্তৃক রিপোর্টে পাওয়া যায় যে, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বর্তমানে ২%-এর কাছাকাছি, অর্থাৎ নিম্নমুখী। ফলে যে জনবিস্ফোরণের তত্ত্বকে সামনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা আদপে মিথ্যা।
উত্তরপ্রদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রক আইনের (উত্তরপ্রদেশ পপুলেশন কন্ট্রোল স্টেবিলাইজেশান এন্ড ওয়েলফেয়ার বিল ২০২১) ১৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কোনো দম্পতির যদি এক বা একাধিক বিকলাঙ্গ বা প্রতিবন্ধী সন্তান থাকে, তাহলে সেই দম্পতির উপর এই দুই সন্তান নীতি প্রয়োগ হবে না। আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী অধিকার বিষয়ক ২০১৬ সালের আইন অনুযায়ী, এই ১৫ নম্বর ধারা তার পরিপন্থী। যে মূহুর্তে কোনো দম্পতির উপর দুই সন্তান নীতি প্রয়োগ হবে না যেহেতু তাদের বিকলাঙ্গ সন্তান হয়েছে, এই যুক্তিতে তখন থেকেই বিকলাঙ্গ বা প্রতিবন্ধী সন্তান একটি বোঝা হিসেব ফুটে ওঠে। নাৎসী ইউজেনিক চিন্তাধারায়, যা কিছু স্বাভাবিকভাবে কর্মঠ নয়, তা ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলা হয় বা তাকে তাচ্ছিল্য করার প্রবনতা দেখা যায়, বা যাকে সরাসরি উৎপাদন ব্যবস্থায় কাজে লাগানো যাচ্ছেনা বা যার নিজের কর্মক্ষমতাকে প্রকট করার জন্য বিশেষ কিছু অধিকার বা পরিস্থিতির প্রয়োজন, তাদেরকে বর্জ্য হিসেবে গণ্য করে দুরে ঠেলে দিতে বা খতম করার মনোভাবই ফুটে ওঠে।
পরিশেষে এটা বলা যায় যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যে কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে দুর্দশা রোধ করার উপায় হিসেবে, তা সম্পূর্ণরূপে ভুল। তার কারণ এই সমস্যার মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানা; খাদ্য সংকট সেই অর্থে নেই বরং সমবন্টনের পদ্ধতি বিকল করে রাখার কারণেই মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছাচ্ছে না। এই কারণে আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করা উচিত। দ্বিতীয় আরেকটি দিক, প্রকৃতপক্ষে আমাদের তত্ত্বে আগে ঠিক করে যেটা তত্ত্বায়িত হয়নি সেটা কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো কিছু আলোচনায় তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে প্রকৃতিরও একটা ধারণ করার সীমারেখা কিন্তু সত্যিই থাকে এবং সেই সীমারেখাকে উল্লঙ্ঘন করলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। ফলে, আমাদের ধরে নিতে হবে যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রকৃতির ওপর যে চাপ আসে, তাকেও নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু এই যুক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিক থেকে আসছে। এটা অর্থসংকটকে লুকিয়ে রাখার অজুহাত হিসেবে উঠে আসছে না। তাহলে নিয়ন্ত্রণ যদি করতেই হয়, তা কিভাবে করা উচিত? নিয়ন্ত্রণ করার উপায়ই হচ্ছে সামাজিক উত্তোলন অর্থাৎ একটা সমাজকে অর্থ সংকট থেকে মুক্ত করে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে কর্মমুখী করতে হবে; খেটে খাওয়ার প্রবণতা সমাজে তৈরি করতে হবে, পরিবারপিছু খাদ্য বন্টন বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক কর্মসংস্থানের পরিকল্পনার ফলে যত মানুষ কর্মমুখী হবে তত স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে চেতনার বিকাশ হবে যা তার সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে মানসিক পরিবর্তন ঘটাবে। সেখানে নির্দিষ্টভাবে আইন করে দুই না তিন সন্তান নীতি অবৈজ্ঞানিকভাবে চাপিয়ে দিতে লাগবে না। মানুষ নিজের ধারণের এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করেই তার সন্তান প্রসবের কথা ভাবতে থাকবে। ফলে এটা একটা সমাজতান্ত্রিক পরোক্ষ পদ্ধতি। প্রত্যক্ষ বুর্জোয়া পদ্ধতি সবসময় অত্যাচারী এবং মানুষকে হত্যা করার প্রবণতার দিকে এগোয়। পরোক্ষ প্রবণতা হচ্ছে খেটে খাওবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে তার সামাজিক উত্তোলনের ফলে মানুষের কাছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে কৃষ্টির সময় বাড়বে। পরিবারের কাছেও তার নিজের অর্থনৈতিকভাবে ধারণ করার সক্ষমতার ধারণা সুস্পষ্ট হবে। সেই অনুযায়ী সে তার পরবর্তী প্রজন্মের সংখ্যা সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করবে। তৃতীয় দিক হল লিঙ্গগত সাম্য প্রতিষ্ঠা, যেখানে দম্পতির মধ্যে পুরুষ এবং নারী উভয়েই সন্তান ধারণ বিষয়ক সিদ্ধান্ত পরস্পরের সাথে আলোচনা করে ঠিক করতে পারবে। চতুর্থত, আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষজন কৃষ্টির সময় যদি না পায় অর্থাৎ শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম এবং আট ঘন্টা কৃষ্টির সময় বা গঠনমূলক সময় কাটানোর যে দাবি, তা যদি সঠিকভাবে বলবৎ না হয়, তাহলে তা বৃহৎ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় কারণ গরীব মানুষের কাছে যৌনতা একটা জীবনের সাংস্কৃতিক অভাবের পরিপূরক হয়ে ওঠে।
Comments
Post a Comment