প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলন - এক লেনিনীয় উত্তরাধিকার

শংকর 


বৈকাল হৃদ। রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল। পূবে তাকালে দেখা যাবে ৬ লক্ষ একর বিস্তৃত বিশাল বারগুঝেনস্কি ঝাপোভেদনিক। সোভিয়েত জমানায় যার সূত্রপাত। ঝাপোভেদনিক --- বিস্তৃত ভূভাগ, যেখানে রক্ষণাবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়া মানুষের প্রবেশ নিষেধ। প্রকৃতির মুক্তাঞ্চল। প্রকৃতির উপর মানুষের যে তান্ডব চলল গত কয়েক হাজার বছরে, তা থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করার শেষ মরীয়া সংগ্রাম। 

কমিউনিষ্টদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি প্রায়শই উত্থাপন করা হয়, এবং ফলে যা ক্রমশ জনপ্রিয় অথচ ভিত্তীহীন, তার মধ্যে অন্যতম হল কমিউনিষ্টরা প্রকৃতির ধ্বংসের বিরুদ্ধে মুখ খোলে না। প্রকৃতিকে রক্ষা করার কোনো শিক্ষাই নাকি মার্কসবাদে নেই। নির্বিচার "উন্নয়ন"-এর ধাক্কায় আজ যে মানবসভ্যতাই বিলুপ্তির পথে তা নিয়ে কমিউনিষ্টদের কোনো মাথাব্যাথা নেই, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। অথচ বাস্তবটা একেবারেই অন্যরকম। 

সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায় যখন মার্কসবাদ বদহজম হয়ে গেছে এমন বহু বামকর্মীই মনে করেন যে, তাঁদের কাজ বোধহয় শুধু মানুষ নিয়ে। নির্দিষ্ট করে বললে, মানব নিয়ে নয়, একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে, শ্রেণি বা শ্রমিকশ্রেণি! বাকি সব চুলোয় যাক। মানব, মানবসভ্যতা, প্রকৃতি-পরিবেশ সব চুলোয় যাক। শুধু শ্রেণি দীর্ঘজীবি হোক! এইভাবে তাঁরা না বোঝেন শ্রেণি, না বোঝেন মানুষ, সর্বোপরি না বোঝেন মার্কসবাদ। একটা রিডাকশনিস্ট অ্যাপ্রোচ থেকে তাঁরা মার্কসবাদকে 'বামন অবতার'-এ পর্যবসিত করে একটা মহান মতবাদকে একটা কিম্ভুত কিমাকার বিষয় বানিয়ে তোলেন। প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে চেঁচানোটা তাঁরা স্বচ্ছন্দে ছেড়ে দিয়েছেন বুর্জোয়া লিবারাল, আর যে পুঁজিপতিরা প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায় শুধু শ্রম নয়, প্রকৃতির নির্মম শোষণের মধ্যে দিয়ে স্ফীত করে তোলে সুপার প্রফিট, তারই টুকরো টাকরায় প্রতিপালিত NGO-গুলির উপর। ফলে তৈরি হয়েছে এক বিচিত্র পরিস্থিতি। 

এই বিচিত্র পরিস্থিতি তাই দাবি করে রাশিয়ায় বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রকৃতির সংরক্ষণ ও রক্ষার যে বিরাট উদ্যোগ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে শুরু হল, সেই ঝাপোভেদনিক আন্দোলনের দিকে সংক্ষেপে এক ঝলক ফিরে তাকাবার। 

ঝাপোভেদনিক কথাটা এসেছে 'ঝাপোভেদ' থেকে, যার অর্থ হল ধর্মীয় আদেশ। বিংশ শতকের শুরুতে রাশিয়ান খ্রীষ্টান পাদ্রীরা মানুষকে গাছ না কাটার যে শিক্ষা দিতেন তা কালক্রমে ধর্মীয় আদেশ বা ঝাপোভেদের চেহারা নেয়। 'তোমরা কাটবে না' (Thou shalt not cut)। সেদিক থেকে দেখতে গেলে প্রকৃতি সংরক্ষণের এই আন্দোলনটা শুরু করেছিলেন তাঁরাই। কিন্তু রাশিয়ায় বিপ্লবের পর এই আন্দোলন বিরাট চেহারা নেয় যার নেতৃত্বে ছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন। লেনিনের দেহরক্ষী প্যাভেল ম্যালকভ তাঁর স্মৃতিচারণায় লেনিনের প্রকৃতিপ্রেম নিয়ে একটা মজাদার গল্প শুনিয়েছিলেন। মস্কোর শহরতলীতে বড় বড় জলাশয়গুলিতে প্রচুর মাছ থাকত। একদিন ম্যালকভ এবং লেনিনের খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কমরেড মাছ ধরতে যান। তারপর কী হল তা ম্যালকভের জবানীতে শোনা যাকঃ

"১৯১৮ সালের গ্রীষ্মকালে আমি, দেমিয়ান বেদনী এবং ইভান স্কভর্টসভ (স্টেপানভ) মাছ ধরতে যাবো বলে ঠিক করি। সে যা মাছ ধরলাম! সত্যি কথা বলতে কি, মাছ যাতে ধরা পড়ে তার জন্য মাছকে মুর্ছিত করতে গ্রেনেড জাতীয় ছোট বোমার ব্যবহার করি। স্বভাবতই আমরা প্রচুর মাছ ধরি। ফিরে এসে আমরা লেনিন-সহ দু' একজন কমরেডকে কিছু মাছ দিই। মাছ নেওয়ার বিষয়ে কনস্ট্যানটিনভা খুবই আপত্তি জানালেও আমি তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হই। তাঁকে ব্যাখ্যা করি এটা কেনা মাছ নয়, আমি নিজে ধরেছি। তবে কিভাবে ধরেছি সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা তাঁর মাথায় আসে নি। একদিন পার হয়েছে। ঠিক তার পরের দিন। ডোমিয়ান বেদনী বাড়িতে কাজ করছিলেন এমন সময়ে তাঁর টেলিফোন বেজে ওঠে। 'আপনি এবং ম্যালকভ কি শুরু করেছেন?' লেনিন জিজ্ঞাসা করেন। 'আপনারা তো অনধিকার চর্চা করেছেন আমি বলবো। এ ধরণের কাজের জন্য আপনাদের দুজনকেই জেলে পুরবো'।"

সেবার এই কমরেডরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে লেনিনকে শান্ত করতে পেরেছিলেন। এহেন লেনিনের কাছে ১৯১৯ সালে নিকোলাই পোদিয়াপোলস্কি নামের একজন তরুন কৃষিবিজ্ঞানী এসে উপস্থিত হন। তিনি সাইবেরিয়া অঞ্চলে একটা নতুন ঝাপোভেদনিকের অনুমোদনের দাবি নিয়ে এসেছিলেন। মনে তাঁর প্রবল ভয়, দ্বিধা এবং সন্দেহ ছিল। কারণ সেই সময়ে দেশ সংকটে জর্জরিত। গোটা শিল্পব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ১৬-টি পুঁজিতান্ত্রিক দেশ রাশিয়াকে অবরোধ করে রেখেছে। কেউই রাশিয়ার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে না। কলচাক আর দেনিকিনের সাথে গৃহযুদ্ধ তখনও শেষ হয় নি। এমতাবস্থায় গৃহযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনই ছিল বিপ্লবী সরকারের কাছে প্রধান বিষয়। জীবন-মরণ লড়াই। এই সময়ে কি না আবার একটা নতুন ঝাপোভেদনিকের জন্য আবেদন! এর অর্থ ছিল একটা বড় ভূভাগকে অর্থনৈতিক-মিলিটারি সহ সমস্ত রকম মনুষ্য হস্তক্ষেপের বাইরে নিয়ে যাওয়া। লেনিন কি সম্মত হবেন, নাকি ভর্ৎসনা করে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। এই সংশয় পোদিয়াপোলস্কির মনে প্রবলভাবেই ছিল।

কিন্তু পোদিয়াপোলস্কিকে অবাক করে লেনিন শুধু মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনলেনই না, সেই ঝাপোভেদনিকের অনুমোদন দিলেন। এবং তার দু' বছরের মধ্যে, ১৯২১ সালে, ঝাপোভেদনিক সংক্রান্ত ডিক্রি পাশ করলেন সোভিয়েতে। এই ডিক্রি "On the Protection of Monuments of Nature, Gardens, and Parks" নামে পরিচিত। এখানে ঝাপোভেদনিক নিয়ে বিস্তারিত নিয়মাবলী স্থিরীকৃত হয়। এর পরেই একের পর এক ঝাপোভেদনিক গঠিত হতে থাকে সারা রাশিয়ায়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তৈরি হতে থাকে "কমিউনিষ্ট পরিবেশযোদ্ধা" দল। দেখতে দেখতে রাশিয়ার বিরাট অঞ্চল ঝাপোভেদনিকের আওতায় চলে আসতে থাকে। প্রায় ৩০ মিলিয়ন একর। ১২৮-টি ঝাপোভেদনিক তৈরি হয়ে যায়। 

১৯৪০-এর দশকে ঝাপোভেদনিক সংক্রান্ত সোভিয়েত নীতিতে কিছু বদল লক্ষ্য করা যায়। আমেরিকাকে ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঘোষণা করে ঝটতি শিল্পায়নের তাগিদে একের পর এক ঝাপোভেদনিক বাতিল করা হতে থাকে। দ্রুতহারে কমে যেতে থাকে তাদের সংখ্যা এবং তাদের অধীনে থাকা ভূভাগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে পড়ে। যুদ্ধ পার করেও পরিস্থিতির যে খুব একটা উন্নতি হল এমন নয়। খ্রুশ্চেভের সময়েও তথাকথিত "উন্নয়ন" এবং সামরিক প্রয়োজনের উপর দেশের প্রধান মনোযোগ বহাল রইল। কিন্তু এই সময়ে বিজ্ঞানী, ছাত্র এবং সচেতন মানুষজন ছিলেন অনেক সংগঠিত। ফলে সরকারী নীতির বিরুদ্ধে শুরু হল এক দীর্ঘস্থায়ী লড়াই। 

কিন্তু ইতিমধ্যে মার্কসবাদী ধ্যানধারণায় বেশ কিছুটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। প্রকৃতি-পরিবেশের প্রশ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে অর্থনৈতিক এবং মিলিটারি বিষয়কেই মার্কসবাদীরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শুরু করেছেন। লেনিনীয় উত্তরাধিকার অনেকাংশেই বর্জিত হয়েছে। বুর্জোয়া উন্নয়নের গতিপথ (Trajectory) থেকে কমিউনিষ্ট উন্নয়নের গতিপথ, ধারণা এবং দর্শনকে পৃথক করে গড়ে তোলার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তার অপমৃত্যু ঘটেছে। ফলে ঝাপোভেদিনিকের লড়াইটা আর কমিউনিষ্টদের হাতে থাকে নি। ফলে এই নেতৃত্ব ফের আধ্যাত্মিক দর্শনের অনুগামীদের হাতে চলে যায়। ১৯৮০-এর দশকে এই লড়াই সাফল্যের সাথে একের পর এক ঝাপোভেদনিকের দাবি আদায় করে নিতে থাকে। ফলে আবার বাড়তে শুরু করে তাদের সংখ্যা। কিন্তু এবার এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে শুরু করে এমন ছাত্ররা যারা নিজেদের পরিচয় দেয় "দ্রুঝিনা" বলে। মধ্যযুগে যে খ্রীষ্টান যোদ্ধারা বহিরাগত আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ভূমি এবং ধর্ম রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ করেছিল তারাই দ্রুঝিনা নামে পরিচিত। ১৯৮০-এর দশকে অত্যন্ত দ্রুত ১৪০-টি দ্রুঝিনা বাহিনী বা স্কোয়াড তৈরি হয়ে যায় যারা সোভিয়েত পরবর্তী জমানাতেও সমান সক্রিয়। কিন্তু সোভিয়েত পরবর্তী জমানাতে ঝাপোভেদনিক নীতিতে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন ঘটানো হয়। আমেরিকার সংরক্ষিত অঞ্চলগুলির আদলে এখানেও ইকোটুরিজমের নামে যথেচ্ছ বিনোদনের ব্যবস্থা শুরু হয়। নামে ঝাপোভেদনিক থাকলেও লেনিনীয় ঝাপোভেদনিকের সঙ্গে তার গুণগত পার্থক্য রয়েছে। 

বর্তমান জলবায়ু সংকটের এই বিশ্বে আমাদের ফের একবার প্রকৃতি ও মানবের সম্পর্ক বিষয়ে মার্কসবাদ লেনিনবাদের বুনিয়াদী শিক্ষাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। কাঁধে তুলে নিতে হবে লেনিনীয় উত্তরাধিকারের গৌরবময় পতাকা।

কমঃ শংকর দাস সিপিআই(এম.এল)-রেড স্টারের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নেতৃত্ব।

Picture Courtesy: http://www.strebeigh.com/russian-nature-saviors-lenins-eco-warriors-new-york-times-2017.html

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার