কলম্বিয়ায় জয়ী বামপন্থী পেট্রো: নয়াউদারবাদ কি বিপদে?

সুরজিত মন্ডল


গত ১৯শে জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফলে যেটা লক্ষ্য করা গেল, কলম্বিয়াতে এই প্রথমবার কোন বামপন্থী প্রার্থী জয়ী হলেন, তাও আবার এত বিপুল শতাংশ ভোটে (প্রায় ৫০ শতাংশের একটু বেশি); প্রার্থীর নাম গুস্তাভো পেট্রো। তিনি ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বোগোটা শহরের মেয়র ছিলেন। এই বোগোটা শহরে ক্ষমতাধীন হওয়াটা কলম্বিয়ার রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ বোগোটাতে কেউ মহানাগরিক নির্বাচিত হলে পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচন বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পার্টিগত ফলাফল ভালো হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। এখন এই গুস্তাভো পেট্রোর সম্পর্কে জানাটা আমাদের এই কারনে জরুরি যে কলম্বিয়ার মতো একটি দেশে এই প্রথম বার কোনো বামপন্থী প্রার্থী নির্বাচিত হলেন।

গুস্তাভো পেট্রো ১৯৭৪ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত M-19 নামক একটি সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। M-19 নামটি আসছে 19th of April Movement থেকে। আসলে এরা একটি গেরিলা বাহিনী। ১৯৭০ সালের ১৯শে এপ্রিল যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হচ্ছিল তখন একটা বড় সমস্যা দেখা দেয়। আসলে কলম্বিয়াতে ১৯৫৩-৫৮ সাল অব্দি সামরিক শাসন চলেছিল। এই সামরিক শাসনের সমাপ্তির পরে দুটি প্রধান ডানপন্থী পার্টি কনজারভেটিভ পার্টি ও লিবারাল পার্টি নিজেদের মধ্যে একটা চুক্তি করে যে, সংসদে তারা পরস্পরের মধ্যে ৫০ শতাংশ করে আসন ভাগ করে নেবে, প্রতিটা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একবার কনজারভেটিভ এবং পরের বার লিবারাল প্রার্থী জয়ী হবে এবং যে বছর কনজারভেটিভদের জয়ী হওয়ার কথা সেবার কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যেকার একাধিক ব্যাক্তি প্রার্থী পদের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং পরের বছর লিবারালদের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া চলবে। এই রকম একটা চুক্তির বলে ডানপন্থী পার্টিগুলি ক্ষমতাধীন হচ্ছিল। এদের বলা হত ন্যাশনাল ফ্রন্ট। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় দেখা যায় যে কিছু উদারপন্থী ও কিছু ডানপন্থীদের সাথে কিছু বামপন্থীদের একটা জোট হয়েছে এই ন্যাশনাল ফ্রন্ট-এর বিরোধীতা করার জন্য এবং যেটা একটু হাস্যকর বা চিন্তার বিষয় সেটা হল, এই ন্যাশনাল ফ্রন্ট-এর বিরোধীতা করতে গিয়ে পিনিলা নামক এক সেনা অধ্যক্ষ যিনি সামরিক অভ্যুত্থানের সময় একনায়ক হিসেবে শাসন করেছিলেন, তাকেই নিজেদের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই জোটের নাম দেওয়া হয় ANAPO বা ন্যাশনাল পপুলার অ্যালায়েন্স। নির্বাচনের ফলাফলে এটা লক্ষনীয় হয়ে ওঠে যে মিশায়েল পাস্ত্রানা, যে ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রার্থী ছিল, তার সাথে পিনিলা, যে ANAPO জোটের প্রার্থী, তাদের মধ্যেকার ভোট সংখ্যায় মাত্র ১ শতাংশের পার্থক্য ছিল। এই সময় বেশ কিছু বিদ্রোহী অভিযোগ তোলে যে নির্বাচনে কোথাও কারচুপি করা হয়েছে পাস্ত্রানাকে জয়ী করার জন্য। বেশকিছু বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তারা মূলত জাতীয়তাবাদের কথাই বলেছিল এবং একইসাথে সারা দেশে সামরিক শাসন পরবর্তী পরিস্থিতিতে যাতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় তা সুনিশ্চিত করার কথা বলেছিল। 

একটা বিষয় এখানে লক্ষণীয়। বর্তমানে যেমন বামপন্থীরা আমাদের দেশের কেন্দ্র সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে এমন একজন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে তুলে ধরছে যে নিজেই প্রাক্তন গেরুয়া সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিল, তেমনই এই কনজারভেটিভ এবং লিবারাল পার্টির মধ্যেকার ভোটগত সন্ধি পরাজিত করার জন্য কলম্বিয়াতেও একই প্রবণতা দেখা যায় যখন বামপন্থীরা ডানপন্থীদের সাথে হাত মিলিয়ে একজন প্রাক্তন সামরিক একনায়ককে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল! 

এই M-19 উরুগুয়ের তুপেমারোস এবং আর্জেন্টিনার মন্টেনেরোস অভ্যুত্থানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঝামেলার ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের যে পরিস্থিতি সারা বিশ্ব জুড়ে তৈরি হয়, তার প্রভাব কলম্বিয়াতে এসে পড়েছিল। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা এবং কলম্বিয়ার বেশকিছু ড্রাগ ব্যবসায়ী, আঞ্চলিক মাফিয়া ও প্যারামিলিটারি পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় প্রচুর গেরিলা বাহিনী কলম্বিয়াতে তৈরি হয় যারা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল এবং এর ফলে একটা গৃহ যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যেটা লক্ষ্য করা যায় যে দেশের সর্ববৃহৎ গেরিলা বাহিনী হল FARC বা রেভলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অফ কলম্বিয়া। FARC-এর পর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ গেরিলা বাহিনী ছিল M-19। এই M-19-এই ১৯৭৪ থেকে ১৯৯০ সাল অব্দি গুস্তাভো পেট্রো সদস্য ছিলেন। M-19-এর সদস্যদের বারংবার ড্রাপ মাফিয়া ও বিভিন্ন প্যারামিলিটারি আক্রমণ করেছে এবং অনেককে খুনও করেছে। ১৯৮০-র দশকে সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে সরে এসে M-19 আসতে আসতে নির্বাচনে ঢুকতে শুরু করে এবং ১৯৯০-এর দশকে তারা বেশ ভালো ফলাফলও করেছিল সংসদে। তখন এই পার্টির নাম হয় M-19 ডেমক্রাটিক অ্যালায়েন্স। M-19-এর প্রধান গেরিলা নেতা কার্লোস পিজারোকে ড্রাগ মাফিয়ারা খুন করে। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আরেকজন গেরিলা নেতা অ্যান্টোনিও নাভারো উলফ M-19-এর প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৯১ সালে যে আধুনিক সংবিধান তৈরি হয় কলম্বিয়ার তা তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠিত কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির তিনজন সহ-সভাপতির মধ্যে একজন ছিলেন অ্যান্টোনিও নাভারো। এই ইতিহাস M-19-এর রয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে অল্টারনেটিভ ওয়ে নামে একটা পার্টি তৈরি করেন গুস্তাভো পেট্রো এবং অ্যান্টোনিও নাভারো উলফ। এই দল পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচনে একটা মাত্র আসনে জয়লাভ করে। এরপর ২০০২ সালে রিজিওনাল ইন্টিগ্রেশান মুভমেন্ট নামে একটি পার্টি তৈরি করা হয় যারা পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচনে একটা আসন এবং বিধানসভা নির্বাচনে চারটে আসন পায়। অর্থাৎ ভালো ফল করেছিল তা বলা যায় না। এরপর ২০০৪ সালে গুস্তাভো পেট্রো চলে আসেন অল্টারনেটিভ ডেমক্রাটিক পোল পার্টিতে। এই পার্টি মূলত সোশ্যাল ডেমোক্রাসির মতধারাকে তুলে ধরেছিল। খুব নির্দিষ্ট মতাদর্শ এই দলে ছিল না বললেই চলে। মূলগতভাবে এরা ছিল নয়াউদারবাদের বিরোধী। এই অল্টারনেটিভ ডেমক্রাটিক পোল ব্রাজিলের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বে তৈরি সাও পাওলো ফোরাম-এর সদস্য ছিল। উল্লেখ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আজও এমন কার্যকরী আন্তর্জাতিকতাবাদী মঞ্চ বামপন্থীরা তৈরি করে উঠতে পারেনি। ২০১০ সালে বেশকিছু মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে এই দল থেকে পেট্রো সরে দাঁড়ান এবং ২০১১ সালে হিউমেন কলম্বিয়া নামে একটি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মূলত একটি লেফট পপুলিস্ট পার্টি। এই পার্টি মোটের উপর বাম মতধারার কিন্তু কোনো বিশেষ আদর্শগত অবস্থান এদের নেই। মূলগতভাবে নয়াউদারবাদের বিরোধীতা করা এদের লক্ষ্য। ২০২২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় হিস্টরিক প্যাক্ট নামে জোট তৈরি হয়। এই জোটের মধ্যে  বেশ কিছু বামপন্থী পার্টি ছিল: গুস্তাভো পেট্রোর হিউমেন কলম্বিয়া, অল্টারনেটিভ ডেমক্রাটিক পোল, ইন্ডিজিনাস অথরিটিজ অফ কলম্বিয়া (এরা কলম্বিয়ার আদিবাসীদের সংগঠিত করেছিল), কমিউনিস্ট পার্টি, কমোন্স, FARC, প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন প্রভৃতি। 

এই ধরনের বেশকিছু বামপন্থী দলের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ এবং ভারতীয় ইতিহাসের সঙ্গে কোথাও একটা মিলও রয়েছে। কলম্বিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র শাখা ছিল FARC। ১৯৮০-র দশকে এই FARC এবং কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কমিউনিস্ট পার্টি বেশি করে সোভিয়েতপন্থী হয়ে উঠেছিল এবং FARC খুব ঘোষিতভাবে চীনপন্থী না হলেও সোভিয়েতের রাজনৈতিক লাইনের বিরোধিতা করছিল। অর্থাৎ অনেকটা আমাদের দেশের CPI(M) পার্টির মতো, যদিও তেলেঙ্গানা আন্দোলন ছাড়া ভারতে দুই আদি কমিউনিস্ট পার্টিতে কোনো সামরিক শাখা বিশেষ আর তৈরি হয়নি। কিন্তু FARC নিজে একটি গেরিলা বাহিনী ছিল। এখানেই ভারতের CPI ও CPI(M)-এর সাথে কলম্বিয়ার FARC-এর একটা পার্থক্য রয়েছে।

FARC-এর একটা অংশ কমোন্স নামে একটা পার্টি পরবর্তীতে তৈরি করে। আবার কমিউনিস্ট পার্টি এবং FARC উভয়েরই কিছু সদস্যরা বেরিয়ে এসে প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন নামে একটি দল তৈরি করে যারা মার্কস পরবর্তী সমাজতন্ত্রের মতধারায় বিশ্বাসী। FARC-কে মার্কসবাদী, লেনিনবাদী বলা যেতে পারে। তারা কৃষি অভ্যুত্থানে বেশি জোর দিয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছিল, চে গেভারার মতধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল এবং দেশের বেশকিছু জায়গায় মুক্তাঞ্চলও প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিল যদিও সেগুলো পরবর্তীতে টেকেনি। অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে বিচ্ছেদের পরবর্তীতে এরা মাওবাদী চরমপন্থার দিকে কিছুটা ঝুঁকেছিল। এই ধরনের একটা ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ইতিহাস কলম্বিয়াতে থেকেছে যদিও তাদের আবার বেশকিছু পার্থক্যও দেখা গেছে। 

এখন যেটা মূল প্রশ্ন তা হল, আমরা পেট্রোকে  নিয়ে আলোচনা করছি কেন? আমরা গুস্তাভো পেট্রোকে নিয়ে আলোচনা করছি এই কারণে যে তিনি দেশের প্রথম একজন বামপন্থী প্রার্থী যিনি রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী হয়েছেন। এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ কারণ কলম্বিয়া এমন একটা দেশ যার পূর্বতন শাসকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দালালি করে এসছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে গুস্তাভো পেট্রো কি ধরনের রাজনীতি করতে চাইছেন সে বিষয় কয়েকটা কথা একটু বলা দরকার। প্রথমত, এই নির্বাচনে গুস্তাভো পেট্রো ডানপন্থীদের যে প্রার্থীকে হারিয়েছেন সে আসলে একজন বিখ্যাত কনস্ট্রাকশন ম্যাগনেট। নাম রোডলফো হার্নান্ডেজ। দ্বিতীয়ত লক্ষণীয়, পেট্রো বলেছেন যে তিনি নতুন করে আর কোন তেল উত্তোলনের প্রজেক্টে সই করবেন না কিন্তু তাঁর ক্ষমতাধীন হওয়ার আগে যে কন্ট্রাক্টগুলো সই করা আছে সেগুলো কার্যকরীই থাকবে। এই অবস্থানের ক্ষেত্রে সমস্যাটা হচ্ছে যে বিভিন্ন তৈল উত্তোলনকারী সংস্থা, যাদের মধ্যে প্রধান হল ক্যানাকল, তাদের কিন্তু আগামী ৪ বছরের জন্য তেল উত্তোলনের একটি কন্ট্রাক্ট সই করাই আছে। তৃতীয়ত, পেট্রো যে জনমোহিনী অবস্থান নিয়েছেন তা হল অর্থবানদের উপর কর চাপানোর পরিকল্পনা। এখন ক্ষমতায় এসে তিনি সেটা কতটা করতে পারবেন সেটা দেখার বিষয়। চতুর্থ বিষয়, পেট্রো নিজের মন্ত্রিসভায় যে অর্থমন্ত্রী আনতে চাইছেন তার জন্য যে সম্ভাব্য নামের তালিকা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে যারা রয়েছে, তারা সবাই কিন্তু মধ্যপন্থী। এদের মধ্যে রয়েছে আলেহান্দ্রো গ্রাভিনা, রুডলফ হোমস এবং হোসে অ্যান্টোনিও ওকাম্পো। এটা চিন্তার বিষয় কারণ অর্থমন্ত্রী তো আসলে পুরো সরকারটা চালায় এবং সে-ই যদি মধ্যপন্থী হয় তাহলে সাধারণত এই প্রবণতাই দেখা যায় যে অল্প কিছুদিন কিছু বামঘেঁষা কথাবার্তা বলার পরে আদতে একটা ডানপন্থী মতধারাতেই কিন্তু সরকারটা চলতে থাকে। পঞ্চম, কলম্বিয়ার যে সর্ববৃহৎ কোম্পানি ইকো পেট্রোল, তাকে বায়ুশক্তি এবং সৌরশক্তি সৃষ্টিকারী সংস্থাতে পরিণত করার একটা পরিকল্পনা পেট্রো রেখেছেন এবং ব্যাঙ্কগুলিতে ইন্টারেস্ট রেট কমানোর একটা পরিকল্পনা তাঁর আছে। ষষ্ঠত, দেশের সকল নাগরিক যারা মাসে হাজার ডলারের চেয়ে কম রোজগার করে তাদের একটা পেনশনের ব্যবস্থা করারও বক্তব্য পেট্রো রেখেছেন। লক্ষণীয়, হাজার ডলারের স্ল্যাবটা এতটাই বড় যে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। সপ্তম, পেট্রো সম্পর্কে বলতে গেলে এটাও লক্ষনীয় যে যখন তিনি বোগোটা শহরের মহানাগরিক ছিলেন তখন তিনি শহরের বিভিন্ন বস্তি এলাকার উন্নয়নের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। 

পেট্রো যে একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের কথা বারংবার বলছেন, তাতে কতটা তিনি সফল হন সেটা আমাদের দেখতে হবে। তাঁর সাফল্যের পেছনে যে বাধা আসতে পারে তার একটা প্রধান দিক হচ্ছে যে সংসদ এই মুহূর্তে বিভিন্ন ডানপন্থী এবং বামপন্থী পার্টির দ্বারা বিভক্ত, যার ফলে একটা বিরাট বড় জোটকে কার্যকর করে কোন র‍্যাডিকাল অবস্থান নেওয়া তাঁর পক্ষে কতটা সম্ভব সেটা একটা দেখার বিষয় অবশ্যই আছে। কিন্তু একই সাথে আমাদেরকে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে বহুদিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের ল্যাটিন আমেরিকার ভরকেন্দ্র কলম্বিয়াতে বামপন্থীরা জিতেছে। ফলে এই বিষয়টি খুব ছোট করে দেখার বিষয় নয়। এর কারণ হচ্ছে আমরা যদি পূর্বতন যে সকল রাষ্ট্রপতি এসেছে কলম্বিয়াতে তাদের কিছু জনের কথা একটু তুলে ধরি তাহলে সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। আন্দ্রেস পাস্ত্রানা রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন FARC গেরিলা গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝতায় আসার বহু চেষ্টা করেন আবার একইসাথে তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বামপন্থীদেরকে দেশ থেকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে প্ল্যান কলম্বিয়া নামে একটি প্রোটোকলও প্রণয়ন করেন। পরবর্তীতে যিনি রাষ্ট্রপতি হন, সেই আলভারো উরিবে ছিলেন মূলত আদিবাসীদের বিরুদ্ধে এবং আদিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিগুলোকে তিনি একপ্রকার দেশে আতঙ্কবাদ ছড়ানোর উপায় হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। এরপরে যিনি রাষ্ট্রপতি হন, সান্তোস কালদেরোন, তিনি বারংবার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সাথে তাঁর বিশাল দহরম মহরম ছিল। তাঁর পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ইভান ডুকুকও ছিলেন ট্রাম্পপন্থী; সর্বশেষ যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় সে সময় তিনি ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি আমাদের রাজ্যের দেউচা পাঁচামির মত ওপেন কাস্ট মাইনিং-এর পক্ষে ছিলেন এবং তাঁর সময়ে বিভিন্ন ড্রাগ মাফিয়াদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে চলেছিল দেশ জুড়ে। এই রকম একটা সামাজিক অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক অধঃপতনের পরিস্থিতিতে পেট্রো জয়ী হয়েছেন। 

গুস্তাভো পেট্রোর যে  ইতিহাস আমরা দেখলাম সেখান থেকে এটা স্পষ্ট যে তিনি যে ধরনের পার্টিগুলির মধ্যে দিয়ে কাজ করে এসেছেন, তাদের কারুরই খুব বিশেষ কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শ ছিল এমনটা নয় এবং তারা ক্ষমতায় এলে কি ধরনের কাজ করে একুশ শতকের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে সেই বিষয়ে খুব বিশেষ কোনো রুট ম্যাপ যে রয়েছে এমনটাও নয়। বারংবার তিনি গরিবদের পক্ষে বেশ কিছু কথা বলে একটা বামঘেঁষা পরিমণ্ডল তৈরি করার চেষ্টা করে এসেছেন কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে আমরা পরিবেশ রক্ষার পক্ষে যদি কথাও বলি বা নয়াউদারবাদের বিরোধীতা করেও থাকি, অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন না করে কি এই বিরোধিতা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? সেই প্রশ্ন উঠবে এবং এখান থেকেই কিন্তু পেট্রো সরকারের পরবর্তীকালে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে লক্ষ্য রেখে যেতে হবে যে কি ধরনের অবস্থান পেট্রো নেন, যেটা তাঁর দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং আশপাশের অঞ্চলের ভৌগলিক এবং রাজনৈতিক অবস্থানের দ্বারা প্রভাবিত হতে চলেছে। এর ভিত্তিতেই আমরা পেট্রোকে চিহ্নিত করতে পারব, যে তিনি কতটা গরীবদের পক্ষে অবস্থান নিতে পারেন, নাকি তাঁকে ডানপন্থীরা ব্যবহার করছে সাময়িকভাবে জনগণের রোষকে স্তিমিত করার জন্য...

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার