দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু ও ইংরেজ রাজপরিবারের বাস্তব রূপ

অদ্রিরাজ তালুকদার

প্রয়াত হয়েছেন ইংল্যান্ডের মহারাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ইংল্যান্ডের লিখিত ইতিহাসে দীর্ঘতম শাসনকাল তার। তার মৃত্যুতে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ দয়াময়ী রাণীর জন্য শোকপ্রকাশ করছেন কেউ আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক ইতিহাস। ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্র নিয়মতান্ত্রিক। নির্বাচিত সংসদই ইংল্যান্ডের প্রধান শাসকশক্তি৷ কিন্তু রাজপরিবার যে ক্ষমতা উপভোগ করে তা কি শুধুই নিয়মতান্ত্রিক রীতি-আচারে সীমাবদ্ধ? সেটা বোঝার জন্য আমাদের একটু ইতিহাসে ফিরতে হবে।

১৬৮৮তে ইংল্যান্ডে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়। এই বিপ্লবের প্রথম সারিতে ছিল ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, প্রতিবাদী পূর্বতন সামন্তপ্রভুসহ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষও। কিন্তু এই বিপ্লব শেষ হয় 'গণতান্ত্রিক' শক্তির সাথে রাজতন্ত্রের একটা সমঝোতার মধ্য দিয়ে। সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষ হয়। কিন্তু একই সাথে নিজেদের বিশাল সম্পত্তি ও রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখার সুযোগ পায় রাজতন্ত্র ও পূর্বতন সামন্তপ্রভুরা। নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যেও তারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে। সংসদে নেওয়া যে কোনো সিদ্ধান্ত রাজা বা রাণীর সই ছাড়া আইনে পরিণত হয় না। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য এমন একটা ছবিই তৈরি করে থাকে যে রাজপরিবার নিরপেক্ষ এবং রাজনীতিতে তারা অনুপ্রবেশ করেন না। কিন্তু এর আগেও, এবং রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সময়কালেও রাজপরিবারের দ্বিচারী ভূমিকা আমরা দেখেছি। 

এই রাণীর শাসনকালে ইংল্যান্ড ৩০টির বেশি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে যেই যুদ্ধগুলিতে মূলত বিদ্যমান বা অতীতের উপনিবেশ দেশে ইংল্যান্ড আক্রমণকারীর ভূমিকায় ছিল। মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশ আক্রমণ করার সবুজ সংকেত দেন রাণী তার শাসনকালে। এছাড়াও ব্রিটিশ রাজের অতীতের ঔপনিবেশিক কালো ইতিহাসের জন্য ক্ষমা চাইতেও অস্বীকার করেন রাণী। তার মধে উল্লেখ্য ভারতে এসে রাণী এলিজাবেথ ঘুরে গেছেন জালিয়ানওয়ালাবাগ। কিন্তু সেই জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারি ক্ষমা তিনি চান নি। শুধু তাই নয়, কমনওয়েলথের শীর্ষনেতৃত্ব বলে বিবেচিত হন ইংল্যান্ডের রাণী বা রাজা। বস্তুত স্বাধীন কমনওয়েলথ দেশগুলো কিন্তু এখনও সেই কমনওয়েলথকে সেলামী পাঠান 'দীর্ঘকালীন সুসম্পর্কের' খাতিরে। তাই ভারত এবং বাংলাদেশও রাণীর মৃত্যুতে শোকদিবস পালনের কথা ঘোষণা করেছে। তার কারণ হয়তো অতীতে ব্রিটিশ শাসক ও এই দেশের শাসকশ্রেণীর সমঝোতা - স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী চরিত্র দেখে ব্রিটিশ শাসক ১৯৪৭-এ তড়িঘড়ি ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নয়। ক্ষমতা হস্তান্তর হয় ব্রিটিশ পুঁজিবাদী শ্রেণী থেকে ভারতীয় জমিদার-পুঁজিপতিদের হাতে। এই শোকপালন হয়তো সেই পুরোনো সমঝোতার প্রতি বিশেষ ভঙ্গি।

শুধু আন্তর্জাতিক বিষয়েই নয়। দেশের মধ্যেও রাজপরিবার বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করে। তার মধ্যে অবশ্যই তাদের চরম বিলাশবহুল জীবনযাপন, যার অর্থ আসে মানুষের দেওয়া কর থেকে। রাজা বা রাণীকে কেন্দ্র করে বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতা অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা ইংল্যান্ডের মানুষের জন্য কি লাভজনক? দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর সাথে সাথেই রাজা হন তার ছেলে চার্লস। এবার দেশের টাকায়, স্ট্যাম্পে তার প্রতিকৃতি থাকবে। তুলে নেওয়া হবে পুরোনো নোট - যা একটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া৷ 

২০১৯ সালে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় না থেকেও নিজের ব্রেক্সিট সংক্রান্ত উদ্দেশ্য সফল করতে প্রধানমন্ত্রী রাণীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন, এবং রাণীও তার কথায় সংসদ রদ করেছিলেন। রাজনীতিতে রাণীর নিরপেক্ষতা বজায় রাখার এই দৃষ্টান্ত! 

রাজপরিবারের ব্যক্তিজীবনেও কত দ্বিচারিতা রয়েছে সেটাও উল্লেখ্য। ব্রিটিশ রাজপরিবার চার্চ অফ ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত এবং গীর্জাকে তারা পরোক্ষভাবে ব্যবহার করে এসেছে নিজেদের ক্ষমতার সাফাই দিতে এবং মানুষের মনে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে। এই চার্চ অফ ইংল্যান্ড কোনো বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া ব্যাক্তির সাথে রাজপরিবারের কারুর বিবাহের অনুমোদন দেয় না। অথচ, আজ এলিজাবেথের ছেলে চার্লস রাজা হচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া ক্যামিলাকে বিবাহ করা সত্ত্বেও। পরকীয়ার অভিযোগে তার সাথে বিচ্ছেদ করে ডায়ানা স্পেন্সার বা রাজকুমারী ডায়ানা। ১৯৯৭-এ যখন ডায়ানা মারা যান, এই অভিযোগও উঠেছিল যে তাকে হত্যা করেছে রাজপরিবারই। 

এছাড়াও তৃতীয় চার্লস পরিচালিত একাধিক এনজিও অভিযুক্ত হয়েছে আর্থিক তছরুপ ও দূর্নীতির অভিযোগে। বিশাল সম্পত্তির মালিক প্রাক্তন রাজকুমার (বর্তমান রাজা) দেশ বিদেশের পুঁজিপতিদের বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে এই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাইওয়ানের কুখ্যাত ব্রুনো ওয়াং, ওসামা বিন লাদেনের তুতো ভাই বকর বিন লাদেনের সাথেও তার আদানপ্রদান ছিল।

এহেন গৌরবান্বিত রাজপরিবারের শোক ভাগ করে নিতে আপত্তি কেন থাকবে ভারত বা বাংলাদেশের সরকারের?

আমরা যারা গণতন্ত্র, মেহনতী মানুষের অধিকারের পক্ষে তথা সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে তারা রাণীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ তো দূরে, সম্পূর্ণ রাজতন্ত্রের উৎপাটন ছাড়া অন্য দাবী করতে পারি না।

Updated: 7:05pm IST; 12/09/2022

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!