কোন আপস নয়?

ভি আই লেনিন

ফ্রাঙ্কফুর্ট পুস্তিকার উদ্ধৃতি থেকে দেখা যায় “বামপন্থীরা” কত জোর দিয়ে এই স্লোগান তুলেছেন। দুঃখের বিষয় যেসব লোকেরা নিঃসন্দেহে নিজেদের মার্কসবাদী বলে মনে করেন, বা মার্কসবাদী হতে চান তাঁরাও মার্কসবাদের মূল সত্যিটি ভুলে যান। মার্কসের মতো এঙ্গেলস হচ্ছেন সেই অতি অল্প সংখ্যক লেখকদের একজন যাঁর মহৎ রচনার প্রত্যেকটি কথার একটা সুগভীর তাৎপর্য রয়েছে; তেত্রিশ জন ব্লাঁকিপন্থী কমিউনার্ডের [১] ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা করে ১৮৭৪ সালে সেই এঙ্গেলস লিখেছিলেনঃ

“ব্লাঁকিপন্থী কমিউনার্ডরা তাঁদের ঘোষণাপত্রে লিখেছেন, ‘আমরা কমিউনিস্ট,  কারণ আমরা মাঝপথে কোথাও না থেমে, কোনো আপস না করে – আমাদের লক্ষে পৌঁছতে চাই। এসব আপস বিজয়ের দিনটিকেই শুধু স্থগিত রাখে, প্রলম্বিত করে দাসত্বের যুগ’।

জার্মান কমিউনিস্টরা কমিউনিস্ট কারণ প্রত্যেকটি মাঝপথের অবস্থিতি, প্রত্যেকটি আপসের মধ্য দিয়ে তাঁরা সুস্পষ্টভাবে তাঁদের চরম লক্ষ্য অনুধাবন করে এবং সে দিকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলেন। সে লক্ষ্য হলো, শ্রেণীসমূহের বিলোপ এবং এমন একটা সমাজব্যবস্থার পত্তন করা যেখানে জমি বা উৎপাদন যন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা থাকিবে না। ঐ সব আপস – রফা তাঁদের সৃষ্ট নয়, ঐতিহাসিক বিকাশের গতিপথেই সেগুলি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ঐ তেত্রিশজন ব্লাঁকিপন্থী কমিউনিস্ট কারণ তাঁরা মনে করেন – যেহেতু তাঁরা মাঝামাঝি ব্যবস্থা আর আপস রক্ষা এড়িয়ে যেতে চান তাতেই ব্যাপারটার নিস্পত্তি হয়ে গেছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই যদি ‘ব্যাপারটা শুরু হয়’ আর একবার যদি তাঁরা ক্ষমতায় আসেন তাহলে তার পরের পর দিনই ‘কমিউনিজম প্রবর্তন করা হবে।’ একাজ অবিলম্বে করা সম্ভব না হলে তাঁরা কমিউনিস্টই নন।

“ধৈর্যহীনতাকে অকাট্য তাত্বিক যুক্তি হিসাবে উপস্থিত করার চেষ্টা কি অপরিসীম ছেলেমানুষিরই না পরিচয়।” (“ব্লাঁকিপন্থী কমিউনার্ডদের কর্মপন্থা” – এফ এঙ্গেলসঃ জার্মান সোসাল ডেমোক্রেটিক পত্রিকা “ফোকস্টাট”, ১৮৭৪। নং ৭৩, ১৮১৯ সালে পেট্রোগ্রাডে রুশ ভাষায় অনুদিত প্রবন্ধ ১৮৭১-১৮৭৫ এর সংকলন পৃঃ ৫২-৫৩”)

ওই প্রবন্ধেই এঙ্গেলস ভাইলাঁ সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন – তাঁর “অনস্বীকার্য গুনাবলীর” উল্লেখ করেছেন। (গোদের মতোই, ১৯১৪ সালে আগষ্ট  মাস পর্যন্ত ইনি ছিলেন আন্তর্জাতিক সমাজবাদের একজন বিশিষ্ট নেতা। পরে এঁরা দুজনেই  সমাজবাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। কিন্তু যা স্পষ্টই ভুল, বিশদ বিশ্লেষণ না করে তা ছেড়ে দেবার লোক এঙ্গেলস নন। বয়সে তরুন ও অনভিজ্ঞ বিপ্লবীদের কাছে আর যথেষ্ট বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ পেটি-বুর্জোয়া বিপ্লবীদের কাছে “আপস ঘটতে দেওয়া” অত্যন্ত “বিপজ্জনক” ধারণাতীত এবং ভ্রান্ত মনে হয়। অনেক কুতার্কিকরা কমরেড ল্যান্সবেরি উল্লিখিত বৃটিশ সুবিধাবাদের নেতাদের মতোই (অসাধারণ ও অতি “অভিজ্ঞ” রাজনীতিক হওয়ার) যুক্তি দেয়ঃ “বলশেভিকরা যদি কোনো প্রকার আপস করতে পারে আমরাই বা কেন যে  কোনো ধরণের আপস করতে পারব না?” অসংখ্য ধর্মঘট   (শ্রেণী সংগ্রামের শুধু এই অভিব্যক্তিকেই যদি ধরি) থেকে পাঠ গ্রহণ করে শিক্ষিত  শ্রমিকরা এঙ্গেলস ব্যাখ্যাত সুগভীর (দার্শনিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্বিক) সত্যকে সাধারণত ভালো করেই বোঝেন।  প্রত্যেকটি শ্রমিকই ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে এসেছেন, আপসের “অভিজ্ঞতা” ও তাঁদের আছে। অনেক সময় আংশিকদাবি পেয়ে বা অনেক সময় কোনো দাবি না পেয়েই ঘৃণ্য উৎপীড়ক ও শোষকের সঙ্গে আপস করে তাঁদের কাজে ফিরে যেতে হয়েছে।  গণ-সংগ্রাম ও শ্রেণী-দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধির আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা বাস করেন। তাই তাঁরা বাস্তব অবস্থার চাপে (ধর্মঘট তহবিলের বা বাইরের সমর্থনের অভাব, চরম বুভুক্ষা এবং অবসাদ) বাধা হয়ে যে আপস করতে হয়, সে আপসে আপসকারী মজুরের বিপ্লবী নিষ্ঠা ও পুনরায় সংগ্রাম করার প্রেরণা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় না তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকদের  আপসের তফাত ধরতে পারেন। নিজেদের স্বার্থপরতা, কাপরুষতা, পুঁজিবাদীদের পা-চাটার বাসনা, পুঁজিদারদের তরফের চোখরাঙানি, কখনো পীড়াপীড়ি, কখনো ঘুষ, কখনো বা তোয়াজের কাছে পোষ মানিতে রাজী হওয়া – এ সবই বিশ্বাসঘাতকরা (ধর্মঘট ভঙ্গকারী দালালেরাও “আপস” করে।) পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর চাপায়। (বৃটিশ ট্রেড ইউনিয়নের ইতিহাসে নেতাদের এই ধরণের বিশ্বাসঘাতক আপসের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে এই ধরণের ব্যাপার ঘটতে দুনিয়ার সব দেশের প্রায় সব শ্রমিকই দেখেছেন।)

কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবস্থা বিশেষ গোলমেলে ও জটিল অবস্থায় “আপসের” স্বরূপ চিনতে বিশেষ বেগ পেতে হয়। এমন বেগ তো নরহত্যার ক্ষেত্রেও পেতে হয় – কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে নরহত্যা সম্পূর্ণ সঙ্গত, এমন কি  প্রয়োজন (যথা, ন্যায়সঙ্গত আত্মরক্ষার্থে) ছিল, না অমার্জনীয় অসাবধানতার ফলে বা সুচতুর পরিকল্পনা মাফিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা নির্ধারণ করা অনেক সময় খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। অবশ্য, রাজনীতিতে বিভিন্ন শ্রেণী এবং দলের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সময় একান্ত বেশি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয় যে তার ফলে ধর্মঘটের সময়কার ন্যায্য “আপস”, না ধর্মঘট ভঙ্গকারী দালাল নেতার বিশ্বাসঘাতক “আপস” – এ ধরণের প্রশ্নের চেয়ে তার বিচার অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।  সর্বক্ষত্রে প্রযোজ্য এমন একটা সাধারন নিয়ম বা সূত্র (“আপস বরবাদ!”) আবিস্কারের চেষ্টা ভুল। নিজেদের মাথা খাটিয়ে প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে অবস্থার সঙ্গে তাল রাখতে হবে। আসলে এই হলো পার্টি সংগঠন ও সুযোগ্য পার্টির নেতাদের অন্যতম কাজ। অর্থাৎ একটা বিশেষ শ্রেণীর চিন্তাশীল* প্রতিনিধিবৃন্দের দীর্ঘস্থায়ী, অবিরাম, বহুবিধ ও সর্বব্যাপী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জন – শুধু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই নয়, জটিল রাজনৈতিক সমস্যার দ্রুত এবং সঠিক সমাধানে পৌঁছবার মতো রাজনৈতিক বোধ আয়ত্ত করা। 

অতরিক্ত মাত্রায় সরল ও সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ লোকরাই মনে করেন, সুবিধাবাদ, যার বিরুদ্ধে আমরা আপসহীন  লড়াই চালাই, চালাবও তার সঙ্গে আর বিপ্লবী মার্কসবাদ বা কমিউনিজমের মধ্যেকার সীমারেখা মুছে ফেলার পক্ষে সাধারণভাবে আপসের ন্যায্যতা স্বীকার করাই যথেষ্ট। এই সব ভদ্রলোকেরা যদি এখনো না জানেন যে প্রকৃতি বা সমাজ্জগতে সব সীমারেখাই পরিবর্তনশীল এবং কিছুটা পরিমাণে প্রচলিত ধারার অনুবর্তী তবে দীর্ঘদিনের শিক্ষা, অনুশীলন এবং রাজনৈতিক ও প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা ছাড়া তাঁদের অন্যভাবে সাহায্য করার কোনো পথ নেই। প্রত্যকটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ ঐতিহাসিক মুহুর্তের রাজনীতিগত ব্যবহারিক সমস্যা থেকে প্রধান প্রধান বর্জনীয়, বিশ্বাসঘাতক আপসের দৃষ্টান্ত – যে আপসের মধ্যে বিপ্লবী আন্দোলনের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর সুবিধাবাদের প্রকাশ হয়েছে তা – বেছে নিয়ে ত্র স্বরূপ প্রকাশ করে তা রোধ করার জন্য সর্বপ্রযত্ন চেষ্টা করা উচিত। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের যুগে সমান মাত্রায় লুণ্ঠনকারী, স্বার্থগৃধ্নু দুই দলের মধ্যে প্রধান এবং মূল সুবিধাবাদ ছিল ‘সমাজতন্ত্র-মার্কা’ উগ্র জাতীয়তাব্দ বা সোসাল শভনিজম অর্থাৎ “পিতৃভূমির রক্ষা-ব্যবস্থাকে” সমর্থন করার নীতি। এই ধরণের যুদ্ধে এই ধরণের সমর্থনের অর্থ আসলে “আপন আপন” বুর্জোয়া শ্রেণীর লুন্ঠকারী স্বার্থ রক্ষাই। যুদ্ধের পর, “জাতি-সংঘ” [২] রূপী দস্যুর সমর্থন, বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মৈত্রীর সমর্থন, “সোভিয়েত রাষ্ট্রশক্তির” বিরুদ্ধে বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও বুর্জোয়া পার্লামেন্টারিবাদের আপসের সমষ্টিগত রূপই হলো সুবিধাবাদ – বিপ্লবীশ্রমিকশ্রেণীর এবং তাদের স্বার্থের পক্ষে এ অত্যন্ত মারাত্মক ।

“অন্যান্য পার্টির সঙ্গে আপস, .... সব রকম কৌশল ও মীমাংসার নীতি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে নাকচ করে দিতে হবে”।

জার্মান বামপন্থীরা তাঁদের ফ্রাঙ্কফুর্ট পুস্তিকায় ঐ কথাগুলি লিখেছেন।  

এই যাদের মত, সেই সব বামপন্থীরা সজোরে বলশেভিকদের কেন যে নিন্দা করেন না সেটি আশ্চর্য। কারণ জার্মান বামপন্থীরা নিশ্চয়ই জানেন যে, অক্টোবর বিপ্লবের আগে পরে উভয় সময়েই বলশেভিবাদের সমগ্র ইতিহাসটাই অন্যান্য পার্টি, এমন কি বুর্জোয়া পার্টির সঙ্গেও কৌশল করা, স্ময় নেওয়া ও আপস-রফার দৃষ্টান্ত দিয়ে ঠাসা।

আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া শ্রেণীকে উচ্ছেদ করার লড়াই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সাধারণত যা ঘটে তার কঠোরতম লড়াইয়ের থেকেও শতগুণ কঠিন, দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল। এ লড়াই চালানো অথচ আগে থাকতেই কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে অস্বীকার করা, সাম্ভাব্য মিত্রপক্ষের (যদি তা সাময়িক, অস্থায়ী, দোদুল্যমান এবং শর্তসাপেক্ষও হয়) সঙ্গে আপস করতে অস্বীকার করাটা কি চরম হাস্যকর ব্যাপার নয়? এ যেন অনাবিষ্কৃত, এ পর্যন্ত অলঙ্ঘ্য কোনো পর্বতশীর্ষে দুরূহ অভিযান পরিচালনা করতে  গিয়ে আগে ভাগেই আঁকা বাঁকা পথ ধরে এগোতে পিছু হটে আসতে বা নির্বাচিত পথ পরিত্যাগ করে অন্য পথে চেষ্টা করতে অস্বীকার করার শামিল নয় কি? তবু আমরা দেখেছি এমনি ধারা অপ্রিপক্ক ও অনভিজ্ঞ (তারুণ্যই যদি এর কারণ হতো তাহলে আক্ষেপ কয়ার বিশেষ কিছু ছিল না। ভগবানেরই বিধান এই তরুণেরা একটা সময় এমনি ধারা বাজে কথা বলবেন) লোকেরাও ওলন্দাজ কমিউনিস্ট পার্টির কিছু সভ্যের – প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, প্রকাশ্য বা গোপন, আংশিক অথবা সামগ্রিক যে ভাবেই হোক না কেন – সমর্থন পাচ্ছে।

শ্রমিকদের প্রথম সমাজবাদী বিপ্লবের পর, এক দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদের পর, সেই দেশের শ্রমিকশ্রেণী অনেকদিন পর্যন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর তুলনায় দুর্বল থাকে তার সহজ কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বুর্জোয়া শ্রেণীর ব্যাপক সম্বন্ধ। সংযোগ। তাছাড়া যে দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদ ঘটেছে সেই দেশের ছোটখাট পণ্য উৎপাদন মারফত স্বতঃস্ফুর্ত ও ক্রমাগত পুঁজিবাদ এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর পুনরুজ্জীবন। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী শত্রুকে পরাজিত করতে হলে সর্বশক্তি প্রচেষ্টা করতে হবে। সেজন্য অবশ্যই শত্রুপক্ষের প্রত্যেকটি এমন কি, সামান্যতম ‘মনোমালিন্য’, বিভিন্ন দেশের বুর্জোয়াদের  মধ্যেকার এবং দেশগুলোর ভিতরেও নানা গোষ্ঠী ও ধরণের বুর্জোয়াদের প্রত্যেকটি স্বার্থসংঘাত সুচতুরভাবে ব্যবহার করতে হবে। তেমনই আবার, গণ-সমর্থন লাভের প্রত্যেকটি এমন কি সামান্যতম সুযোগেরও সদ্ব্যবহার করতে হবে – তা সে সমর্থন যতই সাময়িক দোদুল্যমান, অস্থায়ী, অনির্ভরযোগ্য বা শর্তসাপেক্ষই হোক না কেন।  যাঁরা এ কথাটা বোঝেন না তাঁরা মার্কসবাদ বা সাধারণভাবে বৈজ্ঞানিক আধ্যনিক সমাজবাদের বিন্দুবিসর্গও বোঝেন না।  যাঁরা বেশ দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সত্যকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের দক্ষতা কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে পারেননি, তাঁরা এখনও শোষকদের কবল থেকে খেটে-খাওয়া মানুষদের মুক্ত করার সংগ্রামে বিপ্লবী শ্রেণীকে সাহায্য করতে শেখেননি। আর এ কথা শ্রমিকশ্রেণি কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পূর্ব এবং পরবর্তী উভয় যিগ সম্পর্কেই প্রযোজ্য।   

মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছিলেন – আমাদের তত্ত্ব কতকগুলি আপ্তবাক্যের সমষ্টি নয়, পরন্তু তা কর্মের পথ প্রদর্শক। আর কাউটস্কি, অটো বয়ার প্রভৃতি যাঁরা মার্কসবাদের ‘পেটেন্ট’ নিয়েছেন তাঁদের সবচেয়ে বড়ো ভুল এবং সবচেয়ে বড়ো অপরাধ হলো এই যে এ কথাটা তাঁরা বোঝেননি এবং শ্রমিক বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলিতে এ শিক্ষা কাজে প্রয়োগ করতে পারেননি। প্রাক্‌-মার্কসীয় যুগের মহান রূশ স্পমাজবাদী এন জি চের্নিশেভস্কি বলতেন, “রাজনৈতিক কার্যকলাপ নেভস্কি সড়কের ফুটপাথ নয়” (সেন্ট পিটার্সবুর্গের একদম সিধা প্রধান সড়কের পরিচ্ছন্ন, চওড়া ও মসৃণ ফুটপাথ)। চের্নিশেভস্কির পরবর্তীকালে এ সত্য উপেক্ষা করা বা ভুলে যাবার জন্য রুশ বিপ্লবীদের অনেক আত্মত্যাগের মূল্য দিতে হয়েছে। এ সত্য উপলব্ধি করার জন্য অনগ্রসর রুশদের যেরকম চড়া দাম দিতে হয়েছিল বামপন্থী কমিউনিস্ট এবং শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি বিশ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপীয় ও মার্কিন বিপ্লবীদের ততটা যাতে না দিতে হয়, সেজন্য সব্রকম চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য।   

রাশিয়ার জারতন্ত্রের পতনের আগে রাশিয়ায় বিপ্লবী সোসাল ডেমোক্রাটরা বারংবার উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের ব্যবহার করেছে অর্থাৎ, তাদের সঙ্গে নানারকম কার্যকরী আপস-রফা করেছে।  ১৯০১-০২ সালে এমনকি বলশেভিকদের আবির্ভাবের আগেও “ইসক্রা”র পুরাতন সম্পাদকমন্ডলী (প্লেখানভ, অ্যাকসেলরভ, জাসুলিচ, মার্টভ, পোত্রেসভ ও আমাকে নিয়ে গঠিত) বুর্জোয়া উদারনীতিবাদের রাজনৈতিক নেতা স্ট্রুভ [৩]-এর সঙ্গে  (যদিও অল্পদিনের জন্য) একটা আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁরা কিন্তু সব সময়ই বুর্জোয়া উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে নিরিবিচ্ছিন্নভাবে নির্মমতম আদর্শগত ও রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে সক্ষম হয়েছেন – শ্রমিক আন্দোলনের উপর এই মতবাদের প্রভাব বিন্দুমাত্র প্রকাশের উপক্রমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছেন। বলশেভিকরা বরাবরই এই নীতি অনুসরণ করেছেন। ১৯০৫ সাল থাকে তাঁরা উদারনৈতিক বুর্জোয়া এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের সমর্থন করতে তাঁরা বিরত হননি (যেমন, নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্যায়ে বা দ্বিতীয়বারকার ভোটের সময়) বা বুর্জোয়া-বিপ্লবী কৃষক পার্টি “সোসালিস্ট রেভলিউশনারী”দের বিরুদ্ধে নিষ্করুণ আদর্শগত ও রাজনৈতিক সংগ্রাম বন্ধ রাখেননি – সমাজবাদের মুখোশ ধারণ করলেও তাঁরা যে আসলে পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রী তা প্রকাশ করতে ছাড়েননি। ১৯০৭ সালে ডুমার নির্বাচনের সময় বলশেভিকরা অল্প সময়ের জন্য “সোসালিস্ট রেভলিউশনারি”দের সঙ্গে অনুষ্ঠানিকভাবে এক রাজনৈতিক জোট বাঁধেন। ১৯০৩ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে বেশ কয়েক বছর গেছে যখন আমরা অনুষ্ঠানিকভাবে মেনশেভিকদের সঙ্গে একটি সোসাল ডেমোক্রাটিক পার্টির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। তাই বলে, সুবিধাবাদী এবং শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে  বুর্জোয়া ভাবধারার বাহক হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে আমরা কখনও বিরত হইনি। যুদ্ধের সময় ‘কাউটস্কিপন্থী’ বামপন্থী  মেনশেভিক (মার্টভ) ও “সোসালস্ট রেভলিউশনারী”দের একাংশের (চের্নভ ও নাটানসন) সঙ্গে আমরা কয়েকবার আপস করেছি [৪]। জিমারোয়াল্ড ও কীয়েন্থালে আমরা এদের সঙ্গে একত্র হয়েছি, প্রচার করেছি যুক্ত ফতোয়া। তাই বলে ‘কাউটস্কিপন্থী, মার্টভ এবং চের্নভদের বিরুদ্ধে (১৯১১ সালে নাটানসন মারা যান। তখন তিনি ছিলেন “বিপ্লবী কমিউনিস্ট” নারদনিক [৫]। তাঁদের সঙ্গে আমাদের খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। প্রায় সব বিষয়েই তিনি আমাদের সঙ্গে একমত ছিলেন) আদর্শগত রাজনৈতিক সংগ্রাম থামাই নি বা তাতে একটুও ঢিলে দিইনি, অক্টোবর বিপ্লবের মুহুর্তেও, সোস্যালিস্ট রেভলিশনারিদের কৃষি কর্মপন্থা বিনা বিন্দুমাত্র রদবদলে পুরোপুরি গ্রহণ করে আমরা পেটি-বুর্জোয়া কৃষকদের সঙে বে-সরকারি হলেও একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ (এবং সাফল্যমন্ডিত) রাজনৈতিক জোট বেঁধেছিলাম। অর্থাৎ, ঐ কৃষকদের উপর আমরা যে, জবরদস্তি করে আমাদের মত চলাতে চাই না এবং তাঁদের সঙ্গে একটা মীমাংসা করতে চাই – এ কথাটা প্রমাণ করার জন্য নিঃসন্দেহেই আমরা একটা আপস করেছিলাম। সেই সঙ্গে আমরা “বামপন্থী সোসালিস্ট রেভলিউশনারিদের” সঙ্গে সরকারীভাবেও গভর্নমেন্টে অংশগ্রহণ সমেত একটা রাজনৈতিক জোট গড়ার প্রস্তাব করেছি।  (এবং অনতিবিলম্বে সে জোট গড়াও হয়েছে)। বেস্ট-লিটভ্‌স্ক সন্ধির পর, তারা এই জোট ভেঙ্গে ফেলে এবং ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে আমাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ পর্যন্ত করে ও পরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালায়।

সুতরাং “ইন্ডিপেন্ডেন্টদের” (জার্মানির ইন্ডিপেন্ডেন্ট সোসাল ডেমোক্রাটিক পার্টি, কাউটস্কিপন্থীরা) সঙ্গে একজোট হবার আশা পোষণ করার জন্য জার্মান বামপন্থীরা জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিকে যে আক্রমন করেছেন, কেন যে তা আমাদের কাছে ছেলেমানুষি বলে মনে হয়, “বামপন্থীরা যে ভ্রান্ত তার স্পষ্ট প্রমাণ যোগায়, এবার তা বোধগম্য হবে। আমাদের রাশিয়াতেও জার্মানির শাইডেমানপন্থীদের মতো দক্ষিণপন্থী মেনশেভিক (যারা কেরেনেস্কি গভর্নমেন্টে অংশ নিয়েছিল) এবং জার্মান কাউটস্কিপন্থীদের মতো  দক্ষিণপন্থী মেনশেভিকদের বিরোধী বামপন্থী মেনশেভিকদের (মার্টভ) অস্তিত্ব ছিল। ১৯১৭ সালে শ্রমিক সাধারণকে ক্রমশ মেনশেভিক পক্ষ থেকে বলশেভিক পক্ষে চলে আসতে দেখা যায়ঃ ১৯১৭ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত সোভিয়েতসমূহের প্রথম সর্ব রূশীয় কংগ্রেসে আমরা মাত্র শতকর ১৩টি ভোট পাই। সোশালিস্ট রেভলিউশনারি এবং মেনশেভিকরাই ছিল এই কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সোভিয়েত-সমূহের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (১৯১৭ সালের ২৫শে অক্টোবর) আমরা কিন্তু শতকরা ৫১টি ভোটের অধিকারী হয়েছিলাম। জার্মানিতে কেন শ্রমিকদের দক্ষিণ থেকে বামে আসার সম্পূর্ণ অনুরূপ ঝোঁকের ফলে অবিলম্বে কমিউনিস্টদের দলভারী না হয়ে প্রথমে শক্তিবৃদ্ধি হলো মধ্যবর্তী “স্বতন্ত্র” দলের ? যদিও কস্মিনকালেও এই দলের কোনো স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চিন্তা বা স্বতন্ত্র কর্মনীতি ছিল না – তারা শুধু শাইডেমানপন্থী আর কমিউনিস্টদের মধ্যে দোল খেয়েছেন।

অবশ্যই এর অন্যতম কারণ হলো জার্মান কমিউনিস্টদের ভ্রান্ত কর্মকৌশল। নির্ভীক এবং আন্তরিকভাবে তাঁদের এই ভুল স্বীকার করতে হবে এবং তা সংশোধন করতে শিখতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া পার্লামেন্ট ও প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতির মধ্যেই তাঁদের ভুল নিহিত ছিল, তাঁদের ভুল নিহিত ছিল “বামপন্থী” শিশুসুলভরোগের নানাবিধ প্রকাশের মধ্যে। এখন এ রোগ প্রকাশ হয়ে পড়েছে, আর তাই তা সম্পূর্ণভাবে এবং অনেক দ্রুত নিরাময় হবে – দেহযন্ত্রের অনেক বেশি উপকারও হবে তাতে। 

জার্মানিতে “ইন্ডিপেন্ডেন্ট সোসাল ডেমোক্রাটিক পার্টি” অবশ্যই একটা পুরোপুরি একমতাবলম্বী দল নয়ঃ পুরনো সুবিধাবাদী নেতৃত্ব (কাউটস্কি, হিলফারডিং এবং বোধ হচ্ছে কিছু পরিমাণে ক্রিসপিয়েন, লেডেবর ও অন্যান্যরা (যারা সোভিয়েতে রাষ্ট্রশক্তি ও শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে অপারগ তার পাশাপাশি এ পার্টিতে একটা বামপন্থী শ্রমিক অংশের উদ্ভব হয়েছে – আশ্চর্যরকম দ্রুতভাবে এই অংশের শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে। এই পার্টির সহস্র সহস্র সভ্য (বোধহয়, বর্তমানে এই পার্টির সভ্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ) এসেছেন শ্রমিকশ্রেণী থেকে। তাঁরা আজ শিডেমানকে বর্জন করে অতি দ্রুত কমিউনিজমদের দিকে এগিয়ে আসছেন। ইতিমধ্যেই ইন্ডিপেন্ডন্টদের লাইপ্‌ৎজিগ কংগ্রেসে (১৯১৯ সালে) এই শ্রমিক অংশটি অবিলম্বে এবং বিনাশর্তে তৃতীয় আন্তর্জাতিকে যোগ দেবার দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব এনেছেন। পার্টির এই অংশের সঙ্গে “আপস” করতে ভয় পাওয়া চরম হাস্যকর। পক্ষান্তরে, কমিউনিস্টদের অবশ্য কর্তব্য হলো এঁদের সঙ্গে আপসের একটা উপযুক্ত পথ খুঁজে বের করা। এই আপস একদিকে যেমন এই অংশটির সঙ্গে মিশে যাবার পথ সুগম ও ত্বরান্বিত করবে অন্যদিকে তেমনই “ইন্ডিপেন্ডেন্টদের” সুবিধাবাদি দক্ষিণপন্থী অংশের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের আদর্গত ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে অব্যাহত রাখবে। যথাযথ আপসের পথ খুঁজে পাওয়াটা সম্ভবত খুব সহজে হবে না। কিন্তু একমাত্র হাতুড়ে ওস্তাদরাই জার্মান শ্রমিকদের ও জার্মান কমিউনিস্টদের জয়লাভের “সহজ” পন্থা বাতলে দিতে পারে।  

“সাচ্চা” শ্রমিকশ্রেণী যদি শ্রমিক ও আধা-শ্রমিক (যারা আংশিকভাবে শ্রমশক্তি বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে) আধা-শ্রমিক ও ছোটো কৃষক (এবং খুদে কারিগর, কুটীর শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক ও সাধারণভাবে ছোটখাট মুনিব) ছোট কৃষক ও মাঝারি কৃষকের মধ্যবর্তী বহু সংখ্যক পাঁচমিশালী স্তর দিয়ে পরিবেষ্টিত না থাকত আর শ্রমিকশ্রেণী নিজেই যদি উন্নত এবং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত স্তরে বিভক্ত না হতো, যদি তারা আঞ্চলিক সীমা, শিল্প এবং কখনও কখনও ধর্ম দিয়ে বিভক্ত না হতো তাহলে পুঁজিবাদ পুঁজিবাদই হতো না। এই কারণেই, শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী দল, তার শ্রেণী-সচেতন অংশ কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিকদের বিবিধ গোষ্ঠী, শ্রমিক ও ছোট মুনিবদের নানা দলের সঙ্গে নানারকমকৌশল, নানা ধরণের বন্দোবস্ত ও আপস-রফার আশ্রয় নেওয়া প্রয়োজনীয়, একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কেমন করে এই কৌশলকে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে শ্রমিকশ্রেণীর চেতনা, বিপ্লবী মনোভাব, লড়াই করা ও জয়লাভের সামর্থ্যের সাধারণ স্তরের অবনতি না হয়ে উন্নতি হয় তা জানাটাই হচ্ছে আসল দরকার। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে,  মেনশেভিকদের উপর বলশেভিকদের জয়লাভের জন্য শুধু ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের আগেই নয় পরেও, বলশেভিকদের মহড়া বন্দোবস্ত এবং আপস-রফার কৌশল প্রয়োগ করতে হয়েছিল। অবশ্যই তাঁরা এমন সব মহড়া এবং আপস-রফারই আশ্রয় নিয়েছিলেন যা মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে বলশেভিকদের সহায়তা, গতিবৃদ্ধি, সংহত ও শক্তিবৃদ্ধি করে। পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা (মেনশেভিকরাও এর অন্তর্ভুক্ত) অবশ্যম্ভাবীরূপেই বুর্জোয়া এবং শ্রমিকশ্রেণী, বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং সোভিয়েত ব্যবস্থা, সংস্কার এবং বিপ্লব, শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি ভালোবাসা আর শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব সম্পর্কে আশঙ্কা – এই দোটানার মধ্যে দোল খান। কমিউনিস্টদের পক্ষে যে কৌশল প্রয়োগ করা সঙ্গত তা হলো এই দোটানাকে ব্যবহার করা, উপেক্ষা করা নয়। আর এই দোটানাকে ব্যবহার করতে হলেই যারা বুর্জোয়াদের মুখাপেক্ষী হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়াও যারা শ্রমিকশ্রেণীর দিকে মুখ ফেরাচ্ছে – যখন যতটুকু পরিমাণে ফেরাচ্ছে সেই অনুপাতে – তাদের বিশেষ সুবিধাবাদের প্রশ্ন ওঠে। আমাদের দেশে সঠিক কৌশল প্রয়োগের ফলে মেনশেভিকবাদের ভাঙ্গন ধরেছে এবং ভাঙ্গন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, ঝানু সুবিধাবাদী নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে   

শ্রমিকদের সেরা অংশ, পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের শ্রেষ্ঠ অংশ আমাদের শিবিরে আসছেন। এ হচ্ছে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। “আপস নয়, কৌশল নয়” – এ সব অপরিণামদর্শী “সিধান্তে” বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর প্রভাব বৃদ্ধির কাজ, শ্রমিকশ্রেণীর শক্তিবৃদ্ধির কাজ শুধু ব্যাহতই হয়। পরিশেষে ভার্সাই সন্ধি [৬] অস্বীকৃতির জন্য একগুঁয়ে জেদাজেদিটা নিশ্চয়ই জার্মানির “বামপন্থীদের” আর একটা ভুল। যত “গুরুত্ব” দিয়ে বা  “সাড়ম্বরে”, যত ‘সজোরে’ ও আপ্তবাক্যের মতো করে (উদাহরণস্বরূপ কে হর্নারের কথা বলা যেতে পারে) এই মতকে উপস্থিত করা হবে ততই তা কম যুক্তিপূর্ণ বলে মনে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক-বিপ্লবের বর্তমান পর্যায়েও “ন্যাশানাল বলশেভিকরা” (লেফেনবার্গ  ও অন্যান্যরা) আঁতাতের [৭] বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য এমন কি জার্মান বুর্জোয়াদের সঙ্গে একজোট বাঁধার কথাও তুলেছেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক-বিপ্লবের বর্তমান অবস্থায় তাঁদের এই চরম আজগুবী প্রস্তাবকে শুধু খন্ডন করাই যথেষ্ট নয়। এ কথাটাও বোঝা দরকার যে সোভিয়েত জার্মানির (যদি অচিরে জার্মান সোভিয়েত রিপাবলিকের জন্ম হয়) পক্ষেও এখনকার মতো ভার্সাই সন্ধি স্বীকার করা বা মেনে নেওয়া যে একান্ত প্রয়োজন এ কথা অস্বীকার করার কায়দাটা মূলগতভাবে ভুল। এ থেকে এই সিদ্ধান্ত  করা চলে না যে – যখন শাইডেমানরা গভর্নমেন্টে ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত হাঙ্গেরীর সমর্থনে ভিয়েনায় সোভিয়েত বিপ্লবের সম্ভাবনা চলে যায়নি, তখনো “ইন্ডিপেন্ডন্টদের”  পক্ষে ঐ পরিস্থিতিতে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষর করার দাবিটা ঠিক হয়েছিল। সে সময় ‘ইন্ডিপেন্ডেণ্টরা’ অতি আনাড়ীর মতো প্যাঁচ কষতে গেছেন, কারণ মোটামুটি শাইডেমানপন্থী বিশ্বাসঘাতকদের দায়িত্ব তাঁরা নিজেদের ঘাড়ে নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নির্মম (এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ) শ্রেণীসংগ্রাম চালানোর স্তর থেকে “শ্রেণীহীন” বা “শ্রেণীর অতীত” দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের স্তরে নেমেছেন।

কিন্তু বর্তমানে অবস্থাটা এই যে – কমিউনিজম জয়যুক্ত হলে ভার্সাই সন্ধি নাকচ করে দেওয়া হবে – এরপ সরাসরি ও নিঃসংশয় প্রতিশ্রুতি দিয়ে জার্মান কমিউনিস্টদের পক্ষে নিজেদের আবদ্ধ করা উচিত নয়। সেটা হবে নিছক নির্বুদ্ধিতা। তাদের বলতে হবেঃ শাইডেমান ও কাউটস্কিপন্থীরা এমন অনেকগুলি বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছে যার ফলে সোভিয়েত রাশিয়া ও সোভিয়েত হাঙ্গেরীর সঙ্গে মিতালির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে (এবং প্রত্যক্ষভাবে সে সুযোগ কিছুটা নষ্ট করেছে)। এই ধরণের মিত্রতার পথ সুগম ও প্রশস্ত করার জন্য আমরা কমিউনিস্টরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করব। ভার্সাই সন্ধি নাকচ করা সম্পর্কে, বিশেষ করে এখুনি নাকচ করা সম্পর্কে আমদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই – তা সে যাই হোক না কেন। সফলভাবে এই চুক্তি নাকচ করাটা নির্ভর করে শুধু জার্মান নয় আন্তর্জাতিক সোভিয়েত আন্দোলনের সাফল্যের উপর। শাইডেনমান ও কাউটস্কিপন্থীরা এই আন্দোলনকেই ব্যাহত করেছে – আমরা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। আসল কথাটা হলো এই, আর এখানেই রয়েছে আমাদের মূলগত পার্থক্য। আমদের শ্রেণী শত্রুরা, শোষকের দল ও তাদের হুকুমবরদাররা, শাইডেনমান ও কাউটস্কিপন্থীরা যদি জার্মান ও সোভিয়েত আন্দোলনকে, জার্মান ও আন্তর্জাতিক সোভিয়েত বিপ্লবকে শক্তিশালী করার বহু সুযোগ নষ্ট করে থাকে তা সে তাদের দোষ। জার্মানিতে সোভিয়েত বিপ্লব আন্তর্জাতিক সোভিয়েত বিপ্লবকে শক্তিশালী করবে। ঐ বিপ্লবই ভার্সাই সন্ধি ও সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী (একমাত্র নির্ভরযোগ্য অজেয় এবং বিশ্বব্যাপী ঘাঁটি) ঘাঁটি। নির্বিশেষভাবে, বিনাশর্তে ও অবিলম্বে ভার্সাই সন্ধি থেকে  মুক্তির প্রশ্নকে সবার ওপরে স্থান দেওয়া, সাম্রাজ্যবাদের  জোয়াল থেকে সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক উৎপীড়িত অন্যান্য দেশের মুক্তির প্রশ্নের উপরে এই প্রশ্নকে স্থান দেওয়া বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতা নয়, পেটিবুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক (কাউটস্কি, হিলফারডিং, অটো বরার কোম্পানির পক্ষেই তা সাজে)।   জার্মানি বা ইউরোপের যে কোনো একটা বড়ো দেশের বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদের ফল আন্তর্জাতিক বিপ্লবের পক্ষে এতই বড় একটা লাভজনক ঘটনা যে তার জন্য ভার্সাই সন্ধিকে বেশ দীর্ঘ দিনের  জন্য স্বীকার করা চলে এবং প্রয়োজন হলে করাও উচিত। বিপ্লবের খাতিরে রশিয়া একাই যদি কয়েক মাসের জন্য ব্রেস্টলিটভস্ক সন্ধি সহ্য করে থাকতে পারে তাহলে বিপ্লবের সুবিধার জন্য সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় সোভিয়েত জার্মানির পক্ষে আরও দীর্ঘ দিনের জন্য ভার্সাই সন্ধিকে মেনে নেওয়াটা কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়।

ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সাম্রাজ্যবাদীরা জার্মান কমিউনিস্টদের উসকানি দেবার চেষ্টা করছে, ফাঁদে ফেলতে চাইছেঃ “বল, তোমরা ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষর করবে না।” আর বামপন্থী কমিউনিস্টরা ধূর্ত ও বর্তমান মুহুর্তে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে বিচক্ষণতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার বদলে, “আমরা এখন ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষর করব” বলার বদলে ছেলেমানুষের মতো তাদের ফাঁদে ধরা দিচ্ছেন। আগে থাকতে নিজেদের পথ খোলা না রেখে আমরা তাদের সঙ্গে লড়ব কি না কখন লড়ব আগেভাগে তা আমাদের থেকে বেশি অস্ত্রে সুসজ্জিত শত্রুকে প্রকাশ্যে বলে দেওয়া বিপ্লবী কাজ নয়, নির্বোধের কাজ। শত্রুর পক্ষে স্পষ্টতই সুবিধাজনক, আমাদের পক্ষে নয় – এই রকম সময়ে লড়াইয়ে নামা একটা অপরাধ। অসুবিধাজনক লড়াইকে এড়াবার জন্য যিনি “কৌশল করতে বা আপসরফা করতে” জানেন না, বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তিনি একেবারে অপদার্থ।  

……

*প্রত্যেকটি শ্রেণীর মধ্যে, অত্যন্ত অগ্রসর দেশেও, অত্যন্ত অগ্রসর শ্রেণীর মধ্যেও, এমন কি সেই বিশেষ  মুহুর্তেও যখন তাদের আত্মিক শক্তি একটা অভূতপূর্ব উচ্চতর স্তরে ওঠে তখনও শ্রেণীর মধ্যে এমন একদল লোক থাকেন যারা চিন্তা করেন না, চিন্তা করতে পারেনও না। যতদিন না শ্রেণীহীন সমাজ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও সংহত হচ্ছে, যতদিন তা নিজে বনিয়াদ সৃষ্টি করতে না পারছে ততদিনে হতে বাধ্য। তা যদি না হতো তাহলে পুঁজিবাদ জনসাধারণের উপর যে উৎপীড়ন চালায় তা সম্ভব হতো না।

টীকা (সংক্ষিপ্ত)

১। ব্লাঁকিপন্থী – মজুরী দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তির প্রত্যাশা করত মজুরদের শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে নয় বরং মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীদের ষড়যন্ত্রের মারফৎ

২। জাতি সংঘ – লীগ অফ নেশান্স

৩। ইসক্রার সম্পাদকমণ্ডলী বিদেশ থেকে একটি বেআইনি পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্যে স্ট্রুভের সাথে আলোচনা করেছিলেন। স্ট্রুভের উদ্দেশ্য ছিল ইসক্রার সম্পাদকমণ্ডলীকে নিয়ে ইসক্রার প্রতিযোগী একটি পত্রিকা চালানো কিন্তু এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি।

৪। ১৯১৫ এবং ১৯১৬ সালে দুটি আন্তর্জাতিক সোশ্যালিস্ট কনফারেন্স হয়েছিল।

৫। বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভোলিউশানারিদের নারদবাদ প্রভাবিত একটি গ্রুপ যারা ১৯১৮-র সোশ্যালিস্ট রেভোলিউশনারিদের বিদ্রোহের পর সম্পর্ক ছিন্ন করে।

৬। ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তি সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন – “একটি তুলনাহীন ও লুন্ঠনকারী চুক্তি, যা কোটি কোটি মানুষকে দাসে পরিণত করেছে”।

৭। ১৯০৭ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী আঁতাত চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।

[প্রবন্ধ সূত্রঃ 'বামপন্থী কমিউনিজম শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা'। বঙ্গানুবাদ সূত্রঃ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ১৯৯০] 

 

 


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার