মণিপুরের অশান্তির উৎস সন্ধানে

মৌ বাছার 

মণিপুর আমাদের দেশের উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলির একটি এবং এই রাজ্যে স্থলভূমি বা উপত্যকা অঞ্চল এবং পাহাড়ি অঞ্চল উভয়ই রয়েছে। ৯০% পাহাড়ি অঞ্চলে মূলত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী নাগা এবং কুকিরা থাকে যারা মূল জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ এবং মধ্যবর্তী স্থলভূমি বা উপত্যকা অঞ্চলে থাকে বৈষ্ণবী হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বী মেইটেই উপজাতি যারা মূল জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। আমরা জানি যে বর্তমানে মণিপুরে একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক অস্থিরতা চলছে এবং বিভিন্ন উপজাতিরা একে অপরের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এর ফলে ভারতীয় সেনা এবং আসাম রাইফেলসকে মণিপুরের রাজপথ দখলে রাখার নির্দেশ দিয়েছে সেখানকার ক্ষমতাধীন বিজেপি সরকার। এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হল এটা খুঁজে বের করা যে এই অশান্ত পরিবেশের মূল কারণগুলি কি কি? 

মূল কারণে পৌঁছানোর আগে মণিপুরের রাজনৈতিক ইতিহাস একটু ফিরে দেখা প্রয়োজন। মণিপুর এবং তার ভারতে অন্তর্ভুক্তির ইতিহাস খুবই ঘটনাবহুল এবং বঞ্চনার ইতিহাস। মেইটেই উপজাতিরা বার্মা থেকে মণিপুরের উপত্যকায় এসেছিল আর নাগা এবং কুকি উপজাতিরা পর্বত অঞ্চলে থাকত। মেইটেই রাজ্যের পক্ষ থেকে পর্বত অঞ্চলে বারংবার সৈন্য পাঠানো হয়েছে কুকি এবং নাগা উপজাতিদের দমন করার জন্য। আবার অনেক সময় দেখা গেছে যে বাণিজ্যিক সুফল পাওয়ার উদ্দেশ্যে মেইটেই নাগা এবং কুকিরা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। পরবর্তীতে বার্মার সেনা মণিপুর দখল করলে বার্মার রাজতন্ত্র সেখানকার স্থলভূমি এবং পর্বত অঞ্চল উভয় দখলে রাখার জন্য এই তিন উপজাতির উপরে দমনমূলক কার্যকলাপ শুরু করে, যা সাত বছর ধরে চলে। এই কারণে এই অধ্যায়কে বলা হয় 'The Seven Years Destruction'। পরবর্তীতে প্রথম অ্যাংলো বার্মিজ যুদ্ধের পরিণতিতে ১৮৯১ সালে মণিপুরকে একটি  'প্রিন্সলি স্টেট'-এর তকমা দেয় ব্রিটিশরা। কিন্তু শুরু থেকেই ব্রিটিশরা মেইটেই উপজাতিদের প্রতি বেশী সদয় ছিল এবং বাকি পাহাড়ি উপজাতিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করত। তারা যে নতুন জমি নীতি প্রয়োগ করে তার ফলে দুটো জিনিস লক্ষ্য করা যায়: (১) উর্বর জমি মেইটেইদের হাতে চলে আসে এবং অনুর্বর জমি মূলত কুকি এবং নাগাদের প্রাপ্য হয় (২) এই জমির মালিকানার ক্ষেত্রে একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থার ফলে যাযাবর নাগা এবং কুকি উপজাতিদের যে জীবনশৈলী তা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে যখন ভারতভূখন্ডের ব্রিটিশ শাসনের থেকে স্বাধীনতা লাভ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, সেই সময় মণিপুরের মহারাজা বোধচন্দ্র সিংহ সিদ্ধান্ত নেন যে মণিপুর একটি পৃথক স্বাধীন দেশ হিসাবে থাকবে। কিন্তু মণিপুর ছিল ভারতের ক্ষেত্রে বার্মা এবং চীনের মধ্যবর্তী অবস্থানকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য এবং সেই কারনে ভারত সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এক প্রকার জোর করেই ১৯৪৯ সালে মহারাজাকে দিয়ে মার্জার এগ্রিমেন্ট সই করিয়ে নেন। এর ফলে মণিপুর ভারতের একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বা ইউনিয়ন টেরিটরিতে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াকে মণিপুরের সাধারণ মানুষ মোটেই ভালো চোখে দেখেনি কারণ তারা বহুদিন ধরেই রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে আসছিল এবং ভারতভূখণ্ড স্বাধীনতা লাভ করার অনেক আগেই মণিপুরে বিধানসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে প্রশ্ন ওঠে যে কিভাবে বিধানসভার সদস্যদের না জানিয়ে মহারাজা নিজেই এই মার্জার এগ্রিমেন্টে সই করলেন। আবার অনেকে এটাও মনে করে যে রাজনৈতিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে মহারাজা এই কান্ড করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যেহেতু মণিপুরের সাধারণ মানুষের মনোভাবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অঞ্চলটিকে ভারতভুক্ত করা হয়েছিল, ফলে পৃথক মণিপুর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন পৃথক পৃথক উপজাতিদের আলাদা আলাদা রাজ্য হিসেবে ভারতের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে সৈন্যবাহিনী তৈরি  হয়। যেমন ১৯৬৪ সালে United Democratic Force তৈরি হয়, ১৯৭৭ সালে People's Liberation Army of Kangleipak তৈরি হয় যা কাংলেইপাক কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য যুদ্ধ ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করছিল, ইত্যাদি। মেইটেই উপজাতিরা পরবর্তীতে ভারতের অধীনে মণিপুর রাজ্যের অবস্থানকে গ্রহণ করে ফেলে কারণ রাজনৈতিকভাবে তারাই বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল (ভারতীয় ব্যবস্থায় যে বিধানসভা প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছিল তার ভিত্তিতে)। অন্যদিকে কুকি এবং নাগারা উভয়েই পৃথক দেশের দাবি করে আসছিল, পরবর্তীতে যা পৃথক রাজ্যের দাবীতে পরিণত হয়। কুকিরা চাইছিল কুকিল্যান্ড এবং নাগারা চাইছিল নাগালিম। কুকিল্যান্ড এবং নাগালিমের মধ্যে বেশকিছু অঞ্চল ছিল যা উভয়  উপজাতিদের যে কাঙ্ক্ষিত বাসভূমি তার মধ্যে পড়ছিল। ফলে সেখান থেকেও আবার নতুন করে অশান্তি শুরু হয়।কুকি এবং নাগা উভয় উপজাতিরই নিজস্ব সৈন্যদল রয়েছে। যেমন কুকিদের ক্ষেত্রে কুকি ন্যাশনাল আর্মি, কুকি রেভলুশনারি ফোর্স, কুকি ডিফেন্স ফোর্স ইত্যাদি রয়েছে।নাগাদের ক্ষেত্রেও এমন বহু সৈন্য রয়েছে। নাগাদের সৈন্যবাহিনী অনেক সময় এমন কিছু গ্রামে কুকিদের আক্রমণ করে যেখানে তারা নাগাদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম কারণ নাগারা এই নাগা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে একত্রিত করে নাগাল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়ায় নাগাদের উপর আক্রমণ করতে শুরু করে কুকি ন্যাশনাল আর্মি। ফলে কুকি এবং নাগা উভয়ের মধ্যেই একটা ঝামেলার বাতাবরণ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক কি? 

লক্ষণীয়, উপজাতিদের নিজেদের মধ্যেকার ঝামেলার ফলে ভারত সরকার ১৯৫৮ সালে আফস্পা আইন প্রণয়ন করে।এই আফস্পা আইনে বলিয়ন হয়ে আসাম রাইফেলস বারংবার মানবধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। থঞ্জম মনোরমা নামের একজন মহিলাকে আসাম রাইফেলস কর্তৃক গণধর্ষনের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে মণিপুরের বেশকিছু প্রতিবাদী মহিলারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় আসাম রাইফেলসের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে 'Indian Army Rape Us' ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল। পরবর্তীতে আফস্পা আইন তুলে নেওয়ার দাবীতে আমরণ অনশনে নামে ইরম শর্মিলা চানু, যদিও বর্তমানে তিনি এই আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বর্তমানে যে অশান্তি চলছে সেই প্রেক্ষাপটে মণিপুর সরকার 'Shoot at site' অর্ডার দিয়েছে এবং মণিপুর সরকারের এই মনোভাবকে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছে সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ। এই পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক এই কারণেই যে, যে আসাম রাইফেলসকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথে নিযুক্ত করেছে মণিপুর সরকার তাদের বারংবার বিভিন্ন সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কুখ্যাত ইতিহাস রয়েছে। 

মণিপুরের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম দাবি করেন যে তিনি সমস্ত পর্বত অঞ্চল যেখানে জঙ্গল রয়েছে সেগুলোকে 'রক্ষা' করার উদ্দেশ্যে সেখানকার বসবাসকারি গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করতে চান এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও-তে দেখা গেছে যে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এই পর্বত অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতিদেরকে ড্রাগের ব্যবসা করার জন্য অভিযুক্ত করছেন এবং ফ্যাসিস্ট কায়দায় বলছেন 'I will declare war against you people'। এখন এটা ঠিক যে মায়ানমার থেকে আগত বিভিন্ন শরণার্থীরা অনেক সময় মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে পোস্ত চাষ করে কিন্তু তার মানে এই নয় যে পর্বত অঞ্চলের সমস্ত মানুষকে এক ধাক্কায় আইন বলে তিনি তাদের জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে উচ্ছেদ করবেন। লক্ষণীয় যে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলাকালীন তাদের কোনো পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়নি। এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া তার চরম আকার ধারণ করে চুরাচাঁদপুর জেলায়। চুরাচাঁদপুর জেলার কে সংজং গ্রামে কোনরকম পূর্ব সতর্কতা ব্যতীত হঠাৎ করে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমাদের দেশের সমস্ত বিধানসভায় আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয়েছে সারা রাজ্যগুলির বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার তারতম্যের ভিত্তিতে। স্বাভাবিকভাবেই উপত্যকা অঞ্চলের জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে সেখানকার বিধানসভা আসন সংখ্যা পর্বত অঞ্চলের থেকে অনেক বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবে মেইটেই উপজাতিদের প্রতিনিধি বিধানসভায় কুকি এবং নাগাদের থেকে অনেক বেশি। এই প্রেক্ষাপটে এটা লক্ষণীয় যে এন বিরেন সিং নিজেই মেইটেই উপজাতিদের প্রতিনিধি এবং তিনি ওই চুরাচাঁদপুর জেলাতে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করেছেন যেখানকার গ্রামবাসীরা মূলত কুকি উপজাতির অংশ। ফলে কুকি উপজাতিরা এটা মনে করছে যে মেইটেই উপজাতিরা আসলে কুকিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। এর পরিণতিতেই কুকি উপজাতিরা তাদের জমির অধিকারের জন্য প্রতিবাদ শুরু করে এবং সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতিবাদকে অসংবিধানিক তকমা দিয়ে আদতে সংবিধান স্বীকৃত প্রতিবাদের অধিকারকেই খর্ব করতে চায়। এন বিরেন সিং-এর বিভিন্ন  রাজনৈতিক সভা বানচাল করার জন্য কুকি উপজাতিরা উঠে পড়ে লাগে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে হঠাৎ করে কেন বিজেপি সরকারের একজন মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গল রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন এবং সন্দেহ হয় এই কারণেই যে সারা দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গাতেই বনাঞ্চল ধ্বংস করার প্রক্রিয়াতে লেগে রয়েছে বিজেপি সরকার। এমন কি এই ২০২৩ সালের ২৯শে মার্চে লোকসভাতে  Forest Conservation (Ammendment) Bill কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এনেছে যেখানে বলা হয়েছে যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার অঞ্চল জাতীয় রক্ষী বাহিনীর অধীনে থাকবে। সেখানকার যে বসবাসকারি উপজাতিরা বা আদিবাসীরা রয়েছে তাদের জমির উপর অধিকারকে এই আইন বলে খর্ব করার সম্ভাবনা রয়েছে। এই আইন বলে বিভিন্ন উপজাতিদের ঝুম চাষ প্রক্রিয়াকেও বন্ধ করার উদ্দেশ্য রয়েছে কেন্দ্রের এবং ইকো-ট্যুরিজম-এর নামে আসলে বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে এই বনাঞ্চলগুলি তারা দিয়ে দিতে চায়। ফলে এটা অনেকেই মনে করছে যে এন বিরেন সিং-এর এই কুকি উপজাতিদের উপর আক্রমণ আসলে মণিপুর রাজ্যে এই সংশোধনী বিলের মূল উদ্দেশ্যগুলিকে প্রতিফলিত করারই নীল নকশা ছাড়া আর কিছু নয়। 

All Tribals Student Union-এর পক্ষ থেকে এন বিরেন সিং-এর এই নীতির বিরুদ্ধে ট্রাইবেলস Tribal Solidarity March-এর ডাক দেওয়া হয়। এই পদযাত্রা আসলে সংগঠিত হয় মণিপুরের হাইকোর্টের একটি নির্দেশকে কেন্দ্র করে যেখানে তারা রাজ্য সরকারকে বলছে যে কেন্দ্র সরকারকে বলতে যাতে মেইটেই উপজাতিদের তফসিলি উপজাতির স্ট্যাটাস মিলে যায়। মেইটেই উপজাতিরা ২০১৩ সাল থেকে ST স্ট্যাটাস চাইছে যে স্ট্যাটাস তাদের বহুকাল আগে ছিল। এই স্ট্যাটাস পেলে তাদের দাবি যে তারা তাদের সংস্কৃতি এবং জমি রক্ষা করতে পারবে কারণ তাদের অস্তিত্ব পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে আগত আইন বিরুদ্ধ শরণার্থীদের প্রবেশের ফলে বিপন্ন। উল্টোদিকে, কুকি এবং নাগা উপজাতিদের বক্তব্য হল যে মেইটেইরা এমনিতেই উচ্চশিক্ষিত, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান এবং মণিপুর বিধানসভায় দুই তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী। মেইটেইদের বিভিন্ন প্রতিনিধিরা কেউ কেউ Scheduled Caste (SC) বা Other Backward Classes (OBC) স্ট্যাটাস ইতিমধ্যেই পেয়ে রয়েছে। তাছাড়া মেইটেইদের ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফশিলে স্বীকৃত। এরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তারা যদি তপশিলি উপজাতির তকমা পেয়ে যায় তাহলে কুকি এবং নাগাদের যেটুকু প্রাপ্য রয়েছে তার মধ্যেও তারা ভাগ বসাবে এবং এমনকি বাকিরা আর কাজকর্মও পাবে না। মেইটেইদের প্রতিশোধমূলক আচরণের কারণে কুকি এবং নাগাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যা এন বিরেন সিং-এর বর্তমান পাহাড়ি অঞ্চলের উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কুকি ও নাগাদের মধ্যে আরও বদ্ধমূল ধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কারণেই সারা রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক সময়েই বিভিন্ন মেইটেই রাজনীতিবিদদের বলতে দেখা গেছে যে কুকিরা আসলে শরণার্থী বা ঘুষপেটিয়া এবং এতে কুকিরা খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছে কারণ তাদের বক্তব্য হল যে বহু বছর ধরেই মণিপুরে তারা পর্বত অঞ্চলে বসবাস করে। ফলে তাদেরকে ঘুষপেটিয়া বলার কোন মানেই হয় না। মেইটেইরা যদি এই অতিরিক্ত অধিকার পেয়ে যায় তাহলে কুকিদের ভয় হচ্ছে যে তাদের এমনিতেই ঘুষপেটিয়া বলা হয় এবং নয়া পরিস্থিতিতে তাদের রাজ্য থেকে বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়া মেইটেইরা শুরু করতে পারে। মেইটেইরা শুরু থেকেই যে শরণার্থী তথ্য খাড়া করতে চাইছে তার ভিত্তিতে তারা আইন বলে একটি ইনার লাইন পারমিট অর্থাৎ মণিপুরে ঢুকতে এবং বেরোতে গেলে রাজ্য সরকারের কাছে পারমিশন চাওয়ার অধিকার চাইছে। এই প্রক্রিয়াটি আমাদের দেশের পূর্বতন রাষ্ট্রপতিদের মাধ্যমে বাধাপ্রাপ্ত হলে বর্তমানে তারা এই তপশিলি উপজাতির তকমা লাভের মধ্যে দিয়ে তাদের আশা পূর্ণ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। তাছাড়া মেইটেইদের ভাষা অর্থাৎ 'মৈতৈলোন'কে মণিপুরের প্রধান ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যা বাংলা হরফে লেখা হয়। বর্তমানে বিজেপি হিন্দিকে লেখ্য হরফ করতে চাইছে কিন্তু অনেক উপজাতিরা এই বাংলা এবং হিন্দি উভয় হরফই বর্জন করে নিজেদের প্রাচীন হরফকে এই ভাষার লেখ্য রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদের এই নিজেদের ভাষা নিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিরুদ্ধে।  

এই পরিস্থিতি থেকে মূলত যেটা স্পষ্ট তা হল, দীর্ঘদিন ধরেই উপজাতিদের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তোষ এবং অবিশ্বাস রয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় ধুনো দিয়েছে বিজেপি সরকারের পর্বত অঞ্চল দখলে নেওয়ার রাজনৈতিক অভিপ্সা এবং মেইটেই উপজাতিদের প্রতি বিজেপি সরকারের সদর্থক পক্ষপাত। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অশান্তি নিবারণ করতে হলে যা প্রয়োজন: (১) অবিলম্বে বন সংরক্ষণের নামে উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে। (২) পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে, ২০২১-২২-এর তথ্য অনুযায়ী সারা দেশের মধ্যে মণিপুরে কর্মহীনতার হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৯ শতাংশ, যা জাতীয় হার অর্থাৎ ৪.১ শতাংশ-এর প্রায় দ্বিগুণ। তার মানে সারা মণিপুর রাজ্যজুড়ে কর্মসংস্থানের ব্যাপক অভাব রয়েছে। ফলে সমস্ত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে বিজেপির কর্মসংকোচন নীতির বিরুদ্ধে এবং সার্বিক কর্মসংস্থানের দাবীতে আন্দোলনে নামতে হবে। (৩) মণিপুর বিধানসভায় মেইটেই উপজাতিদের সংখ্যা বেশি কুকি এবং নাগাদের তুলনায়, ফলে জনসংখ্যাভিত্তিক যে আসন সংখ্যা নির্ধারণের ডিলিমিটেশন নীতি তার একটা নঞর্থক রূপ আমরা মণিপুরের বিধানসভার ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। এখন প্রয়োজন হল কুকি এবং নাগাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে ও তাদের কর্মসংস্থানের উপর বিশেষ জোর দেওয়া এবং কুকি ও নাগা অধ্যুষিত অঞ্চলে তাদের বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করা যার বিরোধিতা করছে মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং। ফলে এই মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবী তোলা উচিৎ। 

তথ্য সূত্র 

১. https://www.youtube.com/watch?v=BlGyAH5NSKQ

২. https://thediligent2018.blogspot.com/2021/10/blog-post_15.html

৩. https://timesofindia.indiatimes.com/city/imphal/manorama-irom-face-of-anti-afspa-protest/articleshow/53126074.cms

৪. https://indianexpress.com/article/explained/slowdown-hits-hard-manipurs-jobless-rate-twice-national-average-8598920/

Updated: 07/06/2023

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার