মগজ ধোলাই, যুক্তিবাদ, অন্তর্দৃষ্টি ও কিছু থট এক্সপেরিমেন্ট

ঋদ্ধিমান বসু


'হীরক রাজার দেশে'-র সেই মগজ ধোলাই যন্ত্র আশা করি সবার মনে আছে। সেই মগজ ধোলাই-এর ঘরে বন্ধ করে একটা মন্ত্র, এক বা একাধিক জনের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হত। তারপর তারা সারাক্ষণ সেই মন্ত্রই আউড়ে যেত। তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা বা বোধবুদ্ধি আর কাজ করত না। তারা একধরনের জম্বিতে পরিনত হত। ব্যাপারটা গোটাটাই রূপক। এই ছবিটা ইন্দিরা গান্ধী কৃত ইমার্জেন্সির (১৯৭৬-১৯৭৭) একটা স্যাটায়ার। সেখানে মগজ ধোলাই-এর যন্ত্র হয়ত সরাসরিভাবে কোন বাস্তব জিনিসের রূপক নয়।

তবে আজকের দিনে আমাদের বাস্তব জীবনে এমন একটা জিনিস আছে যাকে সহজেই এই মগজ ধোলাই যন্ত্রের রূপক হিসেবে ভাবা যেতে পারে, আর তা দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সেটা আর কিছুই নয়, মেনস্ট্রিম। মেন্সট্রিম বলতে এখানে শুধুই মিডিয়ার কথাই বলছিনা। প্রিন্ট ও ভিস্যুয়াল সংবাদমাধ্যম ছাড়াও, টেলিভিশন, সিনেমা, পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি সবেতেই নানান ব্যাপারে প্রোপাগাণ্ডা চলে, আমাদের সামনে একটা ন্যারেটিভ পেশ করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বেশিরভাগ প্রভাবশালী ব্যক্তিও (ইন্টেলেকচুয়াল ও ইনফ্লুএন্সার) তাকেই সমর্থন করেন। তবে এই মেনস্ট্রিম ন্যারেটিভ যে শুধু একমাত্রিক, এমনটা নয়। আপাতঃভাবে আমাদের সামনে পরস্পরবিরোধী মতামত, বিভিন্ন (পক্ষ ও বিপক্ষ) মিডিয়ার ছবি তুলে ধরা হয়, যেন ভিন্ন ন্যারেটিভ। কিন্তু সেই মতবিরোধ যে তুচ্ছ কিছু ব্যাপারে, সেই নানান ন্যারেটিভ-এর পিছনে উদ্দেশ্য যে একই, সেটাই অনেকে বুঝতে পারেন না।

এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে আমাদের আর একটা রূপকের সাহাজ্য নিতে হবে; যার নাম 'অ্যালেগরি অফ দা কেভ' (Allegory of The Cave)। বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক প্লেটো, এই তত্ত্ব, তাঁর 'রিপাবলিক'-এর সপ্তম খন্ডে বর্ণনা করেছিলেন।

উনি একটা অন্ধকার গুহা কল্পনা করেছিলেন, যেখানে কিছু মানুষ দেওয়ালের দিকে মুখ করে শিকল দিয়ে বাঁধা আছে, তাদের পক্ষে দেওয়াল ছাড়া আর কিছু দেখা সম্ভব নয়। এরা আসলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরই প্রতীক। এদের পিছনে একটা বড় আগুন জ্বলছে, আর তার পিছন দিয়ে কিছু মানুষ হাতে নানান জিনিসপত্রের রেপ্লিকা (মূর্তি) নিয়ে হাঁটাচলা করছে। বন্দীরা এই ছায়াগুলো দেখে সেগুলোকেই আসল ভাবতে শিখছে। তারা এমন ভাবেই অবস্থিত, যে তারা ঘাড়ও ঘোরাতে পারবে না।

এরকম একজন বন্দী হয়ত মনে মনে বুঝলো, যে তাদের যা দেখানো হচ্ছে, তার সব কিছু ঠিক নয়। সে অনেক চেষ্টা করে তার বাঁধন খুলে ফেলল, এবং সেই গুহা থেকে বেরোতে সক্ষম হল। বেরিয়ে, সে প্রথমবার সূর্য দেখল, সেই সব জিনিসগুলো দেখল, যার এতদিন সে ছায়াই দেখে এসেছে। এবার সে বুঝল, যে সত্যিটা সে এতোদিন দেখেইনি। এই ব্যক্তিকেই প্লেটো দার্শনিক বলেছেন।

তারপর সে ঠিক করল, যে গুহায় ফিরে গিয়ে বাকিদেরও সত্যিটা জানাবে, তাদেরকে গুহা থেকে বেরোতে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু যখন সে ফিরে গিয়ে এ সব বলল, বেশিরভাগ বন্দীই হেঁসে উড়িয়ে দিল, তাকে পাগল বলল। (কন্সপিরেসি থিয়োরিস্টও বলল হয়ত, কিন্তু তখনো ওই শব্দবন্ধটার উৎপত্তি হয়নি, তাই হয়ত প্লেটো ব্যবহার করেননি) বাইরে সূর্যের আলোতে বেরোনোর ফলে, সে ভেতরের ছায়াগুলোও আগের মত স্পষ্ট দেখতে পেলো না। এর মাধ্যমে প্লেটো বোঝাতে চেয়েছেন, যে একবার সত্যের সম্মুখীন হয়, মিথ্যেগুলো তার কাছে ঝাপসাই লাগে।

প্লেটোর লেখায় এটুকুই আছে। তবে এর ওপর নির্ভর করে আমরা নানান বিশ্লেষণ করতে পারি। (extrapolation)

এভাবে বাকি বন্দীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে একটা থট এক্সপেরিমেন্ট (thought experiment) করা যাক। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ হয়ত মনে করে এই ছায়াগুলোই আসল জিনিস, আবার আরেকদল বোঝে যে এগুলো আসল জিনিসের ছায়া, কিন্তু এইটুকু জেনেই তারা খুশি, এর বেশি জানতে চায় না। এবার এরা নিজেদের মধ্যে তর্কে ব্যস্ত থাকলো, দুই দলই নিজেদের ঠিক ও অন্যদের তুলনায় উন্নত ভাবতে লাগল; কিন্তু লক্ষনীয়ভাবে কেউই আসল সত্যটা বোঝার চেষ্টা করল না, দুই দলই ওই দার্শনিকের কথা হেসে উড়িয়ে দিল। তারা আসলে ভয় পেল। তারা শুরু থেকে ওই ছায়াকেই/অথবা ছায়ার পিছনে কিছু একটা আছে, এটুকুই সত্যি বলে জেনে এসেছে, সেইটাই তাদের মনে গেঁথে গেছে, সেটাকে অবিশ্বাস করলে, বা তার বাইরেও কিছু থাকতে পারে ভাবলে, যেন তাদের একটা অস্তিত্ত্ব সংকট তৈরি হবে। তাই তারা এই গন্ডির মধ্যেই থাকতে চাইল। অথচ সেই দার্শনিকের সাহায্য নিয়ে গুহার থেকে বেরিয়ে সত্যের সম্মুখীন হওয়া খুব কঠিন ছিল না। উপায় থাকা স্বত্ত্বেও তারা সেই পথে হাঁটল না।

এটাকে বলে ডিনায়াল(denial)। এর আরেকটা পোশাকি নাম আছে, কগনিটিভ ডিসোন্যান্স (cognitive dissonance)। এবং এর মূলে বহুদিনকার মগজ ধোলাই। এই ধরনের ব্যাপারস্যাপার আমরা কোভিডকালে প্রচুর দেখতে পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি। সব ধরনের মতবাদের মানুষের (আপাতঃভাবে পরস্পরবিরোধী) অধিকাংশই মেন্সট্রিম ন্যারেটিভকেই সমর্থন করেছেন, তাতেই গর্ববোধ করেছেন, মুক্তচিন্তার পথে হাঁটেননি। এখন বোঝা যাচ্ছে যে এই মেনস্ট্রিমে অন্ধবিশ্বাসের কারণে আরও অনেক কিছুই অধিকাংশের বোঝার আয়ত্তের বাইরে।

তাহলে, সত্যিটা বোঝার উপায় কি? শুরুটা মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদ দিয়ে করা যেতে পারে। (তবে যুক্তিবাদটা কীভাবে কাজ করবে, সেটা কোন দিকে প্রবাহিত হবে, তা অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে, সেটায় পরে আসব)

এই ব্যাপারে ব্রিটিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন-এর চিন্তাভাবনা আমাদের সাহাজ্য করতে পারে। ওনার বিখ্যাত কাজ 'নোভাম অরগ্যানাম' (Novum Organum)-এ বিভিন্ন ধরনের যুক্তি, চিন্তা ও সত্যে পৌঁছনোর নানান উপায় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। এর মধ্যে এখানে উল্লেখ্য, 'ইন্সট্যান্স অফ দা ফিঙ্গারপোস্ট' (Instance of the Fingerpost)। মূল তত্ত্বে যাবার আগে বোঝা দরকার ফিঙ্গারপোস্ট কী? এটা হচ্ছে এক ধরনের সাইনবোর্ড, যেখানে হাত আর আঙ্গুল আঁকা থাকে এবং সেগুলো কোনও একটা দিকে নির্দেশ করে। (আজকাল তীর-চিহ্নই বেশি দেখা যায়) সাধারণত এগুলো রাস্তার পাশে থাকে। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে যে হাজারটা মিথ্যা নানান দিকে বিভ্রান্ত করলেও এমন একটা দিকনির্দেশ থাকবে, যেটা একমাত্র সত্যের রাস্তাই চিহ্নিত করবে। এই ফিঙ্গারপোস্ট হবে এমন এক অকাট্য যুক্তি, যার একমাত্র অভিমুখ সত্যই হতে পারে। এবার এই ধারণার নিরিখে, গুহার রূপক নিয়ে আলোচনা করা যাক।

গুহার মধ্যে আমরা দু'ধরনের দল দেখেছিলাম; একদল ছায়াকেই সত্যি বলে মনে করে, এদেরকে আমরা ছায়াবাদী বলব; আরেকদল বোঝে যে ওগুলো ছায়া, কিন্তু বিশ্বাস করে যে ওই ছায়া সৃষ্টিকারী জিনিসগুলো আসল। (সেগুলোও আসলে রেপ্লিকা) এদেরকে আমরা বস্তুবাদী বলব। এই দু'দলের মধ্যে প্রচুর বিরোধ এবং সেটা নিয়েই তাদের সমস্ত চিন্তাভাবনা। এখানে ফিঙ্গারপোস্ট কী হওয়া উচিত? তাদের মনে নানান প্রশ্নই আসতে পারে, তবে আসল যে প্রশ্ন, যেটাকে ফিঙ্গারপোস্ট বলা যেতে পারে, সেটা হল - তাদের মতামতের সঙ্গে তাদের বাঁধন এর কী সম্পর্ক। নিজেদের ঠিক প্রমান করলেও তাদের এই বন্দী দশা ঘুচবে কি?

এই প্রশ্নটা মনে এলেই (এটা বস্তুবাদীদের মনেই আসার সম্ভাবনা বেশি, কারণ তারা অন্তত বুঝেছে যে ওগুলো কিছুর ছায়া) এই সংক্রান্ত আরও প্রশ্ন আসবে, যেমন তাদেরকে কারা বন্দি করে রেখেছে, কারাই বা ছায়াগুলো তাদের দেখাচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু সেই ছায়াবাদী ও বস্তুবাদীরা নিজেদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে এতই আগ্রহী, যে তারা সেই গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ, যেন তাদের মতটা সঠিক বলে প্রমাণিত হলেই তারা সব উত্তর পেয়ে যাবে; এইসব প্রশ্ন তাদের মাথায় আসার আর জায়গা নেই। বস্তুবাদীরা হয়ত ছায়াবাদীদের তুলনায়, সামান্য উন্নত চেতনার, তা স্বত্ত্বেও তাদের ভাবনা একটা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

সেই দার্শনিকের মনে কিন্তু এই প্রশ্ন এবং তার আনুসঙ্গিক প্রশ্নগুলোও এসেছিল। সে তার বন্দী দশা থেকে মুক্তি পাওয়াকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে তার শিকল আলগা করে নিজেকে ছাড়াতে পেরেছিল। তারপর সে বুঝেছিল যে একদল মানুষই আগুনের পিছন থেকে রেপ্লিকাগুলোর ছায়া ফেলছে। যুক্তিবাদ তাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। এবার সে কী করে বুঝল, যে এই গুহার বাইরেও একটা জগত আছে, কিভাবে মনস্থির করল, যে সে বাইরে বেরোবে? তার মতো যুক্তিবাদী তো বাকি বন্দীরাও হতে পারত, তাহলে তারা কেন দার্শনিকের মত ভূমিকা নিতে পারল না? এখানেই ইন্টুইশান বা অন্তর্দৃষ্টির ভূমিকা। এটা একাধারে যেমন যুক্তিবাদের পরিপূরক, তেমনই তার ভিত্তিও। এর সাহায্যেই সেই দার্শনিক অনুভব করেছিল, যে গুহার বাইরেও কিছু একটা আছে এবং সেটা তার জানা উচিত, সত্যের কাছে পৌঁছনোর জন্য। এটা ছিল বলেই তার যুক্তিবাদ সঠিক দিকে চালিত হয়েছিল। এখানেই তফাৎটা গড়ে উঠেছিল।

অন্তর্দৃষ্টি এমন একটা ব্যাপার যেটা সব প্রাণীই পায় প্রকৃতি বা ব্রম্ভান্ড থেকে। এটা বিবর্তনের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়। এটা প্রকৃতি/ব্রম্ভান্ড-এর (যাকে আমরা কেউ কেউ System Intelligence-ও বলি। সিস্টেম ইন্টেলিজেন্স-এর অনেক অভিমুখ আছে, অন্তর্দৃষ্টি ছাড়াও শরীরের স্বয়ংক্রিয় রোগ প্রতিরোধ/নিরাময় প্রক্রিয়া আরেকটা) সঙ্গে এক নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন সময়ে সত্যের আভাসটা দেয়; কোন যুক্তিতর্ক ছাড়াই সত্যটাকে বুঝতে পারা যায়। (প্রকৃতির মধ্যেও এই সিস্টেম ইন্টেলিজেন্স আছে, আর প্রানীদের মধ্যেও আছে, তাই যোগাযোগটা গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারণার সঙ্গে অনেকে অদ্বৈতবাদেরও মিল খুঁজে পেতে পারেন।) এটা এক ধরনের দেখার ক্ষমতা, ইন্সটিন্ক্ট ও বলা যায়। যেমন পশুপাখি, কীটপতঙ্গ একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে তার আভাস পেয়ে, সেখান থেকে সরে যায়, ঠিক সেই রকম। এটা একটা অনূভুতির মত, এর সঙ্গে সাধারণ জ্ঞান, এমনকি আইকিউ-এরও সম্পর্ক নেই। এটা ভাল করে বোঝা গেছে কোভিডকালে। যেখানে অনেক তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ও হাই আইকিউ শহুরে মানুষ, মেন্সট্রিম ন্যারেটিভ-এ ব্রেনওয়াশড হয়ে সেই বুলিই আওড়াচ্ছিলেন, সেখানেই অনেক নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া, প্রান্তিক মানুষ ও গ্রামের সাধাসিধে মানুষ চিকিৎসাবিজ্ঞানের তেমন জ্ঞান না থাকা স্বত্ত্বেও, ষড়যন্ত্রটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। এই তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষদের প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ অনেক নিবিড়, তাই তাদের পূর্বসূরিদের সূত্রে পাওয়া অন্তর্দৃষ্টি অক্ষুণ্ণ ছিল, আরো উন্নত হওয়ারও সুযোগ ছিল। বেশিরভাগ উচ্চশিক্ষিতরা নিজেদেরকে কৃত্রিমতার মোড়কে মুড়ে ফেলে এই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকে এমনই পর্যায়ে চলে গেছেন যে আরোপিত ভাবনা (mainstream doctrine)-কেই ইন্টুইশান বলে ভুল করছেন। তাই, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঠেকে শিখলেও, অনেকে এখনও সত্যের থেকে বহু দূরে।

যুক্তিবাদ না অন্তর্দৃষ্টি, কোনটা আগে মাথায় আসে সেটা নিয়ে অনেক মতামত আছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা অন্তর্দৃষ্টি একটা নোঙর, যেটা যুক্তিগত বিশ্লেষণ ছাড়াই, আমাদের সত্যের আভাস দেয়, তারপর আমরা যুক্তিবাদের মাধ্যমে সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি। আবার অন্তর্দৃষ্টিকে একটা স্টিয়ারিং হুইল-এর সঙ্গেও তুলনা করা যায়, যেটা আমাদের সত্যের দিকে ঘুরিয়ে দেয়, তারপর আমরা যুক্তিবাদের সাহায্যে সেইদিকেই জাহাজটা চালিয়ে নিয়ে যাই। অনেক সময় অনেককে বলতে শুনেছি, যে এরকম অকাট্য যুক্তি থাকা স্বত্ত্বেও কেন সে অন্যকে সত্যিটা বোঝাতে পারল না। এর কারণ সম্ভবত গোড়ায় গলদ। এক্সাকে বোঝানো গেল না, সেই ব্যক্তির নোঙর বা স্টিয়ারিং হুইলটা ইন্টুইশান-এর উপর ভিত্তি করে ছিল না, সেই ক্ষমতা হয়ত সে হারিয়ে ফেলেছে; তার ভিত্তি ছিল মেনস্ট্রিম প্রোপাগাণ্ডা। তাই আমার মতে, অন্তর্দৃষ্টির অভাব থাকলে একজন অতি যুক্তিবাদীর চিন্তার মোড়টাও মিথ্যার দিকেই ঘুরে যায়। তবে আরো একটা ব্যাপারে সাবধান থাকা দরকার। মেন্সট্রিম প্রোপাগ্যান্ডার বিপরীত কোন প্রোপাগাণ্ডাতেও যেন আমরা আচ্ছন্ন না হয়ে পড়ি। এর থেকে বাঁচার উপায়ও ইন্টুইশান।

যা আলোচনা করলাম, তার প্রযোগ কিভাবে করা যেত, তার একটা সাম্প্রতিক বাস্তব উদাহরণ দেব। এই থট এক্সপেরিমেন্ট দিয়েই আমার লেখা শেষ করব। আবার ফিরে যাব করোনাকালে। সেই সময় কিভাবে ক্যান্ডিডেট ভ্যাক্সিন (candidate vaccine)-এর চাহিদা তৈরি করে ও কৌশলে তাকে বাধ্যতামূলক প্রচার করে সেগুলো মানুষকে দেওয়া হয়েছিল, সেটা আগের লেখায় লিখেছি ("রিপিট টেলিকাস্ট": https://thediligent2018.blogspot.com/2023/02/blog-post_26.html)। এই কারণেই অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিকা নিয়েছেন। এদের কথা বাদ দিলে, বলতে হয় বাকিরা ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের অনেকেরই মেনস্ট্রিম প্রোপাগাণ্ডা, পরিবার ও বন্ধুবর্গের মানসিক চাপ (Peer Pressure), সহজে নিজেকে বিজ্ঞানমনস্ক প্রমান করার তাগিদ, ইত্যাদি কারণে প্রশ্নহীনভাবে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। এদেরকে আমরা ছায়াবাদীদের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। পাশাপাশি তুলনায় একটু উন্নত চেতনার মানুষজনও ছিলেন, যারা আরেকটু খবরাখবর রেখেছেন, দু'রকম মতবাদই শুনেছেন, তবুও মেনস্ট্রিমকেই বেছে নিয়েছেন, বস্তুবাদীদের মতোই। আমরা জানি, কোভিড নিয়ে অন্যান্যদের পাশাপাশি অনেক মডার্ন মেডিসিনের ডাক্তারও তাদের মতামত রেখেছেন, দেশে ও বিদেশে। তাদের বৃহদাংশ মেন্সট্রিম প্রচারকেই সমর্থন করেছেন কিন্তু কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রমী ডাক্তার সত্যিটা সবাইকে জানাতে চেয়েছেন, অবৈজ্ঞানিক বিধি নিষেধের বিরুদ্ধে, পরিক্ষাধীন টিকার বিরুদ্ধে বলেছেন। যারা এই দু'পক্ষের ডাক্তারদের কথাই শুনেছেন, তারা বেকনিয়ান মেথোডে সত্যটা নির্ধারণ করতে পারতেন। এখানে ফিঙ্গারপোস্ট হত, "এতে কার লাভ হচ্ছে?" (আর্থিক, ক্ষমতা, বা অন্য দিক দিয়ে)

যারা মেন্সট্রিম-এর পক্ষে তাদের লাভ, না যারা এর বিপক্ষে যাচ্ছেন তাদের? একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, যারা মেন্সট্রিম-এর তালে তাল মিলিয়েছেন, তাদেরকেই মিডিয়া মাথায় তুলেছে, তারা বিভিন্ন ফার্মা কোম্পানি, সংগঠন থেকে অর্থ উপহার ইত্যাদি পেয়েছেন; আর যারা স্রোতের বিরুদ্ধে গেছেন, তাদেরকে মিডিয়া ভুল প্রমান করার চেষ্টা করেছে, বিভিন্ন সংগঠন তাদের বয়কট করেছে, এমনকি কয়েকজনের পূর্ব কৃতিত্বও অস্বীকার করার চেষ্টা হয়েছে। (এটা স্রোতের বিরুদ্ধে চলা সবার সঙ্গেই হয়েছে, তবে বেশিরভাগ তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ মডার্ন মেডিসিনের ডাক্তারদের উপরেই বেশি ভরসা করেন, তাই এই উদাহরণটাই দিলাম। এটা সবার জন্যই প্রযোজ্য।) তাহলে উত্তরটা সহজ, কারা সত্যি বলছে, বোঝা কঠিন নয়। আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও এই প্রশ্ন বা যুক্তি যে অনেকের মাথায় আসেনি, তার কারণ তাদের অন্তর্দৃষ্টির অভাব। যাদের অন্তর্দৃষ্টি ছিল, তাদের মনে অবশ্যই এই প্রশ্ন এসেছে। তাই তারা যুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে পেরেছেন। আর যারা পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তাভাবনাকে ইন্টিউশান বলে ভুল করেছেন, তারা যুক্তির সাহায্যে ভুল সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন।

আজ, টিকার তিন ডোস নেবার পর, হয়ত এঁরা (সব রকম বাদী রাই) মনে মনে বুঝছেন যে ভুল হয়েছে, কিন্তু সেটা অবচেতনেই আটকে থাকছে, সচেতন মনে আসতে পারছে না। (এটাও অন্তর্দৃষ্টির অভাব) তাই এই নিয়ে কথা উঠলেই, তারা একটা আক্রমণাত্ত্বক মনোভাব নিচ্ছেন। এঁদের পরিণতি যে কি হতে চলেছে, তা আন্দাজ করা সত্যিই কঠিন।

এই দুনিয়াটা যাদের ইশারায় চলে (ব্যাঙ্কিং এলিট বা জিয়োনিস্ট যাই বলুন ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা) তাদের প্রত্যেক পরিকল্পনার সূত্রপাত বহুদিনকার। আমরা সবে সবে তা বুঝতে শুরু করেছি। আমরা অন্তর্দৃষ্টি ও তার ওপর নির্ভর যুক্তিবাদ ও গবেষণার সাহায্যে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছি, পারছি। আগামীদিনে এদের প্রতিহত করার ও নিজেদের সুরক্ষিত রাখার এটাই একমাত্র উপায়। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার 

১) সিস্টেম ইন্টেলিজেন্স এবং ইন্টুইশান সম্বন্ধে ভালভাবে জেনেছি Gyrosonics (Wingard Research) এবং বিজ্ঞানী সজল বন্দোপাধ্যায়-এর সৌজন্যে।

২) কোভিডের মেনস্ট্রিম ন্যারেটিভ-এর অসত্যতা বোঝার পর, অনেক মুক্তমনা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট ও সচেতন সাধারন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে এবং আরও অনেকের বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছে। তাদের সবার কাছেই অনেক কিছু শিখেছি। সবার নাম বলে শেষ করা যাবে না।

তথ্যসূত্র 

1) History of Western Philosophy - Bertrand Russel

2) Novum Organum - Francis Bacon

(লেখকের মতামত তাঁর একান্ত নিজস্ব)

Image: craiyon.com

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views